দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাত

সবচেয়ে বেশি বরাদ্দপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের একটি হিসেবে দুর্নীতির অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে ২০১৯ সালে ২৫ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু গত ৪ বছরের বেশি সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।

১৭০০ ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু 
২০২৩ সালে দেশে এক হাজার ৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। ভয়াবহ করোনা ভাইরাসের চেয়ে গড়ে ডেঙ্গুর মৃত্যু বেশি। ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত করোনায় প্রতি বছর গড়ে মৃত্যু হয়েছে ০.৩৬ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল ০.৫৩ শতাংশ। সরকারি হিসেবেই দেশে এক বছরে ডেঙ্গুতে শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৫৪৯ জন (২৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ পর্যন্ত)। 

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকায় পুরনো কীটনাশকই বারবার ব্যবহার করা হয়েছে মশা নিয়ন্ত্রণে। এই কীটনাশকে মশা মরে না। কীটনাশক লাগলে মশা কিছু সময় মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে কিন্তু কীটনাশকের প্রতিক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে আবার উড়ে চলে যায়। মশা নিয়ন্ত্রণে সর্বাধুনিক ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) প্রয়োগ করার চিন্তা-ভাবনা থেকে কিছু বিটিআই আমদানিও করা হয়েছিল, কিন্তু তা ছিল ভেজাল। বিষয়টি কিছুদিন আলোচনায় থাকলেও এখন আর এটা নিয়ে কোনো কথা নেই বলে আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়েছে তা কেউ জানে না।

ঢাকা ও কলকাতায় একই রকম পরিবেশ, ভৌগোলিক অবস্থান থাকা সত্ত্বেও ঢাকা মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। যদিও কলকাতা সিটি করপোরেশন বিটিআই প্রয়োগ করে মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে মশা নিয়ন্ত্রণে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোতেও ভেজাল মেশানো হয়, ফলে ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। 

স্বাস্থ্যের ঠিকাদার মিঠু ফ্যাক্টর
২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু একটি বড় ফ্যাক্টর। এখানকার বড় বড় সব কেনাকাটায় রয়েছে মিঠুর ছোঁয়া। সব টেন্ডার মিঠু পেয়ে থাকেন। কেনাকাটায় স্বচ্ছতার অভাবে এই মন্ত্রণালয়ে ভালো কোনো কাজ হয়নি বলা চলে। শেষ পর্যন্ত মিঠুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দেখা যায় ব্যবস্থা নিতে। তার সম্পদ জব্দ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুদক। গত ১৯ অক্টোবর দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, মিঠুর বিরুদ্ধে দুদকের একটি অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। 

দুদক সূত্র জানায়, মিঠু তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ ও উন্নয়নকাজের নামে প্রভাব বিস্তার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সিএমএসডির সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ মৃত্যুর আগে লিখিতভাবে সরকারকে জানিয়েছিলেন, কেনাকাটায় অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির কারণ হলো স্বাস্থ্য খাত ‘মিঠু চক্র’-এর কব্জায়। এরপরই মূলত রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা তৎপরতা শুরু করে।

শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত দুর্নীতি 
চলতি বছরের ৯ মে উচ্চ আদালতে এক রিট আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘সবকিছুরই একটা সীমা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব সময় কেনাকাটার জন্য প্রস্তুত। একমাত্র আল্লাহই জানেন ওই কেনাকাটায় কী থাকে, আপনারা ১৭ কোটি মানুষের টাকা খাচ্ছেন।’ কারাবন্দিদের যথাযথ চিকিৎসার জন্য সারা দেশের কারাগারে ডাক্তার নিয়োগের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে করা আবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেআর খান রবিন ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জনস্বার্থে মামলা হিসেবে দায়ের করেন। এই রিট প্রসঙ্গে বিচারপতি কামরুল কাদের বলেন, ‘এ দেশের সন্তান হিসেবে আমরা অনেক কিছুই জানি। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। যা দেখেছি তা বিদেশের একটি ছোট হাসপাতালের চেয়েও খারাপ।’ বিচারপতি কামরুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এলাকার কাছাকাছি হলেও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও বেশি দুর্নীতিপ্রবণ। এখানে কোনো যন্ত্রপাতিই সারা বছর সচল থাকে না।

প্রধান সমস্যা কেনাকাটায় দুর্নীতি
অব্যবস্থাপনা ও কেনাকাটায় দুর্নীতি স্বাস্থ্য খাতের প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক। তিনি বলেন, এই দুর্নীতি অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে প্রচলিত যে ব্যবস্থাপনা, তার ভেতর দিয়ে সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন জরুরি। 

স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক ছায়া সংসদে ডা. আ ফ ম রুহুল হক কেনাকাটার দুর্নীতির কথা বলেন। তিনি বলেন, কেনা-কাটায় দুর্নীতি খুব বেশি নজরে আসে না। এসব কারণেই হাসপাতালে কোটি টাকায় মেশিন কেনা হলেও দেখা যায় উপরি কাঠামো আসে কিন্তু মেশিন আসে না। এমন অনেক হাসপাতাল রয়েছে যেখানে কেনাকাটাই হয়নি, কিন্তু বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব কেনা-কাটায় রাঘববোয়ালরা জড়িত থাকে বলে তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না।

আঁখি ও নবজাতকের মৃত্যু
কুমিল্লার মেয়ে আঁখি ও তার নবজাতক সন্তানের মৃত্যু হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা এবং চিকিৎসকের কর্তব্যে অবহেলা হিসেবে আলোচিত ঘটনা ছিল ২০২৩ সালে। ৯ জুন প্রসব বেদনা নিয়ে আঁখি রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হন। সেদিন রাতে তার নবজাতকটির মৃত্যু হয়। সেন্ট্রাল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি হলেও ডা. সাহা দেশেই ছিলেন না। অবশেষে ১৮ জুন রবিবার ভোরে আঁখি রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে মারা যান। চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লোভের কারণেই আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে বলে তার স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন ধানমন্ডি থানায় মামলা করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা ও মিথ্যাচারের অভিযোগ আনেন। 

ডেঙ্গু টিকার সফল পরীক্ষা
এত কিছু নেতিবাচক দিকের মধ্যে কিছু সফলতা রয়েছে স্বাস্থ্য খাতে, তবে এটা বেসরকারি খাতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪ এই চার ধরনের বিরুদ্ধেই টিকার কার্যকরিতা প্রমাণ করেছেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু টিকার এই সফল পরীক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক সাময়িকী ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। ডেঙ্গু রোগের এই টিকার নাম দেওয়া হয়েছে টিভি-০০৫ (টেট্রাভেলেন্ট)। এখন পর্যন্ত টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //