বীরনিবাস ও একটি বমনবৃত্তান্ত

সারাবছর যেমনই হোক, রোজার মাসে কাথুলি মোড়ের ঝাঁকড়া মাথা বটতলায় তেলেভাজার বেশ জমজমাট বাজার বসে যায়। শুধু আমেনার মা নয়, তখন মৌসুমি পাখির মতো আরও কয়েকজনের আগমন ঘটে। তারা তেলেভাজার তাক বোঝে না, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপের এক পিঠ পুড়িয়ে কালি করে ফেলে; সেই কালো ঘা ঢাকতে রং-মাখানো জিলাপি, আম-লিচু-কলা এনে ইফতারির রমরমা বাজার বসায়।

গ্রামের মানুষের হাতে পয়সাকড়ি যেমনই হোক, মুখের যুৎ খুব হয়েছে। বউ-ঝিয়ের হাতে তৈরি বাড়ির ইফতারিতে সারাদিনের উপবাস-ভঙ্গের ছওয়াব অপেক্ষা বাজার থেকে কেনা দু’দানা ক্ষির-খেজুর মুখে দিলেই যেন রোজাব্রত পরিপূর্ণতা পায়। তারা ছোলার ঘুগনি-বেগুনি-পেঁয়াজুও কেনে; কিন্তু তাদের নজর পড়ে থাকে আরবের খেজুর আর রঙিন জিলাপির দিকে।

আমেনার মা এসব মৌসুমি ব্যবসার ধান্ধার মধ্যে নেই, বারো মাস সে ডুবে থাকে ভাজাভুজির মধ্যে। তার হাতের বেগুনি মানে আঁচে-ফোলা বালিশ, আলুর চপে এক দানা চিনেবাদাম দিয়ে অন্যরকম স্বাদ নিয়ে আসে, কেমন করে যেন ছোলার ঘুগনিতে বিরানির ঘ্রাণ চারিয়ে দেয়; সব মিলিয়ে আমেনার মায়ের ভাজাভুজি মানেই অন্যকরম কিছু। তার কখনো খদ্দেরের অভাব হয় না। ফড়িং আর ময়না- দু’ভাই-বোন ত্রস্ত হাতে সব খদ্দের সামলায়।

ফড়িং ছোড়াটার খুব মিষ্টির ওপরে টান। যখন তখন গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কাচের সেল্ফের সামনে। কত দিন বকাঝকা করেছে আমেনার মা। এমন কি নাতির পিঠে দুমদাম কিল-থাপ্পড়ও বসিয়েছে। কাজ হয়নি। রোজার মাসে জিলাপির দোকানে গিয়ে জুলজুল করে তাকায়। হাত পেতে দু’একটা প্যাঁচ-ভাঙা জিলাপি খায়ও।

ময়নার এসব ছুঁকছুঁকানি স্বভাব নেই, নানির মতো ঘাড় নিচু করে কাজ করতে জানে। দুই নাতি-নাতনিকে খুশি করার জন্য আমেনার মা এক দিন বাড়িতে জিলাপি তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। ফড়িং তো তিড়িং-বিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে, নানির কাছে বায়না ধরে, আমাগের দোকানে জিলাপি বেচলি কী হয়!

না, সে প্রস্তাবে মোটেই রাজি নয় আমেনার মা। সেই কবে বছর দশেক আগে মদিনা মিষ্টান্নের মালিক মন্নাফ মোল্লা কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, ভাজাভুজির দোকান দিচ্ছিস দে, মিষ্টি-মিষ্টান্ন যেন না ওঠে দোকানে, অ্যাঁ। দোকান বলতে তেমন কিছুই না, বটতলায় তোলা মাটির চুলায় এটা-সেটা ভাজা, সামনে একটা নড়বড়ে বেঞ্চে খদ্দের বসানোর ব্যবস্থা।

হোক সরকারি জায়গা, তবু মদিনা মিষ্টান্নের সামনের পজিশন, মন্নাফ মোল্লা সেটা বেহাত হতে দেবে কেন! শেষ পর্যন্ত মিষ্টান্ন বিক্রি না করার শর্তে তার হাত-পা ধরে কেঁদে-ককিয়ে বটতলায় থিতু হয়ে বসে আমেনার মা। এসব কথা ফড়িং কিংবা ময়না জানবে কী করে! ওরা তো এই সেদিনের ছেলে-মেয়ে।

আমেনার মেয়ে ময়নাকে নিয়ে হয়েছে আরেক জ্বালা, সে নাকি অতি দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে। লম্বাটে গড়ন বটে, তাই বলে কি হাতে-পায়ে বেড়ে তালগাছ হয়ে যাচ্ছে সে! দেখতে দেখতে এই কাথুলি-মোড়ের বটতলা বেশ আলো ঝলমলে বাজারের চেহারা পেয়েছে এটা সত্যি। বাসের হেল্পার-কন্ডাক্টরও বেশ চিৎকার করে বলে ‘বটতলা বাজার’। তাই বলে এই বাজারে আমেনার বিটি ময়না কখনো হারিয়ে যেতে পারে খুপ করে!

অথচ এই তো সেদিন ঘটনা তো প্রায় নেই রকমই ঘটতে বসেছিল। সন্ধ্যের মুখে কাস্টমারের সংখ্যা বাড়ে। ওরাই দু’ ভাই-বোন খলবলিয়ে চার হাতে সামলায়, আমেনার মাও এক হাতে চুলার মুখে খড়ি গুঁজে দেয়। অন্য হাতে তপ্ত তেলের কড়াইয়ে নানান পদের ভাজা ছাড়ে, চালনি দিয়ে উল্টে দেয়, কাস্টমারের জন্য পিরিচ সাজায়; এ সময় হাতের কাছে ময়না না থাকলে চলে! ক্ষিপ্র হাতে সব কাজ সে সামলায়, এদিক ওদিক যতদূর চোখ যায় নাতনিকে খোঁজে, মুখে গজরগজর করে, মায়ের মনের হাউশ হয়িচে মেয়িকে ইশকুলে দেবে, তো সিখানে তুমার এই মেয়ি চরাবে কিডা সে হুঁশ আছে? হাতের কাছে ফড়িংকে পেলে তার পিঠে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে পাঠায়, তোর বুন গেল কনে, দ্যাখ গা!

ভাই হলেই কি সব সময় বোনকে পাওয়া যায়! আলো-আঁধারির আবডালে কাস্টমার সামলানোর ফাঁকফোঁকরে ফড়িং তার খালাত বোন ময়নাকে বেশ সাধ্যমতো খোঁজে; কিন্তু নাগাল পায় না। তার চেয়ে বছর দু’-একের বড়; কিন্তু তাতে কী, অশৈশব গলায় গলায় ভাব তাদের।

একজনকে ছেড়ে অন্যজনের তো চলেই না, নানিকে কিছু না বলে সে যাবেটা কোথায়! টিয়া-ময়না যেমন গাছের খোঁড়ল থেকে বাইরের পরিবেশ বুঝে গা ঝাড়া দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, ফড়িংয়ের বোন ময়নাও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর কোত্থেকে যেন ডানা মেলে বেরিয়ে আসে, নানির কাছে ছুটে যায়।

নানির তখন চুলার আগুন মাথায় ওঠে, মুখে সেই আগুন ছোটে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চুলার মুখ থেকে জ্বলন্ত লাকড়ি দিয়ে নাতনিকে মারতে উদ্যত হয়। খিস্তি ঝাড়ে-এতক্ষণ কুতায় ছিলি হারামজাদি! জবাব দেবে কী, ময়নার মুখের আনন্দ-আভা মুহূর্তে উধাও। কিছু না বুঝে সে হাইরোড পেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় বাড়ির দিকে।

বাড়ি বলতে গগণডাঙ্গা। এমন একটা দূরের পথ নয়, কাথুলি মোড় থেকে সত্যি সত্যি এক দৌড়ে পৌঁছানো যায়। এটা তাদের বাড়ি নয়, নোয়াপাড়ায় তার পৈতৃক ভিটেমাটি। সে থাকে নানিবাড়িতে। স্বামীর সঙ্গে কী এক খিটমিটিকে কেন্দ্র এক কথায় তালাক খেয়ে দু’বছরের ময়নাকে কোলে নিয়ে নোয়াপাড়া থেকে এক সন্ধ্যায় ময়নার মা চলে আসে গগণডাঙ্গায়। বছর খানেকের মাথায় সে নতুন সংসারের সন্ধান পেলে ময়না পড়ে থাকে নানির কাছে।

জোয়ার নেমে যাবার পর নদীতীরে আটকে পড়া খড়কুটোর মতো দশা হয় তার। হাতের মুঠোয় এন্তার স্বাধীনতা। নানির হাতে-হিল্লেয় লাগার জন্য প্রতিদিন দুপুর গড়ালেই সে চলে আসে কাথুলি মোড়ের বটতলায়। বছর পাঁচেকেরও বেশি সময় ধরে এই জায়গাটার পরিবর্তন দেখছে। চোখের সামনে আলো ঝলমলে বাজার জমে উঠছে। তার বেশ ভালোই লাগে এই আলোর ঝলকানির মধ্যে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াতে।

এতদিন পর মায়ের নজর পড়েছে ময়নার ওপরে। ভাব-ভালোবাসার স্বামী তার, সেও নাকি গায়ে হাত তোলে, মাথার চাঁদিতে রাগ চড়ে গেলে বেধড়ক পেটায়; পিটুনি খেয়ে মুখ বুঁজে হজম করতেই অভ্যস্ত আমেনা। অথচ ক’দিন আগে মায়ের বাড়ি এসে কী যে আকাশ ভাঙা কান্নাকাটি করে তার সীমা-পরিসীমা নেই। সেই কান্নার ভাঁজে ভাঁজে আলগা হয়ে বেরিয়ে পড়ে তার কপাল ভাঙার কেচ্ছা- তার এত পিরিতের স্বামী নাকি খ্রিস্টানপাড়ার এক ডবকা ছুড়ির প্রেমে পড়েছে! কখন কী হয় বলা যায় না।

সব শুনে আমেনার মা প্রথমে গলা ছেড়ে খানিক কেঁদেছে, নারীজন্মের এই পরিণতির জন্য কপাল চাপড়ে আহাজারি করেছে। তারপর সহসা আমেনার গায়ে ধাক্কা দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়, পুরুষ মানষির স্বভাবই ওই রকম, হাতের মুঠ ঢিলা করলিই ফস্কিয়ি যাবে। মেয়েকে সে ঠেলে পাঠাতে চায়, যাও মা তুমার সংসারে যাও, ইখানে তুমার কিডা আছে!

মাকে জড়িয়ে ধরে বেসামাল কান্নাকাটি করে আমেনা। এখানে তার মা আছে, মেয়ে আছে, এর চেয়ে আপনজন কে হয়! কার কাছে যাবে সে! না, আমেনার মা তবু মেয়েকে ঠেলে পাঠাতে চায় তার সংসারে। পুরুষ মানুষ যা-ই করুক মেয়ে মানুষ কবার পারে সংসার ভাঙতে-গড়তে! তার প্রথম পক্ষের ছাড়াছাড়ি হয়েছে সেই কবে, সে জন্য কে দায়ী? ময়নার বাপের ধনুকভাঙা গোয়ার্তুমির কথা কেউ মনে রেখেছে? সবাই দেবে মেয়ে মানুষের দোষ।

মেয়ে মানুষের কি দোষের সীমা আছে! পুরুষের মুখ থেকে একবার হলাহল বেরুলেই হলো, সমাজ সেটা লুফে নেবে, গিলে খাবে। আমেনার মা হাড়ে হাড়ে জানে সে কথা। তাই বলে এক সন্তানের মা হয়েও দ্বিতীয় সংসারে এসে নিষ্ফলা দাম্পত্যজীবনের জন্য আমেনাকেই দায়ী করা হয়- শুনে তো নির্বাক হয়ে যায় আমেনার মা।

মেয়েকে আপন সংসারে ঠেলে পাঠাবার জোর খুঁজে পায় না। বহুদিন পর আমেনা সেই রাতটা মায়ের কাছে কাটায়। ছোট বোন মোমেনার সংসারের খোঁজখবর নেয়। বর্ষকালে গাঙে গাঙে দেখা হয়, তো বোনে বোনে দেখা হতে চায় না। অথচ দুই বোনের সম্পর্ক তো মোটেই খারাপ কিছু নয়।

মোমেনার বাড়িও এমন কিছু দূরে নয়। একই গ্রামের শেষ মাথায় থাকে। ইচ্ছে হলেই যখন-তখন আসতে পারে মায়ের কাছে; কিন্তু তার শাশুড়ির সেটা পছন্দ নয়। পিঠাপিঠি জন্ম বলে একসঙ্গে গলাগলি করে বড় হয়েছে। বিয়ে থা’র পরে নদীর ধারা কখন অলক্ষে ভাগ হয়ে গেছে। বিনিদ্র সেই রাতে মায়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে এক সময় জানতে চায়, মেয়ি মানষির জেবন ক্যানে গাঙের মতোন হয় মা?

এ বড়ই দার্শনিক প্রশ্ন। আমেনার মা কী জবাব দেবে এ প্রশ্নের! রাতের নিকষ আঁধারে সহসা জন্মদাতা বাপের মুখ ভেসে আসে চোখের পর্দায়। কবে কোন কালে মরে পচে মাটিতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তবু তার কণ্ঠের গান শুনতে পায়, এ-পার ভাঙে ও-পার গড়ে রে এই তো নদীর খেলা...। বড্ড নদী অন্তপ্রাণ মানুষ ছিল। নদী-নৌকা-মাছধরা জাল নিয়ে কী যে প্রবল নেশা তার! নদীই তার ধ্যান-জ্ঞান।

বারবার নদীর ছোবলে নিঃস্ব হয়ে ভিটেমাটি হারাতে হারাতে সব শেষে গগণডাঙার এই উঁচু মাঠে ঘর বেঁধে থিতু হয়। নদী-জীবনের অবসান ঘটাতে চাইলেও মরার নদী না-কি তাকে ছাড়তে চায় না। দিনে-রাতে যখন-তখন তাকে ডাকে। সেই ডাকে উতল হয়ে লোকটা এক বর্ষার রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, ঘরে স্ত্রী-কন্যাকে রেখে সে নদীর বুকে সেদিন অন্তিমশয্যা পাতে।

আমেনার মা সেই থেকে আর কখনো নদীমুখো হয়নি। গড়াই নদীর রাক্ষুসী রূপ দেখার সুযোগ হয়নি আমেনার মায়ের। ততদিনে সে ডানা গুটিয়ে আপন বিবরে মুখ লুকানো শামুক হয়ে গেছে। নদীকে আর নদী বলে চেনাই যায় না, শুকনো বুক জোড়া ধু-ধু বালিয়াড়ি। তবু নাম তার নদী, সে তো আর অস্বীকার করা যায় না। তাই নদীপাড়ের গ্রাম চড়াইকোল থেকে আমেনার মায়ের প্রথমে বিয়ের প্রস্তাব এলে ওই নদীর ওপরে রাগ করে সে প্রস্তাব দু’হাতে ঠেলে দেওয়া হয়।

তারপর যে শিবঠাকুরের সঙ্গে সংসার হয়, তিনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, সেই গরবে তার ঘুম আসে না, লাটবেলাট হয়েছেন। দেশের মানুষ তার অন্ন যোগাবে-কী একখান আজগুবি আবদার তার! স্বাধীনতার দু’তিন বছর না পেরোতেই চোখে রং ধরে, দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে নিয়ে আসে অল্প বয়সের যুবতী আলোমতিকে।

যাত্রাগানের ছুকরি, আলোমতির পাঠ করে, সংসারে তার আগমনের পরপরই আমেনা-মোমেনাকে কোলে কাঁখে নিয়ে বাপের বাড়ি গগণডাঙায় চলে আসে ওদের মা। লড়াই করে বাঁচতে শিখেছে, বড় হবার পর মেয়েদের বিয়ে থা দিয়েছে; কিন্তু সে আর স্বামী-সংসারের দিকে ফিরেও তাকায়নি। সেই আলোমতি-প্রেমকুমারেরও কোনো খবর রাখার রুচি কিংবা ইচ্ছে কখনো হয়নি’ কিন্তু এটা তো সত্যি, তাদের দাম্পত্য সম্পর্কটুকু আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়নি কখনো- গভীর সমুদ্রের তলদেশে নিভৃতে পড়ে থাকা তৃণগুল্মের মতো, দৃশ্যমান না হলেও যেন তার অস্তিত্ব অউৎপাটনীয় বাস্তবতায় বিরাজমান।

দুই

সকালবেলায় ময়না বা ফড়িংয়ের হাতে তেমন কোনো কাজ থাকে না বললেই চলে। নানি ঠেলে পাঠায় খাসবাগানে পাতা কুড়াতে অথবা শাক তুলতে। দুটি কাজেই তাদের প্রবল আনন্দ। সেই আনন্দে বাগড়া দেবার আয়োজন করেছে ময়নার মা, মেয়েকে ইশকুলে পাঠাবার সাধ হয়েছে তার। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবদার জানিয়েছে। আবার মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে মেয়েকেও খুব করে বুঝিয়েছে, ল্যাখাপড়া শিখলি জীবন অন্যরকম হয়ি যায়, রোজ ইশকুলে যাবা, কেমন!

ফড়িংকে সঙ্গে নিয়ে বিলপাড়ার ইশকুলে দু’তিন দিন গেছে ময়না, সেখানে মোটেই ভালো লাগেনি।

নানির ধাক্কা খেয়ে তবু যেতে হয় মাঝে মধ্যে। ইশকুলে যাবার পক্ষে-বিপক্ষে একা একাই গজর গজর করে আমেনার মা, আবার নাতনিকে ধরে বেঁধে ইশকুলে পাঠায়। ময়না সেদিন সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েই দিবালোকে ভ‚ত দেখার মতো চমকে ওঠে- এ তো সেদিন সন্ধ্যেবেলার সেই লোকটা! কাথুলি মোড়ের বটতলা থেকে এই বাড়ি পর্যন্ত চলে এলো! মনে করতে চেষ্টা করে, আগে কখনো এ বাড়িতে দেখেছে লোকটিকে! নাহ্, তেমন কোনো স্মৃতি তার মনে পড়ে না। অথচ সেই সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে দু’হাত জড়িয়ে ধরে দিব্যি লোকটি তাকে নাতনি বলে দাবি করে, নানা বলে পরিচয় দেয়, নানির খবর নেয়। সেই লোকটিই তো! তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোর নানি আছে তো বাড়িতে?

না, ময়না কিংবা ফড়িং কেউই বৃদ্ধের হাতে ধরা দেয় না। কোনো জবাবও দেয় না। মাথা গলিয়ে পা বাড়ায় ইশকুলের পথে। হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া শিশু দুটির চলে যাওয়া পথের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকার পর বৃদ্ধ মানুষটি নিজেকে গুছিয়ে নেয়, তারপর ঢুকে পড়ে বাড়ির মধ্যে, ডেকে ওঠে অতি পুরাতন ভঙ্গিতে, ময়নার মা, ও ময়নার মা!

মাত্র এটুকু উচ্চারণেই কেঁপে ওঠে বৃদ্ধের গলা; কিন্তু গলার কাঁপুনির সঙ্গে হাতের কাঁপুনির কী এমন সম্পর্ক কে জানে! যুগপৎ দুটি ঘটনা একই সঙ্গে ঘটে যায়। কণ্ঠের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হাত ফসকে গড়িয়ে পড়ে তৈলমসৃণ লাঠিটি। বৃদ্ধ তখন কী করে!

উঠানের পূর্ব কোণে চুলার মুখ থেকে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে আমেনার মা বাইরের দিকে তাকায়। অভ্যাগত বৃদ্ধের দিকে চোখ পড়তেই সে চমকে ওঠে। বৃদ্ধের চেহারা গোঁফদাড়িতে ঢাকা। লিকলিকে শরীর। পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়া লাঠি তুলে নিয়ে সে আবার ডেকে ওঠে, আমেনার মা!

আমেনার মা বিস্ময়ে হতবাক- মানুষের কণ্ঠস্বর কি অচেনা হয় না! সময়ের ধুলোবালি জমে কত মানুষের চেহারা-ছবি আড়াল হয়ে যায়; কিন্তু মুখের ডাক, গলার স্বর তো সেই আড়াল ঠেলে ঠিকই বেরিয়ে আসে। তখন নিজের কানকে কে পারে অস্বীকার করতে! আমেনার মা হিসাব মেলাতেই পারে না, এত দীর্ঘকাল পরে এই মানুষটি কেন এখানে! কাগজ-কলমে না হোক ছাড়াছাড়ি, সে তো সব অধিকার ছেড়ে এসেছে সেই কবে কোন কালেই। নিজের মেয়ে আমেনা-মোমেনার বিয়ের সময়ে খবর দিয়েও যাকে এ বাড়িতে আনা যায়নি, আজ এই সকালবেলায় তার হলোটা কী!

লাঠি হাতে পাবার পরও বৃদ্ধ সামনে পা বাড়ায় না। চোখ পিটপিট করে কেবল তাকায়। আমেনা মায়ের চোখে চোখ রাখতে চায়। আমেনার মা তখন মাথার আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে বসেছে। বৃদ্ধ হঠাৎ ডুকরে ওঠে, আমাক তুমি মাপ কইরি দ্যাও আমেনার মা।

এ কী কথার ছিরি! আমেনার মায়ের মনে হয়, এমন কথা শুনলে মরা মানুষেরও গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠবে। এত কাল পরে মরণের আগে তবে কি লোকটা নাটক করতে এসেছে? মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে সে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দ্যাখে বুকের কাছে দুই হাত জোড় বেঁধে সে তার ভুলের বিবরণ দিয়ে চলেছে।

দ্বিতীয়বার বিয়ে করা, প্রায় বিনা অপরাধে আমেনাকে তাড়িয়ে দেওয়া (বাস্তবে গলাধাক্কা দেওয়া না হলেও আলোমতির সঙ্গে ভাগাভাগি করে সংসার করতে রুচি হয়নি বলে সে চলে এসেছে), দুই কন্যার প্রতি কোনো প্রকার দায়িত্ব পালন না করা, সর্বোপরি এতদিন কারো কোনো খোঁজ না রাখা- এসবই সে ইনিয়ে-বিনিয়ে ব্যক্ত করে এবং এ অপরাধসমূহের জন্য আমেনার মায়ের কাছে ক্ষমা চায়।

কিন্তু কেন এই ক্ষমা চাওয়া! পুরুষ মানুষের জন্য ও-সব আবার অপরাধ না-কি! তবু কি-না একেবারে বৃদ্ধ বয়সে এসে বিবাহিত স্ত্রীর কাছে হাতজোড় করে দাঁড়ানো! মানুষ কি অন্তর্গত অনুতাপে এতখানি নতজানু হয়! সহসা এরই মধ্যে মোমেনা আবির্ভূত হলে পরিবেশ একটু অন্য রকম হয়ে ওঠে। মোমেনার বাড়ি এই গ্রামের শেষ পাড়াতে, শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে মায়ের বাড়িতে যখন-তখন তার যাতায়াত শুরু হয়েছে। মায়ের এবং ছেলে-মেয়ের খোঁজখবর নেয়। এ দিনও সে বাড়ি ঢোকে ফড়িংয়ের নাম ধরে- ফড়িং কনে গেল মা এই সাতসকালে?

প্রশ্ন ছুড়ে দেবার পর বৃদ্ধ আগন্তুকের দিকে দৃষ্টি পড়ে তার। বড্ড কৌতূহল নিয়ে সে তাকায়, কী যেন উত্তর খোঁজে; কিন্তু সেদিকে না গিয়ে সে আবার প্রশ্ন করে, ফড়িং কনে মা?

‘ফড়িং গেল ইশকুলে।’ আমেনার মা আচনক কথা শোনায়, ‘ওই যি তোর বাপ আয়িচে, বসতি বোল।’

মোমেনার হয় চোখ উল্টানোর দশা- ‘বাপ! আয়িচে!’

বাপ শব্দটির সঙ্গে তার পরিচয় নেই এমন তো নয়! এ সংসারে কত রকম বাপকেই তো দেখা যায়। তার নিজেরও সংসার বাঁধা আছে ফড়িংয়ের বাপের সঙ্গে। একেবারে মাটির মানুষ বলতে যা বুঝায়, সে হচ্ছে তাই। কোথায় ফড়িংয়ের বাপ আর কোথায় বা তার নিজের বাপ! জন্মদাতা বাপের সঙ্গে কখনো তার পরিচয় হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না! কিন্তু মা যদি নিজে মুখে পরিচয় দেয় সন্তানের বাপের, তাহলে আর কী করার থাকে!

মোমেনা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে বৃদ্ধ আগন্তুকের কাছে। চোখ পিটপিট করে তাকায়- এটাই তার জন্মদাতা বাপ! একদিনও সে বাপ বলে ডাকেনি, কাঁধে কিংবা কোলে চড়েনি, একবারও অবুঝ আবদার জানায়নি। জন্মের পর এ নাগাদ তেমন সুযোগই তো পায়নি তারা দুই বোন। বড় বোন আমেনা কি পেয়েছে? মনে মনে হাসি পায় মোমেনার- তাদের মা-ই বা কী পেয়েছে স্বামীর কাছ থেকে? সেই তো নারীত্বের অপমান! সেই তো দুটি শিশু বুকে নিয়ে বাপের ভিটেয় ফিরে আসা! এসব সেই কবেকার কথা, কত বছরের কথা! তা এতদিন পর এই লোকটি এখানে এসেছে কেন? মতলব কী?

ভেতরে ভেতরে মোমেনা খুব নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। একজন বৃদ্ধ মানুষকে (মানুষটি তার জন্মদাতা জানার পরও) ঠাস ঠাস করে বেশ কিছু প্রশ্ন করে, এক প্রশ্নের লেজ ধরে নির্দয়ভাবে আরেক প্রশ্ন করে। পুলিশি জেরার মতো প্রশ্নে প্রশ্নে লোকটিকে দিগভ্রান্ত করে দেয়। অবশেষ বিপর্যস্ত বিপন্নতার মধ্যে সে অকপটে সোজা-সাপ্টা কবুল করে, এতকাল পর তার এই আগমনের পেছনে সত্যিই একটা রহস্য আছে, উদ্দেশ্য আছে।

তিন

সরকারের না-কি সাধ হয়েছে, দেশের কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে গৃহহীন রাখবে না। সরকারি টাকায় ঘরদোর করে দেবে। এই রকম ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। রেডিও-টেলিভিশন যার নেই, সে আর এত খবর জানবে কোত্থেকে! অথচ সরকারি উদ্যোগে এসব নানান প্রকল্পের কাজ তো হচ্ছে ঠিকই। ভূমিহীনকে ভূমিদান, গৃহহীনকে গৃহদান, আরও কত কী! হান্নান-মান্নান দুই ভাই একসঙ্গে চলে গেল আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি বাড়িতে।

সে তো এই কাদের মেম্বরের হাত ধরেই এ সুযোগ পেয়েছে। এমপি সাহেবের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ। সে যা বলে তা-ই হয়। এবার সে গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধার জন্য চেষ্টা করবে, নামধাম লিখে নিয়েছে এবং পাকা কথা দিয়েছে- এ গ্রামের একজনের জন্য হলেও সে নূরু চাচার মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করবেই। বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ এ গ্রামের মাথার মুকুট, সে কেন পরিবার-পরিজন নিয়ে ক্যানেলের ধারে পড়ে থাকবে!

আরও কত কথার ফুলঝুরি ফোটে কাদের মেম্বরের মুখে। স্বাধীনতার এত বছর পরও তার মরহুম পিতার গায়ে লেগে থাকা একাত্তরের কালিমা নিঃশেষে মুছতে চায় না। বর্তমানে সরকারি দলে এসে নাগাদ কাদের মেম্বার গ্রামের মানুষের জন্য তো কম কিছু করেনি, তবু মানুষের কুটুশ-কাটুশ মন্তব্যের শেষ হতে চায় না, আড়ালে-আবডালে ফস করে বলে বসে, রাজাকারের বিটার মুখি বড় বড় কতা!

না, কথায় নয়, কাদের মেম্বর এবার কাজে দেখাতে চায়- একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারি আবাসন দিয়ে সম্মানিত করতে চায়। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে এক গাদা মানুষের সামনে এ ঘোষণা দিয়েছে, কাজেই পিছিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই; কিন্তু সমস্যা হয়েছে একেবারে শেষবেলায় এসে। সরকার ঘর-বাড়ি, টিউবয়েল, ল্যাট্রিন সবই দেবে; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার নামে কমপক্ষে পাঁচ শতক জমি থাকতে হবে; সেই জমির উপরে টাকা ঢালবে সরকার। নূর মোহাম্মদ শেখ এখন জমি পাবে কোথায়!

পৈতৃক সূত্রে সামান্য যে জমি জিরেত সে পেয়েছিল, তা যে কবে কীভাবে হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে, আর আর সে কথা মনেও পড়ে না। অনেকে তার নাটকযাত্রার দোষ দেয়; কিন্তু তার মানতে ইচ্ছে করে না। নিজের দোষ যাত্রার কাঁধে চাপাতে ইচ্ছে করে না। এখন তো জমিও নেই, যাত্রাও নেই, এ জন্য সে কাকে দোষ দেবে?

ভাবতে ভাবতে এক সময় সে কাদের মেম্বারের প্রস্তাব নাকচ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল প্রায়। একেবারে শেষবেলায় মনে পড়ে গগণডাঙ্গার কথা, মনে পড়ে আমেনার মায়ের কথা। মানুষ কি সতীনের সংসার করে না! আলোমতিকে দেখার পর সে একদিনও দাঁড়ায়নি, মেয়ে কোলে নিয়ে চলে আসে বাপের বাড়ি।

ঘরদোর আছে, সামান্য একটু জমিজায়গাও আছে। একমাত্র মেয়ে হিসেবে সে তো সবই পেয়েছে। সেই জমির এক কোনা থেকে যদি পাঁচ শতক সে আমেনার বাপের নামে লিখে দেয়, তাহলে সেই জমির ওপর সরকারি বাড়ি উঠতে পারে, টিউবয়েল-ল্যাট্রিনে গোছানো বাড়ি। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের দুই কন্যা আমেনা ও মোমেনাই হবে সেই বাড়ির মালিক।

ধারালো অস্ত্র দিয়ে কচুগাছ কিংবা কলাগাছ কাটা যেমন সহজ, মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের পরিকল্পনা ও প্রস্তাব শোনার পর আমেনার মা তার চেয়ে আরও সহজে সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। কাথুলি মোড়ের বটতলায় তেলে ভাজার ব্যবসা করেই সে ভালো আছে, সরকারি বাড়ি-ঘর তার দরকার নেই। নূর মোহাম্মদ দাম্পত্য সম্পর্কের প্রসঙ্গ তোলে, স্ত্রীর ওপরে স্বামীর অধিকারের কথা বলে; আমেনার মা সে সব কথা কানেই তোলে না। আগের দিনের পতিব্রতা স্ত্রীর মতোই মাথায় ঘোমটা টেনে ভাতের থালা পানির গেলাস সামনে এগিয়ে ধরে বলে, ভাত খাও দিনি। সম্পর্ক যিখানে আছে, সেইখেনেই থাক। তুমি এ্যাখুন ভাত খাও।

চার

গগণডাঙ্গা থেকে বেরিয়ে এসে পথে নামে ঠিকই, লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুক ঠুক করে পথ পাড়ি দেয়; কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না নূর মোহাম্মদের। বাড়ি কোথায় তার? কোথায় তার ঘর সংসার? মিরপুর-ভেড়ামারাজুড়ে বিস্তৃত গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের ক্যানেলের দুই পাড়ে ঝুপড়ি বাঁধা ভ‚মিহারা মানুষের ভিড়ে তার বাস। সেইখানে অনটনক্লিষ্ট আলোমতির সংসারে আবারও ফিরে যাওয়া! পা উঠতে চায় না। মনে হয় যেন অন্য কারো পায়ে সে হাঁটছে।

আঁকাবাঁকা, উল্টোপাল্টা পা ফেলছে; কিন্তু কেন? সে কি তবে গগণডাঙায় শ্বশুরবাড়িতে থাকার জন্য এসেছিল? আহা, যৌবনে শাশুড়ির আদর-যত্নের কথাও মনে পড়ে যায়, ভেতরে ভেতরে দগ্ধায় সে-সব স্মৃতি। মায়ের স্বভাব পেয়েছে মেয়েতে, ভাত না খাইয়ে সে উঠতেই দেবে না। আসল প্রস্তাবের বেলায় এক কথায় না বলতে একটুও বাধে না তার, অথচ সেই মানুষই ভাতের থালা সামনে ধরে একেবারে বদলে যায়, কত অনুনয় তার, ‘যাচা ভাত কাঁচা কত্তি হয় না, হ্যাঁ! খাও।’

আমেনার মায়ের হাতের সেই ভাত-তরকারি কি গলা থেকে নামতে চায়! কণ্ঠনালির দরজায় দলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হেরিংবোন রাস্তায় অটোভ্যানে মাইল তিনেক পাড়ি দিলে তারপর পাওয়া যাবে জিকে ক্যানেলের ঢাল। এই পথটুকুর জন্য ভ্যানে উঠতেই হয়। ভ্যানের ঝাঁকুনিতে নূর মোহাম্মদের কণ্ঠনালির দুয়ার আলগা হয়ে যায় সহসা, আর তখনই জমাট বাঁধা খাদ্য হড়হড়িয়ে বেরিয়ে আসে। সহযাত্রীদের অনেকেই বিরক্তিতে নাকমুখ কুঁচকে ওঠে। দু’জন সহানুভ‚তিও দেখায় বেশ, আহা বুড়ো মানুষ, কোথায় যে কী খেয়েছে কে জানে!

নূর মোহাম্মদের নেতিয়ে পড়া দেহ যখন মিরপুর হাসপাতালের বারান্দায় নামানো হয়, সৌভাগ্যক্রমে কাদের মেম্বার তখন সেখানে উপস্থিত। থানায় হাসপাতালে কত কারণে যে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের যেতে হয় তার কি ঠিকঠিকানা আছে! হরেন চৌকিদারের কাছে জানা গেল, উত্তরপাড়ার পাতান মিস্ত্রির যুবতী বউ ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে রেখে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। এখন পোস্টমর্টেম-থানা-পুলিশ সামলায় কে! কাদের মেম্বারকেই আসতে হয়েছে মোটরবাইকের তেল পুড়িয়ে। জনসেবা বলে কথা! নূর মোহাম্মদকে দেখার পর সে কি এড়িয়ে যেতে পারে! গ্রামের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা, সবার মাথার মুকুট, তার একটু উপকারের জন্য সে চেষ্টার তো কম করেনি কিছু!

বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ শেখকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে শরীরে স্যালাইন পুশ করানোর খানিক পর আচনক এক সুসংবাদ পরিবেশন করে কাদের মেম্বার-মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি-ঘরের জন্য আর জমি-টমি লাগবে না। সারা দেশের সর্বত্রই মুক্তিযোদ্ধার জমি আছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাকে জমিও দেবে, সেই জমির ওপরে বাড়ি-ঘরও তৈরি করে দেবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গড়া হবে বীরনিবাস। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আর আশ্রয়হীন থাকবে না, ঠিকানাহীন থাকবে না। তারা থাকবে বীরনিবাসে। কাদের মেম্বার আকর্ণবিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে ঘোষণা করে, বীরনিবাসে নূরু চাচার নাম ফাইনাল। আমাদের গ্রামের একমাত্র নূরু চাচাই থাকবে সেই বীরনিবাসে।

জীবনের সায়াহ্নবেলায় এত বড় সুসংবাদ শোনার পরও বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ শেখের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডলে প্রসন্নতার রোদ ঝলসে ওঠে না। বরং আবার বিবমিশার উদ্রেক হয়। ভাতের দলা কণ্ঠনালির দরজা থেকে সরে গেছে। তবু নাড়িভুঁড়ি উগরে বমি করার ইচ্ছে হয়; কিন্তু বমি করার মতো সামান্য খাদ্যকণাও যে তার পেটে আর অবশিষ্ট নেই!

কাজ করার পর যে কেউ তার স্বীকৃতি বা সমর্থন চায়, এটা নতুন কিছু নয়। অনেক বড় মানুষের মধ্যেও এ আকাক্সক্ষা কাজ করে। কাদের মেম্বারের আর দোষ কী, বীরনিবাসের তালিকায় সে চ‚ড়ান্তভাবে নাম তুলে দিয়েছে, তারও একটুখানি প্রশংসার প্রত্যাশা থাকতেই পারে; কিন্তু নূর মোহাম্মদ শেখকে পূর্বাপর নির্বিকার দেখে কাদের মেম্বার মুখটা নামিয়ে আনে তার কানের কাছে। 

বীরনিবাসের আদ্যোপান্ত আবার সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলে এবং শেষে সহাস্য বদনে জানতে চায়, এবার খুশি তো নূরু চাচা?

কী যে অবাক কাণ্ড, উত্তর দেবে কী, মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ শেখের মুখ থেকে ঠিক ওই মুহূর্তে উঠে আসে কাঠবমি। সেই বমির সঙ্গে খাদ্যকণা নেই সত্যি, তারও অধিক (দৃশ্যমান না হলেও) আরও কী সব বর্জ্য লালা এবং থুতুর সঙ্গে উগরে এসে লেপ্টে যায় কাদের মেম্বারের শরীরে। লোকটা তখন কী করে? 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //