কুপার্স কেক

সন্ধ্যার পর একে একে সবাই আসতে শুরু করেছে, যাদের বলা হয়েছে ফোনে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে। সবার মুখে উচ্ছ্বসিত হাসি, হাতে একটা না একটা কিছুর প্যাকেট অথবা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে বাঁধা ফুলের ডাঁটি। ভেতরে ঢোকার দরজা খোলাই, তবু অভ্যেস অনুযায়ী কলিং বেল টেপে অতিথিরা। চাইমের বাজনার মধ্যেই কখনো দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানায় বকুল, কখনো ধন্যা। উপহার হাতে নিয়ে দুজনই বলে, আহা এটা আবার আনতে গেলে কেন?

একটু পর ঘরের ফুলদানিতে কুলোয় না, ফুলের স্তবক, ডাঁটিসুদ্ধ গুচ্ছ রাখতে হয় বুককেসের ওপর, অনেক দিন আগে তোলা তাদের দুজনের ছবির পাশে। নানা রঙের ফুলে খুব উজ্জ্বল দেখায় পুরনো হয়ে যাওয়া বাদামি কাঠের আলমারির ওপরের দিকটা। বকুল আর ধন্যা অর্ডার দিয়ে কুপার্স থেকে দু পাউন্ডের একটা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক এনেছে। ওপরে ‘শুভ জন্মদিন’ আর নিচে নাম লেখা। চারটা ছোট মোমবাতি পাশে রাখা, পরে লাগানো হবে। বকুল কেকটার দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না, চোখ পড়তেই চকিতে সরিয়ে নিচ্ছে। বন্ধুদের কেউ কেউ কেক এনেছে, সে সব তাদের বড় কেকটার পাশে রেখেছে ধন্যা। 

অতিথিদের মধ্যে ধন্যা আর বকুলের সহপাঠী-বন্ধুদের সংখ্যাই বেশি। আর আছে তাদের দুজনের অফিসের সহকর্মী, একই বয়সের হওয়ার জন্য যাদের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বের মতো হয়ে গিয়েছে। বকুলের বন্ধু আর সহকর্মীরাই সংখ্যায় বেশি, কেননা জন্মদিনটা তার। ধন্যা ইচ্ছে করেই দুজনেরই ঘনিষ্ঠ, এমন ছাড়া অন্য বন্ধুদের আসতে বলেনি। তার জন্মদিনে সে নিজের বন্ধুদের বেশি করে ডাকবে। দুজনের বিয়ের পর এটা বকুলের দ্বিতীয় জন্মদিন। ধন্যার আগ্রহেই সে তার প্রথম জন্মদিনে বন্ধুদের ডেকেছিল, বলেছিল সে জন্মদিন পালন করে না। কেন করে না, তার উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিল সে। এবারও জন্মদিন পালনে খুব উৎসাহ দেখায়নি সে। বলেছিল, কী দরকার? আমি তো আর ছোটটি নেই। 

অবাক হয়ে ধন্যা বলেছে, জন্মদিন বুঝি ছোটদেরই হয়? দোকানে তা হলে এত এত কেক রাখে কেন ওরা? জন্মদিন সব বয়সেই হয়। বুঝলে? 

বেশ তো তোমারটা ঘটা করে পালন করা হবে। একটাই দুজনের জন্য যথেষ্ট, বলেছে বকুল। 

কী যে বলো, মাথামুণ্ডু নেই। এক কেকে দুজনের নাম লেখা হয় নাকি? তারপর বলেছে, তোমার কিসস্যু করতে হবে না। আমিই সব করব। বন্ধুদের বলা থেকে দোকান থেকে কেক আনা, অনলাইনে খাবার অর্ডার দেয়া। আমি একাই দিব্যি পারব। এমনকি তোমার বন্ধুদের ইনভাইট করতেও অসুবিধা হবে না। তারপর গম্ভীর হয়ে বলেছে, তুমি শরীরটা ভালো রেখ। মাঝে মাঝে তোমার যে কী হয়! বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতে গেলেই তুমি কেমন যেন হয়ে যাও। আমার খুব অবাক লাগে তখন। বেশ অচেনা লাগে তোমাকে। 

শুনে বকুল হাসার চেষ্টা করে বলে, সবার ভেতরেই একটু রহস্য থাকা ভালো। সবকিছু জানা হয়ে গেলে আর কৌতূহল থাকে না। শুনে ধন্যা চোখ কপালে তুলে বলেছে, আরে বলে কী! তোমার এই হঠাৎ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়া তা হলে ভান? অভিনয় করা? দারুণ তো তুমি। তারপর হতাশার ভঙ্গিতে বলে, আমি তাহলে খুবই আনইন্টারেস্টিং মানুষ! কোনো রহস্যই নেই। আমাকে তুমি তোমার হাতের তালুর মতো পড়ে ফেলেছ। 

বকুল হেসে বলেছে, তোমার তাই মনে হয়?

ধন্যা বলেছে, মনে হতো না। তোমার কথা শোনার পর এখন মনে হচ্ছে। বকুল বলেছে, আরে আমার কথা অত সিরিয়াসলি নিও না। ঠাট্টা করেও তো বলতে পারি। 

বন্ধুরা সোফায়, সতরঞ্জিতে বসে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করছে। হাতে সফট ড্রিংকস, জুসের গ্লাস। অ্যাপলের সিরি বটকে নোরাহ জোন্সের অ্যালবাম বাজাতে বলেছে ধন্যা। টেবিলে রাখা ছোট গোল ডিভাইস ওমপোডে একটার অপর একটা গান ব্লু জাজের সুরে বেজে চলেছে। বাজনার মধ্যে ধন্যা একবার বন্ধুদের বলেছে, এই কেউ অন্য কিছু শুনতে চাইলে বলো সিরিকে। তার কাছে পাঁচ হাজার বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি গান আছে। 

শুনে তার বন্ধু এলমা চোখ বড় করে বলেছে, ওয়াও। এআই জেনারেটেড ডিভাইস! খুব স্কেয়ারি কিন্তু, স্পুকি তো বটেই। মার্গো দেখেছিস? এআই জেনারেটেড বাড়ি। ফ্রাইডে দা থার্টিন্থকে হার মানায়। হোয়াট হরর!

ধন্যা বলে, অন্যদিন শুনব। আজ আনন্দের দিনে ওসব হরর-টরর বাদ দে। 

অনলাইনে নানা রকমের খাবার এসে গেল রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে। পিজ্জা হ্যাভেন থেকে পিজ্জা মার্গারিটা চারটা। কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন থেকে চার বক্স ফ্রায়েড চিকেন। সিক্রেট রেসিপি থেকে ফ্রায়েড হোল স্যাপার ফিশ। কাবাব, নান, ফ্রায়েড রাইস, আইসক্রিম। টেবিলে আপেল, আঙুর, নাশপাতি তো আছেই ডালাভর্তি। আর হ্যাঁ, আদি বিক্রমপুরের দই।

বন্ধুরা দেখে বলে, আরেব্বাস! সারা রাত লাগবে যে এসব খেতে। 

ধন্যা বলে, তাড়াহুড়া নেই। হোক না রাত। কাল তো ছুটি। ধীরে-সুস্থে খাও। 

সবাই তাই করে। ধীরে-সুস্থে খায়। খেতে খেতে কথা বলে। হাসির কথা কেউ বললে হেসে ওঠে সবাই। সন্ধ্যাটা বেশ মসৃণভাবে রাতের দিকে এগোয়, বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে। ধন্যা ওমপোড সিরির উদ্দেশে বলে, সিরি নাউ প্লে কিতারো মিউজিক। কিতারো। 

সিরি যান্ত্রিক স্বরে বলে, ইয়েস। হিয়ার ইজ কিতারো। 

খাওয়া শেষ হয় রাত ১০টার দিকে। এখন কেক কাটা হবে। কিন্তু বকুলকে পাওয়া যায় না। সে হঠাৎ যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে। ধন্যা বন্ধুদের বলে, মনে হয় টয়লেটে গিয়েছে। এখুনি এসে যাবে। 

কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও বকুল আসে না। ধন্যা খুঁজতে খুঁজতে তাকে ব্যালকনিতে দেখতে পায়। অবাক হয়ে বলে, এই তুমি এখানে? সবাই খুঁজছে। এসো ভেতরে। এখন কেক কাটা হবে। 

বকুল অসহায়ের মতো বলে, তোমরা কাটো না! আমার মাথা খুব ব্যথা করছে। 

বারে তা কেমন করে হয়? তোমার জন্মদিনে তুমি কেক কাটবে না? কী যে বলো! এসো দেখি। বলে সে তার হাত ধরে নিয়ে ঘরে ঢোকে। বন্ধুরা দেখে সহাস্যে বলে, দারুণ দেখালে বটে। জন্মদিনে মান-অভিমান। তোমাদের হানিমুন আর শেষ হবে না মনে হচ্ছে। এখন কেকটা কাটা হোক। আমরা ‘হি ইজ এ জলি গুড ফেলো’ বলি। গত বছর তো বলার সুযোগ পেলাম না। 

কেক কাটার জন্য বকুলকে টেবিলে নিয়ে গেল ধন্যা। বকুলের হাতে প্লাস্টিকের ছুরি তার হাত কাঁপছে, সে চোখ অন্যদিকে রেখেছে। কেকটার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে যেন। 

ধন্যা বকুলের হাত ধরে আছে। ফিসফিস করে বলছে, এই তোমার হাত কাঁপছে কেন? জ্বর এলো নাকি? কেকটা কেটে সোফায় বসো গিয়ে। আমি প্যারাসিটামল নিয়ে আসছি। ঠিক হয়ে যাবে। 

কেকটার দিকে তাকালো বকুল। তার হাত কাঁপা বেড়ে গিয়েছে, চোখ দুটো ক্রমেই বড় হচ্ছে। সে ভয় পাচ্ছে। তারপরই সে হড়হড় করে বমি করে দিল টেবিলের ওপর। 

বন্ধুরা চাপাস্বরে বলল, ঠিক গত বছরের মতো। 

দুই.
শেষটায় পয়সা বাঁচাতে জাহাঙ্গীরনগরের বাসটাতেই উঠে বসল বকুল। কন্ডাক্টর ছেলেটা পুরনো, তাকে দেখে চিনলও। গেট ছেড়ে দিয়ে বলল, অনেক দিন পর আইলেন। বিদেশ গিয়াছিলেন বুঝি?

বকুল হ্যাঁ, না জাতীয় অস্পষ্ট কিছু বলে খালি সিটে গিয়ে বসে। বাস পরিচিত পথ ধরে চলতে থাকে। চেনা ল্যান্ডমার্কগুলো একে একে এসে পেছনে চলে যায়। বাস একসময় আশুলিয়ায় পৌঁছে সে দেখে এই দু বছরে রাস্তার দুদিকে অনেক কিছু বদলেছে। নিচু জমি মাটি ভরাট করে বাড়িঘর উঠেছে, এখনো মাটি ভরাটের কাজ চলছে, বাড়ি-ঘর 

উঠছে। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও দেখা গেল। পানির মধ্যে সাইন বোর্ড মাথা উঁচিয়ে মালিকের নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম জানিয়ে দিচ্ছে। 

বাসের ভেতর বসে থাকা ছেলেমেয়েরা জোরে জোরে কথা বলছে। হেসে উঠছে মজার কথা শুনে, বেশ নিশ্চিন্ত আর নিরুদ্বেগ দেখায় তাদের। কাউকে গম্ভীর হয়ে ভাবতে কিংবা উদাসীন হয়ে বসে থাকতে দেখা গেল না। একদিন সেও ওদের মতো ছিল। উচ্ছল প্রাণখোলা, নিরুদ্বেগ, প্রগল্ভ। তার যে ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল না, তা নয়। অন্যদের চেয়ে যথেষ্টই ছিল। কিন্তু ছাত্রজীবনে যৌথ পরিবেশ অনেক ভারী সমস্যাকেই হালকা করে দিয়েছে, অন্তত যখন একসঙ্গে থেকেছে, তখন সামনে এসে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। ঘাগু পাওনাদারের মতো অপেক্ষা করেছে কখন একা পাবে। তাছাড়া ছাত্রজীবনের বেপরোয়া ভাবটাও কাজ করেছে। সমস্যাকে তুচ্ছ করতে শিখিয়েছে। আচারে-ব্যবহারে, কথায় ভাষা ব্যবহার যে কমন ডমিনেটর সেটা সবার সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করেছে যে একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে যে কথা ভাবার কথা, সে সব ভাবা হয়নি। 

বকুল ভাবছে, এই সময় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল, যেন হঠাৎ ব্রেক কষেছে অথবা উঁচু কিছু পেরুতে হয়েছে। সেই ঝাঁকুনি বকুলের হাতে রাখা প্যাকেটটা, নির্ঘাত নিচে পড়ে যেত যদি না সে দুহাতে জড়িয়ে ধরে রাখত। নিচে পড়ে গেলে বাক্সের ভেতরে যা আছে সেটা অক্ষত থাকত না, ভেঙে যেত, দুমড়ে-মুচড়ে যেত, হয়তো গলেও যেত কোথাও কোথাও। সে এক বিশ্রী কাণ্ড হতো। তার এই যাওয়া, অবাক করে দেওয়ার পরিকল্পনা সব ভেস্তে যেত। ভাবতেই কুঁকড়ে যায় সে দুশ্চিন্তায়, সতর্ক হয়ে ধরে রাখে বাক্সটা, যেন কোনোক্রমে পড়ে না যায়। এমন তো না যে সে এই ধরনের বাক্স যখন-তখন হাতে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে যায় সারপ্রাইজ দিতে। এবারই খেয়াল হলো এভাবে গেলে হয়তো মেয়েটির মন খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠবে। একসঙ্গে অনেক কথা বলতে গিয়ে আটকে যাবে গলায়। তারপর হাতে নিয়ে বলবে কী যে পাগলামি করিস! এই খরচের দরকার ছিল? ফুচকা নিয়ে লেকের পাড়ে গিয়ে খেতে খেতে গল্প করতাম দুজন। অথবা বলবে, এই চল না এটা নিয়ে ঝিকরগাছা গিয়ে সবাইকে অবাক করে দিই। তারপরই হাত-মুখে শ্রাবণের কালো মেঘ এনে বলত, এখন তো বাইরে কোথাও যাওয়া যাবে না। ঝিকরগাছাতেও না। আমরা দুজনই বেকার। তারপর ধমক দেওয়ার মতো করে বলত, আর তুই কিনা এই বাক্স নিয়ে এসেছিস আমাকে সারপ্রাইজ দিতে? তোর মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায় এখনো। 

গেটের কাছে বাস থামে, সবাই হুড়মুড় করে নামে। বকুল অপেক্ষা করে। সবাই নামার পর সে নামবে। না হলে কন্যাদের ধাক্কাধাক্কিতে বাক্সটা এতদূর এসে নিচে পড়ে ভেতরে যা-তা হয়ে যাবে। সে একদম শেষে নামবে। এখন সকাল ১০টা, এমন কিছু বেলা হয়নি। আর হলেই বা কী, শিউলির তো ক্লাস নেই। কবেই রেজাল্ট বেরিয়েছে। হোস্টেলে না, গেটের কাছে ছাপরা ঘরে মেস করে থাকে। তার রুমমেটরা অবশ্য এখনো পড়াশোনা করছে। শিউলির পড়াশোনা শেষ, চাকরি খুঁজছে। এর মধ্যে তার এক সহপাঠীর সঙ্গে বেশ কয়েক বছরের ভাবের পর বিয়েও করে ফেলেছে। ছেলেটা অবস্থাপন্ন পরিবারের- বলেছে শিউলি। বেশ কালচার্ড ফ্যামিলি। সব ভাই-বোন পড়াশোনা করে। ছেলেটা সবার বড়। সমস্যা হয়েছে ছেলেটার মা-বাবাকে নিয়ে, তারা শিউলিকে ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। ছেলেটার নাম সুমন, তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বকুলের। ভালো স্বভাবের বলেই মনে হয়েছে তাকে। তবে একটু যেন মনে সাহসের অভাব। লাজুক স্বভাবের, আজকাল ছেলেদের মধ্যে যা দেখা যায় না। এটাকে প্লাসপয়েন্ট হিসেবেই দেখেছে বকুল। তাকে নিয়ে শিউলির দাম্পত্য জীবনে কোনো সমস্যা হবে না। 

বকুল জিজ্ঞাসা করেছে শিউলিকে, সুমনের মা-বাবা তাকে ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করতে চান না কেন?

শিউলি নিজের দুহাত দেখতে দেখতে বলেছে, কালো, সেই জন্য। 

বকুল অবাক হয়ে বলেছে, তুই বলেছিস- ওদের কালচার্ড ফ্যামিলি। অমন ফ্যামিলিতে এসব ভাবে? বলিস কী? আর তুই তো কালো নস, শ্যামলা। তোর চেহারা খুব শার্প। পাওলি দামের মতো। সেই বড় বড় চোখ। 

শিউলি বলেছে, রঙটা মনে হয় অজুহাত। অন্য কিছু চায়। যখন জেনেছে কিছু পাওয়া যাবে না, অমত জানিয়েছে। 

বকুল বলেছে, ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে। কাজি অফিসে কাবিন হয়ে গিয়েছে। এখন তারা অমত করে কী করবেন? সুমন তোকে নিয়ে আলাদা থাকবে। সে তো আর বাচ্চা ছেলে না, নিজের মনমতো চলার বয়স হয়েছে তার। হুঁ! কালচার্ড ফ্যামিলি না ছাই। 

শিউলির মেসের সামনে বেশ কিছু ছেলেমেয়ের ভিড়। তারা কি তাকে শুভেচ্ছা জানাতে চলে এসেছে সকালেই? আহা! তার আর একটু আগে আসা উচিত ছিল। তা হলে সবার আগে সেই শুভেচ্ছা জানাতে পারত। যাক, খুব একটা দেরিও হয়নি। সবার সামনে খোলা হবে বাক্সটা। 

দরজাটা একটু আগে পুলিশ ডেকে ভাঙা হয়েছে। বকুল ভেতরে ঢুকে প্রথমেই দেখতে পায় দুটো পা ঝুলছে। কালো রঙের পায়ের গোড়ালি থেকে সরল রেখায় আলতা লাগানো। বেশ কিছুদিন আগে লাগানো মনে হয়, রঙ ফিকে হয়ে এসেছে। 

বকুলের হাত থেকে বাক্সটা ছিটকে পড়ে মেঝেতে। তার মুখ থেকে একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসে, শিউলি!

কুপার্স- লেখা বাক্সটা মেঝেতে পড়ে খুলে যায়। ভেতরে খয়েরি রঙের চকোলেট কেকের ওপরে লেখা নামটা ভেঙে গিয়েছে। শুধু সাদা ক্রিমের কিছু রেখার ভেতর হরফগুলো এলোমেলো দেখা যায়। 

তিন.
পত্রিকা অফিসে বকুলের কাজটাকে ঠিক চাকরি বলা যায় না। তার অফিসের টাইম বলতে কিছু নেই। যখন কাজ আছে বলে মনে করে নিউজ এডিটর তাকে ডাকেন অফিসে। কোনো ইংরেজি খবর 

থাকলে অনুবাদ করতে দেন। সেই কাজের জন্য স্টাফ আছে দুজন। তাদের একজন না এলে তার ডাক আসে। এভাবে মাসে সাত-আট দিন চলে কাজ পত্রিকা অফিসে। এর জন্য যে টাকা পাওয়া যায় তা অনিয়মিত আর বেশ অল্প। আরও একটা চাকরি করে সে, বাংলাবাজারে এক প্রকাশকের দোকানে বইয়ের প্রুফ দেখা। সেটাও নিয়মিত না, বই ছাপার জন্য এলে ডাক পড়ে। প্রকাশক একবারের বেশি একটা বই প্রুফ দেখতে বলেন না, ভুল থাকতে পারে জেনেও ছেপে দেন। বলেন, এত খরচ করে বই ছাপা যাবে না। দুই জায়গায় এই ছুটা কাজ থেকে যে টাকা পায় তাতে মেসের ভাড়া দিতেই কুলায় না, রোজ খাওয়া হয় কি হয় না, এমন অবস্থা তার। অথচ জার্নালিজমে সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। ইউনিভার্সিটিতেই তার চাকরি পাওয়ার কথা, কিন্তু রাজনীতির জন্য পায়নি। 

এদিকে শিউলির ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। সেও চাকরি খুঁজছে হন্যে হয়ে। কিন্তু তার পড়ার বিষয়টা ছিল এনথ্রপোলজি, চাকরির বাজারে যার কোনো চাহিদা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে তো পছন্দ করে পড়েনি এই বিষয়, ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখে তাকে এই ডিপার্টমেন্টে পড়তে দেওয়া হয়েছে। সাবজেক্টটা মন্দ না, পড়তে ভালোই লেগেছিল। পরীক্ষায় তার ফলও ভালোই, সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট, অল্পের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। সে এখন হোস্টেল ছেড়ে ক্যাম্পাসের বাইরে আরও তিনজন ছাত্রীর সঙ্গে মেসে থাকে। ক্যাম্পাসে এক অধ্যাপকের স্কুলের মেয়েকে পড়ায়। যে বেতন পায় তাতে চলে না, বকুলের মতোই আধপেটা খেয়ে, কোনোদিন বা না খেয়ে থাকে। বকুলকে কয়েকবার বলেছে, ভাইয়া আমার জন্য ছোট একটা চাকরি জোগাড় করে দে। এভাবে আর পারছি না। 

শুনে বকুলের হাসির সঙ্গে কান্নাও পেয়েছে। সে-ই শিউলিকে ঝিকরগাছা থেকে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিতে বলেছিল। শিউলি চেয়েছিল ঝিকরগাছা কলেজেই পড়তে। তা হলে বাবার ওপর কম চাপ পড়ত। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলমাস্টার দুই ছেলেমেয়েকে ঢাকায় রেখে পড়াবেন কী করে? শুনে বকুল বলেছিল, টিউশনি করবি। আমি যেমন করি। মাসে দুটো করা যায়, তাই দিয়ে চলে মোটামুটি, বাকিটা বাবা পাঠাবেন। শিউলি তার কথায় রাজি হয়েছিল। বলেছিল, তা হলে তো ভালোই হয়। দুই ভাইবোন কাছাকাছি থাকব আর একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাব। সারাজীবন তো ঝিকরগাছাই থেকে গেলাম, যার একমাত্র সুনাম হলো এখানকার মেয়েরা বাংলাদেশের অন্য সব জেলার চেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে। বলে সে হেসেছিল। 

সুমন ছেলেটার সঙ্গে শিউলিকে কয়েক দিন দেখার পর সে জিজ্ঞাসা করেছিল কেমন বন্ধু সে। খুব ঘনিষ্ঠ, না ক্যাজুয়াল, কয়েকজনের মধ্যে একজন। শুনে শিউলি বলেছিল, আমাদের মধ্যে এখনো কোনো রিলেশনশিপ গড়ে ওঠেনি, তবে তেমন হতে পারে। 

বকুল বলেছিল, আমি আর কী বলব! বয়সে তোর বড় হলেও তুই তো আর কচি খুকি নোস। নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। দেখিস যেন ভুল করে না বসিস। আবেগ-টাবেগের কোনো মূল্য নেই আমাদের জীবনে। 

শিউলি অবাক হয়ে বলেছিল, আমরা মানুষ। আবেগ ছাড়া মানুষ হয় নাকি?

বকুল বলেছিল, আমি আমাদের কথা বলেছি। আমাদের মতো ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে-মেয়ের আবেগ থাকা বিলাসিতা। আমাদের খুব সতর্ক হয়ে চলতে হয়। সেই জন্য বললাম। 

শুনে শিউলি আর কিছু বলেনি। 

কিছুদিন পর বকুল বুঝতে পেরেছে শিউলির এখন ফেরার উপায় নেই। সে ভেবেছে, বেশ তো ছেলেটার ওপর নির্ভর করা যায়, এটা যদি শিউলি মনে করে থাকে তা হলে সে কেন বাদ সাধতে যাবে? সে বড় ভাই হিসেবে যেটুকু বলার তা বলেছে। এর বেশি বললে শিউলি শুনবে কেন? তার নিজের বিচার-বুদ্ধি আছে। আর কে না জানে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অভিজ্ঞতায় এক ধাপ এগিয়ে। তারা খুব একটা ভুল করে না। 

একটা বিদেশি এনজিওতে ইন্টারভিউ দিয়েছিল বকুল, হবে না জেনেও। আজকাল কোথাও কানেকশন না থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন। তবু দেওয়ার তাই দিয়ে দিল। যেদিন চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেল, তার বিশ্বাসই হতে চায় না। ৫০ হাজার টাকা বেতন, বছরে এক মাস ছুটি। অফিসের গাড়িতে যাওয়া-আসা। এ যেন সব স্বপ্নে দেখা। ফোন করে নিশ্চিত হয়ে সে প্রথমে ফোন করে জানিয়েছে বাবাকে। তারপর ফোন করেছে শিউলিকে। তাকে বলেছে, আর কোনো চিন্তা নেই। তুই যে পর্যন্ত চাকরি না পাবি, অথবা তোদের বিয়ে না হবে, আমার সঙ্গে থাকবি তুই। ভাই-বোনে মিলে বেশ থাকব একসঙ্গে। শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছে শিউলি। তারপর বলেছে আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। 

শুনে আকাশ থেকে পড়েছে বকুল। বলেছে, বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বলিস কী? কেউ জানল না। কোনো অনুষ্ঠান হলো না। এভাবে বিয়ে হয়?

শিউলি বলল, সুমন মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে বিয়ে করেছে। বলেছে, এ ছাড়া আমাদের একসঙ্গে থাকার উপায় নেই। 

বকুল বলল, তুই আমাকেও জানালি না!

শিউলি চুপ করে থেকে বলল, সময় ছিল না। সুমনের মাথায় রোখ চেপে গিয়েছিল। বলেছিল, কী মনে করে মা-বাবা? তারা আমার জীবন ঠিক করবে? হতে পারে না। চলো আমরা আজই বিয়ে করব। এভাবেই বিয়েটা হয়ে গেল ভাইয়া। বলে সে কেঁদে ফেলেছিল। 

বকুল বলেছিল, বেশ। যা হবার হয়েছে। আমি আসব একদিন তোদের সঙ্গে কথা বলতে। সুমন তো এখনো ক্যাম্পাসেই মা-বাবার সঙ্গে থাকে তাই না?

শিউলি বলেছে, হ্যাঁ। সে ঢাকায় চাকরি খুঁজছে। পেলেই আমরা ঢাকায় চলে যাব। 

- শিগগির চাকরি পাবে?

শিউলি বলল, ওর এক মামা এমপি। তিনি ব্যবস্থা করছেন। 

বকুল বলেছে, বেশ। বাবাকে কখন বলবি?

শিউলি বলেছে, আমরা ঢাকায় যাওয়ার পর। 

চার.
মাসের প্রথম বেতন পেয়ে কুপার্সে গিয়ে ব্ল্যাক ফরেস্টের কেক কিনল বকুল। কেকের প্যাকেট নিয়ে সে জাহাঙ্গীরনগর যাওয়ার বাসে উঠল। পেছনের সিটে বসে কোলে কেকের প্যাকেট নিয়ে বসে থাকল সে। তার মুখে মৃদু হাসি, দুষ্টুমি করার আগে যেমন হয়ে থাকে। শিউলিকে দারুণ একটা সারপ্রাইজ দেওয়া হবে। আজ শিউলির জন্মদিন। তারা ভাই-বোন কেউ জন্মদিন পালন করে না। কিন্তু শিউলির জন্মতারিখ তার বেশ মনে আছে। কেকটার ওপর বড় করে তার নাম লেখা হয়েছে। দেখে শিউলি খুশি হবে। এই প্রথম তার জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। খুব বড় সারপ্রাইজ দেওয়া হবে তাকে। 

বকুলের মুখের মৃদু হাসি বড় হয়ে যায়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //