শৈলী অভিসন্ধিকা

‘ইউ অনলি সি হোয়াট
ইওর আইজ ওয়ান্ট টু সি,
হাউ ক্যান লাইফ বি হোয়াট
ইউ ওয়ান্ট ইট টু বি
ইউ আর ফ্রোজেন হোয়েন ইওর হার্টজ নট ওপেন’

ম্যাডোনার ফ্রোজেন গানটা খুব লো ভলিউমে বাজছিল আইপডে। এই গানটা শুনলে শাকিলার বুকের ভেতরটা কেমন হু-হু করে ওঠে। সে কবে থেকে ফ্রোজেন হয়ে আছে! হার্টজ, আইজ কোনো কিছুই খোলা হলো না। অথচ লোকে হয়তো ভাববে এটা তার দুঃখ বিলাস। একটু নাক সিটকানো ভাব নিয়ে বলবে, ‘পয়সাওলাদের কত রকম ন্যাক থাকে! সব পাওয়া হয়ে গেলে যত এক্সট্রিম নিডসের দিকে আগাবে তত এসব আলগা হাহাকার এসে গড়াগড়ি খাবে।’ কিন্তু কে বুঝবে তার কথা! 

বাথটাবে উষ্ণ গরম পানিতে শুয়ে থাকা এই সময়টার সুখ-দুঃখগুলো একান্ত তার নিজস্ব শূন্যতার। যার সঙ্গে হয়তো কোথাও কেউ, বা কিছু জড়িয়ে আছে বা নেই। সাবানের বুদ্বুদগুলোকে দুহাতে সরিয়ে দিতে দিতে নিজের স্পষ্ট হয়ে ওঠা শরীরের দিকে তাকিয়ে ভাবে এ সময়ে ডোপামিন লেভেলটাও কি বেড়ে যায়! মধ্য চল্লিশেও তার চমৎকার শরীর তাকে আন্দোলিত করে। কোথাও এখনো বয়সের ছাপ পড়েনি। টান টান সুডৌল। শ্যাগি নয় একেবারেই। তার অন্য বান্ধবীদের মতো লেজার ট্রিটমেন্টও নিতে হয়নি কখনো। থাইয়ের মসৃণ ত্বকে এক চমৎকার দ্যুতি। অথচ বিয়ের পাত্রী হিসেবে চটকদার ইমেজ ছাড়া এই রূপ বা সৌন্দর্য, কোনো কিছুই ম্যাটার করল না কোনোদিন। তার মহাব্যস্ত শিল্পপতি হাসব্যান্ড তাকে সময়ই দিতে পারল না সেভাবে। ব্যস্ত বলে এতটা আনরোমান্টিক হতে হবে! দেখতে যতটা হ্যান্ডসাম, লাভমেকিংয়ে ততটাই সাদামাটা। কখনো স্ত্রীকে নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। কোনোদিন সামনে থেকে বা পেছন থেকে এসে জড়িয়েও ধরেনি কারণে, অকারণে। যেন মেমোরিতে কতকগুলো কোড সেট করে দেওয়া একটা রোবট। শাকিলার ভেতরে যে কী এক তৃষ্ণা রয়ে গেল জীবনভর! বলতে গেলে বিত্তের সুখের কাছে অর্গাজমের পুলক বন্ধক রেখে কাটিয়ে দিয়েছে। 

স্টুডেন্ট লাইফের এক্সদেরও খোঁজ ছিল না ওই সময়ে। 

কোথায় কে! ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের সময়ের ছেলেগুলো খুব প্রিমিটিভ ধরনের। আর কম বয়সের ছেলেগুলো এরকমই হয়। প্রেমিকা বিয়ে করছে, ‘তো সে প্রতারক, বেওয়াফা। তার ছায়াও মাড়ানো যাবে না।’ নতুন কাউকে জোটানোর মতো মনও ছিল না তার। যদিও হাতছানি ছিল। কিন্তু শাকিলার মন সায় দেয়নি। সে আসলে তার সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছে। যত দিন তার সঙ্গী বিশ্বস্ত থাকবেন। 

তবে তার স্বামী কি তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত! তাকে সব সময় এক ধরনের নজরদারির মধ্যে রাখেনি? এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। একা পার্টিতে যাওয়া যাবে না। সোশ্যাল মিডিয়া এভাবে ইউজ করতে হবে, কোনো ব্যক্তিগত আলাপ সেখানে করা যাবে না। হালকা রসিকতা একদম না! আরও কত কত অলিখিত বন্ধন!

আর যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন হঠাৎ, তখন যেন এক তাড়াহুড়োর মধ্যে পড়ে যান। এত উন্নত চিকিৎসা- তারপরও ধরেই নিয়েছিলেন তিনি আর বেশদিন বাঁচবেন না। জেনেটিক্যালি তাদের নাকি আয়ু কম। তাছাড়া এত কম বয়সে তুমুল স্ট্রাগল করে এত বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হতে হয়েছে, জীবনের ওপর দিয়ে প্রেশার তো কম যায়নি। তাই সময় ফুরিয়ে আসার আগেই তিনি শাকিলাকে প্রতিদিন হাতে-কলমে ব্যবসার সব খুঁটিনাটি বুঝিয়ে গেছেন। লন্ডনে চিকিৎসা নেওয়ার সময়, সুইজারল্যান্ডের বাড়িতে হাওয়া বদলের সময়, যতটা সময় পাওয়া যায়, শাকিলা ট্রেনিংয়ের ওপর থেকেছে। সেবা-টেবা যা করার মেইড, নার্স- এরাই করেছে, শাকিলা সে অবসরও পায়নি। আর যখন চলে গেলেন তখন চার বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার ভার। শুরুর দিকে দুই বছর তার দম ফেলার সময় ছিল না। এক পা মাটিতে তো আরেক পা প্লেনে। 

গত তিন মাস সে একটু ফ্রি। বড় মেয়ে নাতাশাকে বিয়ে দেওয়ার পর জামাই আসায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। ছেলে তাদের আগে থেকেই পছন্দ করে রাখা। শুধু বিদেশের একটা বড় কোম্পানিতে ইন্টার্ন শেষ করে আসতে দু বছর সময় নিতে হয়েছে। তাও এই ব্যবসারই স্বার্থে। 

তবে শাকিলা এক ধরনের অপরাধবোধে ভোগে। তার মেয়েটাকে হয়তো একটু বেশিই স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। সে তার জীবনে নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে তো! মাত্র কুড়িতেই বিয়ে। তার ওপর বরের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য। বিয়ে মানুষকে ঠিক কী দেয়! একটা বন্ধনের সঙ্গে সম্পর্কিত কতকগুলো রেসপনসেবিলিটি? নাতাশার জন্য তো বিষয়টা আরও স্পষ্ট। কিন্তু সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। বিষয়টাকে সে খুব স্বাভাবিকভাবে না নিলে বরং শাকিলাকে ঝামেলায় পড়তে হতো। তাছাড়া এই বয়সের মেয়েদের কাছে বিয়েটা হয়তো একটা ফ্যান্টাসি। শাকিলারও কুড়িতে বিয়ে হয়েছিল। তখন তার কাছে বিয়েটা ফ্যান্টাসি মনে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধারণাটা বদলে গেছে। তাই সে কখনো চায়নি মেয়েটার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হোক। কিন্তু নিয়তি খণ্ডাবে কে! 

এর মধ্যে পঙ্কজ উদাস দরাজ গলায় গেয়ে উঠেছেন, ‘নিকলো না বে নাকাব জামানা খারাব হে।’ শাকিলা শাওয়ারের নিচে ভিজতে ভিজতে ভাবছে, জামানা কি সত্যিই খারাপ এখন? মোরাল পুলিশিং বিষয়টা কি ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে! নারীর পোশাকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মেয়েরা একটু আধুনিক, কম্ফোর্টেবল পোশাক পরে তার গণ্ডির বাইরে বের হলেই ফিজিক্যালি, ভারবালি হ্যারাজড হচ্ছে। একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে বিষয়টা যে তাকে ভাবাচ্ছে না তা নয়। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে তার ডিজাইনের যে ধরন সেটা নিয়ে সে কতটা সফল হতে পারবে! যদিও এই সময়ে দাঁড়িয়ে এ দেশের ফ্যাশন ডিজাইনারদের পক্ষে ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের টিকি ধরাও সম্ভব হবে না। পুঁজিবাজারের রাজনীতি ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড কন্ট্রোল করে। পোশাকের রাজনীতি বরাবরই ছিল। নারীকে ঢেকে রাখা বা উন্মুক্ত রাখার রাজনীতি পুরুষতান্ত্রিক ট্রেড মার্কেটগুলো জিইয়ে রেখেছে। কিন্তু বে-নেকাব বের হলে যে নারীকে পিতৃতন্ত্রের মগজধোলাই করা নারীদের দ্বারাই হেনস্তা হতে হচ্ছে এটা খুব দুঃখজনক। এখানকার পিতৃতন্ত্র নারীকে প্রয়োজনের তাগিদে বাইরে যেতে দিচ্ছে ঠিকই, তবে যত তারা বের হচ্ছে তত তাকে কাপড়ের পুঁটলিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

কপালে একটা দুশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে হাউজকোটটা গায়ে জড়াতে জড়াতে টের পায় পা বেয়ে নামছে উষ্ণ সরু এক স্রোত। এই যাহ্! শুরু হয়ে গেল! এখন আর পিরিয়ড আগের মতো রেগুলার নেই। দুই-তিন মাস গ্যাপ দিয়ে হয়। কিন্তু যখন হয় তখন শাকিলার ভেতরে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে। কিন্তু এমন কেন হবে! অথচ এক সময় এই তিন বা পাঁচ দিন কত অস্বস্তির, কত বিরক্তিকর ছিল তার কাছে। এখন তাহলে বিরক্তিটা বদলে গেল কেন? শুধু কি ফুরিয়ে না যাওয়ার অনুভূতিতে! নাকি শারীরিক কিছু স্থায়ী জটিলতায় এখনি ঢুকে পড়ছে না বলে! তবে আজ তার ছুটি। আজ আর অফিস যাবে না ঠিক করল সে। নিজেকে নিজে ছুটি দিয়ে এক পাক নেচে নিল আপন মনে। তারপর বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ল্যাপটপটা ওপেন করল। 

বেশ কয়েকটা মেসেজ এসেছে তার পেজে। পেজে মেসেজ হামেশাই আসে। শাকিলা এগুলোর সরাসরি জবাব দেয় না। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট পাভেলের এই কাজগুলো করার কথা। ছেলেটা এখন ছুটিতে থাকায় সে নিজেই মেসেজ দেখতে বসেছিল।

এর মধ্যে জিমি আজীম নামের একজন লিখেছে, ক্যান আই টক টু ইউ ম্যাম?

প্রো পিক ও নামটা কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোনো পার্টিতে কি দেখেছে লোকটাকে!
শাকিলা রিপ্লাই দিল, ইয়েস ইউ ক্যান।
- আপনার বিকিনিগুলো দেখলাম ম্যাম, বেশ ভালো লেগেছে।- আমার না, ওগুলো আমার ডিজাইন করা বিকিনি।
- ওহ স্যরি, আপনার ডিজাইন করা। আমি আসলে আপনাকে নক করেছি এজন্য যে, আমি আপনার ডিজাইনের প্রোডাক্টগুলো নিতে চাই।
- আপনি অফিসিয়ালি একটা মেইল  দিলে ভালো হয়। কোম্পানির নাম, কোন দেশ থেকে নিতে চাচ্ছেন ডিটেইলসটা উল্লেখ করবেন, ধন্যবাদ।
- ওহ ম্যাম, আমি বাংলাদেশ থেকে নিতে চাই। আমাদের ই-রিটেইল শপের জন্য।
- বাট আমি তো শুধু ডিজাইন করেছি। এখনো প্রোডাকশনে যাইনি। আর আমার টার্গেট ফরেন বায়ার। দেশি ই-রিটেইল মার্কেট নয়। সে ক্ষেত্রে আমি হয়তো প্রোডাকশনে যাব না, স্যরি।
- আপনি চাইলে কিন্তু প্রোডাকশনে যেতে পারেন।
- বললাম না, এই পোশাকের ক্ষেত্রে আমি দেশি মার্কেটের কথা ভাবিনি। বাই দ্য ওয়ে, বাংলাদেশের রিটেইল শপ থেকে বিকিনি কে কিনবে? কেনই বা কিনবে!
- আমি আপনার সঙ্গে এই বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চাই।
- আপনার যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমরা একটা মিটিং করতে পারি? আপনি চাইলে আমি আপনার অফিসেও আসতে পারি, আবার আমরা রেডিসন ব্লুতে বসতে পারি। অ্যাজ ইউ উইশ!
- ওকে, আমি আপনাকে ভেবে জানাচ্ছি।
- থ্যাঙ্কইউ ম্যাম, আশা করছি খুব দ্রুত আমাদের দেখা হবে।

দুই.
ফ্যাশন ডিজাইনিং শাকিলার হবি। পুরীর ফ্যাশন ডিজাইনিং ইনস্টিটিউটে পড়তে পড়তেই তার বিয়ের ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। শেষে  কোর্সটা শেষ না করে, অসম্ভব সেক্সি বয়ফ্রেন্ডকে বিদায় বলে, তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল। বয়ফ্রেন্ড যে সেক্সি ছিল, এই ধারণা তখন তার ছিল না, ধারণা হয়েছে রিয়েল লাইফ গাড্ডায় পড়ে। যা-ই হোক, পরে দেশে ফিরে তাকে আবার গোড়া থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট শিখতে হলো। তবে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ভূতটা তার মাথা থেকে নামেনি। তবে তার হাসব্যান্ড নানা কৌশলে তাকে এই কাজটা নিয়ে আগাতে দেয়নি। 

তাকে ক্রমাগত খটোমটো টিএমটি স্টিল ইন্ডাস্ট্রি সামলাতে ইনসিস্ট করে গেছে। মাথার মধ্যে যখন স্টিল, তখন রেশমি কাপড় সে ধাক্কা সামলাতে পারেনি। শখের ফ্যাশন ডিজাইনিং ওখানেই কাত। 

তবে ইদানীং ভেবেছে এটাকে একটা সিস্টার কনসার্ন হিসেবে দাঁড় করাবে সে। সেজন্য সে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়েছে পাভেলকে। পাভেল মূলত একজন র‌্যাম্প মডেল। দেখতে সুন্দর বলা যায়। টল, ডার্ক, সিক্স প্যাক, বাইশেপ সব আছে, তবে যা নেই তা হলো- এনাফ ইন্টেলিজেন্স।

পাভেলকে দেখে শাকিলার বান্ধবী রুমানা ইঙ্গিত করে বলে, ভালোই তো জোটাইছো!

শাকিলা একবার ভাবে এই কথার কোনো জবাব দেবে না, আবার ভাবে যে ঘটনা ঘটেনি, বা ঘটবে না, তার একটা ব্যাখ্যা থাকা ভালো। তাই সে বলে, তুই যা ভাবছিস তা না। এটা হলে হয়তো মেন্টাল রিল্যাক্সের একটা ব্যাপার থাকত। বাট এই ধরনের ছেলেরা টাইপড। ওরা যতই আধুনিক হোক, বয়সের পার্থক্য ১০-১৫ বছরের হলে সে নারী যতই আকর্ষণীয় হোক, ওদের কিছু এসে যায় না। আর তাছাড়া চেহারা সুরতে যতটা, মেন্টালি ততটা স্মার্ট না সে।
- তার মানে বাজাইয়া দেখছোস।
- বাজাইয়া দেখার কিছু নেই। হাঁড়ির ভাত একটা টিপলেই বোঝা যায়।

রুমানাটা বেশি কথা বলে, বলেই চলে, অন্যের জীবনের কোনো একটা দুর্বলতা পেল তো নাকটা সেখানে গলিয়ে গলিয়ে তার শোক প্রকাশ করবেই।
- শাকিলা শোন, তোর যা অবস্থা!
- কী অবস্থা?
- জীবনে তো সুখ পাইলি না।
- তোকে কে বলল?

কোনো দুর্বল মুহূর্তে সে কি রুমানাকে বলেছিল কিছু! এখন ঠিক মনে করতে পারছে না। 

রুমানা যেন তার মনের প্রশ্নটা শুনে ফেলেছে এমনভাবে বলল, সব কথা বলতে হবে কেন! আমি কি বুঝি না! তুই একটা স্টিল ইন্ডাস্ট্রির অ্যাকটিং চেয়ারম্যান, অথচ তোর মাথায় ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ভূত। একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ মানুষগুলো ফ্যাশনের প্রতি অবসেসড হয়। তুই তোর লাইফ স্টাইলে ফ্যাশন সচেতন হয়েও হ্যাপি না, সেই টিনএজের একটা শখকে এখনো জিইয়ে রাখছিস। তুই আসলে না বললেও আমি বুঝি, মানসিকভাবে তুই একা, সবার মধ্যে থেকেও একা! বিসাইড দ্যাট আমার সব সময় মনে হয়েছে তুই সেক্সুয়ালিও অবসেসড।
- স্টপ! আর কোনো কথা না।
- আমি এগুলো বলতাম না, বলার কথাও না, তবে শোন, তোকে একটা ভালো বুদ্ধি দেই।
- তোর বুদ্ধি দেওয়া মানে তো সেই!
রুমানার চোখে দুষ্টুমির হাসি, আরে শোন না কথাটা- ইউ আর স্টিল ইয়াং অ্যান্ড সেক্সি।
- তুই থামবি?
- এই যে ম্যাসাজ নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার্লারে শুয়ে থাকোস, তা না করে তুই বরং একজন ক্লীব নিয়োগ দিতে পারিস। ডলাই মালাই সাকিং ইত্যাদি চলবে, বাট কাজের কাজ কিছু না। ফারাওদের হেরেমে থাকত না! খুশবন্ত সিংয়ের লেখায়ও এদের দেখা পাওয়া যায়। 

শাকিলা এবার রেগে যায়, যতটা সম্ভব বিরক্তি ঝরিয়ে বলে, তুই আমাকে কী ভাবিস বল তো?

রুমানা দমবার পাত্রী নয়, সে নব উদ্যমে বলে, আরে শোন না, থাইল্যান্ডের ম্যাসাজ পার্লারগুলোতে কি পুরুষ কর্মী আছে? যদিও ওদের দেখলে পুরুষ না, প্লাস্টিক বেশি মনে হয়!
- তুই থামবি না বুঝতে পারছি। ঠিক আছে বল, বলে বলে শান্তি পা।
- আচ্ছা শোন তোর জায়গায় যদি কোনো পুরুষ থাকত, সে বিয়ে না করলেও হেরেমখানা কানায় কানায় ভরে রাখত না?
- সব মানুষকে যৌনতার মানদণ্ডে মাপতে হবে কেন? এই আকর্ষণের বাইরেও তো কিছু থাকতে পারে। স্রেফ বন্ধুত্বও অনেক সময় মানসিক প্রশান্তি নিয়ে আসতে পারে। আমি আসলে ওরকম কাউকে ভাবছি। যে হবে উচ্ছল, প্রাণবন্ত, বুদ্ধিদীপ্ত।

তিন.
পাভেলকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেটা সে খারাপ করে না। চলে আর কি! ইদানীং সে প্রায়ই ঘ্যান ঘ্যান করছে একটা ফ্যাশন শো অরগানাইজ করার জন্য। একটা ফ্যাশন শো অরগানাইজ করা মানে বিরাট ঝক্কি। একই সঙ্গে মডেল, মেকআপ আর্টিস্ট, স্পন্সর, মিডিয়া, ডিজে সব একা হাতে সামলানো। পাভেল যদি না পারে! পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে যাবে। তবে কোনো একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দিলে হয়তো এতটা চিন্তা হতো না, কিন্তু ক্লথিং ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে যে ডিজাস্টার বয়ে গেছে, তাতে এত টাকা খরচ করার মতো বোকামি করা যাবে না। সদ্য প্যানডামিক পেরিয়ে যাওয়া সময়ে যেখানে গ্যাপ, বারবেরি, ক্যালভিন ক্লেইনের মতো ব্র্যান্ডগুলো ব্যাংকরাপ্টসি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে অ্যাক্সেস নেওয়া অত সহজ হবে না। তার ওপরে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। ডলারের দাম হু-হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এ সময়ে মূল ব্যবসার হাল শক্ত করে না ধরে এসব শখের খোরাক জোগানো যাবে না। মেয়ে-জামাই কী ভাববে! শাশুড়ি দেউলিয়া হওয়ার উৎসবে মেতেছে!

তার শখের দাম কেউ দেবে না। মেয়ে তো বলেই, এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারপারসন। এতগুলো বিজনেস উইং। সিআইপি স্ট্যাটাস এনজয় করো, সোসাইটিতে এমনকি মিডিয়াতেও তো তোমার গুরুত্ব কম না! তার ওপর তোমার এ কী অদ্ভুত খেয়াল মম!

- ওই যে বললি, সিআইপি স্ট্যাটাস এনজয় করি, তার মানে ওউন করি না। আমি এমন কিছু এনজয় করতে চাই, যা আমি ওউন করি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়।

মায়ের যে ব্যক্তিত্বের ধার ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, তাতে এই কথার পরে আর কথা বাড়ানোর সাহস নাতাশা দেখায় না।

তবে শাকিলার মনে একটা খটকা ঢুকে যায়, মেয়ে কি তাহলে বড় হয়ে যাচ্ছে? কথাগুলো কি তার, নাকি জামাইয়ের শিখিয়ে দেওয়া!

মনে মনে হাসে শাকিলা, জামাই আর কত দিন শেখাবে, বা শেখাতে পারবে! নাটাই তো তার হাতে। সে নিজেই এখন তার নিজস্ব আইডেন্টিটিতে জোর দিতে চাচ্ছে তাই অন্য বিষয়গুলোতে জোর দিচ্ছে না। জীবনে নিজের চাওয়ারও গুরুত্ব দিতে হয়। জীবন মানে তো শুধুমাত্র কতকগুলো রেসপনসেবিলিটি বয়ে নিয়ে যাওয়া না!

চার.
একজন স্ট্রাগলিং ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে শাকিলাকে একদিকে পোশাকের ডিজাইনের দিকে যেমন প্রতিনিয়ত নজর রাখতে হয়, তেমনি নজর দিতে হয় ব্র্যান্ডিংয়ের দিকেও। তার টার্গেট ইন্টারন্যাশনাল বায়ার। ডোমেস্টিক বায়ার ঠিক তাকে ধারণ করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক মানের পোশাক ডিজাইনের চেষ্টা এদেশে বেশ কয়েকজন ডিজাইনার করে যাচ্ছেন। কিন্তু বিনোদন মিডিয়াটা ইন্টারন্যাশনালি রিচ করতে না পারায় দেশের ফ্যাশন ডিজাইনাররা ক্লিক করতে পারছেন না। একমাত্র বিবি রাসেল অ্যাজ এ ডিজাইনার ব্র্যান্ডিংয়ে কিছুটা সফল হলেও বাকিরা গার্মেন্টসগুলোতে অন্যের ডিজাইনের নির্দেশনা মেনে ঘাড় গুঁজে কাজ করে চলেছে। 

শাকিলার এক সময়ে নিজস্ব ব্র্যান্ড দাঁড় করানোর ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু নিজস্ব ব্র্যান্ড আর দাঁড়াল কই! 

তবে মেয়ের সঙ্গে সেদিনের ওই ঠান্ডা তর্কটা, তাকে আরও দৃঢ়চেতা করে তুলেছে। হোক দেশি রিটেইলার, ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

জিমি আজীম নামের লোকটার সঙ্গে অফিসে না, রেডিসনেই দেখা করবে মনস্থির করল শাকিলা। 

পাঁচ.
লিভাইস আর সাদা পোলো শার্টে জিমি আজীমকে দেখে শাকিলার সত্যিই ভালো লেগে গেল। শাকিলা জীবনে পুরুষ কম দেখেনি, তবে ভালো লেগেছে খুব কম সংখ্যক পুরুষকে। বিশেষ করে যারা খুব ইন্টেলিজেন্ট তারাই তাকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। তবে গত কয়েক বছরের মধ্যে এত ভালো কাউকে লাগেনি। এর প্রধান কারণ হয়তো জিমির হাসি। সাদা শার্টের সঙ্গে তার ঝকঝকে দাঁতের হাসি দেখে মনে হচ্ছিল- একটা রিয়েল পার্ল! কোনো পুরুষকে এর আগে শাকিলার গোটা একটা ঝিনুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা মুক্তো দানার মতো মনে হয়নি। জিমির দৈহিক গঠন সাধারণ। জিম করা সুগঠিত নয়, আবার মোটা থলথলে নয়। সে হয়তো ন্যাচারালি সুন্দর। এমনও হতে পারে সে হেলদি ফুড খায়। ভেতরে ভেতরে হেলথ কনশাস। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো তো এক একটা প্রতারণার ফাঁদ। বেশ কয়েকটা সম্পর্কে সে মিডিয়ায় নিউজ দেখেছে। সেখানকার একজন সিইও এরকম স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট হওয়াই স্বাভাবিক। শাকিলা মুখে এমন একটা সৌজন্যের হাসি দেওয়া এক্সপ্রেশন ঝুলিয়ে রাখে যেন তার ভেতরটা ছেলেটা কিছুতেই বুঝতে না পারে।  

তবে জিমির চোখে শাকিলা মুগ্ধতা দেখতে পায়। পুরুষের এই চোখ দেখে বরাবরই অভ্যস্ত সে। কিন্তু এই মুগ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে চাতুর্যও থাকতে পারে। তাদের মতো হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের সঙ্গে কানেক্টেড থাকা এদের পার্ট অব বিজনেস পলিসি। যে কোনো রকম বিজনেস ডিলের আগে একে বাজিয়ে দেখে নিতে হবে। তাই পাভেলকেও সঙ্গে আনেনি সে।

ছয়.
কথা শুরু করে জিমিই। গলার স্বরটা ভরাট, পুরুষালি আবার মিহি সিল্কি একটা স্মুথনেস আছে। ভারতীয় কবি, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার গুলজারের মতো অনেকটা। গুলজারের সঙ্গে মুম্বাইয়ে একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল একবার। 

কো-ইন্সিডেন্টলি তিনিও সাদা পোশাক পরেন। এই ছেলেটা যে স্মার্ট সন্দেহ নেই। বয়স মধ্য তিরিশ হবে।
- ওয়েল ম্যাম, আপনি যে আপনার এত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে সময় দিয়েছেন, এ জন্য আই অ্যাম সো গ্রেটফুল।
- না, ইটস ওকে। আমারও নিশ্চয়ই ইন্টারেস্ট আছে, নইলে আসব কেন!
- আপনি কী নেবেন ম্যামলাতে, নাকি ব্ল্যাক কফি?
- আই প্রেফার ব্ল্যাক কফি।
- আমিও তাই ধারণা করেছিলাম। আমি কিন্তু অনেক দিন ধরেই আপনার ডিজাইন ফলো করি। বছর দুয়েক আগে একটা ফ্যাশন শো করেছিলেন না, ওটাতে আমি গিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে একটু আলাপও হয়েছিল, আপনি হয়তো মনে রাখেননি।
- ওহ্, তাই হয়তো আপনাকে আমার চেনা মনে হচ্ছিল।
- তাই! ইটস মাই প্লেজার। আর সঙ্গে সঙ্গে আপনার স্মৃতি শক্তিরও প্রশংসা করতে হয়! অ্যাকচুয়ালি আপনার কাজ দেখে আমার মনে হয়েছে, ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রে আপনি দেশি ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করেন। সত্যি বলতে কী, আপনার তৈরি ওই ইজিপশিয়ান বিকিনিটা আমার এত ভালো লেগেছে!
- হ্যাঁ, আমি দেশি ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করি, বলতে পারেন প্রোমোট করি দেশি প্রোডাক্ট।
- হ্যাঁ, একেবারে ইউনিক ম্যাটেরিয়াল অ্যান্ড ডিজাইন।
- ম্যাটেরিয়াল খুব ইউনিক না, আমাদের হাতের নাগালেই আছে, শুধু প্রয়োগটা আলাদা। ওই বিকিনির ওপরের টপটা রাজশাহী সিল্কের ওপর চুনরি, এবং নিচের স্কার্ফটা রেশম সিল্কে টাইডাই। টাইডাই আর চুনরির কম্বিনেশনে একটা এথনিক ভাইব আনতে চেয়েছি মূলত পোশাকটাতে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো অন্যখানে, এদেশে বিকিনি পরে কে?
- আপনি দারাজের বিজ্ঞাপনটা দেখেননি বোধহয়। এইসব বড় বড় ই-শপে বিক্রি হয় ওয়ার্ল্ডের বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডেড বিকিনি। এখানে পাওয়া যায় অ্যানডি, হানজা, অনিয়া, সামার সল্ট, সলিড অ্যান্ড স্ট্রাইপড ইত্যাদি। ওয়ার্ল্ড ফেমাস বিকিনি এখানে পাবেন। তবে আমার মনে হয় এগুলোর থেকে আপনার ডিজাইন করা বিকিনি কম এক্সক্লুসিভ নয়। আমাদের শপিং জোন থেকেও তো অনেক বিক্রি হয়।
- এগুলো কেনে কারা? ফরেন বায়ার?
- না, এদেশের।
- বলেন কী! এসব কিনে তারা কোথায় পরে?
- আসলে ম্যাম এটা শুধু বেডরুমে বা নিজস্ব হাম্মামখানায় বা বাড়ির ছাদের সুইমিং পুলে হাজব্যান্ড-ওয়াইফের মধ্যেই পরা হয়। এক ধরনের রক্ষণশীল স্বামী-স্ত্রীর ধারণা- এ ধরনের পোশাক পরলে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে!
- থাক! বুঝতে পেরেছি। আসলে কি জিমি, আমার কিছু প্রিজার্ভেশন আছে। আমি বিকিনি ডিজাইন করেছি, লঞ্চ করেনি। আমার ডিজাইন করা পোশাক কোনো অন্দরমহলে ব্যবহারের জন্য বানাইনি। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, টাকার জন্য আমি কাজটা করি না। আমার কাছে টাকার চেয়ে বেশি জরুরি ফেম। আমার দেশের প্রোডাক্টসের প্রচার। দেশ শুধু ঘাড়গুঁজে অন্যের ডিজাইন করা পোশাক সেলাই আর কত দিন করবে বলুন!
- তা ঠিক ম্যাম। জিমির স্বরটা কেমন মিইয়ে আসে। সে মৃদু স্বরে বলে, আপনি একবার ভেবে দেখতে পারেন। ইউ টেক টাইম। আমাদের অত তাড়া নেই। 

বিজনেস কোড ওয়ার্ড ‘আমাদের’ শব্দটা টন করে ওঠে শাকিলার কানে। কিন্তু এই ‘আমাদের’ শব্দটা ‘আমার’ হয়ে উঠতে পারত, শাকিলা একটু লিবারেল হলে। সে তার প্যাশন থেকে একটু সরে এলে। কিন্তু তা আর সম্ভব না। কত কত অসম্ভব নিয়েই তো প্রতিনিয়ত যুঝছে সে। ধু-ধু প্রান্তরে নিঃসঙ্গ একা দাঁড়িয়ে থাকার মতো এক শূন্যতা এসে 

ক্ষত-বিক্ষত করে শাকিলাকে। শাকিলা ভাবে মানুষ তার নিজের কাছেই সবচেয়ে বেশি অবরুদ্ধ। হয়তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, এমন জিনিসটাও কখনো হয়ে ওঠে সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য। আর তাই তো বিজনেসের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো ভাবতে ভাবতে হাতের নাগালে থাকা মুক্তো দানাটা গড়িয়ে গভীর সমুদ্রে পড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয় তার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //