সাকুরা সাকুরা, এটা মেঘ না কুয়াশা!

এ দেশের প্রকৃতিতে যে ঋতুটি প্রথম এসে দোলা দেয়, তা হলো বসন্ত। শুরু হয় মার্চ মাসে। তারপর একে একে জুনে গ্রীষ্ম, সেপ্টেম্বরে হেমন্ত এবং ডিসেম্বরে শীত।

চার রঙের রূপ-বসন্তে অনাবিল আবিলতা, গ্রীষ্মে সবুজ উষ্ণতা, হেমন্তে ঝরাপাতার প্রগাঢ়তা, আর শীতে শুভ্র-কঠিন শীতলতা। এই চার ঋতু মিলে কানাডার প্রকৃতিকে দিয়েছে ভিন্ন ধরনের চরিত্র। যা উপলব্ধি করতে প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে, ফিরে ফিরে যেতে হয় প্রকৃতিরই কাছে। আবহাওয়া যেমনই হোক এরই মাঝে ঘুরে বেড়ানো। 

তাই দেশের প্রকৃতির রূপ দেখার জন্য বছরের প্রথম ঋতু বসন্ত থেকেই শুরু করতে হবে, যখন প্রকৃতি প্রশস্ত জাগ্রত হয়ে উঠতে থাকে এবং সবকিছু ফুলে ফুলে ভরে দেওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। তারপর গ্রীষ্মের আদুরে রোদের চমক মেখে নিতে, ফুলের পরিপূর্ণ সম্ভার তো তখনই জলসা বসায় ভোরের ভৈরব থেকে রাতের মালকোষ পর্যন্ত। আর শরৎকাল, যতদূর চোখ যায় সোনালি, কমলা, হলুদ ও টকটকে লাল অগ্নিবর্ণের পাতা দিয়ে মাটিকে ঢেকে দেবে। শীতকালের বরফ এবং তুষারও অনেক সুন্দর, তবে তা দেখতে শীতকালে কখনোই আমার প্রকৃতির কাছে যাওয়া হয় না। স্প্রিং, সামার, ফলের রূপ, রস, সুধা আ-নেত্র পান করে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেও শীত থেকে যেন হাজার মাইল দূরে থাকার সাধনা করি। কারণ এই শীত আমি চিনি না, জানি না। সে আমাকে কাছে টানে না, বরং ভয় পাইয়ে দেয়।

আজ যাত্রা শুরু করেছি বসন্তের বুকের গভীরে যাব বলে। এবার সে রকমই ইচ্ছে দিয়েই শুরু করেছি। আঁকছি নিপাট সুন্দর এক বসন্তের ছবি।

কানাডার বাতাসে উড়ছে মোহন মায়ার ঘ্রাণ। তার আবেশ গায়ে মেখে চলছি পশ্চিমের দিকে। বাতাসের ঘন নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার চোখে-মুখে। বাসের জানালা দিয়ে দূরের আকাশটা অনেক কাছে এসে দাঁড়াল। উত্তরের আকাশ সবসময়ই কাছাকাছি মনে হয়। খুব সুন্দর দিন, সামান্য শীতের স্পর্শ আছে, কিন্তু দৌরাত্ম্য নেই। হলদে রেণুর মখমল মাখানো রোদের পর্দায় দুলছে শহর। যাচ্ছি সাকুরার আবেশ মেখে নিতে। এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ফুটে যায় চেরি ফুলগুলো। তাই এখনই এই অলৌকিক দৃশ্য দেখার যথার্থ সময়। বাস থেকে নেমে সাবওয়েতে ঢুকতে ঢুকতে মনে হলো, চেরি ব্লোসমসের স্বর্গীয় উদ্যানের কাছাকাছি যাচ্ছি তাহলে! তাই ঘুরেফিরে ভারি আনন্দ। শুরু হয়ে গেছে ঘরছাড়া মানুষের ঘোরাঘুরি।

আজ যেখানে যাচ্ছি। সেটা প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। গাড়িতে করে গেলে ঘণ্টাখানেক, আর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অর্থাৎ বাস-সাবওয়ে ধরে গেলে প্রায় দুঘণ্টা লাগে। কী আছে সেখানে? আছে, রাজাধিরাজের বেশে সবুজের মুকুট মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা এক উদাত্ত প্রান্তর। কানাডার টরন্টো শহরের অনন্য ও বিস্তৃত প্রকৃতি-প্রাঙ্গণ, তারই কথা বলব আজ। চার ঋতুর চার রকমের রূপ-সুধায় যেন সে যে কোনো মানুষকে আপ্লুত করে তোলে। নির্মল বাতাস ও সবুজ চত্বরে 

হেঁটে-বসে-শুয়ে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হ্যাঁ, হাইপার্ক। সেখানেই যাচ্ছি, যাকে আদর করে টরন্টো শহরের ফুসফুস বলে ডাকা হয়।

হাইপার্কে চেরি ব্লোসম

এদেশে বেশিরভাগ মানুষের মনে প্রকৃতির প্রতি প্রবল এক মমতা ও যত্ন রয়েছে। এরা মনের আনাচে-কানাচে ধারণ করে সুজলা-সুফলা অনিন্দ্য শোভন প্রকৃতি-প্রেম। প্রায় ছয় মাস কঠিন শীতের মাঝে বসবাস করা দেশটি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে প্রকৃতির কী মূল্য। তাই তো এখানে বসন্ত, গ্রীষ্ম ও হেমন্তে নানারঙের মন মাতিয়ে দেওয়া রস কড়ায়-গণ্ডায় গ্রহণ করতে আকুল হয়ে থাকে সকলে। আমিও তা থেকে বিচ্ছিন্ন নই। দেশে থাকতে চারপাশে অঢেল প্রাকৃতিক শোভা আছে বলে যে গাছপালা, ঘাসলতা, ফুল-পাখির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাকাইনি। মনে করেছি, আরে সে তো আছেই! আজ এদেশে এসে বুঝেছি তার কী মূল্য! প্রকৃতি কতটা প্রাণের চাওয়া, কতটা অমূল্য!

যেতে যেতে বারবার মনে পড়ছিল, যত্ন-অযত্নে বেঁচে থাকা আমার দেশের প্রকৃতির কথা। ভালোবেসেছি, কিন্তু যত্ন করিনি। ঠিক যেন মা। চোখ কি ভিজে গেল! ভাগ্যিস রোদ চশমায় ঢাকা আছে চোখ। 

ট্রেন একসময় পুব থেকে পশ্চিমের পঁচিশ নম্বর সাবওয়ে স্টেশন এসে থামল। পৌঁছে গেলাম হাইপার্কে প্রবেশ করার সবচেয়ে কাছের স্টেশনে। এই সাবওয়ে স্টেশনও পার্কের নামে নামকরণ ‘হাইপার্ক’। ব্লোর-স্ট্রিট ওয়েস্টের দুই পাশে পার্ক ও স্টেশন, মুখোমুখি। রাস্তা পার হয়ে হাইপার্কের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল, আহ! বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রান্তরে প্রবেশ করে গেছি, নিজের দৃষ্টি ও ফুসফুস দুই-ই স্বস্তি পাবে এবার। ওই তো কিছুটা দূরে দেখতে পাচ্ছি সাদা, গোলাপি গুচ্ছগুচ্ছ চেরি ফুলের নহবত। বাতাসে মাথা দুলিয়ে ডাকছে, চারদিক উপচে পড়ছে। আজ তারই দর্শনে অসংখ্য মানুষ এসেছে প্রিয় হাইপার্কে। প্রাণ ভরে তারা ছবি তুলছে। চেরি ফুলের পাশে নিজেকে সঁপে দিয়ে আরও নিবিড় হওয়ার চেষ্টা করছে।

নর্থ আমেরিকার চেরিফুলের উৎসবে টরন্টোর বেশ নামডাক রয়েছে। একজন টরন্টোবাসী হয়ে এই সুযোগ হারাতে চাই না। ফিরোজা রঙের আকাশে মিশে থাকা থোকা থোকা গোলাপি-সাদা চেরিফুল হাতছানি দিয়ে ডাক দিয়ে যায়। টরন্টোর আবহাওয়া সংবাদ জানিয়ে দিয়েছে, এ বছর মে মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু করে মাত্র দেড় সপ্তাহ পর্যন্ত তরতাজা চেরিফুল থাকবে। চেরিফুলের সৌন্দর্য দেখতে হলে এরই মাঝে যেতে হবে, তা না হলে ক্ষণস্থায়ী এই ফুল ধুলায় মিশে যাবে।

টরন্টোর ডাউনটাউনের পশ্চিমে অবস্থিত হাইপার্ক। স্থপতি জন জর্জ হাওয়ার্ড ১৮৭৩ সালে প্রায় ৪০০ একর জমির ওপর অবস্থিত উদ্যানটি, পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য টরন্টো সিটিকে দান করেন। তারপর ১৮৭৬ সালে তা জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কী নেই এখানে, সব বয়সীদের জন্য খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক ও বিনোদন মঞ্চ, ছোটোদের প্লে-গ্রাউন্ড, পুকুর, বাগান, চিড়িয়াখানা, উন্মুক্ত কাঠবিড়ালির ঝাঁক, নানা জাতের পাখি, মাছ এবং মিউজিয়াম, রেস্টুরেন্ট, গ্রিনহাউস ও পিকনিক এলাকা। টরন্টোর বৃহত্তম পাবলিক পার্ক বলে এখানে অনেক হাইকিং ট্রেইল এবং সারা পার্ক ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে গ্রীষ্ম থেকে শরৎ পর্যন্ত টয় ট্রেনের ব্যবস্থা। 

রয়েছে বিরল প্রজাতির ওক গাছের সমাহার। হাইপার্ক জুড়ে বিশাল ব্ল্যাক ওক সাভানা গাছ এই আবাসস্থলের অন্যতম বৈশিষ্ট্যময় বৃক্ষ। এদের অনেক গাছের বয়স ১৫০ বছরের বেশি। আরও রয়েছে ইস্টার্ন হেমলক, রেড ওক, রেড ম্যাপেল ও ইস্টার্ন হোয়াইট পাইনের মতো শক্তিশালী গাছ। এছাড়া হোয়াইট ওক, হোয়াইট সিডার, হোয়াইট বার্চ, ব্ল্যাক চেরি ও হলুদ বার্চও রয়েছে। সেসব বৃক্ষ ক্রমশ মানুষের মাঝে ছায়া-মায়া-ভালোবাসার প্রগাঢ়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বারবার ঘুরেফিরে যাওয়ার মতো জায়গা এটি। যতবার যাই, ততবারই নতুন কোনো দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসি। যেমন করোনা ভাইরাসের আগে এই পার্কের অন্যতম অভিজ্ঞতা ‘শেক্সপিয়ার ইন দ্য হাইপার্ক’। প্রতি গ্রীষ্মে কানাডিয়ান স্টেজ কোম্পানি পার্কের বিখ্যাত অ্যাম্ফিথিয়েটারে শেক্সপিয়ারের নির্বাচিত নাটকগুলো প্রদর্শন করে আসছে। অ্যাম্ফিথিয়েটারটি গ্রেনেডিয়ার ক্যাফের পুব দিকে পাহাড়ের পাশে এবং কয়েকশ লোকের আসন রয়েছে এতে। এটি টরন্টোনিয়ানদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি ইভেন্ট মঞ্চ। তো কোভিডের আগে এখানে বসে নাটক উপভোগ করেছি। টিকিট কাটিনি, যেটুকু দিতে ইচ্ছে করেছে অনুদান দিয়েছি, আমার মতো অনেকেই তা করেছে। কিন্তু অতিমারি এসে সব স্তব্ধ করে দিলে অ্যাম্ফিথিয়েটারও চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছে। অবশেষে ২০২২ থেকে আবারও শেক্সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ হতে শুরু করেছে। গত বছর সারা গ্রীষ্ম ধরে তারা রোমান্টিক কমেডি ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ করেছে, এ বছরের ঝুলিতে আনতে যাচ্ছে ‘মিডসামার নাইট’, শুরু হবে জুলাই থেকে। 

হাইপার্কে শেক্সপিয়ার প্রযোজনার গ্রীষ্মকালীন নাট্যানুষ্ঠানটি ১৯৮৩-তে শুরু হওয়ার পর থেকে, কানাডিয়ান স্টেজের সবচেয়ে আইকনিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি হয়ে ওঠে। চল্লিশ বছরের সার্থক যাত্রা ও সফলতার পালক তাদের টুপিতে। কখনও হাইপার্ক অ্যাম্ফিথিয়েটার হলের প্রশস্ত উন্মুক্ত অঙ্গনে একটি নাটক বা একটি লাইভ আউটডোর মিউজিক শো দেখা মানে, এমন একটি দুর্লভ অভিজ্ঞতা, যা চিরকালীন স্মৃতির অংশ হয়ে থাকবে।

কোথাও বেড়াতে যাব আর কফি খাব না! এ আমার পঞ্জিকায় লেখা নেই। ঢুকে পড়লাম গ্রেনেডিয়ার ক্যাফেতে। পার্কের কেন্দ্রে অবস্থিত তিনশ সিটের এই রেস্তোরাঁর আউটডোর প্যাটিওটিও চমৎকার। ভেতরে অসাধারণ ডেকোরেশন, বিশাল এক শারদীয় ম্যাপেল বৃক্ষ একেবারে মাঝখানে ছাদ ফুঁড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে ডাইনিং সাজানো হয়েছে। ১৯৫৮ সালে গ্রেনেডিয়ার ক্যাফে শুরু। হরেকরকমের খাওয়ার পাশাপাশি অল-ডে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা। আর কী চাই! কফি ও স্ল্যাকস খেয়ে বের হলাম। 

আবারও ফিরে আসি, চেরি ব্লোসমসের কথায়। এদেশে আকর্ষণীয় এই চেরি ব্লোসমসের আগমনের একটি ইতিহাস আছে বৈকি। ১৯৫৯ সালে জাপানের নাগরিকদের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে, হাইপার্কে প্রথম চেরি গাছ রোপণ করা হয়। সব মিলিয়ে দুই হাজারটিরও বেশি চেরি গাছ টরন্টোকে উপহার দিয়েছিল জাপান। এখন তা বেড়ে সংখ্যায় আরও অনেক বেশি। হাইপার্কের চেরি গাছগুলো সাকুরা নামেও পরিচিত, জাপানি ভাষায় ‘সাকুরা’ মানে চেরি ব্লোসমস। আগেই বলেছি-এই ফুল এপ্রিলের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে মে মাসের প্রথমে ফোটে। তারপর সপ্তাহ দেড়েক পরেই ঝরে সারা। জাপানে জাতীয় ফুল চেরিকে স্পিরিচুয়াল প্রেরণার প্রতীক হিসেবেও মনে করা হয়। শুনেছি সাকুরা, সময়ের নবায়ন ও আশাবাদকে প্রতিনিধিত্ব করে। এর পাপড়িগুলো শীতের সমাপ্তি চিহ্নিত করে এবং বসন্তের শুরুকে নির্দেশ করে। প্রতিবছর হাইপার্কে চেরি ফুলের আকর্ষণে ১০ লাখেরও বেশি দর্শকের সমাগম হয়। দিনে দিনে তা আরও বাড়ছে।

গ্রেনেডিয়ার ক্যাফে

গাছগুলো গ্রেনেডিয়ার ক্যাফের কাছাকাছি রাস্তার দুপাশে, গ্রেনেডিয়ার দীঘির ধারে হিল-সাইড গার্ডেন, ওয়েস্ট রোড এবং জেমি-বেল খেলার মাঠের পশ্চিম পাশে খুব গুছিয়ে লাগানো। নানারকমের চেরির মাঝে আকেবোনো এবং ফুগেনজো গোত্রের ফুলের সমাগম এখানে সবচেয়ে বেশি। সাকুরা গাছগুলো অকৃত্রিম সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে। তবে পাশাপাশি আরও অনেক ফুল ফুটেছে-টিউলিপ, ফোরসিথিয়া এবং ম্যাগনোলিয়া দেখা যাচ্ছে। অসংখ্য ফটোগ্রাফার চেরি নিয়ে এ বছর তাদের শ্রেষ্ঠ ক্যাপচারটি তোলার জন্য নিপুণভাবে হাজারটা শট নিয়ে চলছে।

জায়গায় জায়গায় সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড। অনলাইনেও কত যে অনুরোধ-উপরোধ। কারণ গাছগুলোকে তো ঠিকমতো অনেক বছর বাঁচতে দিতে হবে। অনুরোধগুলো যেরকম- “ফুল ছিঁড়বেন না। ডাল ধরে ঝাঁকাবেন না, টানাটানি করবেন না, ভাঙবেন না। গাছে চড়বেন না, এমনকি বাচ্চাদেরকেও গাছের শাখায় উঠতে, দাঁড়াতে বা বসতে নিষেধ করবেন। গাছের ভেতরে বা আশেপাশে কোনো আবর্জনা রাখবেন না। গাছের ক্ষতি না করে ছবি তুলুন। ফুলগুলো উপভোগ করুন এবং তাদের আশেপাশের পরিবেশকে সম্মান করুন। মনে রাখবেন, শিকড় থেকে শাখা পর্যন্ত গাছকে সম্মান করা মানে প্রতিটি গাছকে অনেক বছর ধরে ফুল ফোটানো এবং উপভোগ করতে সাহায্য করবে।”

এ দেশেও সচেতনতার কথা নানা উপায়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষই সেসব সম্মানের সঙ্গে মান্য করার চেষ্টা করে। 

এদিকে বিয়ে-পূর্ব বাগদানের ছবি তোলার জন্য কয়েকজন যুগল এদিক-সেদিক ফটোসেশন করে যাচ্ছে, সাদা গাউন ও এঙ্গেজমেন্ট রিং নিয়ে হুলুস্থূল আনন্দ। তাদের ঘিরে ইভেন্ট অর্গানাইজারদের দৌড়াদৌড়ি। ক্যামেরা, ট্রলি অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ততা। আর যাদেরকে ঘিরে এই মহোৎসব তাদের মুখে অপূর্ব হাসির ধারা। ভালোই লাগছে দেখতে। এক-দুবার তাকিয়েই চলতে শুরু করলাম। কারও কিছু দেখে বাড়তি কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকাটা, এদেশে বড় অসম্মানের। কাজেই যা দেখেছ বাপু বেশ দেখেছ, এবার পা চালিয়ে অন্য দিকে যাও। এখান থেকে যেতে যেতে হয়তো আরও কতকিছু কুড়িয়ে নেওয়ার মতো পেয়ে যাব। তাতে দু’হাত উপচে পড়লে পড়তেও পারে। 

লেকসাইড রোড ধরে এগোতেই একজন শিল্পীকে দেখলাম তার ক্যানভাস জুড়ে চেরি ব্লোসমস এঁকে যাচ্ছে। বাহ দারুণ তো! কখনও সে একটু দূরে চলে গিয়ে নিবিড়ভাবে নিজের আঁকা ছবি ও সাকুরার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে। আবারও ফিরে এসে আরেকটি আঁকা এঁকে দিল। কেউ তাকে বিরক্ত করছে না। আমিও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শিল্পী ও শিল্পের সংযোগ উপভোগ করলাম। তেলরং নয়, তিনি আঁকছিলেন অ্যাক্রেলিক কালার দিয়ে। মানুষের মনের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা কত না ছবি এভাবে নানা রঙের রূপ ধরে আঁকা হয়ে যায়, কে জানে!

দেখি আর হাঁটি। কিন্তু এবার চড়ে বসলাম, টয়-ট্রেনে। লাল এবং সাদা রঙে সাজানো কয়েকটি ওয়াগনকে টেনে নিয়ে চলে এই ট্রেন। নানা ভাষা ও নানা বয়সীদের সমাবেশ এতে। তবে বাচ্চাদের সম্মিলিত আনন্দে ছেলেবেলার ট্রেনে চাপার স্মৃতি ফিরে এলো। প্রায় আধঘণ্টার এই ট্রেন জার্নি, পুরো হাইপার্ক ঘুরিয়ে দেখাল। ট্রেনের হুইসেল শুনে খুব আনন্দ পেলাম। উপভোগ করার মতো কত যে কিছু এখানে। সবকিছু তো লিখে শেষ করা যায় না। একটা পার্ক শতাব্দীর কথা বলে। একটা পার্ক প্রকৃতির বিশ্বস্ততা তুলে দেয় মানুষের হাতে। এখানে হেঁটে দৌড়ে বাইসাইকেলে চেপে চলছে সকলে। এরই মাঝে দাঁড়িয়ে যাই, দেখি। নিজেকে আবিষ্কার করি অপার বিস্ময়ে! এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন সুন্দর ফুলের দেখা পাওয়াও তো এক পরম মহার্ঘ। লাবণ্যে উজাড় করে তুলে দিচ্ছে তারা।

হাইপার্কে সারাদিনের জন্য আসা হয়। এখানে মন ভরে কত কী যে করার ও দেখার আছে হিসেব নেই। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার একটু একটু করে পুবে যাত্রা শুরু করতে হবে। যেভাবে দেখলে প্রাণ ভরে যায়, তা আমার কখনোই হয় না। কিছু অপূর্ণতা রয়েই যায়। এবারও তাই হলো। আমার কানে তখন ভেসে আসছে ছোটবেলায় শোনা জাপানের এক-দেড়শ বছরের প্রাচীন সেই জনপ্রিয় লোকগীতিটি, যার প্রথম কয়টি লাইন বাংলায়-

“সাকুরা সাকুরা... 

মাঠে, পাহাড়ে, গ্রামে

যতদূর চোখ যায় 

এটা মেঘ না কুয়াশা?

সাকুরা সাকুরা...” 

সামনে-পেছনে তখন বিকেলের সোনারং রোদের মাঝে ঘোরলাগা হালকা গোলাপি-সাদার প্লাবন। নরম মখমলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ চেরিফুল, বসন্তকালে ফুটলেও হৃদয়ের মাঝে সে প্রস্ফুটিত হতে থাকে চিরকাল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //