মহামারিতে পর্যুদস্ত দেশের মিডিয়া

গত ২১ জানুয়ারি আমার সাবেক কলিগ আফজালুর রহমান ৩১ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি বিজিসিতে কর্মরত ছিলেন। এর আগে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নাইনের পুরো নিউজ টিম ছাঁটাই হওয়ায় বেশ কিছু দিনের জন্য বেকার হয়ে পড়েছিলেন এই তরুণ মেধাবী সাংবাদিক। 

করোনাভাইরাস কোনো বয়স মানেনি, মানেনি পেশা। বিশেষ করে ফ্রন্টলাইনের মানুষ, চিকিৎসক ও গণমাধ্যমকর্মীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সারাবিশ্বেই গণমাধ্যমের ওপর করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বন্ধ হয়েছে হাজার হাজার পত্রিকা। চাকরি হারিয়েছেন সাংবাদিকরা। অনিয়মিত হয়ে পড়েছে বেতন-বোনাস।

গত বছরের ৩০ নভেম্বর প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বলেছিলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সব সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংবাদপত্র। মফস্বলে আঞ্চলিক সংবাদপত্রের অবস্থা আরও খারাপ। এসব টিকিয়ে রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। না হলে মফস্বল সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র হুমকির মুখে পড়বে।

করোনাভাইরাস মহামারির মহাদুর্যোগের মধ্যেই বিদায় নিয়েছে ঘটনাবহুল ২০২০ সাল। যাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বছরের। গত বছরের প্রায় পুরোটাই কেটেছে মৃত্যুর আতঙ্কে। অভূতপূর্ব ঘাতক করোনাভাইরাস এক বছরের মধ্যেই কেড়ে নিয়েছে বিশ্বের প্রায় ২১ লাখ মানুষের প্রাণ, আক্রান্ত হয়েছে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ। করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে উন্নত-অনুন্নত কোনো দেশই রেহাই পায়নি। বাংলাদেশে আক্রান্ত সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, মৃতের সংখ্যা আট সহস্রাধিক।

অন্যান্য দেশের মতোই করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত ও বিপর্যস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণমাধ্যম, সংবাদপত্রশিল্প ও সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকা। সারাদেশে যারা আক্রান্ত হয়েছেন ও মারা গেছেন, তাদের প্রায় সবাই নিয়মিত কর্মস্থলে যেতেন। সংবাদপত্রের রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার এবং টেলিভিশনের রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানদের ঘটনাস্থলে যেতে হয়েছে খবর ও ছবি সংগ্রহের জন্য। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার তাদের দ্বারা অফিসে কর্মরত সাংবাদিকদের অনেকেই সংক্রমিত হয়েছেন।

বেশ কিছু দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে পড়ে। নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে যেসব পত্রিকা, সেগুলোর আকার কমে যায়। ১৬ বা ২০ পৃষ্ঠার পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যা হয়ে পড়ে ৮ অথবা ১২। পত্রিকাগুলোর প্রচারসংখ্যাও ব্যাপকহারে কমেছে। কোনো কোনো পত্রিকার প্রচারসংখ্যা অর্ধেক অথবা দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়। প্রচারসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ পত্রিকা কেনায় পাঠকদের অনীহা। পত্রিকার গ্রাহকদের মধ্যে ধারণা জন্মেছিল, ছাপা পত্রিকা ঘরে এলে তার সঙ্গে করোনাভাইরাসও আসতে পারে। সে কারণে তারা পত্রিকা কেনা বন্ধ করে দেন। যাদের সুযোগ, সামর্থ্য ও আগ্রহ ছিল, তারা ঝুঁকে পড়েন পত্রিকাগুলোর অনলাইন এডিশনের দিকে।

প্রচারসংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও অনেক কমে যায়, কারণ করোনাভাইরাস বিপর্যয়ের সঙ্গে আসে শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা। এমন পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এর ফল ভোগ করতে হয় পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মচারীদের। অধিকাংশ পত্রিকায় বেতন হয়ে যায় অনিয়মিত। কোনো কোনো পত্রিকায় লোকবলও কমানো হয়, বেকার হয়ে পড়েন অনেক সাংবাদিক।

দেশে সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৩৫টি। বেসরকারি চ্যানেলগুলো করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টিভি চ্যানেলের আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে বিজ্ঞাপন কমেছে অথবা বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমেছে। অধিকাংশ চ্যানেলের বেতন হয়েছে অনিয়মিত, লোকবল কমানো বা ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। অনেক সাংবাদিকের ঘরে খাবার জোটেনি। বেশিরভাগ পত্রিকার মালিক বেতন পরিশোধ করেনি। ঈদের সময় ঈদ বোনাস দেয়নি বেশিরভাগ টেলিভিশনের মালিকপক্ষ। 

এরই মধ্যে অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। লম্বা সময় এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকায় বয়স বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে অন্য পেশা গ্রহণ করার মতো অবস্থাও তাদের নেই। অথচ করোনাভাইরাস মহামারির বিস্তার প্রতিরোধে, জনগণকে সচেতন রাখতে এবং করোনাসংক্রান্ত তথ্য প্রচারের মাধ্যম হলো সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিও। তাই করোনাভাইরাসের মতো দুর্যোগ ও বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে মিডিয়াকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

দুই

গত ১০ মাসে সারাবিশ্বে প্রতিদিন গড়ে দু’জন করে মাসে প্রায় ৬০ মিডিয়াকর্মী মারা যান। ৫৯ দেশের অন্তত ৬০৩ মিডিয়াকর্মী মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকায় ৩০৩, এশিয়ায় ১৪৬, ইউরোপে ৯৪, উত্তর আমেরিকায় ৩২, আফিকায় ২৮ জন মারা যান। 

একক দেশ হিসাবে পেরুতে সবচেয়ে বেশি ৯৩ মিডিয়াকর্মী মারা গেছেন। ব্রাজিলে ৫৫, ভারতে ৫৩, ইকুয়েডরে ৪২ মিডিয়াকর্মী মৃত্যুবরণ করেন। আর ইউরোপে মৃত্যুর দিক থেকে ইতালি শীর্ষে অবস্থান করছে, সেখানে ৩৭ সাংবাদিক মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ৩১, পাকিস্তানে ২২, তুরস্কে ১৭, যুক্তরাজ্যে ১৩, পানামায় ১১, বলিভিয়ায় ৯, আফগানিস্তান, ডমিনিকান রিপাবলিক, নাইজেরিয়া ও রাশিয়ায় আট এবং আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া ও হন্ডুরাসে সাতজন করে সাংবাদিক মারা গেছেন।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ সংক্রমণ। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে এবং নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে। মৃতের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে। হাসপাতালেও ঠাঁই হয়নি বহু রোগীর। সব সংবাদপত্র, টিভি স্টেশন খোলা থাকলেও সাংবাদিকদের ‘সেকেন্ড হোম’ জাতীয় প্রেস ক্লাবও লকডাউন করা হয় ২১ মার্চ এবং তা একটানা চলেছে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। 

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয় ৪৪ সংবাদকর্মীর। এটি একটি পরিসংখ্যান। করোনাভাইরাস সংক্রমণে সাংবাদিক মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আক্রান্ত হয়েছেন ১২৩ পত্রিকা, ৪০ অনলাইন পোর্টাল, ৩২ টিভি মিডিয়া, পাঁচটি রেডিও স্টেশন এবং দুটি নিউজ এজেন্সির অনেক সাংবাদিক। জাতীয় এবং মফস্বল মিলিয়ে এক হাজার ১২৪ সাংবাদিক কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছেন। এর বাইরে অনেকেরই উপসর্গ থাকলেও, তা রয়েছে পরিসংখ্যানের বাইরে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //