করোনার বছর ২০২০

২০২০ সালের মার্চ মাসের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, করোনার প্রথম খবর চীনের হুবেই প্রদেশে আসে। তারিখ ছিলো ১৭ নভেম্বর ২০১৯। যদিও করোনা নিয়ে চীনের উহান শহরের নামই প্রথমে শোনা যায়। তবে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট বলছে করোনার প্রথম খবর আসে হুবেই প্রভিন্স থেকে। যদিও পেশেন্ট জিরো নিয়ে এখনো জল্পনা থেকে যাচ্ছে।

২০১৯ এর শেষ দিনে চীন জানাতে বাধ্য হয় যে উহানে কয়েকটি ভাইরাস নিউমোনিয়ার ঘটনা ঘটেছে। যার নেপথ্যের রহস্য ধরা যাচ্ছে না। উহানের সামুদ্রিক প্রাণী বিক্রির বাজার ফোকাসে আসে। একদিকে ততদিনে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে করোনা ছড়ায়। উহানের ভাইরোলজি সেন্টার বিশ্বের নজরে আসতে থাকে। ততদিনে দেশ থেকে দেশান্তরে করোনার প্রকোপের খবর ছড়াতে শুরু করে।

দেশে করোনায় আক্রান্ত, মৃত্যু ও সুস্থ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১২ হাজার ৪৯৬ জন। ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৫৩১ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭০ জন। দেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয় ৮ মার্চ। সেদিন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন নারী ও দুইজন পুরুষ। তাদের মধ্যে দুইজন ইতালি থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। অপর একজন তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। এদিকে করোনার প্রথম দিকে নমুনা পরীক্ষার হার কম হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক মাধ্যমেও এ নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়েছিলো। করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে।

করোনায় চিকিৎসা সেবা
করোনাভাইরাস অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে হওয়ায় একই হাসপাতালে অন্যান্য রোগী ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের একসঙ্গে চিকিৎসা দেয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই শুধু করোনা রোগীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল প্রয়োজন হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রথম দিকে ঢাকায় পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

করোনায় অন্য রোগীদের দুর্ভোগ
দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় করোনাভাইরাস বিষয়টিকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়ায় করোনা আক্রান্ত নন কিন্তু অন্য গুরুতর রোগ রয়েছে এমন রোগীরা জরুরি চিকিৎসা সেবা থেকে ‘বঞ্চিত’ হয়েছেন। করোনার প্রথম দিকে প্রাইভেট চেম্বার ছিলো বন্ধ, হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রোগী নিয়ে বিপাকে ছিলো স্বজনরা। সাধারণ পরীক্ষা করানোও ছিলো দুষ্কর। সাধারণ রোগীদের দুর্ভোগের শেষ ছিলো না। চিকিৎসা না পেয়েই মারা যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে। সেই সাথে ডাক্তার ও হাসপাতাল মালিকদের আচরণও ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ।

করোনায় লকডাউন
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য ১৯ মার্চ প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা। শিবচর উপজেলায় ওষুধের দোকান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চের ২৬ তারিখ থেকে কয়েক দফায় মোট ৬৬দিন সাধারণ ছুটি ছিলো। এরপর ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত শর্ত সাপেক্ষে অফিস খুলে দেয়া হয়। পাশাপাশি চালু হয় গণপরিবহন এবং অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে এখনো। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাধারণ ছুটি ছিলো অনেকটা অন্য দেশগুলোর জারি করা লকডাউনের মতো।

করোনায় স্কুল কলেজ বন্ধ
করোনাভাইরাসের কারণে ১৬ মার্চ সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব স্কুল ও কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় চলমান ছুটি পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ঘোষণা আসে। তবে কওমি মাদ্রাসা এখন এ ছুটির আওতামুক্ত রয়েছে। করোনার কারণে ব্যসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছেন। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

করোনায় পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে হঠকারিতা
করোনা পরিস্থিতিতে গত ২৭ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের তৈরি পোশাক কারখানার অধিকাংশই বন্ধ ছিলো। দীর্ঘদিনের ছুটি থাকায় ওইসব বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের বিরাট একটা অংশ গ্রামে চলে যায়। এই সময়কালে গণপরিবহনও বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে গণপরিবহন বন্ধ রাখার সময়সীমা আরো বাড়ানো হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে বিপত্তিতে পড়ে ছুটিতে বাড়ি চলে যাওয়া গার্মেন্টস কর্মীরা। কেননা গণপরিবহন বন্ধের সময়সীমা বাড়ানো হলেও, তাদের ছুটি বাড়েনি। হিসেব মতে ৫ এপ্রিল কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে তাদের। ফলে উপায় না পেয়ে ‘লক ডাউনের’ মধ্যে দল বেঁধে পায়ে হেঁটেই রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা। ফলে এর সমালোচনায় দেশব্যাপী মুখর হয়ে ওঠে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বইতে শুরু করে সমালোচনার ঝড়। তীব্র সমালোচনার মুখে ৪ এপ্রিল রাতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সভাপতি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখতে গার্মেন্ট মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানান। তাতে নতুন মোড় নেয় সমালোচনা। নানা জন নানা ভাবে সমালোচনা করতে থাকেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। তাদের বক্তব্য ছিলো, শ্রমিকদের নিয়ে খেলেছে গার্মেন্ট মালিকরা। এর পরেও অনেক পোশাক শ্রমিকদের মাঠে নামতে হয়েছে বেতন-ভাতা আদায়ের দাবিতে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা ঘোষণা
করোনার মোকাবেলা ও দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায় এক দশমিক ২২ লাখ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে বলে নভেম্বর ২৬ জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। করোনার প্রথম দিকে করোনাভাইরাসের আর্থিক প্রভাব কাটাতে ৫ এপ্রিল ৭২,৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। মূলত ক্ষুদ্র, মাঝারি ও রফতানি খাতের জন্য এই প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আরো প্রণোদনা আসতে পারে সরকারের তরফ থেকে।

করোনায় স্বাস্থ্য খাতে কেলেঙ্কারি
করোনাকালে জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারি পিছু লেগেই ছিলো স্বাস্থ্য বিভাগের। একের পর এক জালিয়াতির কথা বেরিয়ে আসে। তার মধ্যে রয়েছে করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার ঘটনাও। র‌্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে ভয়াবহ জালিয়াতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র। আর এ পর্যন্ত জালিয়াতির যে চিত্র সবাইকে আবার চমকে দেয় তা হলো মোহাম্মদ সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। কভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতাল করোনার টেস্টের নামে রোগীদের থেকে নমুনা নিয়ে টেস্ট না করেই রিপোর্ট দিয়ে দিতো। সে টেস্টের জন্য একদফা রোগীদের থেকে ফি নিত। আবার সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী রোগীদের ফ্রি টেস্ট করিয়েছে দেখিয়ে সরকারের থেকে টাকা নিত। করোনার টেস্ট নিয়ে বড় ধরনের জালিয়াতি করে জুনের শেষ সপ্তাহে ব্যাপক আলোচনায় আসে জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভের মুখে পড়েন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল চৌধুরী ও তার স্ত্রী ডাক্তার সাবরিনা। স্বাস্থ্য খাতে ভয়াবহ সিন্ডিকেটের প্রধান মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মহা প্রতারক শাহেদ করিম এবং জেকেজি হেলথ কেয়ারের বিতর্কিত ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী। সাহেদের অবৈধ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা দিতে আবার চুক্তিও করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে। তার এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি নয়, উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে এলজিআরডি সচিবসহ আরো অনেক প্রভাবশালী আমলাকেও। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সার্জিক্যাল মাস্ক আমদানি করতে গিয়েও বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতার বিরুদ্ধে। খোদ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ওই নেতার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ এনে মামলা হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের ঘটনায় অভিযুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

করোনায় স্বাস্থ্য কর্মীদের মৃত্যু
করোনা মহামারির সময়ে সম্মুখ সারির যোদ্ধা বলা হয় করোনা রোগীদের সেবা দেয়া চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে। তাদের উৎসাহ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দেন। তবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম চিকিৎসক ছাড়া এখনো পর্যন্ত আর কেউ পাননি সরকার প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সরাসরি নিয়োজিত’ কর্মীরা প্রণোদনা পাওয়ার যোগ্য হবেন। তবে এই সরাসরি নিয়োজিত হিসেবে কাদের সংজ্ঞায়িত করা হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় এখনো প্রণোদনার টাকা পাননি সম্মুখ সারির যোদ্ধারা। এদিকে বিএমএর হিসাব অনুযায়ী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত করোনায় ৮ হাজার ১৩৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে চিকিৎসক দুই হাজার ৮৮১ জন, নার্স এক হাজার ৯৭৩ ও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন তিন হাজার ২৮১ জন। চিকিৎসক মারা গেছেন ১১৩ জন।

করোনায় ব্যসরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি হাসপাতালগুলোর দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা দীর্ঘদিনের। গত কয়েক দশকে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বরাদ্দ ও নজর কম থাকায় উন্নত সেবার জন্য নাগরিকদের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে। ফলে সময় যত গড়িয়েছে, স্বাস্থ্যখাতে প্রাইভেট সেক্টরের আধিপত্যও বেড়েছে, বেড়েছে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে স্বল্পমূল্যে কিংবা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়ার বদলে সরকার কেন এই খাতে বেসরকারি খাতকে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দিলো? স্বাস্থ্যখাতে প্রাইভেট সেক্টরের অব্যবস্থাপনা করোনা মহামারি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ব্যসরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম যেন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনাগুলোর পরিষ্কার ব্যাখ্যা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দিচ্ছেন না। এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নজরদারি ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি এই পর্যায়ে এসেছে। করোনাকালে পরীক্ষার দুর্ভোগ, অনিয়ম, অসংগতি এবং হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব ঘটনা জনমনে যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও হাসপাতালে আস্থা রাখতে পারছেন না বলে মানুষ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

করোনা নিয়ে রাজনীতি
মার্চ মাস। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত। পুরো দেশে আতঙ্ক। দিন যাচ্ছে আতঙ্কও বাড়ছে। প্রবাসীসহ অনেকেই করোনা পরীক্ষা করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। কিটের সঙ্কট। নেই পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে করোনা শনাক্তে স্বল্পমূল্যে এবং দ্রুত টেস্টিং কিট উদ্ভাবনের কথা জানায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। দেশের মানুষের মধ্যে তীব্র আশার সঞ্চার হয়। মহামারি বিবেচনায় দ্রুত কিট বাজারে আনার অনুমোদনের আবেদন জানায় গণস্বাস্থ্য। শুরু থেকেই দেখা যায় নাটকীয়তা। গণস্বাস্থ্যের কিটের নমুনা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যাননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিংবা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরসহ সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। এরপর সিআরও (কন্ট্রাক্ট রিসার্চ ফার্ম) প্রতিষ্ঠান নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। ওষুধ প্রশাসন ও গণস্বাস্থ্যের সেই দ্বন্দ্বও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। একপর্যায়ে গণস্বাস্থ্যের দাবি মেনে ‘নামসর্বস্ব’ সিআরও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কিটের সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষার পক্ষে মত দেয় ওষুধ প্রশাসন। এক মাসের বেশি সময় কার্যকারিতা যাচাই শেষে বিএসএমএমইউয়ের ‘কার্যকারিতা যাচাই কমিটি’ জুনের শেষ দিকে জানায়, গণস্বাস্থ্যের কিট কার্যকর নয়। তবে গণস্বাস্থ্য জানায়, বিএসএমএমইউয়ের পরীক্ষায়ই তাদের কিট ৭০ শতাংশ সফল। এই মুহূর্তে এতটুকু সফল কিট বিশ্বের কোথাও নেই। ওই সময় পর্যন্ত কিটের সক্ষমতা যাচাইয়ে ওষুধ প্রশাসনের কোনো নীতিমালা ছিলো না। গণস্বাস্থ্যের কিটের ফল প্রকাশের পর ওষুধ প্রশাসন কিট যাচাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে নীতিমালা অনুসরণ করে, সেই নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশের জন্য। গণস্বাস্থ্য দ্বিতীয়বার তাদের কাছে গেলে ওষুধ প্রশাসন বলে, নতুন প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী কিটের সক্ষমতা যাচাই করে আনার জন্য। এ সময় গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘নতুন নীতিমালা অনুযায়ী কিটের সক্ষমতা যাচাই করার মতো পরীক্ষাগার বাংলাদেশে নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার অনুমোদন না দিলেও বছরের শেষ দিকে এসে ১০ জেলায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু করেছে সরকার।

করোনার টিকা নিয়ে দুর্নীতির আশঙ্কা
করোনার ভ্যাকসিন কিনছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে টিকা কেনায়। এ জন্য দরকার ৩ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। আর টিকা কিনে তা গ্রামগঞ্জে পরিবহনের জন্য থাকছে ৭৬৫ কোটি টাকা। আমদানি করা টিকা সংরক্ষণ করতে আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৩৭০ কোটি টাকা। টিকা কীভাবে দেয়া হবে, কী ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে এবং সংরক্ষণ পদ্ধতি কেমন হবে-এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ খরচ ধরা হয়েছে ৯৩ কোটি টাকা। টিকা আমদানির সময়ে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এবং কমিশন বাবদ আরো কয়েক কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে টিকা দেশে আসার পর তা সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সাড়ে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা খরচ হবে। এই প্রকল্প শুধু টিকা কেনা ও বিতরণেই সীমাবদ্ধ নয়; করোনা রোগীদের চিকিৎসায়ও খরচ করা হবে। এই প্রকল্পে চিকিৎসাসামগ্রী কিনতে ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। টিকা দেয়ার সময় স্বাস্থ্যকর্মীরা এসব চিকিৎসাসামগ্রী ব্যবহার করবেন। এছাড়া সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি যন্ত্রপাতি কেনায় ৩৭০ কোটি টাকা; করোনার নমুনা সংগ্রহে ১৮ কোটি টাকা; পিসিআর কিট, র‍্যাপিড টেস্ট কিট কেনাকাটায় ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। সার্বিকভাবে এই প্রকল্পে সরকার দেবে ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি তিন কোটি ডোজ করোনার ভ্যাকসিন ক্রয় করছে। সরকার অবশ্য সরাসরি সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে এ ভ্যাকসিন কিনছে না। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস সিরাম থেকে এ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করেছে। এদিকে সরাসরি সিরাম থেকে ভ্যাকসিন না কেনায় বাংলাদেশ ৭২৫ কোটি টাকারও বেশি অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সরকার যদি অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি সরাসরি অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে কিনতে পারতো, তাহলে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন ১.৭৮ ইউরোতে (২.১৫ ডলার) অথবা এর কাছাকাছি দামে কিনতে পারতো বলে মনে করছেন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা। ফলে করোনার টিকা নিয়েও দুর্নীতির আশঙ্কা করছে অনেক বিশেষজ্ঞ।

রেমিটেন্স ও রিজার্ভ অর্জনে সবোর্চ্চ রেকর্ড
করোনা পরিস্থিতিতেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক (১ ডিসেম্বর) রেমিটেন্সের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়- চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসের চার মাসেই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর এই মজুত ৪২ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ডে উন্নীত হয়েছিল।

করোনায় দেশের কর্মসংস্থান
করোনার কারণে টালমাটাল বিশ্ব। অর্থনীতির অবস্থা নাজুক। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, করোনার তাণ্ডবে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ শতাংশ মানুষ আর গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন। শহরাঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়েছে ঢাকায়। ‘লুজিং লাইভলিহুডস: দ্য লেবার মার্কেট ইম্প্যাক্টস অব কভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি কর্মক্ষেত্রে করোনার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানার জন্য গত ১০ জুন থেকে ১০ জুলাই ফোনকলের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তৈরি করা হয়েছে। তবে এ প্রতিবেদন তৈরিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার’ জরিপের ফলাফলও বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরাঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ কর্মহীন হয়েছে ঢাকায়। এখানে ৭৪ শতাংশ মানুষে তাদের চাকরি হারিয়েছেন। ঢাকা বিভাগের গ্রামাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন এই করোনায়। গ্রামাঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এখানে চাকরি হারিয়েছেন ৪৭ শতাংশ চাকরিজীবী। এই বিভাগের শহর এলাকার চাকরি হারিয়েছেন ৫৪ ভাগ। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, করোনায় চট্টগ্রাম বিভাগের শহর এলাকার ৬৩ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলের ৪৪ শতাংশ; খুলনা বিভাগের শহরের ৫৯ ও গ্রামাঞ্চলে ৩৯ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগের শহরে ৬১ শতাংশ ও গ্রামের ৩৫ শতাংশ; রংপুরে যথাক্রমে ৫৮ ও ৩৭ শতাংশ এবং সিলেটে যথাক্রমে ৬৬ ও ৩৯ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছে। আইএলও ও এডিবি’র যৌথ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, করোনা ও লকডাউনের কারণে বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদে চাকরি হারিয়েছেন ১১ লাখ ১৭ হাজার তরুণ। দীর্ঘমেয়াদে তা বেড়ে ১৭ লাখ ৭৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তরুণদের চাকরি হারানোর সাতটি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে কৃষি খাতে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ, খুচরা বাণিজ্য খাতে ১২ দশমিক এক শতাংশ, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট খাতে দুই দশমিক ছয় শতাংশ, অভ্যন্তরীণ পরিবহন সেবা খাতে সাত দশমিক চার শতাংশ, নির্মাণ খাতে ১২ দশমিক আট শতাংশ, টেক্সটাইল খাতে ১৩ দশমিক ছয় শতাংশ ও অন্যান্য সেবা খাতে চাকরি হারিয়েছেন চার দশমিক পাঁচ শতাংশ। এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, করোনার কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছে মোট দেড় কোটি মানুষ। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, করোনার কারণে ৮০ শতাংশ যুবকের আয় কমে গেছে। জানা গেছে, করোনাকালে চাকরি হারিয়ে বিদেশ থেকে কর্মী ফেরত আসার ঢল থামছে না। প্রতি মাসেই এমন ফিরে আসা কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। অক্টোবর মাসে ফেরত এসেছেন ৮০ হাজার ৭৮২ জন। সেপ্টেম্বরে এসেছিলেন ৭০ হাজার ৫৯৬ জন। গত ১ এপ্রিল থেকে সাত মাসে দেশে এসেছেন দুই লাখ ৪৫ হাজার ৭৯০ জন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বাতিল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু যেদিন প্রথম রোগী শনাক্ত হয়, ৮ মার্চ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সীমিতভাবে উদযাপিত হবে। বড় পরিসরে জনসমাগম করা হবে না। ১৭ মার্চের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানটিও বাতিল করা হয়।

করোনা পরিস্থিতিতে খেলাধুলা
করোনার শুরুর দিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট হলেও দ্বিতীয় টেস্ট আর মাঠে গড়ায়নি। সেই থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। ফুটবল মাঠে গড়ায় নেপালের বিরুদ্ধে প্রীতি ব্যাচ দিয়ে। অন্য খেলাধুলার অবস্থাও একই রকম। করোনা ছাড় দেয়নি খেলোয়াড়দেরও। আক্রান্ত হয়েছেন- মাশরাফি বিন মর্তুজা, বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া থেকে শুরু করে আরো অনেক খেলোয়াড়। করোনাকালে বিসিবির সব আয়ের পথই বন্ধ। আইসিসির নির্ধারিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এসিসির এশিয়া কাপ হয়নি। তার মানে এসবের অংশগ্রহণ ফি এবার পাবে না বিসিবি। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী চুক্তি থেকে আইসিসি ও এসিসির যে আয় হতো, সেটির ভাগও আসবে না। হোম সিরিজগুলো সব স্থগিত হয়ে গেছে। আগের টেলিভিশন স্বত্ব চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর করোনাজনিত অনিশ্চয়তায় নতুন চুক্তি এখনো হয়নি। স্থায়ী আমানতের সুদ ছাড়া ২০২০ সালে কোষাগারে তাই তেমন কিছুই পড়ার সম্ভাবনা নেই।

করোনাকালে শিল্প-সাহিত্য
পৃথিবীর ইতিহাস নতুনভাবে রূপ নিলো করোনাকালে। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি আজ স্তব্ধ। সাহিত্যিকদের আড্ডা হয়েছে ভার্চুয়াল। তবে প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২ লাখ পরিবার ছিলো অসহায়। করোনায় অপরাপর ব্যবসায়ীদের মতো সংকটে পড়েছেন বই ব্যবসায়ীরাও। অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরপরই দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার কারণে গ্রন্থ-প্রকাশনা খাতে প্রভাব পড়েছে বেশি। প্রকাশনা ব্যবসায়ের নেতাদের দাবি, এই আর্থিক ক্ষতির ধাক্কাটা হতে পারে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার বেশি।

করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে ২৭৫ স্থানীয় সংবাদপত্র
করোনাভাইরাসের কারণে পত্রিকা কেনার হার অনেক কমে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কলেবর সীমিত করতে বাধ্য হয়। দেশের উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশিত ৪৫৬টি স্থানীয় সংবাদপত্রের মধ্যে ২৭৫টি (৬০.৩১%) সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অনিয়মিত অর্থাৎ বিজ্ঞাপন পেলে অথবা অর্থসংস্থান হলে ১৮টি (৩.৯৫%) সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক (বিআইজেএন) এর এক জরিপ এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য সংগ্রহের সময়কাল ছিলো ২৩ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত। জরিপে রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের ৩৪টি জেলার ৪৫৬টি স্থানীয় দৈনিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকার উপরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। মিডিয়াভুক্ত সংবাদপত্রগুলোর তালিকার ভিত্তিতে নয়, স্থানীয়ভাবে যেসব সংবাদপত্র করোনাকালের আগে প্রকাশিত হতো- সেগুলো জরিপের আওতায় আনা হয়। করোনাকালে চাকরি হারিয়েছে অনেক সাংবাদিক ও সংবাদের সাথে যুক্ত অনেক কর্মী।

করোনাকালেও বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে উত্থান
অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে করোনার মধ্যেও বিশ্ব সেরা হয়েছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার। ১২ অক্টোবর এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটাল লিমিটেডের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। দেশে করোনা প্রভাবের আগেও নানা সংকটেই ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। আর কভিড দুর্যোগে অব্যাহত দরপতনে বন্ধ রাখা হয় ৬৬ দিন। পরবর্তীতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগসহ বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের বেশকিছু পদক্ষেপে আবারো প্রাণ ফিরে পায় দেশের পুঁজিবাজার। যার ফলশ্রুতিতে জুলাই-সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে বিশ্বের শেয়ারবাজারে বিশ্ব সেরা পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটাল লিমিটেড। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এশিয়ার শেয়ারবাজারের উত্থান হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বেশি ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ উত্থান হয়েছে।

করোনাকালে রাজনীতি
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে ছিলো কাদা ছোড়াছুড়ি। এর মধ্যেই ২৪ মার্চ করোনার কারণে দুইটি শর্তে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। নির্বাহী আদেশে এই মুক্তি দেয়া হয়। শর্ত দুইটি ছিলো- তিনি বিদেশে যাবেন না এবং বাড়িতে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে বেরিয়ে তিনি গুলশানের বাড়িতে যান। পরে অবশ্য তার এই মুক্তির মেয়াদ আরো বাড়ানো হয়। এখনো তিনি গুলশানের বাড়িতে অবস্থান করছেন। বছরের শেষে এসে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ায় ভাস্কর্য। ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে হেফাজতে ইসলামের আপত্তিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে দেশের রাজনীতির মাঠ। এর মধ্যে কুষ্টিয়াতে ভাস্কর্য ভাঙচুর নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আসে আওয়ামী লীগ থেকে। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া নিয়ে তারাও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ভাস্কর্য আর হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

করোনাকালে বাংলাদেশের ভূরাজনীতি
ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিবেচনায় এই অঞ্চল আগে থেকেই স্পর্শকাতর। এক ধরনের সহাবস্থানের কালচার গড়ে উঠলেও, মাঝে মধ্যে এতে উত্তেজনা দেখা দেয়। সেই উত্তেজনা প্রশমনে অনেক সময় লেগে যায়। নিকটবর্তী ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাদের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় পড়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে চীনের অবদান রয়েছে। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীন বর্তমানে বেশি ঋণ দিচ্ছে। পদ্মা সেতুসহ বড় বড় সেতু নির্মাণে চীনের অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যায়েও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের দিকে কিছুটা হলেও ঝুঁকেছে বাংলাদেশ। করোনাকালেও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো অগ্রগতি হয়েছে। চীনের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধির কারণে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই নাখোশ। তাই চীনকে দূরে সরাতে ভারত অনেক বেশি সক্রিয় তৎপরতা শুরু করে। ভারত তাই ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো নিবিড় করার চেষ্টা করছে। বিদায়ী বছরে মহামারির মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বছরের শেষে ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। পরে বাংলাদেশ ও ভারত সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেন। সই হওয়া সমঝোতা স্মারকগুলো হচ্ছে হাইড্রোকার্বনে সহযোগিতার বিষয়ে রূপরেখা, কৃষি খাতে সহযোগিতা, নয়াদিল্লি জাদুঘরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সহযোগিতা, হাতির সুরক্ষায় অভয়ারণ্য নিশ্চিত করা, হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প চালু, বাংলাদেশ-ভারত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফোরামের ট্রাম্প অব রেফারেন্স এবং বরিশালে সুয়ারেজ প্রকল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক। বাংলাদেশের পক্ষে সংশ্লিষ্ট সাত মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সচিব বা শীর্ষ কর্মকর্তা আর ভারতের পক্ষে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী সই করেন। এদিকে বাংলাদেশ-ভুটান অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) পারস্পরিক স্বার্থের দিক দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো সুসংহত করেছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কেননা বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর হলো। আর ভুটানই প্রথম দেশ, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

বছরজুড়ে শোবিজে বিয়ে ও বিচ্ছেদ
করোনার কারণে অনেককিছু থেমে ছিলো। বড় ক্ষতি হয়েছে চিত্র জগতে। অর্থ সংকটে রয়েছেন অনেক তারকা। তবুও থেমে ছিলো না তারকাদের বিয়ে ও বিচ্ছেদের ঘটনা। এ বছর তৃতীয়বারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন অভিনেত্রী শমী কায়সার। দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন মডেল অভিনেত্রী আনিকা কবির শখ। বছরজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনায় ছিলেন আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী মিথিলা ও তার ভারতীয় স্বামী সৃজিত। সৃজিতের ঢাকা ও মিথিলার কলকাতা সফর নিয়ে বছরজুড়েই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ছিলো। চলতি বছর হুট করেই রাজধানীর একটি কাজী অফিসে বিয়ে করেছিলেন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমনি। নাট্য নির্মাতা কামরুজ্জামান রনিকে বিয়ে করেন এ নায়িকা। কিন্তু কী থেকে কী হলো- মাত্র পাঁচ মাসেই সংসার ভেঙে গেলো। করোনার মধ্যেই পরীমনির পথে হেঁটেছেন অভিনেতা জিয়াউল হক অপূর্ব ও শবনম ফারিয়া। এ বছর তাদের দু’জনেরই ঘর ভেঙেছে। এছাড়াও বছরের শুরুতেই অনিকের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন চিত্র নায়িকা শাবনূর। সিনেমা না ছাড়ায় স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছেন বাংলা সিনেমার এক সময়ের জনপ্রিয় নায়িকা মুনমুন। চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে তাদের বিচ্ছেদের খবরটি প্রকাশ্যে আসে। এছাড়া বছরজুড়ে বিয়ের গুঞ্জনে আলোচনায় ছিলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি। তবে সে গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি হানিমুন থেকে ফিরেই বিচ্ছেদের গুঞ্জনে নাম আসে চিত্রনায়িকা তমা মির্জা ও তার স্বামী হিশাম চিশতীর।

২০২০ সালে যাদের হারালাম
এ বছর না ফেরার দেশে চলে গেছেন- অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন, প্রখ্যাত প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর, ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ইমামুল কবির শান্ত, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, সিলেটের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সাবেক এমপি মকবুল হোসেন, সাবেক এমপি কামরুন্নাহার পুতুল, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ, বিএনপির চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, বিএনপির সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির, কামাল লোহানী, অভিনেতা আলী জাকের, চিকিৎসক মঈন উদ্দিন, চিকিৎসক আবুল মোকারিম মো. মহসিন উদ্দিন, হেফাজতের আল্লামা আহমদ শফী, মাওলানা নুর হোসেন কাসেমী, প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান, যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম বাবুল, শিল্প উদ্যোগতা আব্দুল মোনেম, পার্টেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এ হাসেম, এসআলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম, সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান মোহাইমিনুল ইসলাম, সিএমডি’র সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ, উপ-পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমানের মৃত্যু, সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইন, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার নুরুল হক মানিকসহ আরো অনেকেই।

আলোচিত কিছু ঘটনা
বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলো- প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ, সিলেটের এমসি কলেজে নববধূকে ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড, গত ২৯ জুন সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে ময়ূর-২ লঞ্চ দুর্ঘটনা, সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা, কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে হত্যা, ৪ ডিসেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে স্থানান্তরের প্রথম ধাপে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর আলোচনার জন্ম দেয়। বছরের শেষ দিকে এসে পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর সমাপ্তি এর মধ্যে আশার সঞ্চার যোগায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //