ভাষা, সংগ্রাম ও বিপন্ন ভাষা

ভাষা আসলে একটি অদ্ভুত প্রতীকী ব্যবস্থা, যেখানে সচেতনতার উপাদানগুলো- যেমন বহির্জগতের অভিজ্ঞতা, আমাদের চিন্তা, অনুভব ইত্যাদি সম্পর্কিত হয় মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কতকগুলো বিশেষ অঞ্চলের কাজের সঙ্গে। আমরা যখন কথা বলি তখন ক্রমাগতভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ চালিত হয়, সমন্বিত হয়।

ভাষা ব্যবহারের সময় অসংখ্য প্রতীকী শব্দ যখন একই সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, তখন একটি জটিল ধারণা বা চিন্তার সমন্বিত প্রবাহ এর সঙ্গে সূত্রবদ্ধ হয়। ভাষা এমন এক অস্ত্র, একটি হাতিয়ার-যা আমাদের ভাবনা, কল্পনা, অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা, আবেগ বা যুক্তির সব ধরনের অভিব্যক্তিকে ধারণ ও সঞ্চালিত করতে পারে। আমাদের ভাষা চিন্তার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি সম্পর্কিত।

ভাষার কথা বললে এটা সহজেই এসে যায়। মায়ের মুখের ভাষার অধিকারের জন্য মানুষ লড়বে, এটা স্বাভাবিক বিষয় শুধু নয়, চিরায়ত সত্যও। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জনগণের অনমনীয় মনোভাবের চিহ্ন হলেও এটা ছিল সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় কথা বলা, লেখা ও ভাব প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও।

সে জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম থেকেই একটি বহুমাত্রিক প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এই অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশই ঘটেছে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বস্তুত মাতৃভাষায় শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও ভাব-প্রকাশের অধিকার বিশ্বের অধিকাংশ ভাষাভাষী মানুষই এখন কার্যকর করতে পারছে না। অধিকাংশ ভাষাই এখন হুমকির সম্মুখীন। অধিকাংশ ভাষাভাষী মানুষই বর্তমানে পরাজিত, বিপর্যস্ত অবস্থায় প্রাণপণে চেষ্টা করছেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। একুশে ফেব্রুয়ারি তাদের সে চেষ্টায় একটি প্রতীকী অবলম্বন।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) শিশুরা জন্মের পর থেকেই তাদের ভাষা ও বাংলা ভাষা দুটিই শেখে। তাদের বলা যায় দ্বিভাষিক। তাদের ভাষা বিকাশশীল নয়, বিলীয়মান ভাষারূপে তালিকাভুক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বাদ দিয়ে শুধু তাদের গোষ্ঠীগত ভাষায় যদি শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, তাহলে কি তাদের উন্নতির সুযোগ বাড়বে?

ইংরেজ শাসনের অবসান বহু দিন আগে হলেও মস্তিষ্ক থেকে উপনিবেশের ভূত এখনো যায়নি। ইংরেজি জানাটা এখনো শিক্ষিতের মূল বিষয় হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় টিকে আছে। অন্ধ ইংরেজি প্রীতি ও বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার ভাবও অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এসব শুভ লক্ষণ নয়।

অধ্যাপক ডক্টর আহমদ শরীফ তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’-এ লিখেছেন, ‘বাঙলা করেছে শিক্ষার মাধ্যম, যদিও এখনো ইংরেজিই বাস্তবে চাকরি-বাকরি আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি-কূটনীতি ক্ষেত্রে আবশ্যিক ও অপরিহার্য ভাষা। কাজেই বড় চাকরি যেন ধনী-সামন্ত-বুর্জোয়া বেনেদের আয়ত্তে থাকে শাসন-প্রশাসন-অর্থ-সম্পদ প্রভৃতির মতো, সে ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।’ সত্যি, বাংলা বড়ো দুর্ভাগা থেকে গেল আজ অবধি। 

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা স্বাধীন হলেও সংকট রয়েই গেল। শ্রেণি চেনার দিক বিবেচনায় আমরা দেখলাম সমাজে আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনা করে মানুষের উচ্চবর্গ নিম্নবর্গ চিহ্নিত হচ্ছে এখনো। ভাষাবিজ্ঞান বলে, ভাষা তৈরির কারিগর মেহনতি মানুষ। মেহনতি মানুষের ভাষা শহরে এলে সেটাকে তথাকথিত ভদ্র লোকেরা কাট-ছাঁট করে ‘মান ভাষা’ নাম দিয়ে ব্যবহার করে।

ভাষার রূপকাররা থেকে যায় অশুদ্ধ ভাষার অধিকারী। আর তথাকথিত ভদ্দরলোকেরা তৈরি করেন আধুনিক ভাষারীতি। নাম হয় সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা। মেহনতি মানুষের ভাষা ঢাকা পড়ে যায় আধুনিক কলা-কৌশলে। মেহনতি মানুষ যারা ভাষা তৈরি করে, তারা হয়ে রয় নিম্নবর্গের। মানে আর্থিক শোষণের জোয়াল ভাষায়ও জায়গা নেয়। 

ভাষা নিজেও কি স্বাধীন? না, স্বাধীন নয়। ইশারা, ভূপ্রকৃতিগতভাবে নির্মিত সুর-সব মিলে তৈরি হয় ভাষা। কিন্তু পল রবসন যখন গেয়ে ওঠে-ওরা মানুষের গান গাইতে দেয় না বা আব্দুল লতিফ যখন গান করেন ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় তখন কি মনে হয় ভাষা কোনোভাবে স্বাধীন হয়েছে? তারপরও এ কথাই ঠিক যে একমাত্র মানুষের ভাষা আছে। অন্য কোনো প্রাণীর ভাষা নেই। 

সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো সম্প্রতি জানিয়েছে, প্রতি দুই সপ্তাহে বিশ্বের বুক থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে সে ভাষার মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া। এতে বিশ্বের বৈচিত্র্য খর্ব হচ্ছে। সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। আর মানবজাতি হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধি। একে মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির বড় ধরনের বিপর্যয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।

মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা একবার বলেছিলেন, ‘যখন আপনি কোনো ভাষায় কাউকে কিছু বলেন, তা তার মস্তিষ্কে পৌঁছায়, সে তা বুঝতে পারে। আর যখন তার নিজের ভাষায় বলেন, তখন তা তার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়।’ মাতৃভাষাকে তাই হৃদয়ের ভাষা বলেই মানেন ভাষাবিদরা।

কিন্তু আমাদের দেশে প্রায় ৭০টি (মতান্তরে ৪৫টি) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করে। হাজার বছরের সংস্কৃতি পরম্পরা ও ভাষিক ঐতিহ্য রয়েছে তাদের। সেসব ভাষা ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক রীতি-নীতির রং ও রসে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, দেশে বাংলাসহ মোট ভাষা রয়েছে ৪১টি। যার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা আছে ৩৩টি।

এর মধ্য থেকে ১৪ ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ভাষা গবেষকরা। একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে রাজবংশী, রাই, বাগদি, কোচ, হদি, কুঁড়ুখ, আদি মালতো ও ভালুর মতো আরও কয়েকটি ভাষা। বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে খাসিয়া, সাঁওতাল, মুণ্ডা, মান্দি (গারো), ককবরক, লালেং (পাত্র), পালিয়া, মৈতেয়মণিপুরী, খুমি, বম, খেয়াং, পাংখো, লুসাই, ম্রো, চাক, ঠার বা থেক, মারমা, চাকমা, বিষষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, সাদরি ও হাজং। এ ছাড়া সিং, কর্মকার, গণ্ড, বেদিয়া, বর্মণ ও লোহার ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। 

ইউনেস্কোর সূত্র মতে, পৃথিবীতে কোনো ভাষায় কথা বলা মানুষের পরিমাণ যদি পাঁচ হাজারের কম হয় তাহলে সে ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে বিপন্ন ভাষার সংখ্যা ১৪টি। বাংলা-ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার ক্রমাগত আগ্রাসনের কারণে সব আদিবাসী ভাষাই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

ভাষা গবেষকরা সম্প্রতি বাংলাদেশে এমন ভাষাভাষী মানুষের খোঁজ পেয়েছেন যারা সংখ্যায় হাতেগোনা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে এসব ভাষার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাঙামাটির সাজেক অঞ্চলের শৌরা ভাষা তারই একটি, যে ভাষায় বর্তমানে কথা বলার মানুষ আছে মাত্র পাঁচজন। একই এলাকার রেংমির্চা ভাষায় কথা বলেন ৩০-৪০ জন। এদের সবারই বয়স পঞ্চাশের বেশি।

জীবিত এই মানুষগুলোর মৃত্যুর পর পরই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই ভাষাগুলো। কারণ তাদের উত্তর প্রজন্ম এ ভাষায় কথা বলে না। দৈনন্দিন জীবন, কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়ায় ওই ভাষার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। ফলে চিরতরে হারিয়ে যাবে এ ভাষা। পাহাড়ি এলাকার এসব ভাষার পাশাপাশি সমতলেও একই রকম বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় কয়েকটি ভাষা।

দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাত্র ১৯টি পরিবারের শখানেক মানুষ কথা বলে ‘কড়া’ ভাষায়। একই অবস্থায় রয়েছে কোদা, মেগাম, পাঙ্গুখুয়া, বম, চাক, আসোচিন, মরু, কুরুক্স, প্নার, সৌরিয়া, খেয়াং, খোজী, কন্দু, মুণ্ডা ইত্যাদি ভাষা। বিপন্নতার ঝুঁকিতে থাকা ভাষাগুলোর সুরক্ষায় বড় দাগে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। তার মধ্যেই চলছে ভাষার বিন্যাস, ভাষার গতিপ্রবাহ।

বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিভেদে মানুষের মুখের ভাষাও আলাদা। ভাষার এই বৈচিত্র্যের ফলে বিভিন্ন ভাষার জন্ম হয়েছে, আর সেসব ভাষার চর্চা মানুষ তার বংশ পরম্পরায় করে আসছে।

এভাবে ছোট থেকেই মা, বাবা, পরিবার ও অন্যদের কাছ থেকে শেখা ভাষাই হয়ে ওঠে মানুষের নিজ মুখের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে শেখা হোক বা অন্য কারো কাছ থেকে-এটাই আমাদের কাছে মাতৃভাষা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, জনসংখ্যার বিচারে যা বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বাধিক কথ্য ভাষা।

বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ সমগ্র পৃথিবীর প্রায় ২৬ কোটি মানুষ এই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে থাকেন। এরপরও বাংলা ভাষার যে অবস্থা তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে পুঁজিবাদের কদাকার রূপ বাজার অর্থনীতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ বাড়ছে। এতকালে বাংলা ভাষারও কোনো ভাষা নীতিমালা তৈরি হয়নি। ফলে ভাষার যে পরিবর্তন ঘটছে তা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। 

এক সময় আমরা এফএম রেডিওর ভাষা নিয়ে কথা বলতাম। কিন্তু এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাষার ব্যবহার আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যেমন ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা, বা বাংলা ভাষারই যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে তা ভয়াবহ। একই সঙ্গে ভাষা বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা দেখি আমরা অনেক কিছু হারাচ্ছি আবার অনেক কিছু নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু কোনটা ভালো সেটাই মূল কথা। 

হালে লক্ষ করা গেছে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের আঞ্চলিক ভাষাকে হারিয়ে ফেলছি। আমাদের গ্রামগুলোর যত ভেতরে কালো পিচঢালা সড়ক, হিনো, বাজাজ, অশোক লেল্যান্ডসহ বহুজাতিক কোম্পানির গাড়ি ঢুকছে, মানুষ তত তথাকথিত ভদ্দরলোক সাজতে মান ভাষার ব্যবহার শুরু করেছে।

আমরা যে অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করি ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থান অনুযায়ী আমাদের কণ্ঠের সহজাত সুরটি ভূ-প্রকৃতিগত কারণে তৈরি হয়। এখানে আরেকটা কথা বলা জরুরি। ভাষা তৈরি হয় মেহনতি মানুষের কাজের প্রয়োজনে। মেহনতি মানুষ যেখানে বসে কাজ করে সেখানের অবস্থান অনুযায়ী ভাষার কাঠামো ও সুর তৈরি হয়।

এ কারণে আমরা বাচনভঙ্গি, ভাষার কাঠামো ও সুরের মধ্য দিয়ে বুঝতে পারি বিভিন্ন জেলার ভাষার পার্থক্য। আবার ভাষা শুনে বুঝতে পারি কোন এলাকার মানুষ। একই ভাষা শুধু উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার অঞ্চল প্রকাশ করতে পারে। এটাই আঞ্চলিকতা। এই ভাষার উচ্চারণ ও ব্যবহাররীতিতে কিছু তফাত আছে প্রমিতের থেকে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা যদিও বলেছেন ১৫-২০ কিলোমিটার পরপর ভাষার পরিবর্তন দেখা দেয়। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থান ভেদে ৮ কিলোমিটার অন্তরও ভাষা বদলে যায়। বিশেষত চট্টগ্রামে ভাষার প্রকৃতি খুব দ্রুত বদলে যায়। তবু এই বদলের মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। বৈচিত্র্য আছে ভাষায়-ব্যবহারে-সুরে। সারা দেশের অঞ্চলভেদে ভাষার বৈচিত্র্য একদম আলাদা।

এই ভাষার মাধ্যমে আঞ্চলিকতার গভীর বন্ধন গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে আত্মার একটা ভিন্ন সম্পর্ক বিরাজ করে। কারণ একই অঞ্চলের ভাষার ব্যবহার রীতি বহু মানুষের ভেতরে একটা ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি করে। নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে মানুষের আত্মার একটা মেলবন্ধন থাকে। মানুষ জন্মের পর মায়ের কাছে যে ভাষাটা শেখে, সেটা তার অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে। আঞ্চলিক ভাষা মিশে থাকে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে।

বিশেষত একই আঞ্চলিকতার মানুষের সঙ্গে কথার মধ্য দিয়ে যে প্রাণ-প্রাচুর্যের সঞ্চার হয় সেটাও আলাদা। কিন্তু গ্রামের ভেতর শহর যত ঢুকে যাচ্ছে মানুষ তত বেশি ভদ্রলোক হওয়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য তার আঞ্চলিক ভাষায়, সেখানে এখন যে তার নিজস্বতা হারাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে যখন মশকরা করা হয়, তখন নিঃসন্দেহে বোঝা যায় শিক্ষার মান এগিয়েছে না পিছিয়েছে।

আঞ্চলিক ভাষা ক্রমশ উপেক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে আঞ্চলিক ভাষাই নগরে গিয়ে নাগরিক ভাষা বা মান ভাষায় রূপ নেয়। আমাদের নদীমাতৃক দেশ। জালের মতো ছড়ানো সব নদী। নদীর পাড়ের মানুষের ভাষা সুরের বৈচিত্র্য একরকম, পাহাড়ের এক রকম আবার সমতল অঞ্চলের একরকম। কিন্তু পরিবেশ প্রকৃতি উজাড় করে পুঁজিবাদ প্রকৃতিকে যেমন ধ্বংস করছে, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশে কাজ করা মানুষগুলোর পেশাও কেড়ে নিচ্ছে।

উন্নয়নের নামে ধান, নদী-খাল যেমন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার পাহাড় সমতলও চলে যাচ্ছে উন্নয়নের তালিকায়। এ অঞ্চলের মানুষ চলে যাচ্ছে কোথাও রুটি-রুজির সন্ধানে। ফলে ভাষার অঞ্চল খালি হচ্ছে-হারাচ্ছে ভাষা বৈচিত্র্য-আঞ্চলিকতা। ভাষা নিয়ে মানুষ যেখানে যাচ্ছে, সে সেখানের ভাষায় কথা বলছে। সেখানেও সুর সহসা যায় না।

এটা কলকাতায় গেলে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। কলকাতার ভাষার সঙ্গে সবাই দ্রুত তাল মেলালেও এলাকার মানুষ পেলে সে তার আঞ্চলিকতায় ফিরে যায়। এ অবস্থা খোদ ইউরোপ আমেরিকাসহ সব মানুষের বেলায়। তারপরও ভাষার বিবর্তনে ও পুঁজির অসম বিকাশের মধ্য দিয়ে হারাচ্ছে আঞ্চলিক ভাষা-ভাষার প্রাণ।

আঞ্চলিক ভাষাকে নির্বাসনে দিয়ে মান ভাষা টিকতে পারবে কিনা এটাও একটা বিষয়। মানুষের মতো ভাষারও সমাজ আছে- শ্রেণি আছে। সেদিক থেকে আঞ্চলিক ভাষা অচ্ছুত হলেও ভাষা তৈরির কারিগর। এটা না বুঝলে সংকটের মুখোমুখি হবে ভাষাই। তাই এখনই বিষয়টি চিন্তায় আনা দরকার। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //