রক্ত ও ঋণের গল্প

চিঠিগুলো প্রথম হাতে পড়েছিল বাসা বদলের সময়। পিকআপ ভ্যানে মালপত্র ওঠাতে যেয়ে একটা পুরনো লাগেজ নিচে পড়ে যায়। লক ভেঙে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে কতকগুলো ভাঁজ করা কাগজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কাগজগুলো অনেক আগের। একটা কাগজ হাতে তুলে নেয় রাইসুল। ভাঁজ খুললে কয়েক লাইনের লেপ্টানো লেখা চোখে পড়ে। ভাষাটা চেনা মনে হয় কিন্তু পড়তে পারে না। তবে এগুলো যে চিঠি, তা অনুমান হয় ধরনে। এটি বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা।

আজ এই চিঠিগুলোই রাইসুলের কাছে প্রধান প্রমাণ। তার শরীর তিরতির করে ঘামে। একদিকে রক্তের সম্পর্ক, অন্যদিকে চরম সত্যের আবিষ্কার! কোন দিকে যাবে রাইসুল? 

ডাইনিং টেবিলে একটা ছুরি। রাইসুল একবার চিঠিগুলোর দিকে তাকায়, একবার ছুরিটার দিকে তাকায়। দেশ বড়, না সম্পর্ক? প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে জেড বিমানের মতো।

রাইসুল মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। যুদ্ধের অনেক পরে তার জন্ম হলেও বই পড়ে, চলচ্চিত্র দেখে, গান শুনে, ইতিহাস থেকে জেনে, সাংগঠনিক চর্চায় রাইসুল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। স্বাধীনতা, মুক্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সে যে কোনো কিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এমনই তার অনুভূতি। 

কোভিড-১৯ এ দেশের সবুজ-শ্যামল ছায়ার গায়েও আছড়ে পড়েছে। যেহেতু রোগটা দস্যুর মতো দুর্ধর্ষ, প্রবল ছোঁয়াচে সেহেতু সদ্য-ফেরত প্রবাসীরা কিছু দিন ঘরে থাকলে দোষ কোথায়? কী এমন ক্ষতি এতে? সন্দেহভাজনরা নির্দেশ মান্য না-করা, হাসপাতাল থেকে পালিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া, অবাধে ঘোরাঘুরি করা ইত্যাদি ভাইরাল খবরে দাউদাউ করে তার রাগ চড়ে মাথায়। খিটমিট লাগে রোগটাকে সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায়। পত্রিকা, টিভি, অনলাইন দেখলে হ-য-ব-র-ল-এর অভাব নেই।

সন্ধ্যার আগে হাঁটতে বের হয় রাইসুল। বাসার কাছে ফাস্ট ফুডের দোকানটাতে বসে। দুজন মুরব্বিও নির্দিষ্ট দূরত্বে বসেছে। তাদের মুখেও মারিকালে দেশে ফেরত প্রবাসীদের অসচেতনতার আলাপ। প্রথমজন ক্ষুব্ধ স্বরেই দ্বিতীয়জনের উদ্দেশে বলে, ‘এই সময়ে বিদেশফেরতদের মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী এ দেশের রাজাকারদের মতো সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে যাওয়া দরকার। কেউ যেন খোঁজ না পায়। যদি তারা রোগটি বহন করে তবে তা আর ছড়াবে না। যদি বহন না করে, নির্দেশিত চৌদ্দ দিন পর বের হবে। এটাই তো নিরাপদ, তাই না?’

‘রাজকারদের মতো সেল্ফ কোয়ারেন্টিন।’ বাক্যটিতে রাইসুলের কান আটকে যায়। ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকারদের সঙ্গে এ শব্দটি কীভাবে যায় তা তাকে ভাবনায় ফেলে। প্রবীণ দুজনের কাছে জানতে চেয়েও চাওয়া হয় না। বাসায় ফিরে ইন্টারনেটে সার্চ করতে থাকে। শেলফ্ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কিছু বই নামিয়ে দেখতে থাকে, কিছুই পায় না। 

দিনকয়েক পর রাইসুল তার চাচা সিরাজুল ইসলামের শরণাপন্ন হয়। হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতেই চাচা সম্বোধন করেন,‘কী রে এত দিন পর আমাদের মনে পড়ল?’ 

‘মনে পড়ে সব সময়ই চাচা। আসা হয় না মাত্র। আর যে অবস্থা চলছে! তোমরা কেমন আছো?’ 

‘ভালো।’ 

‘একটা বিশেষ কাজে তোমার কাছে এসেছি।’

‘বল।’

সিরাজুল ইসলামের পড়ার ঘরে তারা দুজন একটা টেবিলের দুই প্রান্তে বসে। রাইসুল বলে,

‘চাচা, তুমি তো মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষকও। এ দেশে প্রথম রাজাকারদের নামের ডায়েরি তুমিই প্রকাশ করলে। লিখলে কোন রাজাকার কোথায় আত্মগোপনে আছে। তাই না?’

‘তা ত্ইু জানিস?’

‘বলো তাহলে, সেল্ফ কোয়ারেন্টিন শব্দটির সঙ্গে রাজাকার শব্দটি কীভাবে সম্পর্কিত?’

‘এই কথা! আমি ভাবলাম কী-না কী।’ 

একটু সময় নিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলতে থাকেন, ‘সেল্ফ কোয়ারেন্টিনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সুসম্পর্ক নেই। সুসম্পর্ক তাদের সঙ্গে, যারা রাজাকার, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশেরই মানুষ হয়ে এ দেশের বিরোধিতা করেছে। গুম, খুন, ধর্ষণ, লুটপাটসহ জঘন্য দুষ্কর্মের অগ্রভাগে ছিল। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে যখন দেশ স্বাধীন হলো, তখন তারা শাস্তি পাওয়ার ভয়ে কেউ এলাকা ছাড়ল, কেউ দেশ ছাড়ল, কেউ আত্মগোপনে চলে গেল। অনেকে সেল্ফ কোয়ারেন্টিনের পথ বেছে নিয়েছিল। কেউ কেউ এখনো ওই অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে। তারা পারতপক্ষে ঘরের বাইরে যায় না, লোকের সঙ্গে মেশে না।’ 

শেষ কয়েকটি কথায় চমকে ওঠে রাইসুল। আপন চাচার কথাগুলোর সঙ্গে মিলে যায় তার বাবার লাইফস্টাইল! তার বাবা হামিদ মোল্লাও তো ঘর ছেড়ে খুব বের হয় না। কোথাও যায় না, কারও সঙ্গে মেশে না। সঙ্গনিরোধের মতো ঘরেই সব কর্ম। মুহূর্তে একটা কিছুর গন্ধ এসে লাগে তার চৈতন্যে। সে জানতে চায়, ‘আচ্ছা চাচা, একটা পরিষ্কার কথা বলবে?’

‘বল।’

রাইসুল নিঃসংকোচে প্রশ্ন করে, ‘বাবা কি রাজাকার ছিল?’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’ 

‘জানো না, নাকি বলতে চাও না চাচা?’

সিরাজুল ইসলাম কাঁচুমাচু। রাইসুলের চোখে ভেসে ওঠে লাগেজের লক ভেঙে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া কাগজগুলো। তার সন্দেহ বাড়ে। কিছু একটা ভেবে পরের কথার জন্য অপেক্ষা না করে ফিরে আসে বাসায়। বসে মায়ের সঙ্গে। জানতে চায়, ‘মা, আমাদের বাবা কি রাজাকার ছিল?’

মা নিলুফার ইয়াসমিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বুঝতে পারেন না, কী বলবেন। তিনি মৃদুস্বরে বলেন, ‘আমি জানি না।’ 

মা ও চাচার উত্তর দুটি মিলে যায় একপ্রান্তে। রাইসুলের মাথায় তিরতির করে রক্ত উঠতে থাকে, ‘বাবা রাজাকার!’ হনহন করে সে নিজের ঘরে ঢোকে। কাঁধব্যাগে কিছু একটা ঢুকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। 

দুই
এক সপ্তাহ পর ফিরে আসে রাইসুল। বাসাটা সুনসান। এক ধাক্কায় চাপানো দরজাটার কপাট খুলে দাঁড়ায় তার বাবা হামিদ মোল্লার সিনা বরাবর। প্রবল শক্তি নিয়ে বলে, ‘বাবা, তুমি কি রাজাকার ছিলে যুদ্ধের সময়?’

হামিদ মোল্লার মুখটা রেখাময় হয়ে ওঠে মুহূর্তে। চোখজোড়া হয়ে ওঠে মৃত মাছের পীতের মতো। যে প্রশ্ন এত বছর কেউ করেনি, সে প্রশ্ন নিজ সন্তানের মুখে! থরথর করে কাঁপতে থাকে তার ন্যুব্জ শরীরটা। সে ভারসাম্যহীন। রাইসুল আবার প্রশ্ন করে, ‘সত্যি তুমি স্বাধীনতাবিরোধী ছিলে?’

বিরামহীন বিস্ময়চিহ্নে ঘেরা হামিদ মোল্লা বলে ওঠে, ‘জানি না।’ 

তিনজনের তিনটি উত্তর এক মৌলিক বিন্দুতে উত্তীর্ণ হলে রাইসুলের সন্দেহ চূড়ান্ত রূপ পায়। চেতনায় যে রাজাকার-আলবদর-আলসামসকে সে চরম ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছে বড় হতে হতে, সে দলেরই একজন তার বাবা! বিশ্বাস হতে চায় না। রাইসুল হামিদ মোল্লার মুখের ওপর ছুড়ে মারে এক বান্ডিল কাগজ। 

তিন
বাসা বদলের দিন পাওয়া চিঠিসদৃশ কাগজগুলোকে বাবার তারুণ্যের প্রেমপত্র মনে করে কৌতূহলবশত কিছু কাগজ রাইসুল রেখে দিয়েছিল নিজের কাছে। সেগুলো সে গত সাত দিনে অনুবাদ করিয়ে এনেছে। চিঠিগুলোর নিচে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ক্যাম্পের পাকিস্তানি মেজরের নাম, দস্তখত। কোনোটির নিচে সিলমোহর। কোনোটিতে লেখা-কখন কোন গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে হবে। কোনোটিতে লেখা-কখন কাকে ক্যাম্পে তুলে আনতে হবে, কোন রাতে কতজন তরুণী মেজরদের ফুর্তির জন্য প্রয়োজন। কোনোটিতে বর্বরতার নীলনকশা আঁকা। হাড় হিম হয়ে আসে। তার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি নিবিড়ভাবে চষে ওই অঞ্চলে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাওয়া তথ্যের উপস্থাপনে হামিদ মোল্লার পথ থাকে না আর অস্বীকারের।

হামিদ মোল্লা একেবারে নির্বাক। রাইসুল তথ্য না-হয় পেল পৈতৃক ভিটা-দেশে অনুসন্ধান করে, কোথায় পেল এ চিঠিগুলো! তবে কি গভীর ভুলেই চিঠিগুলো রয়ে গেছে এত যুগ? 

রাইসুল চিঠিগুলোর দিকে তাকায়। তার জন্মদাতার দিকে তাকায়। চোখ যায় টেবিলে রাখা চকচকে ছুরিটার দিকে। রাইসুলের মাথাটা তীব্রভাবে ঘুরপাক খায়। বমি আসে নাড়িভুঁড়ি উল্টে। রাইসুল বমিটা আটকে রাখতে চায়। পারে না। সে ওয়াক করে তার বাবার ওপর উগরে দেয়। হামিদ মোল্লা ‘মাগো...’ বলে কাত হয়ে পড়ে পাশের আলমিরার উপর, তারপর থকথকে কাঁচা বমির ওপর। 

রাইসুল আবার ‘ওয়াক থু’ করে একদলা থুতু নিক্ষেপ করে কাতরাতে থাকা দেহটায়।

পরক্ষণে নিজের প্রতিও ঘৃণা গুলিয়ে ওঠে সমান, ঘৃণাটা পাক খায়, আরও পাক খায়। একজন যুদ্ধাপরাধীর রক্ত তার শরীরে! 

মানতে পারে না। মেনে নিতে পারে না সে। দ্বিগুণ বেগে তার আবার বমি আসে শূন্যপেট মোচড় দিয়ে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //