উত্তাল বছর শান্তভাবে শেষ, দমনপীড়নেও অটুট বিএনপি

বিদায়ী ২০২৩ সাল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির জন্য ছিলো রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় একটি বছর। বছর জুড়েই দলটির নেতাকর্মীরা রাজপথে মিছিল সমাবেশ করেছেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাত করে, ১৭ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসার উচ্চাশা জাগে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে। তারা এও মনে করেছিলো যে- একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটা সম্ভব হতে পারে।

বিএনপি সারাবছর যা কিছু করেছে, তার লক্ষ্য ছিলো- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, তাদের প্রত্যাশার ফলাফল অর্জন করা। শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সাল বিএনপির জন্য হতাশার মধ্য দিয়েই শেষ হয়।

গত দুই মাস বিএনপির কর্মকাণ্ডের ওপর দমন-পীড়ন তীব্রতর হয়। এমন প্রেক্ষাপটে, দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় সবাই হয় কারাগারে যান, নয়তো পলাতক জীবনে চলে যান। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। এমন অবস্থায় আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন বর্জনের পর আগামী সময়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে ফিরে আসা এবং নেতাকর্মীদের পুনরুজ্জীবিত করা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।

বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, আগামীতে চরম নেতৃত্ব সংকটের মুখোমুখি হবে বিএনপি। কারণ, বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মী ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আর বিএনপির দাবি মতে, কম-বেশি ২৬ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দল পুনর্গঠন করার পাশাপাশি বিএনপিকে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়ে আসতে হবে; যাতে তারা শান্তিপূর্ণভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, বিএনপির অহিংস আন্দোলন, ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি। তাদের আন্দোলন নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি; তবে প্রায় সব বিরোধী দল এ দাবিকে সমর্থন করেছে।

তিনি আরো বলেন, “তাদের সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে তাদের সমর্থন বেড়েছে।” বিএনপিকে বিভক্ত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা নেতৃত্বের বড় সাফল্য বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আলী রিয়াজ।

ড. রিয়াজ উল্লেখ করেন, বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর সরকারের কর্মকাণ্ডে এটা স্পষ্ট হয়, তারা আসলে বিএনপিকে প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে একটি নির্বাচন করতে চেয়েছিলো। তিনি বলেন, “সুতরাং বিএনপি বর্জন করতে চায় কি না, তা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে।”

অধ্যাপক আলী রিয়াজ আরো বলেন, “আমাদের জোর দিয়ে বলতে হবে, বিএনপি একা নির্বাচন বর্জন করছে না। বিএনপির অনুপস্থিতি প্রমাণ করেছে যে, চলমান নির্বাচন একটি পাতানো অনুষ্ঠান।”

তিনি উল্লেখ করেন, হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে এবং দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করার কারণে বিএনপি একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা দুর্ঘটনাবশত নয়, এটা বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনার অংশ।”

গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির কর্মসূচি আকর্ষণ হারাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আলী রিয়াজ। তিনি বলেন, “তবে ৭ জানুয়ারির পর তারা কী কৌশল গ্রহণ করে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।” এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, যত কঠিনই হোক না কেন, বিএনপিকে রাজপথে ফিরে আসতে হবে এবং জন সমাবেশে অংশ নিতে হবে।

আলী রিয়াজ বলেন, ৭ জানুয়ারির পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কেমন হবে, তার সঙ্গে বিএনপির ভবিষ্যৎ জড়িত। আর, তাদের ভবিষ্যৎ অন্যান্য বিরোধী দল থেকে আলাদা হবে না। তিনি মনে করেন, কেউ যদি বিএনপিকে বিলুপ্তপ্রায় শক্তি বলে অভিহিত করতে চায়, সেটি স্পষ্টতই ভুল হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে সরকার রাজনৈতিক সুযোগ দেয়ায়, বিএনপি ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে। তিনি বলেন, “সরকার যেমন ভেবেছিলো, বিএনপি রাজপথে সক্রিয় থাকলে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না, তাই তারা আবার কঠোর দমন-পীড়ন চালিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে।”

বিএনপির রাজনীতি সঠিক পথেই চলছে বলে উল্লেখ করেন নুরুল আমিন বেপারী। বলেন, দলটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের দাবির পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তুলতে পারে। অধ্যাপক আলী রিয়াজের সঙ্গে একমত পোষণ করেন ড. বেপারী। তিনি বলেন, বিএনপিকে সব বাধা অতিক্রম করে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করতে হবে।

ড. বেপারী বিশ্বাস করেন ৭ জানুয়ারির ‘একতরফা নির্বাচন' দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।তিনি বলেন, “বিএনপি যদি সঠিক কৌশল নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা সফল হতে পারে।”

আন্দোলনের বিবর্তন
বিদায়ী ২০২৩ সালকে নির্বাচনী বছর হিসেবে বিবেচনা করে, জানুয়ারি থেকেই সমাবেশ ও বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বিএনপি। দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা জোরদার করার জন্য বিভিন্ন ইউনিট এবং সহযোগী সংগঠনগুলো সংস্কার করা হয়। ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত জনসমর্থন নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে বিএনপি এবং সাফল্য অর্জন করে।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে, গত ২৭ জুলাই যুগপৎ ও এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। তিন ডজনের বেশি দল যুগপৎভাবে রোডমার্চ ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে বিএনপি ও অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। বিএনপি তাদের এক দফা দাবির পক্ষে রাজধানী ঢাকায় বড় পরিসরে সমাবেশ করে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ বছরব্যাপী আন্দোলনের প্রায় চূড়ান্ত রূপ হিসেবে দেখা দেয়।

টার্নিং পয়েন্ট
বছরব্যাপী কর্মসূচির সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। ফলসরূপ, ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে জনসভা করার ঘোষণা দেয় বিএনপি। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে এই সমাবেশ শুরু হলেও পুলিশ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ হয়। সহিংসতায় এক পুলিশ কনস্টেবলসহ তিনজন নিহত হয়। আহত হয় কয়েকশ' মানুষ। মাঝপথে ভণ্ডুল হয়ে যায় মহাসমাবেশ। সংঘর্ষের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর অভিযান শুরু করে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শেষ পর্যন্ত, রাজপথে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনুপস্থিতিতে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

গত ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর, দুই মাসের বেশি সময় ধরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের অধিকাংশ কার্যালয় তালাবদ্ধ রাখা হয়। গত ১৬ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী বিজয় র‌্যালি বের করলেও কেন্দ্রীয় কার্যালয় খোলা হয়নি। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, গত দুই মাসে পুলিশ প্রায় ২৪ হাজার বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ২৫ জন নেতাকর্মী। এছাড়া, পাঁচ থেকে দশ বছর আগের বিভিন্ন মামলায় বিএনপির তিন ভাইস চেয়ারম্যানসহ দেড় হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে সাজা দেয়া হয়েছে।

আবার হরতাল-অবরোধ
গত ২৮ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর, বিএনপির আন্দোলন গতি হারায়। আর, দীর্ঘদিন পর হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করে বিএনপি। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো গত ২৯ অক্টোবর থেকে ১২ দফায় ২৩ দিন দেশব্যাপী অবরোধ পালন করে। আর, চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করে।

অবশেষে, ২০ ডিসেম্বর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি; যা কার্যত জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। এরপর, দেশব্যাপী গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি দেয় বিএনপি। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপি ২০২৩ সাল শেষ করেছে।

নির্বাচন বর্জন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায়, বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় নির্বাচন বর্জন করছে দলটি। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমরসহ প্রায় ২৪ জন মধ্যম পর্যায়ের নেতা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

গত ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার শাহজাহান ওমর জামিনে মুক্তি পান এবং একদিন পর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পরে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। বিএনপির শরিকদের মধ্যে কেবল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম নির্বাচনে অংশ নেন। বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন, সরকার তাদের দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে অথবা ভয়াবহ পরিণতির ভয় দেখিয়ে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টা করে।

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কা
লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, হার্ট, চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিদায়ী বছরের অনেকটা সময় ধরে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। খালেদা জিয়া গত ৯ আগস্ট বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি এখনো হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। -ইউএনবি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //