নৈতিক বিপর্যয়ের এক অতিমারি

কোভিড-১৯- বিপর্যয়ের নানান মাত্রা

করোনাভাইরাস গোত্রীয় সার্স-কোভ-০২ ভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ অতিমারি নিঃসন্দেহে এক মারাত্মক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে এসেছে। প্রকাশিত সংখ্যা মতে, জানুয়ারি ২০২১-এর শেষ সপ্তাহ নাগাদ বিশ্বব্যাপী ১০ কোটিরও অধিক আক্রান্ত রোগী আর বিশ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু মানব ইতিহাসে এক ভয়াবহ ঘটনা। 

এর সঙ্গে রয়েছে পরীক্ষার দ্বারা শনাক্ত না হওয়া সম্ভবত আরও কয়েকগুণ রোগী, রিপোর্টবিহীন আরও অনেক মৃত্যু, কোভিড-১৯-পরবর্তী দৈহিক-মানসিক জটিলতা (যার কিছু কিছু আমরা জানি আর বহু কিছুই অজানা) এবং সেই সঙ্গে অসংক্রামক ব্যাধি, গর্ভস্থ শিশু ইত্যাদির ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী সম্ভাব্য প্রভাব। দৈহিক-মানসিক বিপর্যয়ের সঙ্গে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি চরম অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের সৃষ্টি করেছে কোভিড-১৯। বিশেষত শিক্ষা ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবকদের মধ্যে শুধু ভবিষ্যৎ জীবনের বাস্তবিক অনিশ্চয়তাই সৃষ্টি করেনি, বরং এক সার্বিক অবক্ষয়ের ব্যাপক উদ্ভব ঘটিয়েছে। 

দৈহিক-মানসিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষাগত বিপর্যয়ের পাশাপাশি রয়েছে আরেকটি মারাত্মক বিপর্যয়, যার সৃষ্টি হয়েছে মানব জাতির আদিমতম পশুবৃত্তিক প্রবণতাগুলোর বৈশ্বিক বিস্তারের মাধ্যমে- যেন সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের পাশাপাশি আরেকটি অদৃশ্য ভাইরাস এক ‘মিউটেশন’-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে সারাবিশ্বে, সৃষ্টি করেছে অনৈতিকতার এক অতিমারি।

কার আগে কে চিকিৎসা পাবেন

যুদ্ধের মাঠে নিজে আত্মত্যাগ করে মৃত্যুন্মুখ সহকর্মীর মুখে আগে পানি তুলে দেওয়ার গল্প আমাদের সবসময় উদ্বুদ্ধ করেছে; কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্রই প্রদর্শন করেছে। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও অক্সিজেন, আইসিইউ কিংবা হাসপাতাল বেডের সংকট দেখা দিলে দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে ওঠা বিধি বা আইনভিত্তিক standard operating procedure (SOP) কঠিন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। ধরা যাক, আশি বছরের এক বৃদ্ধ আর চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়সের এক মাঝবয়সী কোভিড-১৯ রোগীর জন্য একটি দুর্লভ আইসিইউ বেডের সমান প্রয়োজন। অথবা ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো কো-মর্বিডিটিসহ মাঝবয়সী এক রোগী আর পাশাপাশি সমবয়সী সাধারণ এক রোগীর জন্যও সমানভাবে প্রয়োজন একটি হাই-ফ্লো অক্সিজেন ক্যানুলার। যখন ওইসব দেশে এই ধরনের বেড বা উপকরণ উদ্বৃত্ত ছিল, তখন চিকিৎসা সুবিধা প্রদানে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। আইনের দিক থেকে দেখতে গেলে দু’পক্ষেরই সমান অধিকার রয়েছে সেবা পাওয়ার; কিন্তু চরম সংকটের মধ্যে সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্স কিংবা ব্যবস্থাপক কী সিদ্ধান্ত নেবেন? 

একদিকে বয়স বা অন্যান্য কো-মর্বিডিটির কারণে এক পক্ষের রোগীর অবস্থা অধিকতর গুরুতর, তাই তাদের দাবি বেশি হওয়া উচিত বলে মনে হবে। তাদের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। আবার অন্যপক্ষে চিকিৎসা না দিলে মৃত্যুঝুঁকি প্রবল অথচ চিকিৎসা দিলে বেঁচে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কার অগ্রাধিকার? আইন এখানে সমাধান দিতে পারছে না- নৈতিক বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সত্যি বলতে কি, উন্নত দেশেও এর উত্তর মেলেনি- সেখানেও বহু অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি, সোজা কথায় নীতিহীনতার মহামারি দেখা যায়। আর উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো বা উপকরণের প্রচুর ঘাটতি, সেখানে তো কথাই নেই- সেখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর মহামারি- অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার অবাধ প্রদর্শনী! এর বহু উদাহরণ বাংলাদেশেও জাজ্জ্বল্যমান। 

শুধু চিকিৎসা সেবাই নয়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধেও নৈতিকতার সমস্যা এই মুহূর্তে সারাবিশ্বেই প্রকট। গুটিকয়েক ধনী দেশের কথা বাদ দিলে, ভ্যাকসিনের সংখ্যা এখনো সারাবিশ্বেই সীমিত। অগ্রাধিকার তালিকা দরকার, কার আগে কে পাবে। ধরা যাক, একই পরিবারে একজন ফ্রন্ট লাইনার, যেমন চিকিৎসক বা নার্স, যার বয়স কম। অন্য আরেকজন সদস্য সত্তরোর্ধ্ব কিংবা ষাটোর্ধ্ব, সঙ্গে হৃদরোগ রয়েছে। দু’জনের মধ্যে অগ্রাধিকার স্থির করা যাবে কীভাবে? একজন রোগীর সংস্পর্শে যান; কিন্তু নিয়ম মতে তাকে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) পরতে হয়, তাই তিনি কিছুটা সুরক্ষিত। অন্য জন কিছু না কিছু কাজে বাইরে যান- বাজার-সওদা করেন, কোনো পিপিই ব্যবহার করেন না, তার ঝুঁকি প্রকৃত পক্ষে মোটেও কম নয় এবং আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুঝুঁকি আরও বেশি। একটি সমাধান- তাকে গৃহবন্দি রাখা; কিন্তু তার দৈহিক-মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তা মারাত্মক ক্ষতিকর। এ অবস্থায় আইন কোনো সমাধান দেয় না, নৈতিক বিবেচনা দরকার; কিন্তু কে দেবে এই নৈতিক দিকনির্দেশনা? রাষ্ট্র?

ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র- চির পুরাতন নতুন লড়াই

ব্যক্তির স্বাধীনতা বনাম সমাজ ও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব, সভ্যতার প্রথম থেকেই এ দ্বন্দ্ব। দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বলেছিলেন, ব্যক্তি নাগরিক কখনো ‘ন্যায্য’ হতে পারে না- কেবলমাত্র একটি রাষ্ট্রই ন্যায্য হতে পারে। অন্য কথায় একটি ন্যায্য রাষ্ট্রের মাঝে বাস করলেই কেবল একজন ব্যক্তির ন্যায্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। ব্যক্তি আর রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে এক প্রান্তে মতাদর্শ কিংবা পেশি-শক্তিভিত্তিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র আর অন্য প্রান্তে রয়েছে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র- বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রের অবস্থান এর মাঝামাঝি। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্য বর্তমান অতিমারি এক পোয়াবারো অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের নামে নানা ধরনের বিধি-বিধান, বিশেষত জনসমাবেশ ও মত প্রকাশের ওপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞা- এসব দেশে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে ‘আলেয়া’ হয়ে দেখা দিয়েছে সংক্রমণ দমনে তাদের আপেক্ষিক সাফল্য; কিন্তু এর ফলে রাষ্ট্রীয় অনৈতিকতার কুফল যে সারাবিশ্বের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কত মনোদৈহিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যাধির উদ্রেক করছে, তার হিসাব কে নেবে? এমন কি গোড়াতেই কর্তৃত্ববাদী চীন কর্তৃক উহানে করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত তথ্য গোপন ও যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে সারা বিশ্বের যে এত সর্বনাশ হলো, এর বিপরীতে তাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সাফল্যকে তো মানবজাতির জন্য এক ‘আলেয়াই’ বলতে হবে। 

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো- এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী সাফল্যের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে মধ্যপন্থী দেশগুলোর সুযোগ সন্ধানী শাসকবৃন্দও সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে দ্রুত ডানে সরে যাওয়ার- নিজেদের ক্ষমতা পোক্ত করার হাতিয়ার হয়ে যাচ্ছে সকল বিধি-বিধান। ব্রাজিল-ভারতসহ কিছু রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই এ কথার সত্যতা মিলবে। রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার অধোগামিতার এক মহা সুযোগ করে দিয়েছে এই অতিমারি। 

অন্যদিকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্যও ব্যক্তি-রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বজনিত এক নৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে এই অতিমারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুযোগ-সন্ধানী ট্রাম্পের কথা না-ই বা বললাম; কিন্তু অপেক্ষাকৃত সৎ সরকারগুলোর জন্যও এটি কঠিন সিদ্ধান্তের বিষয়। একদিকে মূল গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুযায়ী, ব্যক্তির অধিকার যা সংবিধানে নিশ্চিত; অন্যদিকে তাৎক্ষণিক জনস্বাস্থ্যজনিত প্রয়োনে বহু বহু নিষেধাজ্ঞা (এমনকি মত প্রকাশের ওপরও), কোন কোন ক্ষেত্রে যা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। কেউ আদালতে গেলে বিপদ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের সঙ্গে নৈতিকতার সংঘাত। সুইডেন তো প্রথমে ঝুঁকিই নিল না, লকডাউনও দিলো না, কিছুটা অধিক ‘মৃত্যুহার’ মেনে নিয়েও। এখন অপেক্ষাকৃত কঠোর হলেও সীমারেখার ভেতরে থেকে সাবধানে এগোচ্ছে। তাদের যুক্তি- ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব হলে দীর্ঘমেয়াদে অন্যান্য রোগ-ব্যাধিসহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল ভালো হবে না। নেদারল্যান্ডসও ইউরোপের মধ্যে বেশ শিথিল নীতি-নিয়মের পথে ছিল, হঠাৎ অনেক কঠোর হতে গিয়ে বিপত্তি। একেবারে গণবিদ্রোহ, তাদের ইতিহাসে নজীরবিহীন। প্রথাগতভাবেই উদারনৈতিক ডাচ সমাজ, রিফরমেশনের সময় ফ্রান্স বা ইংল্যান্ড থেকেও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে দার্শনিক-লেখকরা পালিয়ে বাঁচতেন হল্যান্ডে। আর এখন সেখানেই ব্যক্তির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা। প্রতিবাদ তো হবেই! তবে কোনো সহজ উত্তর আছে কি এর? বর্তমান অতিমারি গণতান্ত্রিক নৈতিকতার জন্যও সৃষ্টি করেছে এক কঠিন প্রশ্নের।

ব্যক্তিক-পরিবারিক-সামাজিক নৈতিকতায় ভাঙন

ব্যক্তিক-পরিবারিক-সামাজিক পর্যায়ে চরম নিষ্ঠুরতার বহু উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এই অতিমারি। আমাদের দেশেও সন্তানরা অসুস্থ বাবা-মাকে পরিত্যাগ করেছে! হাসপাতালে সেবার জন্য পাওয়া যায়নি কোনো স্বজনকে, লাশের দাফন সম্পন্ন করেনি সমাজের মানুষ- এমন উদাহরণ ভুরিভুরি। ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ বা সংগঠন এগিয়ে এসেছে নানান সহায়তা নিয়ে, এটি সত্যি; কিন্তু তার দ্বারা মুছে যায় না ব্যক্তি পর্যায়ে চরম আত্মকেন্দ্রিকতার পশুসুলভ চেহারা, যা স্বাভাবিক সময়ে লুকিয়ে ছিল নানান মুখোশের আড়ালে। বিষয়টি আবার নতুন করে নৈতিক দর্শনের আদি একটি বিতর্কের উদ্রেক ঘটায়। এক ধরনের তত্ত্বে মানুষ অমৃতের পুত্র, আলোর সন্তান, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, আত্মায় বহন করে নিয়ে এসেছে যাবতীয় মঙ্গল ও শুভ চেতনা- পার্থিব জীবনে কিছু দুষ্ট প্রভাবে তা বিকৃত হয়ে যায় বলে কিছু কিছু মানুষ অমানবিক হয়ে ওঠে। 

অন্য ধরনের তত্ত্বে (যার মধ্যে গণতন্ত্রের মূল নৈতিকতা ‘ইউটিলিটারিয়নিজম’ও রয়েছে) মানুষের মধ্যে জান্তব আত্মকেন্দ্রিকতাকে (সুখের প্রতি আকাক্সক্ষা আর দুঃখ থেকে পলায়ন) একটি মৌলিক প্রবৃত্তি হিসেবে মেনে নেয়। এসব তত্ত্বে সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য হলো- সামাজিক চুক্তিভিত্তিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুখ। 

এই প্রেক্ষাপটে ধর্ম, জাতীয়তা ইত্যাদি আদর্শভিত্তিক উগ্র মৌলবাদের উত্থানের একটি সুযোগ এনে দিয়েছে এই অতিমারি। মানুষের চরম অমানবিকতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক নৈতিকতার ব্যর্থতার (যা প্রকৃতপক্ষে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, চরম পুঁজিবাদের ব্যর্থতা) বিপরীতে কোনো না কোনো সনাতন মতাদর্শকে দাঁড় করিয়ে জনগোষ্ঠীকে বিকল্প সব উগ্র নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ করার সংগঠিত প্রয়াস এখন অতিমারিকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে। 

সংকটে বিশ্বমানবতার নৈতিকতা

আধুনিক জাতীয়তাবাদের উত্থান মানুষের ইতিহাসের অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক ঘটনা; কিন্তু ইতিমধ্যেই মানুষ সে নেশাতে বুঁদ হয়ে গেছে। যতই রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্ব মানবতার জয় গান গাই, অন্তরে ধর্ম-ভাষা-বর্ণভিত্তিক সংগঠিত জাতীয়তাবাদের ধারণা ক্রমশ পোক্ত হয়ে যাচ্ছে। ‘america first’ না বললে শুধু মার্কিন জনগণের ভোট হারাতে হয় না, বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বললে অধিকাংশ বাঙালির পছন্দ হয় না। এই অবস্থায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য আঞ্চলিক-বৈশ্বিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান কিছুটা মলমের মতো কাজ করে যাচ্ছিল; কিন্তু এই অতিমারি জাতিরাষ্ট্রগুলোর আত্মকেন্দ্রিকতা আর নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসে রোগ-নির্ণয় সামগ্রী, চিকিৎসা সামগ্রী এবং সাম্প্রতিককালে ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বিশ্ব মানবিকতা ভুলুণ্ঠিত হয়ে উগ্র-জাতীয়তাবাদী নৈতিকতার জয়জয়কার দেখা গেছে। 

আরও এক ধাপ এগিয়ে কোনো কোনো দেশ এসব সামগ্রীর মাধ্যমে উপনিবেশবাদী নৈতিকতার প্রসার ঘটাচ্ছে। বর্তমানে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ও ভ্যাকসিন উপনিবেশবাদ ভৌগোলিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদেরই একটি হাতিয়ার বলা যেতে পারে। এ সবের ফলে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের মাঝে বিরাজমান অসমতার মাত্রা অতিদ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকও এ ব্যাপারে হতাশা ও সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। 

প্রকৃতির প্রতি মানুষের বোধ

একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব অনুযায়ী, বর্তমান করোনাভাইরাস এসেছে উহানের বাজারে বিক্রীত মাংস থেকে। বিতর্কে না গেলেও একটি কথা সত্যি যে, প্রকৃতি উজাড় করে মানবজাতি যেভাবে নিজের ভোগ-লিপ্সাকে ক্রমেই প্রসারিত করে চলছে, তার ফলে পশু-পক্ষী সংশ্লিষ্ট (zoonotic) বহু রোগব্যাধি মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পাওয়া প্রায় অবধারিত। মানুষের সীমাহীন ভোগের আকাক্সক্ষা পরিবেশের ওপর দ্রুত যে আঘাত হানছে প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ নেবে এবং ইতিমধ্যে নিচ্ছেও। সময় থাকতেই তাই প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের নৈতিকতার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। 

শুধু ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুখ’ কাম্য হলে চলবে না, মানুষের মধ্যে ন্যূনতম সমতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো মানুষকে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেও প্রকৃতি উজাড় করতে না হয়। আর ভোগের আকাক্সক্ষায় টানতে হবে একটি সীমারেখা। মানুষের নৈতিক চেতনা শুধু মানুষের মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না, মানুষ আর প্রকৃতিকে এক সূত্রে গেঁথে গড়তে হবে আমাদের নৈতিক ভিত্তি, আর তার ওপর গড়ে উঠবে সমাজ ও রাষ্ট্রের আইনগত অবকাঠামো। একমাত্র তাহলেই নিশ্চিত হবে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান।

কোভিড-১৯ : নৈতিক দর্শনের পুনরুত্থান প্রয়োজন

কোভিড-১৯ অতিমারির চিকিৎসা ও প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজন নিঃসন্দেহে অনেক দরকার; কিন্তু শুধু এর দ্বারাই মানব জাতির মধ্যে সৃষ্ট অনৈতিকতার এই গভীর ক্ষত সেরে উঠবে না; বরং সম্ভাবনা এই যে, মানবজাতির অনৈতিক আচরণ এই ক্ষতকে গভীরতর করে গোটা মানবজাতিকেই ধ্বংসের মুখোমুখি করবে। তাই এখনই এর প্রতিবিধানের জন্য গভীর আলোচনা ও অনুধাবন প্রয়োজন।

নৈতিক দর্শনের আলোচনা এখন ‘সেকেলে’ হয়ে গেছে, শুধু পুঁথিতে বা পাঠকক্ষেই সীমাবদ্ধ- যেন ‘আইনের শাসন’ থাকলেই সব সমাধান হয়ে যাবে; কিন্তু আসলে তা নয়, মানবের ইতিহাসে নিত্যনতুন নৈতিক সমস্যার উদ্ভব হবে- কোভিড-১৯ সেটিই দেখিয়ে দিচ্ছে। এর সমাধানে চিন্তাশীল মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : চিকিৎসাবিদ, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //