ফিরে দেখা ২০২০: ‘ফোকলা’ ব্যাংক খাত

কভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে চলতি বছর শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত আছে। সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যেও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শুধু ব্যাংক খোলা ছিল। 

সাধারণ ছুটির মধ্যে সচল থেকেও অর্থনীতিতে অনেকটাই অচলায়তনের ভূমিকায় ছিল ব্যাংকগুলো। অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ দেয়া তো দূরের কথা; বরং সর্বকালের সবচেয়ে কম হারে ঋণ দেয়া হয়েছে। অথচ করোনাকালীন প্রণোদনা বিতরণের দায়িত্ব ছিল ব্যাংকগুলোর হাতে। সেই কাজটিও সঠিকভাবে করেনি। বরং যেসব ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কারণে ব্যাংকগুলো ধুঁকছে, প্রণোদনার টাকাও দায়সারাভাবে তাদের পকেটেই তুলে দেয়া হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাতা-কলমে ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো দেখা গেলেও, প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকগুলো ‘ফোকলা’ হয়ে গেছে। নানা দিক থেকে ব্যাংকের অবস্থা আগের তুলনায় দুর্বল হয়েছে। 

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। সংক্রমণে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এতে আন্তর্জাতিক আমদানি-রফতানি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এতে বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্যও থমকে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি স্থানীয় বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যায়। 

করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এই প্যাকেজের মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো এই প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে সচেষ্ট ছিল বেশি। নিজেরা অন্য ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। আবার প্রণোদনার যে টাকা দিয়েছে তা শিল্পপতিদের। অন্য ছোট ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পেয়েছেন সামান্যই। ব্যাংকের কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি। করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংকগুলো অনেকটা ইচ্ছা করেই ব্যবসা করেনি। তবে ব্যবসা না করলেও আয় হয়েছে অনেক বেশি। এটি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ছাড়ের কারণে। থমকে যাওয়া ব্যাংক খাত খাতা-কলমে সচল দেখানো হচ্ছে। তবে প্রকৃত চিত্র ভিন্ন।

এ বিষয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত আসলে ফোকলা হয়ে গেছে। এর জন্য মূলত দায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেভাবে ব্যাংক খাতকে তদারকি করার দরকার ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা কারণে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতিকে সচল করার দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর হাতে দেয়া হয়; কিন্তু ব্যাংকগুলো প্রণোদনার অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করেনি। ধনিক শ্রেণির হাতে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা তুলে দিলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক মানুষকে প্রণোদনা দিতে গড়িমসি করছে ব্যাংকগুলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো একেবারেই আগ্রহ দেখায়নি।’

মন্দার বছরেও ব্যাংকগুলোতে সচল ছিল রেমিট্যান্স আয়। আমদানি ব্যয় অনেক কম হয়েছে। যেটুকু রফতানি আয় হয়েছে ব্যয় না হওয়ার কারণে তা উদ্বৃত্ত আকার ধারণ করেছে। এই বৈদেশিক উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রার কাছে বিক্রি করায় রিজার্ভ বেড়েছে ব্যাপকহারে। ৩৩ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ বেড়ে ৪২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। স্থবিরতার কারণে এটি বেড়েছে। 

চলতি বছরের ব্যাংক খাতের অবস্থা তুলে ধরতে এক জরিপ চালায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, ব্যাংক খাতের অবস্থা স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ। ২০১৯ সালের তুলনায় দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘করোনাকালে এসএমই খাত অথবা অনানুষ্ঠানিক খাত যে ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছে, তা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। এতে সবচেয়ে দুর্বলতা রয়েছে অর্থায়নে। আমরা বিস্মিত হয়েছি- ব্যাংকগুলো একদিকে বলছে, তাদের প্রচুর অলস অর্থ রয়েছে। আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, এসএমই খাতগুলো সেই সুযোগ নিতে পারছে না। দেখা যাচ্ছে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ আর ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফারাক বাড়ছে। এটি আমাদের জন্য দুঃশ্চিন্তার কারণ।’

ব্যাংক খাত খারাপ হলেও তা ধরা পড়ছে না। কারণ বছরজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নানা ছাড় সুবিধা ভোগ করছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে রয়েছে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থ ফেরত না দিলেও তা খেলাপি না করা। খেলাপি করার সময়সীমা বাড়ানো। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের নিয়মনীতি শিথিল করা। পরিদর্শন বন্ধ রাখা। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর আয় না করেও আয় দেখাতে পারছে। এতে ব্যাংকগুলোর মুনাফা ব্যাপকহারে বেড়েছে। অথচ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে অনেক কম হারে। অক্টোবরে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৮.৬১ শতাংশ হারে, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। 

তবে বছরের শেষ দিকে এসে জারি করা এক নিয়মে ব্যাংকগুলোর চিন্তা বেড়েছে। অনাদায়ী অর্থের বিপরীতেও কাগুজে আয় দেখানোর সুযোগ কিছুটা কমে যাবে ব্যাংকগুলোর। গত এপ্রিল থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন করা হয়। আবার করোনাভাইরাসের কারণে কিস্তিু আদায়ও কমে যায়; কিন্তু ছাড়ের সুযোগে আয় বৃদ্ধি পায়। তবে সর্বশেষ সার্কুলারে সেই সুযোগটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। 

নিয়মানুযায়ী, খেলাপি না হওয়া বা অশ্রেণিকৃত ভালো মানের ঋণে খাত ভেদে সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয় ০.২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। নতুন নিয়মানুযায়ী, সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বাইরে নতুন করে আরো ১ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে। অশ্রেণিকৃত বা ভালো এসএমই ঋণের ওপর ০.২৫ শতাংশ, পেশাদারদের ভোক্তা ঋণে ২ শতাংশ, আবাসনে ১ শতাংশ, অন্য ভোক্তা ঋণে ৫ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। এছাড়া কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণে ১ শতাংশ, ক্রেডিট কার্ডে ২ শতাংশ, স্টক ডিলার ঋণে ২ শতাংশ ও সব ধরনের বিনিয়োগের ওপর ১ শতাংশ হারে সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। খেলাপির মানভেদে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার ৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এতে নিয়মিত ঋণের বিপরীতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে হবে। এই প্রভিশন রাখতে হয় পরিচালন মুনাফা থেকে। অর্থাৎ, পরিচালন মুনাফা বাড়লেও নিট মুনাফা কমে যাবে। 

গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ঋণ ৯ লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ও এসএমই ঋণ ৪৪ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ৯ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। অন্যান্য সব বছরই খেলাপি ঋণ বাড়ে; কিন্তু এ বছরই ভিন্ন চিত্র।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরে ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রয়েছে। আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকের মূল কাজ। ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য রয়েছে। এটির বড় অংশ হয়েছে রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ টাকা পাওয়ার কারণে। করোনাভাইরাসের কারণে গ্রাহকরা ঋণের টাকা ফেরত দেবেন কি-না, এমন আশঙ্কা থেকে ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধ রেখেছে ব্যাংকগুলো। সুদ ও ঋণ বাবদ যে নগদ আয়, তাও প্রায় বন্ধ। আমদানি-রফতানির বিপরীতে কমিশন বাবদ যে আয় হওয়ার কথা, তাও হচ্ছে না। 

এসব আয় বন্ধ হওয়ার পর ছাড়ের কারণে ২০২০ সালের ব্যাংকের সূচক ভালো দেখাচ্ছে; কিন্তু ছাড় সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত ‘ফোকলা’ চিত্র বের হয়ে আসবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //