পুরনো সুগন্ধির মতোই টিকে আছে শিল্প-সাহিত্য

শিল্প এখনো পুরনো সুগন্ধির মতো হালকা সুবাসের রেশ ছড়িয়ে যায়। অনেকটা সে রকম ভাবেই বেঁচে আছে করোনাকালের শিল্প-সাহিত্য।  পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে সে কেবল ফিরে আসে মাত্র। এক সমীক্ষা বলছে করোনা সংক্রমণ, লকডাউন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো ঘটনা খুব বেশি করে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সাহিত্যে।

সমীক্ষার এই তথ্যটুকু আমাদের তেমন অবাক করে না। আশ্চর্য হলো সমীক্ষার দ্বিতীয় তথ্য। যা বলছে যে করোনাকালে বৃদ্ধি পেয়েছে লেখকের সংখ্যা। আর তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। লেখা, সে যেমনই গুণমানের হোক, মানসিক অবসাদ কাটাতে শিল্প-সাহিত্যকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন অনেকে। এসময়ের লেখাগুলোর বিষয়েও রয়েছে বৈচিত্র্য। করোনার দিনগুলিতে অধিকাংশের লেখায় প্রেম ভর করেছে, তেমনই এসেছে অলীক কল্পনাবিলাস। যার মাধ্যমে রূঢ় বাস্তব থেকে পালাতে চেয়েছেন অনেকে। অনেকে আবার মৃত্যুভয় জড়িয়ে থাকা এই সময়কেই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখায়। আঙুলের ডগার সঙ্গে তো স্নায়ুমাধ্যমে যুক্ত মস্তিষ্ককোষ- এই পথেই উত্তেজনা জাগিয়ে এখন মানসিক অবসাদ কাটাচ্ছেন লেখকরা। একনজরে দেখা যাক ২০২০ সালের শিল্প-সাহিত্যের চিত্র।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিক্রি ও নতুন বইয়ের সংখ্যা
বই বিক্রিতে নতুন রেকর্ড গড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০। এবার মেলায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। যা গতবারের তুলনায় দুই কোটি টাকা বেশি। বাংলা একাডেমীর নিজস্ব বিক্রি হয় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই। বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের মেলায় বিক্রির পরিমাণ ছিলো ৮০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ছিলো ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৬ সালে ৪০ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ৯৫ লাখ, ২০১৪ সালে ছিলো সাড়ে ১০ কোটি এবং ২০১৩ সালে ১০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বইমেলায় প্রকাশিত মোট বইয়ের সংখ্যা ছিলো ৪ হাজার ৯১৯টি। এর মধ্যে গল্প ৬৪৪টি, উপন্যাস ৭৩১টি, প্রবন্ধ ২৭১টি, কবিতা ১ হাজার ৫৮৫টি, গবেষণা ১১২টি, ছড়া ১১১টি, শিশুতোষ ২০৩টি, জীবনী ১৪৯টি, রচনাবলী ৮টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ১৫২টি, নাটক ৩৪টি, বিজ্ঞান ৮৩টি, ভ্রমণ ৮২টি, ইতিহাস ৯৬টি, রাজনীতি ১৩টি, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ৩৬টি, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক ১৪৪টি, রম্য ও ধাঁধা ৪০টি, ধর্মীয় ২০টি, অনুবাদ ৫৬টি, অভিধান ১৪টি, সায়েন্স ফিকশন ও গোয়েন্দা বিষয়ক ৬৭টি এবং অন্যান্য ধরনের ২৬৮টি।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার
ভাষার মাসে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করেন দেশের ১০ কবি ও সাহিত্যিক। এবার কবিতায় মাকিদ হায়দার, কথাসাহিত্যে ওয়াসি আহমেদ, প্রবন্ধ ও গবেষণায় স্বরোচিষ সরকার, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, অনুবাদে খায়রুল আলম সবুজ, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণে ফারুক মঈনউদ্দীন, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞানে নাদিরা মজুমদার, নাটকে রতন সিদ্দিকী, শিশুসাহিত্যে রহীম শাহ এবং ফোকলোরে সাইমন জাকারিয়াকে পুরস্কৃত করা হয়। বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ২ লাখ টাকা। এছাড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ক্রেস্ট ও সনদ দিয়ে সম্মানিত করা হয়।

একুশে পদক
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক ২০২০ পান দেশের ২০ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান। এবছর একুশে পদক ২০২০ পেয়েছেন- ভাষা আন্দোলনে মরহুম আমিনুল ইসলাম বাদশা (মরণোত্তর); শিল্পকলায় (সংগীত) বেগম ডালিয়া নওশিন, শঙ্কর রায় ও মিতা হক; শিল্পকলায় (নৃত্য) মো. গোলাম মোস্তফা খান; শিল্পকলায় (অভিনয়) এম এম মহসীন; শিল্পকলায় (চারুকলা) অধ্যাপক শিল্পী ড. ফরিদা জামান; মুক্তিযুদ্ধে মরহুম হাজি আক্তার সরদার (মরণোত্তর), মরহুম আব্দুল জব্বার (মরণোত্তর), মরহুম ডা. আ আ ম মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) (মরণোত্তর); সাংবাদিকতায় জাফর ওয়াজেদ (আলী ওয়াজেদ জাফর); গবেষণায় ড. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ কারী আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ ছাইফুর রহমান নিজামী শাহ; শিক্ষায় অধ্যাপক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া; অর্থনীতিতে অধ্যাপক ড. শামসুল আলম; সমাজসেবায় সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান; ভাষা ও সাহিত্যে ড. নুরুন নবী, মরহুম সিকদার আমিনুল হক (মরণোত্তর) ও বেগম নাজমুন নেসা পিয়ারি; চিকিৎসায় অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার এবং গবেষণায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে সরকার ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতি বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, এককালীন দুই লাখ টাকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেয়া হয়।

স্বাধীনতা পুরস্কার
এবছর দুজন মরণোত্তরসহ ৮ ব্যক্তি ও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, চিকিৎসাবিদ্যা, সংস্কৃতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার-২০২০ ’-এ ভূষিত করে সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ীরা হলেন- স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, কমান্ডার (অব.) আবদুর রউফ (মরণোত্তর), বুদ্ধিজীবী মুহম্মদ আনোয়ার পাশা (মরণোত্তর) ও আজিজুর রহমান। চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যাপক ডা. মো. উবায়দুল কবীর চৌধুরী ও অধ্যাপক ডা. এ কে এম এ মুক্তাদির। সংস্কৃতিতে কালীপদ দাস ও ফেরদৌসী মজুমদার, শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমস, সাহিত্যে অবদানের জন্য এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের নাম প্রথমে ঘোষণা করা হলেও সমালোচনার কারণে পরবর্তীতে বাতিল করা হয়। পুরস্কার হিসেবে ১৮ ক্যারেট সোনার একটি ৫০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণপদক, সনদ ও ৫ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়।

করোনার কারণে হচ্ছে না ঢাকা লিট ফেস্ট
বাংলাদেশের লেখকদের সাথে অন্যান্য দেশের লেখকদের জানাশোনার সুযোগ করে দেয়া এবং বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশের সাহিত্যকে তুলে ধরে ঢাকা লিট ফেস্ট। এ উদ্দেশ্য ২০১২ সাল থেকে শুরু হয় সাহিত্যের এই  উৎসব। তবে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের কারণে এটি পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। জনপ্রিয় এই আয়োজনের দশম আসর ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘ নয় বছরের এই আয়োজনে অংশ নিয়েছেন অসংখ্য রথী-মহারথী লেখক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ঢাকা লিট ফেস্ট বাংলাদেশের একমাত্র আয়োজন, যেখানে নোবেল বিজয়ী কথা সাহিত্যিক ভিএস নাইপল, জীববিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী হ্যারল্ড ভারমাস অংশ নেন। এছাড়াও অস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী টিল্ডা সুইন্টন, পুলিৎজার বিজয়ী লেখক বিজয় শেষাদ্রিসহ অনেকেই অংশ নেন এই আয়োজনে।

করোনাকালে শিল্প-সাহিত্য
করোনায় শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি আজ স্তব্ধ। প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২ লাখ পরিবার ছিলো অসহায়। করোনায় অপরাপর ব্যবসায়ীদের মতো সংকটে পড়েছেন বই ব্যবসায়ীরাও। অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরপরই দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার কারণে গ্রন্থ-প্রকাশনা খাতে প্রভাব পড়েছে বেশি। প্রকাশনা ব্যবসায়ের নেতাদের দাবি, এই আর্থিক ক্ষতির ধাক্কাটা হতে পারে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার বেশি। এতো কিছুর পরেও থেমে ছিলো না সাহিত্য চর্চা। সাহিত্যিকদের আড্ডা হয়েছে ভার্চুয়াল। সাধারণ ছুটির সময়টা লেখকরা কাজে লাগিয়েছেন সাহিত্য চর্চা করে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা

বছরের শেষ দিকে এসে করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। করোনা সংক্রমণের কারণে বইমেলা ভার্চুয়াল না সরাসরি অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে বাংলা একাডেমি। বইমেলা যথাসময়ে হবে কি না তা নিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আগের মতোই ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে এ মেলা শুরু হবে না বলে জানা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বইমেলা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে মার্চ মাসের মাঝামাঝি গিয়ে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

করোনার বছর হারিয়েছি
করোনার বছর না ফেরার দেশে চলে গেছেন- অধ্যাপক ও কবি হিমেল বরকত, কবি ও প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা, কবি আদিত্য কবির, কবি, অনুবাদক ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোশতাক আহমদ, শিখা প্রকাশনীর মালিক কাজী নজরুল ইসলাম বাহার, কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ‘কালি ও কলম’র সম্পাদক আবুল হাসনাত, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক রশীদ হায়দার, চিত্রশিল্পী মনসুর উল করিম, ভাস্কর্য শিল্পী মৃণাল হক, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খান, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, ছড়াকার আলম তালুকদার, কথাসাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য, রম্য লেখক সাজ্জাদ কবীর, কবি ও চিত্র সমালোচক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, কবি আশরাফ সিদ্দিকীসহ আরো অনেককে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //