খেলাপি ঋণ ও অর্থপাচার সংকট সমাধানে অগ্রগতি নেই

দেশের অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে অর্থের সংকট। বহুদিন ধরে খেলাপি ঋণ, অর্থপাচার ও  কর ফাঁকির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্বল্প সময়ে সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।

আইএমএফ প্রাথমিকভাবে ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি সহায়তা দিতে আর্থিক খাতের সংস্কারের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে এই শর্ত পরিপালন করতে হবে। কিন্তু শর্ত পরিপালনের ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমার পরিবর্তে বাড়ছে। অর্থপাচার রোধেও তেমন কিছুই করা হয়নি। 

বিভিন্ন শর্ত পরিপালনের অবস্থা জানতে বাংলাদেশে সফর করছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। বিভিন্ন ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে তারা। প্রতিনিধি দলটি বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে উল্লেখ করছে, দেশের অর্থনীতি বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ও অবলোপন থেকে আদায়ও তেমন হচ্ছে না।

আবার ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত সরিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকেরা। ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের জন্য যে পাঁচ আইন করতে হবে, সেগুলোর একটি মাত্র মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেয়েছে, বাকিগুলোর খসড়া আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) আওতায়।

বাংলাদেশের জন্য গত জানুয়ারিতে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের শর্তের মধ্যে রয়েছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আইএমএফ মিশনকে জানানো হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের ঋণ রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪২২ কোটি টাকা।

এর মধ্যে তাদের খেলাপি ঋণ ৫৬ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকের ৫৮ শতাংশ, আর সবচেয়ে কম সোনালী ব্যাংকের ১৫ শতাংশ। ছয় ব্যাংকের গড় খেলাপি হার দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ। পুরো ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২০২০ সালে ৭ দশমিক ৬৬, ২০২১ সালে ৭ দশমিক ৯৩ এবং ২০২২ সালে বেড়ে তা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে বলে আইএমএফকে জানানো হয়।

খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখা বাধ্যতামূলক। সোনালী, জনতা ও বিডিবিএল বাড়তি সঞ্চিতি রাখতে পারলেও বাকি তিন ব্যাংকই ঘাটতিতে রয়েছে। যেমন অগ্রণীর ৪ হাজার ৪২২ কোটি, রূপালীর ২ হাজার ৮১৫ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। আর বেসিক ব্যাংক ১২৭ কোটি টাকা লোকসানে থাকলেও বাকি পাঁচ ব্যাংকের নিট মুনাফা মোট ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। 

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মিশনকে জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ থেকে পাঁচ ব্যাংকের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১০ কোটি টাকা। তারা আদায় করেছে মাত্র ১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। আর অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা, আদায় ৩৪৬ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিডিবিএল ছাড়া পাঁচ ব্যাংককে ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পুনর্মূলধন দেওয়া হয়েছে।

দেশে চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে মার্কিন ডলারের অভাবে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারিতে আমদানি ব্যয় ছিল যেখানে ৮৩২ কোটি ডলার, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা দাঁড়ায় ৫১৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছর আগের তুলনায় শুধু এক মাসে আমদানি ব্যয় কম হয়েছে ৩৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট পুরোপুরি না কাটার কারণ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের জন্য আগে খোলা এলসির নিষ্পত্তি এখনো করতে হচ্ছে।

দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় ৫টি আইনের সংশোধনের শর্ত জুড়ে দেয় আইএমএফ। এর মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ গত ২৮ মার্চ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা কমিটি। এটা এখন সংসদে পাঠানো হবে। এক পরিবার থেকে ব্যাংকের পর্ষদে একাধিক ব্যক্তি যাতে থাকতে না পারেন এবং টানা ৯ বছর তারা যাতে পর্ষদে থাকতে না পারেন, এটা আইএমএফের চাওয়া।

বর্তমানে এক পরিবারের চারজন টানা ৯ বছর থাকতে পারেন ব্যাংকের পর্ষদে। আইনের খসড়ায় চারজন থেকে কমিয়ে তিনজন করা হলেও টানা বছরের ব্যাপারে হাত দেওয়া হয়নি। খসড়ায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনাসহ তাদের বিভিন্ন সুবিধা কর্তনের কথা বলা হয়েছে।

হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১-এর সংশোধনের খসড়া এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাসংক্রান্ত কমিটিতে আছে। দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭-এর সংশোধনের খসড়াটি পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-কে নতুন করে করা হচ্ছে। ৫ এপ্রিল এর খসড়া ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন, সংসদ ও বিচারবিষয়ক বিভাগে। অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর সংশোধনের খসড়াও আছে ভেটিংয়ের জন্য।

এদিকে পর্যালোচনার মধ্যে কিছু  কিছু বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থা ক্রমশ অবনতি হয়েছে। এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। পুরো ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি ভালো থাকলেও ৯টি ব্যাংকের এ ব্যাপারে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৭টিই হচ্ছে ইসলামি ধারার শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত সরিয়ে গ্রাহকেরা তা নিয়ে গেছেন প্রচলিত ধারার ব্যাংকে। ইসলামি ধারার এ ব্যাংকগুলো এতে বড় ধরনের আমানত সংকটে ভুগছে। 

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের ঘাটতির পাশাপাশি অন্য সমস্যা হচ্ছে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য ব্যাংকগুলোতে যথাযথ লোক নিয়োগ দেওয়া হয় না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগই এ জন্য দায়ী। কারণ নিয়োগের সুপারিশটি এ বিভাগই করে।

আবার ব্যাংকের পরিচালকের কথাই যদি বলি, এক পরিবারের চারজনের টানা ৯ বছরের পরিবর্তে বড়জোর দুজনের শুধু ৩ বছর থাকা উচিত পর্ষদে। চারজনের পরিবর্তে তিনজন করা হচ্ছে, আবার ৯ বছরের বিধানে হাতই দেওয়া হচ্ছে না। এটা কোনো সংস্কার হলো?

এদিকে আইএমএফের শর্ত মোতাবেক রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতিতে সংস্কার করা হচ্ছে। এজন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ৭০০ কোটি ডলারের ইডিএফ থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা ৫০০ কোটি ডলারে নামিয়ে এনেছে। তহবিলের আকার কমিয়ে আনায় ব্যবসায়ীরা আপত্তি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, নগদ সহায়তা দেওয়া হলেও এর ওপর আবার টাকা কাটা হয়। এর কোনো মানে খুঁজে পান না তারা। 

এদিকে অর্থপাচারের বিষয়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে আইএমএফ। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যের বিপরীতে ৩০০ কোটি ডলার কেন দেশে আসছে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এটা তো অনেক বছরের ব্যাপার। এ সময়েই যে ডলার আসেনি, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। দেখতে হবে কত লম্বা সময়ের অঙ্ক এটা।

অর্থ পাচার বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস গত নভেম্বরে বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১-২২ প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা দুরূহ কাজ। ডলার একবার চলে গেলে সহজে ফেরত আনা যায় না।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //