অর্থনীতি ২০২০: মহামারি মোকাবিলার বছর

বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ মোকাবিলায় পার হয়েছে বছরের প্রায় তিন-চর্তুথাংশ সময়। বাাংলদেশের অর্থনীতিও এর প্রভাবমুক্ত ছিলো না। তবে আশার কথা হলো, অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় মহামারির প্রভাব পড়েছে সামান্যই। 

পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়িয়েছে ১৯৭০.০০ ইউ এস ডলারে। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিলো ১৮২৮.০০ ইউ এস ডলার। অবশ্য জিডিপি বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় ৮.১৫ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫.২৪ শতাংশে। 

 

সূত্র: পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়

২০১৯-২০ অর্থবছরে অন্যান্য সূচকগুলোর মধ্যে বিনিয়োগের হার, শিল্প / উৎপাদন হার, কৃষি বৃদ্ধির হার, গার্হস্থ্য সঞ্চয় হার, জাতীয় সঞ্চয় হার, আমদানি-রফতানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ছিলো উর্ধ্বমুখি। যদিও এ হিসেব বছরের প্রথম অর্ধেক সময়ের। 

 

সূত্র: পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়

কভিড-১৯-এর মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দর রফতানির নতুন রেকর্ড গড়েছে। অক্টোবরে প্রকাশিত এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটাল লিমিটেডের এক প্রতিবেদনে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে জুলাই-সেপ্টম্বর এ তিন মাসে বিশ্ব সেরা হয়েছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার।


সূত্র: পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়

সূত্র: পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়

অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে বেকারত্বের হার বেড়েছে। মার্চে যা ছিলো ২.৩%, জুলাই মাসে তা বেড়ে ২২.৩৯% হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রশিত জরিপে পরিবারিক গড় আয় ২০% কমেছে। জরিপে জানা যায়,  মার্চে  প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিলো ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা নেমে এসেছে ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। এ সময়কালে পরিবারের ব্যয় ৬ দশমিক ১৪% কমেছে। মার্চে পরিবার প্রতি মাসিক খরচ ছিলো ১৫ হাজার ৪০৩ টাকা, আগস্টে তা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১১৯ টাকায়। গত ৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় “কভিড -১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার ওপর ধারণা জরিপ ২০২০” শীর্ষক প্রতিবেদন এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের জিডিপির মোট ৭ শতাংশ আসে প্রবাসী আয় থেকে। প্রবাসীরা ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। এই আয়ের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬১৪ কোটি ডলারে।

সূত্র: পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়

এ আয় বৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং দেশিয় গবেষণা সংস্থাগুলোর র্পূবানুমান ভুল প্রমানিত হয়েছে। তারা আভাস দিয়েছিলো, মহামারীর কারণে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ২২ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। 

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে প্রায় দুই লাখ প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরত আসতে পারে এমন আশঙ্খার কথা বলা হয়েছে। যদিও প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ হারানো, বেতন কমার মতো নানান সঙ্কটের আশঙ্কায় রয়েছেন। 

করোনার কারণে সারা বিশ্বে পুরো অভিবাসন খাতটা সংকটে পড়েছে ৷ তবে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব ও অবদানের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের অভিবাসনের বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে এ মুহূর্তেই আলোচনা শুরু করতে হবে। 

এরমধ্যে যারা দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের কোনো কাজ নেই, আয়ের উৎস নেই। এ প্রবাসীরাই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর দয়িত্ব সরকারের। সহজ শর্তে উদ্যোক্তা ঋণ প্রদানসহ তাদের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। 

করোনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ঝুঁকিতে পড়েছে । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী দেশের অর্থনীতিতে সেবা খাত ৫০ শতাংশ, শিল্পখাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষি ১৪ শতাংশ অবদান রাখে। করোনায় সেবা ও শিল্প খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। 

এডিবি (এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক) তার সবশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে ১ হাজার ৩শ’ কোটি ডলারেরও বেশি। লকডাউন ও সাধারণ ছুটিসহ মহামারীর প্রভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে।

আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) প্রকাশিত ‘কান্ট্রি ফোকাস’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত পোশাক রফতানি ও রেমিটেন্স মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। 

বিশ্ব ব্যাংক বলছে, বিগত (২০১৯-২০) অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই থেকে তিন শতাংশে নেমে আসতে পারে। যদিও করোনা সংকটের আগে সাত শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। 

চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে । জ্বালানি তেলের দাম কমায় মধ্যপ্রাচ্যে থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স ২২ শতাংশ কমে যাবে। ধনী দেশগুলোর অর্থনীতির উপর করোনার প্রভাবের ফলে পোশাক রফতানি আয়ও কমে যেতে পারে।

নতুন অর্থবছরে (২০২০-২১) প্রায় পৌনে ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেটকে একদিক থেকে সাহসী বলা যায়।  যদিও এর সাফল্য নির্ভর করছে করোনার সংক্রমন কমে যাওয়া এবং অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসার ওপর। বিশ্বের বড়ো সংস্থাগুলোর ভাষ্য যাই বলুক, তাদের হিসেব-নিকেষ ভুল প্রমান করে বাংলাদেশ নিজের সক্ষমতা প্রমান করেছে বহুবার।

বছরের শেষদিকে ভুটানের সাথে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ। এটিই বাংলাদেশের প্রথম অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি। সে বিবেচনায় গত ৬ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক। স্বল্পোন্নত দেশে উত্তীর্ণ হতে হলে এ ধরনের চুক্তির গুরুত্ব রয়েছে।

চুক্তিটি আমাদের দেশের অবস্থানকে একধাপ এগিয়ে নিলো। জন্মলগ্ন থেকেই ভুটানের সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও হৃদ্যতাপূর্ণ। বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভুটান পারস্পরিক রাজনৈতিক বন্ধুত্বের সূচনা করেছিলো।

নতুন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ১০০টি পণ্য ভুটানে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। ভুটানের ৩৪টি পণ্য বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিলো ৫৭.৯০ মিলিয়ন ডলার। এ অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য সম্পর্কে নতুনমাত্রা যোগ করবে। 

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠককে ঘিরে গতদ ১৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দু‘দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। হাইড্রোকার্বন খাতে সহযোগিতা, হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, বাংলাদেশ-ভারত সিইও ফোরামের টার্মস অব রেফারেন্স, নয়াদিল্লি জাদুঘরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি, হাতির সুরক্ষায় অভয়ারণ্য নিশ্চিত করা, বরিশালে সুয়ারেজ প্রকল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, কৃষি খাতে সহযোগিতার প্রত্যাশা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরিত হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //