নিজের সঙ্গে কথোপকথন

আমি প্রায় ১০ বছর দিল্লিতে আছি। কাজের জগতে প্রতিদিন নিঃশব্দে শহীদ হই। এর মাঝে কখনো কখনো ফাঁকি দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে ইচ্ছে করে। তখন পাহাড় ছাড়া অন্য কোথাও পালাবার কথা মাথায় আসে না। বাড়ির সবাই পাহাড় অন্তপ্রাণ। তাই ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ে প্রচুর ঘুরেছি। যাকে বিয়ে করেছি, সেও পাহাড়প্রেমিক। তাই প্রতিবছর পাহাড়ে যাওয়া নিশ্চিত।

ছোট ছোট গ্রাম, পাহাড়ি নদীর পাশে হোম স্টে, ফার্ম স্টেগুলোই আমাদের শান্তিতে ফাঁকি মারার জায়গা। এর মধ্যে কখনো কখনো আবার মা,বাবা, বর, ভাই, বন্ধু দাদা, সহকর্মীদের বাদ দিয়ে একলা পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সেই সুযোগ এলো অক্টোবর মাসে, গান্ধী জয়ন্তীর বেশ কয়েক দিনের ছুটিতে। ভাবলাম, কারও সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে পাহাড়ে ঘুরে আসি। এখনকার ভাষায় সোলো ট্রিপ।

রাজধানীতে থাকার অনেক সুবিধে। বড় সুবিধে, ওভার নাইট বাস জার্নি, ঘুম থেকে উঠে চোখ মেললেই দেখা যায় সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মস্ত হিমালয়। হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, অপূর্ব সব জায়গা; কিন্তু আমাদের দেশের অবুঝ ভ্রমণকারীদের আবার অনেক বায়না, দুর্গম পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল চাই, জঙ্গল কেটে ঝা চকচকে রাস্তা চাই, দামি রেস্তোরাঁ দরকার। এইসব গা জোয়ারি নাগরিক উন্নয়নের জেরে পাহাড়ে প্রতিবছর ধস, অকথ্য জলকষ্ট, বন্যা-সব মিলিয়ে নিরীহ পাহাড়ি জনজাতির চরম দুর্ভোগ। এ বছর সুন্দরী হিমাচলের রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড সব শেষ হয়ে গেছে। অপরূপ সিকিমের পথঘাট, সড়ক, বসতি সব রাক্ষসী তিস্তার গর্ভে তলিয়ে গেছে। এর ফলে পাহাড়ে গিয়ে যারা ছোট্ট কোনো গ্রামে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে থাকতে চান, তিরতিরে নদীর পাশে সময় কাটাতে চান, ঘাসে পা ফেলে হাঁটতে চান, জঙ্গলের গাছের ছায়ায় দুই দণ্ড জিরোতে চান, স্থানীয় খাবার খেতে চান, তাদের হয়েছে মহাবিপদ। 

কিন্তু আমার মন যখন উড়াল দিয়েছে, তখন কার সাধ্য আমাকে আটকায়। এক হিমাচলি বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আদতে সে কলকাতার মেয়ে; কিন্তু কোভিড সময়ে লকডাউনের কালে কোম্পানি যে স্বাধীনতা দিয়েছিল, ওয়ার্ক ফ্রম এনিহোয়ার, তা কাজে লাগিয়ে সে হিমাচলবাসী হয়ে গেছে। সে-ই পরামর্শ দিল, সোলো ট্রিপের। কোথায় থাকা যেতে পারে তাও বলে দিল। আমিও চললাম, হিমাচলের কাঙ্ড়া উপত্যকায়। পাহাড়ি ধস এদিকেও হয়েছে। তবে আপাতত রাস্তা যা দেখছি, ভালোই। কাঙ্ড়া ভ্যালি মানেই রৌপ্যোজ্জ্বল ধৌলাধার পর্বতমালা। ধর্মশালা, ম্যাকলয়েডগঞ্জ, এক টুকরো বিয়াস নদী, দালাই লামার প্রাসাদ, পুরনো ব্রিটিশ স্থাপত্য। তিব্বতি জনজাতি ও হিমাচলি সংস্কৃতির এক অনন্য মিশ্রণ। 

এবারে মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ঘটনাচক্রে পড়েছিল সোমবার। আমার উড়ু উড়ু মন হিসেব কষে নিল। শনিবার, রবিবার, সোমবার মিলিয়ে তিন রাত, চার দিনের সুন্দর একটা ট্রিপ হতেই পারে। শুক্রবার রাতে মজনু কা টিলা থেকে আমার বাস। সকালে ছোট্ট রুক স্যাক পিঠে অফিস গেলাম। অফিসের কাজ তড়িঘড়ি শেষ করে, ক্যাব নিয়ে সোজা মজনু কি টিলায়, রাত ১০টার বাস ধরতে। পাহাড়ে তো বছরে দু-তিনবার যাওয়াই হয়। কখনো দলবেঁধে, কখনো আমরা দুজন। কিন্তু একদম একা, এই প্রথম। তিরিশের কোঠায় পা দিয়েছি। চলতে-ফিরতে প্রায়ই দেখছি যে আমার বয়সী তো বটেই, আমার চেয়েও কিছু বড়, এমনকি ছোটরাও সাহস করে সোলো ট্রিপে বেরিয়ে পড়ছে। তাছাড়া শুধু বেড়ানোই বা কেন, সব মেয়েরই কিছু না কিছু নিজস্ব স্পেস আছে। 

সেই স্পেস সে জিতে নিয়েছে, নানান লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, প্রত্যেক মেয়ের ঘরে-বাইরে, কমবেশি লড়াই করতেই হয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে কোথাও লড়াই নেই, এমন কখনো দেখিনি। অধিকার, স্বাধীনতার লড়াই মেয়েদের করতেই হয়। 

সোলো ট্রিপে আমাকে উৎসাহ দিল আমার বছর তিরিশ ও বাইশের দুই বন্ধু এবং অবশ্যই আমার বর। তাদের উৎসাহে বেরিয়ে পড়েই মনে হলো, পাহাড়ে গেলে মন চাঙ্গা হবেই। পাহাড় বারেবারে বুঝিয়ে দেয়, প্রকৃতির কাছে মানুষ বড় তুচ্ছ, ক্ষুদ্র। পাহাড়ের কাছে গেলেই পরম আনন্দ। অনাবিল শান্তি। পাহাড় কাছে টেনে রাখে ভালোবাসা দিয়ে। সে বুঝিয়েও দেয়, তার থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা করা ভুল। অপরাধ। 

বাস ছাড়ল ঠিক রাত ১০টায়। আমি মোটামুটি সামনের সিটে। পাশে, সহযাত্রী এক শিখ তরুণী। কথায় কথায় জানাল, আসলে ওর বাড়ি চন্ডিগড়ে। কিন্তু আমার মতোই বেশ কয়েক বছর ধরে দিল্লিবাসী। এটা-ওটা গল্প করে সময় কাটল। কিছুক্ষণ বাদে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দুনিয়া দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম। দিল্লি ছাড়িয়ে পানিপথ, শোনার, কার্নাল, চন্ডিগড় ছাড়িয়ে বাস ছুটছে দ্রুত গতিতে। রাতের অন্ধকারে। হেড ফোনে গান শুনতে শুনতে কখন চোখ একটু বুজে এলো। পরদিন চোখ খুলতেই দেখলাম, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত হিমালয়। হিমালয়ের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিবারের মতো তাকে সেলাম করলাম। কুর্নিশ জানালাম। 

এসেছি বৈচিত্র্যময় কাঙ্ড়া ভ্যালিতে। হিমাচল প্রদেশের অপরূপা জনপদে। মাথার কাছে দীর্ঘ বরফাচ্ছাদিত ধৌলাধার রেঞ্জ। বুকের কাছে সুন্দরী কিছু পাহাড়ি শহর ম্যাকলয়েডগঞ্জ, ধর্মশালা। আপাতত আমার অস্থায়ী ডেরা, ধর্মশালা থেকে চড়াই পথে কিছুটা গিয়ে এক হোস্টেল। নাম, লিভ ফ্রি। নামের মধ্যেই কেমন মুক্তির আনন্দ। তরুণ এক দম্পতির তৈরি এই আবাস। কোনো কড়া অনুশাসন নেই। একা, দুজনে বা বড় দল সবাই এখানে থাকতে পারেন। একা একা এই হোস্টেলের সহআবাসিকদের দেখছিলাম। ভাবছিলাম সবার জীবনেই নিশ্চিত কোনো গল্প আছে। হয়তো টানাপড়েন রয়েছেও। প্রেম, বিচ্ছেদ, আনন্দ, দুঃখ, অভিমান আছে সবই। কিন্তু সবাই ছুটে এসেছে পাহাড়ের সঙ্গে কথোপকথন ও সুন্দর সময় কাটাতে। কিছু মানুষ পাহাড় কেটে, জঙ্গল সাফ করে নদীর গতিপথ বদলে দিয়ে চেষ্টা করে চলেছে, দুর্বার প্রকৃতিকে জয় করতে। যদিও সে চেষ্টা বৃথা। আমাদের জীবনের গতিবিধি সবই ওই অজ্ঞাত প্রকৃতির কাছে বাঁধা। 

লিভ ফ্রি হোস্টেলের ভলান্টিয়ার সিমরান, আমাকে একটা ঘর দিল। ছোট, ছিমছাম, পরিষ্কার। দিল্লিতে আমাদের বিপুল কমপ্লেক্সের আঠারো তলা বহুতলের পশ ফ্ল্যাটের তুলনায় এই আবাস কত ছোট। কিন্তু পাহাড়ে এসে আমি তো আকাশে আলোয়, ধুলায় ঘাসে এই মুক্তিই তো খুঁজেছিলাম। খানিক পর এক বাটি ধোঁয়া ওঠা সুপি নুডুলস খেয়ে চললাম নদীর ধারে। আমার বড় হয়ে ওঠা যে পরিবেশে, সেখানে মা-বাবা বা পরিবারের কাউকেই সেভাবে পুজোআচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা করতে দেখিনি। কিন্তু বাঙালি বলে শারদোৎসবের গন্ধ শিরায় শিরায় মিশে আছে। পাহাড়ের কোলে, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, কাশফুল আর বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদী বিয়াসের অপূর্ব ক্যানভাস দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কাটল। কাজের জগতের চাপ, পারিবারিক চাপ নিমেষে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। নদীর ঠান্ডা জলে পা ডোবালাম। এ এক বিরল শান্তির অনুভূতি। নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, আড়ালে থাকা নাম না জানা পাখির ডাক। অপূর্ব শান্তি ও মুক্তির দুনিয়া।

একদা পাঞ্জাবের গভর্নর ডোনাল্ড ম্যাকলয়েডের নামে ম্যাকলয়েডগঞ্জ। ধর্মশালা, ম্যাকলয়েডগঞ্জ ছিল ব্রিটিশদের গরমের দিনের আস্তানা। এখনো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্রিটিশ অতীত। পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট চীনের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা এই পাহাড়ি জনপদে পালিয়ে এলে ভারত সরকার তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেন। দালাই লামাকে অনুসরণ করে দলে দলে তিব্বতি রিফিউজি এসব তল্লাটে ডেরা বাঁধেন। ধর্মশালা হয়ে ওঠে লিটল লাসা। ফলে ধীরে ধীরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে তিব্বতের সংস্কৃতি প্রভাব ফেলতে লাগল। স্থানীয় খাদ্যাভ্যাস বদলে গিয়ে জনপ্রিয় হতে লাগল মোমো থুপ্পা। খাবারের কথা বলতে বলতে মনে হলো, অনেকক্ষণ কিছু খাইনি। পেট চিনচিন করছে। হোস্টেলে গিয়ে রুটি ও দেশি মুরগির ঝাল ঝাল কারি খেয়ে ভাবলাম যে, কজন আর এ জীবনে এই অমৃতের স্বাদ পাবে! এই স্বাদের ধারেকাছে আসে না পাঁচ তারা হোটেলের স্বাদ। ঘুমোতে যাব। আচমকা কারেন্ট চলে গেল। অস্থির অস্থির লাগছে। বাপ-মায়ের আহ্লাদী মেয়ে বলেই হয়তো একটু অসুবিধে হলেই ধৈর্য হারাই। অবশ্য এটা গড়পড়তা বাঙালির স্বভাব। বাইরে এসেও বাড়ির আরাম খোঁজা। ঘুম কিন্তু এসে গেল। 

ভোরে উঠে দেখি চারপাশে ছোট ছোট হরেক দোকান। এক পা এগোতে না এগোতেই চমকে দেখি বাঘ। বাঘের চেয়েও যাকে ভয় পাই, সেই বিশাল চেহারার এক জার্মান শেফার্ড। ভয়ে ভয়ে তাকাতে দেখি, বেচারা কুকুর বিষণ্ণ, কাতর চোখে আমাকে দেখছে। শুনলাম ওর নাম ছোটু। অত বিশাল কুকুরের নাম ছোটু শুনে হাসি পেল। নিমেষে ভয় দূর হয়ে গেল। কিছুটা হেঁটে পাহাড়ের ওপরে গেলাম। সামনে শিব ক্যাফে। ছিমছাম। হিমালয় তো শিবের বাসভূমি। মা-বাবার কাছে প্রচুর মিথলজি শুনে শুনে শিব সম্পর্কে কৌতূহল আশৈশব। ক্যাফেতে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে দূর পাহাড় দেখা এক অন্য অনুভূতি। দেখতে দেখতে দিন চলেছে ঢিমেতালে। ফোন পারতপক্ষে ছুঁয়েও দেখছি না। শহরের সব ব্যাধি থেকে আমি মুক্ত হতে চাই। 

ফেরার সময় হয়ে আসছে; কিন্তু কাছের বিটলু গ্রাম যেতেই হবে। ঝলমলে নীল আকাশ। অজানা পাখির ঝাঁক শব্দ করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ছোট্ট ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। এক চিলতে নদী বয়ে চলেছে। লোকজন প্রায় নেইই। অদ্ভুত এক ঝুলন্ত সেতু আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জলের শব্দ শুনছি। কাছেই ছোট্ট এক ক্যাফে। তার ভেতরে লাইব্রেরি। আমি আনমনে রুমির কবিতা সঙ্কলন নিয়ে ঘোর লাগা মুগ্ধতায় পাতা ওল্টাতে লাগলাম। কোনো ভালো সময় বেশিক্ষণ বোধহয় থাকে না। শৈশবের মতো চট করে হারিয়ে যায়। বিষণ্ণ হৃদয়ে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে মনে পড়ে গেল, কাল সক্কাল সক্কাল উঠে পড়তে হবে। ফিরতে হবে যান্ত্রিক দিল্লি শহরে। সেখানে অফুরন্ত প্রাচুর্য; কিন্তু সে কখনো এই মায়াবী পাহাড়ের সমকক্ষ হতে পারবে না। প্রকৃতির বিকল্প কখনোই শহুরে জীবন হতে পারে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //