অনুবাদ গল্প

আয়তাকার বাক্স

বিখ্যাত মার্কিন লেখক, কবি, সম্পাদক ও সাহিত্য সমালোচক। বিশেষ করে রহস্য ও আতঙ্কের গল্পে আকাশছোঁয়া খ্যাতি তার। অনেকে তাকে রহস্য গল্পের জনক বলে থাকেন। এডগার অ্যালান পো ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বস্টনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৪৯ সালের ৭ অক্টোবর মাত্র ৪০ বছর বয়সে ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বালটিমোরে তার জীবনাবসান হয়। 

কয়েক বছর আগে চার্লসটন এসসি থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার টিকিট সংরক্ষণ করেছিলাম। জাহাজটার নাম ছিল ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স’। একটা সুন্দর প্যাকেট জাহাজ (মূলত চিঠিপত্র পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়)। জুন মাসের ১৫ তারিখে জাহাজ ছাড়ার কথা, যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে। ১৪ তারিখে আমি জাহাজ পরিদর্শনে এলাম, আমার কেবিনে সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে। 

তালিকায় অনেক যাত্রীর নাম দেখলাম, নারী যাত্রীর নাম সাধারণভাবে যা দেখা যায় সেই তুলনায় কিছু বেশিই। যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন আমার পরিচিত, এর মধ্যে কর্নেলিয়াস ওয়্যাটকে দেখে আমি খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠলাম, একজন তরুণ শিল্পী, যার উষ্ণ বন্ধুত্বে আমি বাঁধা পড়েছিলাম। সিয়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমার সহপাঠী ছিলেন, আমরা দুজনে সেখানে একসঙ্গে প্রচুর আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। প্রতিভাবান মানুষদের যে সব গুণ থাকা উচিত সে সবই তার মধ্যে ছিল। সে ছিল সাংঘাতিক উন্নাসিক, মনুষ্যবিদ্বেষীই বলা যায় তাকে, সংবেদী ও প্রবল উৎসাহী। এই সব গুণের সমাহার ছাড়াও তিনি ছিলেন এক সাচ্চা আর উষ্ণ মনের অধিকারী, যা অন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রায় দেখাই যায় না। 

দেখলাম, তিনি তিনটি কেবিন নিয়েছেন। অথচ তালিকায় দেখছি তারা চারজন। তিনি নিজে, তার স্ত্রী আর তার দুই বোন। ঘরগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত, প্রতি ঘরে ওপরে-নিচে একটি করে বার্থ। অর্থাৎ চারজনের জন্য দুটি ঘরই তো যথেষ্ট ছিল, তাহলে তিনটি কেন! এই চিন্তাটা আমায় ভাবিয়ে তুলল। স্বীকার করছি, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে এই ধরনের কৌতূহল মোটেই শোভন নয়, তবু চিন্তাটা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। খুঁজেই চলেছি উত্তরটা। হঠাৎই পেয়ে গেলাম উত্তর। আশ্চর্য এতক্ষণ যে কেন এটা আমার মাথায় আসেনি। নিশ্চয় ওই ঘরটা ওর ভৃত্যের জন্য নেওয়া হয়েছে। তালিকাটা আবার মনে করার চেষ্টা করলাম, কই না, তালিকায় কোনো ভৃত্যের নাম তো দেখিনি। তবে কী? কী হতে পারে? তালিকাটা ‘এবং ভৃত্য’ প্রথমে লেখা হয়েছিল, পরে আবার তা কালি লেপে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আচ্ছা, অতিরিক্ত মালপত্রের জন্য ঘরটা নেওয়া হয়নি তো? হ্যাঁ, তাই হবে নিশ্চয়ই। এমন কিছু জিনিস যেটা সে অন্য যাত্রীদের জিনিসের সঙ্গে দিতে চায় না, যেটা সে চোখে চোখে রাখতে চায়। সেই মহার্ঘ ছবিটা হতে পারে কী? যেটা কেনার জন্য তিনি ইতালীয় ইহুদি নিকোলিনোর সঙ্গে দরকষাকষি করেছিলেন...। তাই হবে। এই সমাধানটায় বেশ সন্তুষ্ট হলাম। মাথা থেকে দূর করে দিলাম চিন্তাটা। 

তার দুই বোনের সঙ্গে আমার ভালোই পরিচয় ছিল, মধুর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর বুদ্ধিমতী তারা। বেশিদিন হয়নি আমার বন্ধু বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীকে আমি দেখিনি, তবে বন্ধু আমায় প্রায়ই তার স্ত্রীর কথা বলতেন, তার স্বাভাবিক উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিমায়। তিনি নাকি যেমন অতুলনীয় সুন্দরী তেমনই বিদগ্ধ আর রুচিসম্পন্ন। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে আমি অধীর হয়েছিলাম। 

১৪ তারিখে যেদিন আমি জাহাজটা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, সেদিন ওয়্যাট ও তার সঙ্গীদেরও পরিদর্শনে আসার কথা, ক্যাপ্টেন হার্ডি আমাকে সে কথাই বলেছিলেন ও কাজ মিটে যাওয়ার পরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করলাম যাতে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়। সেই সময়েই এই কৈফিয়ত এলো, ‘মিসেস ওয়্যাটের শরীরটা ঠিক ভালো নেই, তাই আগামীকাল জাহাজ ছাড়ার আগে তিনি উপস্থিত হতে চাইছেন না।’ 

পরদিন আমি হোটেল থেকে বেরিয়ে জাহাজ ঘাটের দিকে যাচ্ছি, ক্যাপ্টেন হার্ডি আমার সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘বিশেষ কারণবশত’ (অর্থহীন কিন্তু সুবিধাজনক বুলি) আরও একদিন কি দুদিন ইন্ডিপেন্ডেন্স ছাড়তে পারবে না, ছাড়ার উপযুক্ত সময় হলে আপনাকে খবর দেওয়া হবে। অবাক হলাম, সুন্দর দখিনা হাওয়া বইছে, এর মধ্যে ‘বিশেষ কারণ’ কী হতে পারে? বিমর্ষ হলাম কিন্তু করার তো কিছু নেই। বাড়ি ফিরে গেলাম। আরামে আলস্যে সময় কাটতে লাগল। 

জাহাজ ছাড়ার খবর আর আসেই না, প্রায় সপ্তাখানেক বাদে প্রত্যাশিত খবরটা এলো। আমি তড়িঘড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে জাহাজে উঠলাম। গাদাগাদি ভিড় যাত্রীদের, সবাই চাইছেন যত তাড়াতাড়ি পারেন নিজের নিজের আসনে গুছিয়ে বসতে। ওরা এলো আমি আসার মিনিট দশেক পর। দুই বোন, তার স্ত্রী এবং তিনি অর্থাৎ কর্নেলিয়াস ওয়্যাট। সেই একই রকম নাকউঁচু ভাব, তোমাদের মতো অগাবগাদের থেকে আমি আলাদা গোছের, আর কী! এ সবের সঙ্গে আমি ভালোই পরিচিত। যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েই এগিয়ে গেলাম ওর দিকে, কিন্তু উনি যেন আমাকে দেখেও দেখলেন না। নেহাত তাচ্ছিল্য ভরেই তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় করানোর দায়িত্ব তার মিষ্টি আর বুদ্ধিমতী বোন মারিয়ানের ওপর ছেড়ে দিলেন। 

মিসেস ওয়্যাটের পুরো মুখটাই অবগুণ্ঠনে ঢাকা ছিল। আমার বাওয়ের উত্তর দেওয়ার জন্য যখন উনি ঘোমটা সরালেন; স্বীকার করতেই হবে আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। আমার শিল্পী বন্ধুটি তার স্ত্রীর রূপের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন তিনি তার পত্নীর সৌন্দর্যের গুণকীর্তনে। 

কিন্তু চর্মচক্ষে দেখছি তিনি অত্যন্ত সাধারণ চেহারার এক নারী। কুশ্রী হয়তো নন, তবে প্রায় তাই-ই। বন্ধুটির অপরূপ রূপবর্ণনার ধারকাছ দিয়েও ইনি যান না। কিন্তু তার সাজপোশাক অত্যন্ত সুরুচির পরিচয় বহন করছে। তবে কি বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, অন্তরের? ঐশ্বর্য দিয়েই ইনি আমার শিল্পীবন্ধুটির হৃদয় জিতে নিয়েছেন? আমার সঙ্গে একটি-দুটি কথা বলেই উনি তার স্বামীর সঙ্গে তাদের ঘরে চলে গেলেন। 

আমার ছেড়ে যাওয়া অনুসন্ধিৎসা আবার ফিরে এলো। কোনো ভৃত্য যে নেই তা তো দেখাই যাচ্ছে। ওই অতিরিক্ত মালপত্রের মধ্যে কী রহস্য আছে সেটা আমায় জানতেই হবে। কিছুক্ষণ পর মালগাড়িতে এলো একটা আয়তাকার পাইন কাঠের বাক্স। আর ওটা তাদের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সমুদ্রবক্ষে গিয়ে পড়লাম। 

আমার প্রশ্ন বাক্সটার আকার নিয়ে। বাক্সটা আয়তাকার কেন? খুব নজর করে দেখেছি, লম্বায় ওটা ছ-ফুট আর চওড়ায় আড়াই ফুট মাপের। এইরকম একটা আকারের বাক্স, বেশ অদ্ভুত কিন্তু। কী থাকতে পারে ওতে? একটু ভাবতেই বেরিয়ে এলো উত্তর। নিজের প্রখর অনুমান শক্তির জন্য বেশ একটু গর্বও অনুভব করলাম। ওতে নিশ্চয় কয়েকটা বা অন্তত পক্ষে একটা ছবি আছে। ছবির দালাল নিকোলিনোর সঙ্গে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে কর্নেলিয়াস ছবিটা নিয়ে দরাদরি করেছিল বলে আমার কাছে খবর আছে। অদ্ভুত আকারের বাক্সটায় আর কিছুই নয়, লিওনার্দোর ‘লাস্ট সাপার’ ছবিটার নকল থাকার জোর সম্ভাবনা। ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন ওই ছবিটা কিছুদিন নিকোলিনোর জিম্মায় ছিল, এ কথা আমি জানতাম। দুয়ে দুয়ে চার করতে পেরে আমি এবার নিঃসন্দেহ হলাম। আমার সূক্ষ্ম বিচারশক্তির পরিচয় পেয়ে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে মুখ টিপে হাসলাম। একটা বিখ্যাত ও দুর্মূল্য ছবির নকল ও আমার নাকের ডগা দিয়ে পাচার করছে, ভাবছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সংকল্প করলাম ব্যাপারটা নিয়ে ওর পেছনে আমি লেগে থাকব। 

একটা ব্যাপার আমার মনে খচ খচ করছে। বাক্সটা অতিরিক্ত কেবিনে না রেখে ওর ঘরেই রাখা হয়েছে। ঘরের মেঝের প্রায় সবটুকু জায়গা দখল করে রেখেছে বাক্সটা। এতে নিশ্চয় শিল্পী ও শিল্পীপতনীর যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছে, বিশেষ করে যে আলকাতরা বা রঙে এলোমেলো অক্ষরে বাক্সটার ওপরে ঠিকানা লেখা আছে তা থেকে একটা কড়া অপ্রীতিকর গন্ধ বেরোচ্ছে। ঢাকনার ওপরে এই কথাগুলো লেখা আছে ‘মিসেস অ্যাডিলেড কার্টিস, অ্যালবানি, নিউইয়র্ক। চার্জ অব কর্নেলিয়াস ওয়্যাট, এসকোয়ার। দিস সাইড আপ। টু বি হ্যানডেল্ড উইথ কেয়ার।’

আমি জানি যে, মিসেস অ্যাডিলেড কার্টিস শিল্পীর স্ত্রীর মা, কিন্তু রহস্যের গন্ধ পেয়ে আমি পুরো ঠিকানাটা পড়লাম। যা বুঝলাম, ওই ছবিটা আর কোথাও নয়, আমার উন্নাসিক বন্ধুটির নিউইয়র্কের চেম্বার স্ট্রিটের স্টুডিওতেই যাচ্ছে। 

প্রথম তিন-চারটা দিন আবহাওয়া ছিল খুবই ভালো, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যাত্রীরাও ছিল দিলখুশ আর মিশুকে। তবে অবশ্যই ওয়্যাট আর তার বোনদের এই ‘মিশুকে’ যাত্রীদের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। ওয়্যাটের ব্যবহার অবশ্য আমি ধরছি না। তার স্বভাবের মধ্যেই একটা বিষণ্ণতা ছুঁয়ে থাকত। কিন্তু এখন যেন তার চেয়েও বেশি। সত্যি বলতে কি, বেশ রুক্ষ লাগত। তবু তার মধ্যে এই খ্যাপামি আমি মেনে নিতে পারি। কিন্তু তার বোনদের এ হেন ব্যবহারের কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাইনি। 

তারা বেশিরভাগ সময় তাদের ঘরের ভেতরেই কাটাতেন। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধেও তারা অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইতেন না একেবারেই। 

মিসেস ওয়্যাট কিন্তু মেলামেশায় উৎসুক ছিলেন। গপ্পোবাজ ছিলেন তিনি। নারী যাত্রীদের সঙ্গে তিনি বাড়াবাড়ি রকমের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তার কথাবার্তার তেমন ছিরিছাঁদ ছিল না। অবান্তর কথা বলতেন। এক কথায় বাজে বকতেন। 

অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওয়্যাট কীভাবে এইরকম একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। এর একটা সহজ উত্তর হতে পারে সম্পত্তি। কিন্তু আমি জানি তা মোটেই ঠিক নয়; ওয়্যাট আমাকে বলেছিল, ‘মেয়েটি কোনো সূত্র থেকেই একটি ডলারও আমাকে এনে দেয়নি। আমি বিয়ে করেছি ভালোবাসার জন্য এবং একমাত্র ভালোবাসাই এর কারণ এবং কনে আমার ভালোবাসার যোগ্যর তুলনায় অনেক অনেক বেশি।’ 

বন্ধুর এসব আবেগঘন মুহূর্তগুলো মনে পড়লে হতবুদ্ধি হই আমি। এমনটা কী সম্ভব যে তার যাবতীয় বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে! এছাড়া আর কী-ইবা ব্যাখ্যা হতে পারে এর? যে কিনা এত পরিশীলিত, এত বুদ্ধিদীপ্ত, এত ছুৎমার্গী, সৌন্দর্যের পূজারি সে কী করে....’ মহিলাটি অবশ্য তার প্রতি খুবই অনুরক্ত, বিশেষ করে বন্ধুর অনুপস্থিতিতে, যখন তিনি নিজেকে হাসির খোরাক করে ঘন ঘন তার স্বামীর সাতকাহন করে বেড়াতেন, তার জিভের ডগায় লেগে থাকত, ‘আমার অতিপ্রিয় স্বামী’ কথাটি। ইতোমধ্যে অবশ্য সবাই বুঝে গেছেন তার স্বামী তাকে এড়িয়ে চলেন, বেশিরভাগ সময়েই নিজেকে তিনি তার ঘরেই আটকে রাখেন। তিনি তার স্ত্রীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন যাতে উনি যাত্রীদের সঙ্গে আমোদ করে সময় কাটাতে পারেন। 

অবশেষে একদিন আমার বন্ধু ডেকে এলেন। আমি তার সঙ্গে মন্থর পায়ে একবার এদিক একবার ওদিক পায়চারি করছিলাম। গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে ছিলেন তিনি। আমার কথার হাঁ হুঁ করে কোনোরকমে উত্তর দিচ্ছেন, সেও খুবই চেষ্টাকৃত। দু-একবার রঙ্গ রসিকতার চেষ্টাও করে দেখলাম, কিন্তু ওদিক থেকে আনমনা ক্ষীণ হাসি ছাড়া আর কিছুই জুটল না। এবার তাই ঠিক করলাম একটা জোর ধাক্কা দেওয়া দরকার। একটু একটু করে কথাবার্তার মোড় বাক্সটার দিকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। ওটার ‘অদ্ভুত আকার’ নিয়ে কথা তুললাম, বলার সময় ঠোঁটে একটা চতুর হাসি এনে, চোখ টিপে ওর বুকে একটা হালকা টোকা মারলাম। কিন্তু উনি আমার এই নির্দোষ মশকরা মোটেই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। প্রথমটা মনে হলো, আমার এই কথার চাতুর্য বুঝে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব। তারপর ধীরে ধীরে যখন তার মাথায় ঢুকল, মনে হলো চোখদুটি বুঝি কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসবে। লাল হয়ে গেলেন তিনি, তারপর অসহ্য বিবর্ণ, তারপর, আমার কথায় যেন দারুণ আমোদ পেয়েছেন, সারা শরীর কাঁপিয়ে প্রচণ্ড জোরে হা হা করে হাসতে শুরু করলেন। আমাকে অবাক করে সে হাসি চলতেই থাকল, বরং হাসির দমক আরও বেড়েই চলেছে। এভাবে ১০ মিনিট বা তারও বেশি সময় ঘরে সে ভয়ঙ্কর হাসি চলেছিল। অবশেষে যখন হাসি থামল, সপাটে তিনি হুড়মুড় করে ডেকের ওপর পড়ে গেলেন। 

আমি দৌড়ে গেলাম তাকে তুলতে, মনে হচ্ছে মারাই গেছেন বুঝি! 

কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে অতি কষ্টে তার হুঁশ ফেরানো হলো, প্রথমটা তিনি অসংলগ্নভাবে এলোমেলো বকছিলেন, তারপর একটু ধাতস্থ হতে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। পরের দিন তিনি অনেকটা সামলে নিলেন বটে, তবে তা প্রায় পুরোটাই বাহ্যত, মানসিক স্বাস্থ্যের কথা জানতে চাইলে বলব, একেবারেই কোনো উন্নতি হয়নি। ক্যাপ্টেন মনে হয়, তার এই অপ্রকৃতিস্থতার ব্যাপারে আমার কোনো যোগ থাকতে পারে, এমন কিছু আঁচ করেছিলেন, তাই তার কথামতো আমি বন্ধুকে এড়িয়ে চলছিলাম। তাছাড়াও ক্যাপ্টেন আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ব্যাপারটা আমি জাহাজে আর কাউকে যেন না বলি। 

বন্ধুর এই অসুস্থতার পর এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটল যা আমার আগে থেকেই থাকা সন্দেহকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। ওই ঘটনার পর আমার স্নায়ুর ওপর বেশ চাপ পড়ে আর তা কাটানোর জন্য খুব কড়া গ্রিন টি খেতাম। যার ফলে রাতে ঘুম ভালো হতো না, সত্যি বলতে কি, দুই রাত আমি একেবারেই ঘুমাতে পারিনি। আমার কেবিনের সামনের দিকটা ছিল মূল কেবিন বা খাওয়ার ঘর। আমার মতো একা যারা ছিল তাদের সবার কেবিন এমনই ছিল। ওয়্যাটের ঘরগুলো ছিল মূল কেবিনগুলো থেকে একটা স্লাইডিং দরজা দিয়ে আলাদা করা। দরজাটা কখনোই তালাবন্ধ থাকত না, রাতেও নয়। ঢেউয়ের দাপটে মাঝে মাঝেই জাহাজ যখন কাত হয়ে যেত, স্লাইডিং দরজাটা খুলে যেত, সেটাকে বন্ধ করবার গরজ কেউ দেখাত না। কিন্তু আমার বার্থটার অবস্থান এমন জায়গায় ছিল যে, আমার ঘরের দরজাটা খোলা থাকলে (গরমের জন্য দরজাটা আমি সবসময় খুলেই রাখতাম) ওদের কেবিনের একটা অংশ পরিষ্কার দেখা যেত। 

মিসেস ওয়্যাট ওই দুই রাতে (পরপর দু-রাত নয়) রাত ১১টা নাগাদ চুপিসারে বন্ধুর ঘর ছেড়ে অতিরিক্ত ঘরে চলে যেতেন। সারারাত তিনি ঘরেই থাকতেন যতক্ষণ না বন্ধু তাকে ডেকে তার ঘরে না নিয়ে যেতেন। অর্থাৎ কার্যত তারা আলাদা। দুজনে আলাদা কেবিনে রাত কাটান, নিঃসন্দেহে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা তারা গভীর মনোযোগের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করছেন। এতক্ষণে অতিরিক্ত কেবিন নেওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। 

আর একটা ব্যাপার আমাকে খুবই উৎসুক করেছিল। ওই দুটি নিদ্রাহীন রাতে মিসেস ওয়্যাট তার ঘরে চলে যাওয়ার পরপরই আমি বন্ধুর ঘর থেকে খুব ক্ষীণ কিছু শব্দ শুনতে পেতাম। কিছুক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার পর আমি ওই শব্দের কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। বাক্সটার ঢাকনা খোলার জন্য বাটালি আর মুগুরের ঠোকাঠুকি। মুগুরের মাথাটা আবার রেশম বা নরম সুতি কাপড় দিয়ে জড়ানো, যাতে খুব কম আওয়াজ হয়। 

এভাবে আমি বুঝে নিতাম ঠিক কখন তিনি বাক্সটার ঢাকনাটা আলগা করলেন। এও বুঝতাম ঠিক কোন সময়ে ঢাকনাটা পুরোপুরি খুলে নিচের বার্থে রাখলেন। খুব সাবধানে এই কাজটা করলেও বার্থের কাঠের কিনারায় ঢাকনাটা লেগে খুব হালকা কিছু আওয়াজ আমার কানে আসতোই। 

এরপর হিমশীতল নীরবতা। এক ধরনের ক্ষীণ গোঙানির আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যেত না। যেন খুব আস্তে আস্তে বিড়বিড় করে কেউ কিছু বলছে। আমার কল্পনা যেন সেই আওয়াজের স্রষ্টা। চাপা দীর্ঘশ্বাস বা কান্নার সঙ্গে সে আওয়াজের খুব সাদৃশ্য। সে আওয়াজ যেন আমার কানে বেজেই চলেছে। 

যে দুটি রাতের কথা আমি বলেছি, উভয় রাতেই ভোর হওয়ার ঠিক আগেই পরিষ্কার শুনেছি আয়তাকার বাক্সটার ঢাকনা লাগিয়ে পেরেকগুলো যেখানে যেখানে মারা ছিল সেখানেই আবার ওই কাপড়ে মোড়া মুগুর দিয়ে ঠুকে লাগিয়ে দিচ্ছেন। কাজ শেষ করে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পূর্ণ পরিচ্ছদে মিসেস ওয়্যাটকে ডাকার জন্য তার ঘরের দিকে যেতেন। 

সাত দিন হয়ে গেল আমরা সমুদ্রে আছি। আমরা এখন কেপ হাটেরাস ছেড়ে এগিয়েছি। আবহাওয়া কদিন ধরেই হুমকি দিচ্ছিল আমাদের। এখন ঝড়ো হাওয়া উঠল, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে। যদিও আমরা এর জন্য তৈরিই ছিলাম, বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে সবরকম সাবধানতা নেওয়া হয়েছিল। 

এই অবস্থার মধ্য দিয়েই ৪৮ ঘণ্টা আমরা নিরাপদে পেরিয়ে এলাম। জাহাজটা যে সত্যিই দুর্দান্ত তা নানাভাবেই সে প্রমাণ দিল। এই সময়কাল পেরনোর পর যে প্রবল বাতাসটা ছিল সেটা সাংঘাতিক ঝড়ের রূপ নিল। ঝড়ের দাপটে পালটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে এমন অবস্থা হলো যেন মনে হচ্ছে কটা ফিতে উড়ছে। এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় তিনজন লোককে হারালাম আমরা, জাহাজের রান্নাঘরটাও ভেঙে গেল। এরপর ঝড়ের ভয়ঙ্কর দাপট খানিকটা কমল, আগের টালমাটাল অবস্থা কাটিয়ে সমুদ্রের বুকে জাহাজটা কিছুটা হলেও ধাতস্থ হয়েছে। 

ঝড়ো হাওয়া কিন্তু চলছিলই, সেটা থামার বা কমারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ঝড়ের সঙ্গে ক্রমাগত অসম লড়াই চালিয়ে দড়িদড়াগুলোর অবস্থা একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে। ঝড়ো হাওয়ার তৃতীয় দিনে বিকাল ৫টা নাগাদ প্রবল হাওয়ার দাপটে জাহাজের মিজিন মাস্ট (তিন মাস্তুলওয়ালা জাহাজের পশ্চাদভাগের সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী মাস্তুল) ভেঙে গেল। ঘণ্টাখানেক বা তার বেশি সময় ধরে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাণপণ যুঝে যাচ্ছিলাম; কিন্তু জাহাজের প্রবল দুলুনির জন্য আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। এই সময়েই ছুতোর মিস্ত্রি জাহাজের পেছনে এসে জানাল, জাহাজে চার ফুট জল দাঁড়িয়ে গেছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো পাম্পগুলোও দেখা গেল তখন বসে গেছে।

এ হেন বিভ্রান্তি আর হতাশার মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, জাহাজকে হালকা করার জন্য যতটা সম্ভব মালপত্র ফেলে দিতে হবে। এতে করে আপাতত উপকার হলো বটে; কিন্তু পাম্পগুলো কিছুতেই আর সচল করা গেল না, সেই সঙ্গে জাহাজের ছিদ্রটা ক্রমশই বড় হচ্ছে। 

সূর্য অস্ত গেলে ঝড়ের দাপট অনেকটাই কমল। সমুদ্র শান্ত হলো। একটা ক্ষীণ আশা জাগল আমাদের বুকে, নৌকোগুলোর সাহায্য নিয়ে হয়তো বেঁচেও যেতে পারি। রাত ৮টা নাগাদ জোর হাওয়ায় সব মেঘ উড়ে গেল, আকাশে পূর্ণচন্দ্র দেখা দিল, সৌভাগ্য বলতে হবে, আমাদের নিবে যাওয়া উৎসাহকে এই দৃশ্য আবার উসকে দিল। সাংঘাতিক পরিশ্রমের পর আমরা লং বোটটাকে জলে ভাসাতে সমর্থ হলাম, কোনো বড় দুর্ঘটনা ছাড়াই। জাহাজের সব কর্মচারী আর বেশিরভাগ যাত্রীই সেই নৌকায় নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নৌকাটা ছেড়ে দিল। প্রচুর কষ্ট স্বীকার করে তৃতীয় দিনে তারা নিরাপদে ওক্রাকোক পৌঁছেছিলেন। 

ক্যাপ্টেনকে নিয়ে ১৪ জন আমরা জাহাজে রয়ে গেলাম। জাহাজের পেছনে বাঁধা নৌকার (জলি বোট) ওপর আমাদের ভাগ্যকে সঁপে দিতে হলো। নিরাপদেই ওটাকে জলে ভাসানো গেল, ভাগ্য ভালো যে জলে স্পর্শ করবার সময় ওটা ডুবে যায়নি। ক্যাপ্টেন, তার স্ত্রী, মি. ওয়্যাট এবং তার সঙ্গীরা, একজন মেক্সিকান অফিসার, তার স্ত্রী ও চার সন্তান, আমি আর আমার নিগ্রো খানসামা- এই কজনে নৌকায় বসলাম। 

স্বাভাবিকভাবেই খুব প্রয়োজনীয় কিছু পোশাক আর জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছুই আমাদের সঙ্গে আমরা নিইনি, নেওয়ার কথা ভাবিওনি। জাহাজ থেকে আমরা কখন কয়েক ফ্যাদম এগিয়েছি, আমাদের সবাইকে চরম অবাক করে মি. ওয়্যাট নৌকার ওপর উঠে ক্যাপ্টেন হার্ডিকে ঠান্ডা গলায় বললেন, নৌকাটাকে যেন অবশ্যই জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তার আয়তাকার বাক্সটা নিয়ে আসার জন্য। 

‘বসে পড়ুন, মি. ওয়্যাট’, একটু রুক্ষভাবেই বললেন ক্যাপ্টেন হার্ডি। ‘আপনি যদি না বসেন, ডুবে মরতে হবে আমাদের সবাইকে। জল প্রায় নৌকার কানা ছুঁয়ে ফেলেছে।’

‘বাক্সটা’ চিৎকার করে বলল মি. ওয়্যাট। তখনও তিনি দাঁড়িয়ে আছেন! ‘না, ক্যাপ্টেন হার্ডি না, আপনি পারেন না আমায় প্রত্যাখ্যান করতে। বাক্সটা মোটেই ভারী নয়, তুচ্ছ ওটার ওজন, একেবারেই তুচ্ছ। ঈশ্বরের দোহাই, আপনার উদ্ধারের দোহাই! আমি মিনতি করি আপনাকে, বাক্সটা আমায় আনতে দিন।’

এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তার এই আন্তরিক আবেদন বুঝি ক্যাপ্টেনকে স্পর্শ করল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি আগের কঠোরতা অর্জন করে বললেন, ‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন মি. ওয়্যাট। আপনার কথা আমি শুনব না। আমি বলছি, আপনি বসুন, না হলে নৌকাটাই ডুবে যাবে। আরে আরে, কী করছেন আপনি! ধরুন ওকে, শক্ত করে ধরুন, না হলে উনি এখনই জলে ঝাঁপ দেবেন।’ ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হতে না হতে সত্যিই তিনি জলে ঝাঁপ দিলেন। তারপর অতিমানবিক প্রচেষ্টায় তিনি জাহাজ থেকে ঝোলানো দড়িটা ধরে ফেললেন। দড়িটা বেয়ে জাহাজে উঠেই তিনি উন্মত্তের মতো দৌড়ে কেবিনের দিকে গেলেন। 

ইতোমধ্যে প্রবল সামুদ্রিক স্রোতের টানে আমরা জাহাজ থেকে অনেকটাই দূরে ভেসে এসেছি। প্রাণপণ চেষ্টা করলাম যাতে নৌকাটাকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমাদের এই ক্ষুদ্র নৌকা দারুণ স্রোতের অনুকূলে পালকের মতো ভেসে এগিয়ে চলল। 

জাহাজ থেকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে যেতে আমরা দেখলাম সেই উন্মাদ মানুষটি (এ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায় তাকে) রাক্ষুসে শক্তি প্রয়োগ করে সেই আয়তাকার বাক্সটা টেনে আনছেন। চরম বিস্ময়ে আমরা দেখলাম জাহাজ থেকে ঝোলানো তিন ইঞ্চি মোটা দড়িটায় প্রথমে বাক্সটায় বেশ কয়েক পাক, পরে নিজেকে কয়েক পাক বাঁধনে জড়িয়ে নিলেন। তারপরই ঝাঁপ দিলেন সমুদ্রে। মুহূর্ত পরেই আর তাদের দেখা গেল না, হারিয়ে গেলেন চিরদিনের মতো। 

বিমর্ষতা গ্রাস করেছিল আমাদের। বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বেরোয়নি আমাদের মুখে। ঘণ্টাখানেক পর এই অসহ্য নীরবতাকে ঝাঁকি মেরে একটু ঝুঁকি নিয়েই আমি বলে উঠলাম, ‘ক্যাপ্টেন, আপনি লক্ষ করেছেন ওরা কেমন হঠাৎ করে ডুবে গেলেন? আমার একটু যেন ক্ষীণ আশা ছিল।’ 

‘ডুবে ওরা যেতেনই,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘লবণ গুলে যাওয়ার পর ভেসে উঠতেও বেশি দেরি হবে না।’

‘লবণ।’ বিস্ময়ে আমি চিৎকার করে বলে ফেললাম। 

‘হাশশ।’ মৃত মানুষটির স্ত্রী আর ভগ্নিদের ইঙ্গিত করে সাবধান করলেন ক্যাপ্টেন। ‘সময় সুযোগমতো এই নিয়ে কথা বলা যাবে।’

প্রচুর ভোগান্তির পর আমরা সবাই অল্পের জন্য সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেলাম। দিন চারেক অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে কাটিয়ে রিয়ানোর দ্বীপপুঞ্জে জীবন্মৃত অবস্থায় পৌঁছলাম। সপ্তাখানেক সেখানে ছিলাম আমরা। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নিউইয়র্ক পাড়ি দিই। 

‘ইন্ডিপেন্ডেন্স’ ডুবে যাওয়ার মাসখানেক পর হঠাৎই ক্যাপ্টেন হার্ডির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় ব্রডওয়েতে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কথাবার্তার মোড় ঘুরে গেল সেই বিপর্যয়ের দিনগুলোতে, বিশেষ করে আমার হতভাগ্য শিল্পী বন্ধুটির দিকে। ক্যাপ্টেনের মুখ থেকেই সব জানতে পারলাম। 

‘তার নিজের, স্ত্রী, দুই ভগ্নী আর ভৃত্যের নামে জাহাজের টিকিট সংরক্ষণ করেছিলেন। তার স্ত্রী সত্যিই ছিলেন অপূর্ব রূপসী, সঙ্গে অত্যন্ত মার্জিত রুচিসম্পন্ন মহিলা। ১৪ জুন সকালে (যেদিন আমি প্রথম জাহাজ ঘাট পরিদর্শনে যাই) হঠাৎই তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। আমার তরুণ বন্ধুটি শোকে পাগল হয়ে যান। মরদেহ তার শাশুড়ির কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি ছিল। অন্য দিকে তাদের সঙ্গে একই জাহাজে একটি মৃতদেহ যাচ্ছে- এ কথা জানাজানি হয়ে গেলে ১০ জনের মধ্যে নয়জনই তাদের যাত্রা রদ করে দেবেন, এমনই সংস্কার মানুষের। এই উভয় সংকট থেকে বাঁচার জন্য ক্যাপ্টেন হার্ডি একটা প্রমাণ আকারের বাক্সে প্রচুর পরিমাণে লবণ দিয়ে আমার বন্ধুর স্ত্রীর মৃতদেহ তার মধ্যে চালান করে দিয়ে বাক্সটাকে ‘পণ্য সামগ্রী’ হিসেবে দেখিয়ে জাহাজে তুললেন। এই মৃত্যুর খবর কাউকে জানানো হলো না। যেহেতু তার স্ত্রীর নামে টিকিট বুক করা আছে তাই কাউকে এই যাত্রার সময়কালে তার স্ত্রীর ভূমিকায় দেখাতেই হয়। আর এই কাজে তার স্ত্রীর পরিচারিকার থেকে যোগ্য আর কেই-বা হতে পারেন। যে অতিরিক্ত ঘরটি ভাড়া করা হয়েছিল তাতে তার নকল স্ত্রী রাতে ঘুমাতেন, দিনের বেলায় তিনি যতটা সম্ভব তার আসল স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন।’

সবকিছু শোনার পর নিজে কী মারাত্মক ভুল করেছি তা এখন বুঝলাম। নীচ কৌতূহলকে প্রশ্রয় দিয়ে কী কুৎসিতভাবেই না তাকে আমি সন্দেহ করেছিলাম!

এরপর থেকে এমন রাত বিরল, যে রাতে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পেরেছি। দু-চোখের পাতা এক করতে গেলেই আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই ভয়ঙ্কর হাসি, যার হাত থেকে কোনোদিন আমার নিস্তার নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //