আহমেদ সেলিম
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:২৮ পিএম
আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:৫৮ পিএম
২০২৩ সাল দেশের রাজনীতির জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে রাজপথ ছিল উত্তপ্ত। কিন্তু বছর শেষে তা আর ধরে রাখতে পারেনি বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার নিজেদের অধীনে নির্বাচনের জন্য অনড় ছিল। বছরজুড়ে রাজনৈতিক মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বিরোধীদের মোকাবিলা করার পাশাপাশি এবার বিদেশি পরাশক্তিগুলোর ‘চাপ’ও সুকৌশলেও সামলেছে। আর জাতীয় পার্টি নানা নাটকীয়তা করলেও শেষমেশ আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। বছর শেষে নানা নাটকীয়তার ইতি ঘটিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯ দলটি দল।
এরপর চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ করে বিএনপি। সেদিন মহাসমাবেশ চলাকালে কাকরাইলে পুলিশ, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ কনস্টেবল হত্যা, পিস্তল ছিনতাই, পুলিশের কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, নাশকতা, ভাঙচুর, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, গাড়ি পোড়ানো, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগ ওঠে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
মহাসমাবেশের দিন সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে করা অনেকগুলো মামলায় গ্রেপ্তার হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রথম সারির গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ নেতা।
এসব নেতার বাইরে বর্তমানে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার এড়াতে দলের অনেক নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন। ২৮ অক্টোবর রাত থেকে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেওয়া তালা আজও খোলেনি। দলের প্রথম সারির নেতারা জেলে থাকলে দ্বিতীয় সারির নেতারা দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেবেন-এমন দলীয় সিদ্ধান্ত থাকলেও বর্তমানে বিএনপিতে চরমভাবে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে।
যে কারণে সমমনা দলদের নিয়ে নির্বাচনে বিএনপির তফসিল আটকানো ও নির্বাচন বানচালের জন্য হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি দিলেও খুব জমাতে পারেনি।
গত ২০ ডিসেম্বর সরকারের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন’-এর ডাক দিয়েছিল বিএনপি। ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন, ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনী দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকা, সকল প্রকার কর, খাজনা ও ইউটিলিটি বিলসহ অন্যান্য প্রদেয় না দেওয়া, ব্যাংকে আমানত না রাখা এবং আদালতে হাজিরা না দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়।
ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে প্রথম দফায় ২৪ ডিসেম্বর অবরোধ ও এর আগে ২১ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে। বছরের শেষদিনেও দ্বিতীয় দফার গণসংযোগ কর্মসূচি করেছে দলটি।
সার্বিক বিষয়ে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, ‘নির্বাচনের প্রাক্কালে দলের বিভিন্ন কর্মসূচি যেভাবে চলার কথা, সেভাবেই চলছে। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে কারাগারে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এসব মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার করে বিএনপির আন্দোলনকে থামানো যাবে না এটাও সত্যি। অনেক শীর্ষ নেতা কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন, তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।’
রাজনীতি সচেতন অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কৌশলে বছরজুড়ে বিদেশি চাপ ও বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলা করে বিদ্যমান ব্যবস্থায় আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অনেকটাই সফল হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২৩ সাল ছিল আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ঘটনাবহুল একটি বছর।
২৮ অক্টোবর সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল বিএনপি। এই কর্মসূচি থেকে সরকার পতনের লক্ষ্যে লাগাতার কর্মসূচি চালানো হতে পারে এমন কথাও চাউর ছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যেভাবে বসে গিয়েছিল, একই কায়দায় বিএনপির নেতারা এখানে বসে যাবেন-এমন আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটের সামনে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগও। সেই কর্মসূচি থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রথমে কাকরাইল এলাকায় সমাবেশে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালান। সেখান থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু। পুলিশের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা শুরু করে। সংঘর্ষের পর শেষ পর্যন্ত পণ্ড হয়ে যায় বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মিশন। এরপর বিএনপি আর বড় কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও আওয়ামী লীগের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও দাতা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা এসে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। একই সঙ্গে নতুন ভিসানীতিও ঘোষণা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধানের বিষয়টি সামনে এনে ও বিএনপির অতীত রাজনীতির বিষয়গুলো তুলে ধরার কৌশল অবলম্বন করে বিদেশিদের সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে সংলাপ ও বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়টি কৌশলেই প্রত্যাখ্যান করা হয়। ২৮ অক্টোবরের পর বাংলাদেশের বড় তিনটি দলকে চিঠি দিয়ে ‘পূর্বশর্ত ছাড়া’ সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সেই চিঠির ইতিবাচক সাড়া দেয় বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে চিঠি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চিঠির বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। পরে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সচিবালয়ে গিয়ে লুর সেই চিঠি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে পৌঁছে দেন। তখন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সময়কে কারণ হিসেবে দেখিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে, এই মহূর্তে সংলাপের আর সুযোগ নেই।’ এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা নিয়েও মুখ খুলতে শুরু করে আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত রাশিয়া। এছাড়া চীন ও ভারত নির্বাচনের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে এমন বার্তাও দেওয়া হয়েছে দেশগুলোর পক্ষ থেকে। ফলে কূটনৈতিকভাবেও নেওয়া কৌশলগুলোতে সফলতা আসার ফলস্বরূপ ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলেও মনে করে রাজনীতিসচেতন মহল।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh