আবু কালামদের মুখ

একটাও বাদ দেবে না, সব-সব আনবে কিন্তু- হাতে লম্বা একটা ফর্দ ধরিয়ে হুঁশিয়ার করে দেয় মর্জিনা বেগম। জানে স্বামী আবু কালাম বেভুদা ধরনের মানুষ। জীবনে ঠিকঠাক বাজার করতে পারল না বা শিখলো না। অনেক সময়ে মর্জিনা বেগমের প্রশ্ন জাগে, এই বেভুদা মানুষটা আমার লগে মশকরা করে? নাইলে অফিস আদালত বন্ধু বান্ধব রাস্তাঘাটের এত ভজঘট সামলায় কেমনে?

রাস্তাঘাটের ধুলো ঝেড়ে বাসার মধ্যে ঢুকলেই মানুষটারে আর চেনা যায় না, কোট প্যান্ট টাই জামা গেনজি আন্ডারওয়ার ঠিকই থাকে, কোনো কিছুই হারায় না কিন্তু বাসায় ঢুকলেই কেমন হারিয়ে যায়। কোথায় যায় বুঝতে পারে না মর্জিনা বেগম- অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। আর লোকটাকে ঘৃণা করে না ভালোবাসে না থাকার জন্য থাকে- জীবনের মাঝ সময়ে এসেও বুঝতে পারে না মর্জিনা।

এত বড় ফর্দ দিলা! আবু কালাম আর্তনাদ করে, গত সপ্তাহে না তিন হাজার টাকার বাজার করলাম। আবার এত বাজার? মুশুরের ডাল, চিনি, লবঙ্গ, দারচিনি, দেশি মুরগি, ফার্মের মুরগি, সোয়াবিন তেল... তাকায় স্ত্রী মর্জিনা বেগমের দিকে-এত বাজার ক্যান?

মুখের মধ্যে জমিয়ে রাখা পানের রস জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে কড়া দৃষ্টিতে তাকায় স্বামীর দিকে, আমার মরা বাপে খাবে তার লাইগা আনতে বলেছি। ক্যান তোমার মনে নাই, রাইতে এত বুঝাইয়া কইলাম আমার ছোট বোন রেবার বড় ছেলে সালাম চাকরি লইয়া সিঙ্গাপুর যাইতেছে। আমারে সালাম করতে আসবে। সঙ্গে সালামের নতুন বৌ, ওর বাপ মায়ে বুইন আর ভাই আসবে। অগো ভালো-মন্দ খাওয়াতে হবে না? আমি বড় খালা। তুমি বড় খালু। ছেলেটা তোমাকে কি পরিমাণ ভক্তি শ্রদ্ধা করে।

ও! মুখটা কেমন নোনতা লাগে আবু কালামের, ভক্তি শ্রদ্ধা করলেই বাজার করে খাওয়াতে হবে! নরম গলায় নিজের মুখে নিঃশব্দে বলে। পাশে দাঁড়িয়ে খরখরা চোখে তাকায় মর্জিনা বেগম, তোমারে যে মাঝে মধ্যে আদর করে ছোট লোক বলি, এমনি এমনি বলি না।

ছোট লোক কও আর বড় লোক কও, আমার পকেটের অবস্থা তুমি জানো না? 

পকেটের অবস্থা জানার টাইম নাই, এখন বাজার করে আনো। মেহমান আসবে সন্ধ্যার পরে। যাও... মর্জিনা বেগম এক ধরনের ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দেয় আবু কালামকে। ব্যাগ হাতে বাসার বাইরে এসে বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখা প্রতিবেশী রামানন্দ রায়ের সঙ্গে। রামানন্দ রায় এই গলির পরের গলির বায়ের দিকের সাততলা বাসার মালিক। লোকটা লম্বা, প্রায় সাত ফুটের কাছাকাছি, অনেকটা তালগাছ সমান; কিন্তু হাটে কুজো হয়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে। মনে হয় হারিয়ে যাওয়া টাকা খোঁজে। রামানন্দ রায় ব্যবসা করে কুকুরের। বাসার সব কটা তলায় কুকুরগুলো থাকে। কত বিচিত্র ধরনের কুকুর যে দুনিয়ায় আছে- রামানন্দ বাবুর কুকুর কারখানায় না গেলে জানতো না আবু কালাম। 

কুকুর পালা বা ব্যবসার কারণে, হাসি হাসি মুখে বলেন তিনি- ধরেন দাদা আপনার বাসাটায় চুরি চামারি হওয়ার ভয় আছে, হয়তো চুরি ডাকাতিও হয়েছে, নিরাপত্তার জন্য মানুষ না রাইখা কুকুর রাখেন, একটু আদর আপ্যায়ন করেন, দেখবেন মানুষের চাইতে কুকুর অনেক ভালো পাহারা দেয়।

ভ্রু কুঁচকে তাকান আবু কালাম, কি সব বলেন আপনি? মানুষের চেয়ে কুকুর...

শেষ করতে পারেন না, মুখের বাক্য টেনে বলেন রমানন্দ রায়, আবারও কইতেছি মানুষের চাইতে কুকুর অনেক কৃতজ্ঞ প্রাণী। বিশ্বাস না করলে, আপনি আমার বাসায় আসেন। একটা কুকুর আপনারে মাগনা দিমু।

রামানন্দ বাবুর আবেদনের মধ্যে এক দিন আবু কালাম দুপুরের সময় গেলেন রামানন্দ রায়ের বাড়ি। কলিং বেল টিপতেই নিজে দরজা খুলে নিয়ে গেলেন ভিতরে। প্রতিটি কক্ষে সোফা টেবিল লেপ তোষক ডাইনিং টেবিল সাজানো। কুকুরেরা সোফায় বসে ঝিমায় অথবা মিহি স্বরে ঘেউ ঘেউ করে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন রামানন্দ রায়, আবার কলিংবেল। 

একজন কর্মচারী কিছুক্ষণ সুন্দরী মাঝ বয়েসী এক মহিলাকে নিয়ে ঢোকে রুমের মধ্যে। মহিলার নধর কোলে ছোট আকারের সাদা রঙের কুকুর, সারা শরীরে লোম ঝুলছে। কুকুরটা জিহ্বা বের করে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখছে আর হাসছে।

আপা কেমন আছেন? হাসি মুখে তাকান রামানন্দ রায়।

ভালো আছি দাদা, আমার আর একটা কুকুর লাগবে।

মুখে আরও হাসি ছড়িয়ে পরে রামানন্দ রায়ের, কি ধরনের কুকুর নেবেন?

জার্মান শেপার্ট নয়তো সরাইলের ডাল কুকুর- 

চোখ কপালে রায়ের, এত কামড়ানো কুকুর আপা।

আমি এই কুকুরই চাই, গম্ভীর গলা ভদ্র মহিলার। আমি এমন একটা কুকুর চাই, যে কুকুর আমার কাছে কোনো মানুষকে ঘেঁষতে দেবে না। এমন কী আমার স্বামীকেও না। আর এই কুকুরটা, হাতের কুকুরটা দেখিয়ে বলে, ওকেও পাহারা দেবে।

কুকুর দিয়ে কুকুর পাহারা? বিস্ময়কর প্রশ্ন আবু কালামের। 

সেই রামানন্দ রায়ের সঙ্গে দেখা হতেই প্রশ্ন করেন আবু কালাম, কেমন চলছে আপনার কুকুর ব্যবসা?

ভালো, ভালো চলছে দাদা। আপনি তো আর আইলেন না, কইলাম টাকা পয়সা লাগবো না, একটা কুকুর লইয়া যান। নিলেন না-

কুকুর কেমনে আনি বাসায়? মানুষের খাওনই দিতে পারি না...

দু’জনে বাজারের মধ্যে ঢুকে দুদিকে ছড়িয়ে পরে। আবু কালাম পকেট থেকে বের করে স্ত্রী মর্জিনা বেগমের দেয়া বাজারের ফর্দ বের করে। মুশুরির ডাল দুই কেজি, গোল আলু পাঁচ কেজি, টমেটো দুই কেজি, পাকা মসলা পঞ্চাশ টাকার, গায়ে দেয়া সাবান একটা আশি টাকা, চায়ের প্যাকেট একটা একশত আশি টাকা কেনার পর ব্যাগে ভরে আবুল কালাম দাঁড়ায় তেলের দোকানের সামনে। পরিচিত ক্রেতা দেখে ভূড়িঅলা তেল দোকানদার হাসে, ওই ছক্কু মিয়া ভাইজানরে পাচ লিটারের সয়াবিনের একটা জার দে-

ছক্কু বাড়িয়ে দেয় পাঁচ লিটারের সোয়াবিনের জার। জারটা নিয়ে পায়ের কাছে রেখে টাকা বের করেন আবু কালাম- কত টাকা ভাই?

আটশো বিশ টাকা!

হাসেন আবুল কালাম-আরে ভাই, দুইটা না একটার দাম কন।

তেলঅলাও হাসে, আছেন কোন দ্যাশে? পনেরো দিনের মধ্যে তেলের দাম বাইরা গেছে দুইগুণ, বোঝলেন? আমি পাঁচ লিটারের একটা তেলের জারের দামই কইচি আপনারে-আটশো বিশ টাকা। 

আটশো বিশ টাকা, পাঁচ লিটারের সোয়াবিন তেলের দাম? মাথার চুল উড়তে শুরু করে আবু কালামের, কন কি আপনে?

হ, তেলের দাম মেলা বাইরা গেছে। দেন টেকা দেন... হাত বাড়ায় তেল দোকানদার, কোন দেশে আছি কইতে পারি না, সাড়ে চারশো টাকার তেল এখন ডাবলেরও বেশি।

আবু কালাম তেলঅলার কাছে টাকা গুনে দিচ্ছেন, টাকা গুনে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে শরীরের প্যান্ট শার্ট গেনজি জাঙ্গিয়া কেউ খুলে নিচ্ছে উপরের দিকে, তিনি চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না, তিনি শূন্য আকাশের দিকে উড়ে যেতে লাগলেন একা শো শো শো বাতাসের সঙ্গে। পাশে পাশে উড়ে চলছে পাঁচ লিটারের তেলের জারটাও। তেলের জারটা উড়ছে আর হাসছে খিকখিক... তিনি উড়ছেন ন্যাংটো পতাকা এক। 

দুই

বুঝলেননি? বাড়িঅলা আলাউদ্দিন মিয়া বাতিক শব্দ বুঝলেননি উচ্চারণের পর ডান হাতের অনামিকা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে গলার স্বরগ্রামের সঙ্গে আটকে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ বের করে পাশে রাখা পাত্রে ফেলে আবার তাকায়, সব শালারা সাধু। ঘুষ খায় না। আরে ব্যাটা ঘুস পাইলে না খাবি? ঘুষ খাওয়া কি চাট্টিখানি সাহসের ব্যাপার? বুকের পাটা লাগে ঘুষ খাইতে। আমি ঘুষ খাই- নিয়মিত খাই। বলা যায়, ঘুষ খাইতে না পাইলে দিনটাই আমার খারাপ যায়। অবশ্য ঘুষ ছাড়া দিন আমার খুবই কম যায়। 

আলাউদ্দিন মিয়ার শরীরের রঙ ফরসা সাদা। মুখে চাপ দাড়ি। মাথায় জিন্না টাইপের কালো রঙের বড় টুপি। নিজের বাসার ড্রয়িংরুমের নির্দিষ্ট সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে জীবনের রমণীয় কীর্তি বয়ান করতে দারুণ পছন্দ করেন আলাউদ্দিন মিয়া। বাড়িটা আটতলার, তিনি থাকেন চারতলায়- পুরোটাজুড়ে। দুই ইউনিটের বাড়ি। নিজের বাড়ি বিধায় দুই ইউনিট ভেঙে একটা করেছেন। বিশাল ফ্ল্যাট, প্রায় বাইশশো স্কয়ার ফিট। চাকরি করেন আয়কর অফিসে। শোনা যায়, এই বাড়ির মতো ঢাকা শহরে আলাউদ্দিন মিয়ার আরও কয়েকটা বাড়ি আছে কিন্তু লোকটা ধরা দেয় না। দেখলে মনে হবে মাটির তৈরি সাপ, ছোবল দিতে জানে না; কিন্তু সময়ের ফোড়ে তেড়ে উঠতে ওস্তাদ। কারণ, কোমরে জোর টাকার।

নিজেই বলেন আলাউদ্দিন মিয়া, নিজের বাসার প্রসারিত ড্রয়িংরুমে হেলে দুলে, বাসার অন্যান্য ভাড়া মালিকের বয়স্ক পিতারা আসেন বিকেলে গল্প করতে বা সময় কাটাতে। আরও একটা ঘটনা, বিকেলে আলাউদ্দিন মিয়ার বাসায় প্রচুর খাবার-দাবারের আয়োজন থাকে। অফিস থেকে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে আলাউদ্দিন মিয়া লুঙ্গি পরিধান করে ড্রয়িংরুসে বসেন সোফার শেষ দিকে দুই পা ছড়িয়ে। ধীরে ধীরে তিন তলা, ছয় তলা, আট তলা, নিচতলার বয়স্কজনরা আসেন, তেলে তেলে গল্প জমে। আসলে জমে না, জমান আলাউদ্দিন মিয়া নিজেই। প্রতিদিন অফিসের নানান ধরনের ফিরিস্তি দেন, যেই ফরিস্তির মধ্যেভাগে থাকেন তিনি। কতটা সত্য, কতটা বানোয়াট, কতটা নিজেকে জাহির করার... বাকিদের বোঝার উপায় থাকে না; কিন্তু একই ঘটনা বা গল্প বার বার শুনতে ভাড়ায় থাকা বয়স্কজনেরা মুড়ি-চানাচুর পিঠা সিঙ্গারা পুরি ইত্যাদি সাবাড় করে। যেহেতু বিকেলটা আলাউদ্দিন মিয়ার ড্রয়িংরুমে খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে কাটে, সবাই অংশ নেয়, মন্তব্য ঝাড়ে, হাসেও প্রয়োজন হলে।

বাড়িতে ভাড়া আসার পর আবু কালামও যোগ দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন মিয়ার ড্রয়িংরুমের আনন্দঘন চক্রে। কয়েক দিন আসার পর বুঝতে পারলেন, মূলত একজন লোকের চামড়ার নিচের চর্বির পরিমাণ জানানোর পাশাপাশি খুব পরিকল্পনা করে আলাউদ্দিন মিয়া নিজের বাদ্য বাজানোর জন্য আয়োজন করে থাকে। মানুষ হিসেব অনেকটা রগচটা, কিছুটা বেহিসেবী, চিমটিখানেক লাগাম ছাড়া। চোখের সামনে কোনো কিছুর অসঙ্গতি দেখলে কোনো কিছু না ভেবে মুখে যা আসে বলে ফেলেন।

স্ত্রী মর্জিনা বেগমের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়ার বিষয় থাকে, মুখের লাগামহীন বাক্য। রিকশায় তো পারতপক্ষে আবু কালামের সঙ্গে ওঠে না মর্জিনা বেগম। রাস্তায় অনেক রিকশা গাড়ি ট্রাক চলছে। চলতে চলতে রিকশা কোনো গর্তে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ওয়াসার চৌদ্দগুষ্ঠী তুলে গালি দেন আবু কালাম, হারামজাদারা- আমরা ট্যাক্স দেই না? রাস্তা ফুটা ফাটা ক্যান? জনগণের টাকায় দামি গাড়িতে চড়ো, বছরের পর বছর বিদেশে থাকো, বছরের পর বছর চুক্তি বাড়াও খুঁটির জোরে আর রাস্তায় রাস্তায় গর্তে পরি আমরা, শূয়োরের বাচ্চা...

আশপাশের লোকজন তাকায়। কেউ হাসে। কেউ সমর্থন করে। কোনো কোনো ভদ্রলোক প্রকাশ্যে রাস্তায় খিস্তিখেউড়ে বিরক্ত হয়ে ভ্রæকুঁচকে তাকায়। সেই তাকানোয় জ¦লে ওঠে মর্জিনা বেগম, তোমারে না কইচি রাস্তায় গালিগালাজ করবে না।

ক্যান? তোমার বাপরে গালিগালাজ করি?

চোখের মধ্যে আগুনের দৃষ্টিতে তাকায় মর্জিনা,... অসভ্য... ইতোর

রিকশা থামিয়ে নেমে যায়। এই ঘটনা অনেকবার ঘটেছে ঢাকা শহরের রাস্তায়, কিন্তু আবু কালাম নির্বিকার। অবশ্য একটা বিষয় মনে মনে খুব পছন্দ করে মর্জিনা বেগম, যখন রাস্তায় পুলিশ পাহারায় পতাকা শোভিত গাড়িতে কাউরে যেতে দেখে বাঁশি বাজিয়ে, চিৎকার করে ওঠে আবু কালাম- দেখেন দেখেন বড় বড় চোর যাইতেছে।

চোর? পাশের লোক অবাক।

আরে দেখতেছেন না। পুলিশ পাহারা দিয়া লইয়া যাইতেছে। পুলিশ কাকে পাহারা দেয়? চোর ডাকাইতদের... 

আবু কালামের এই আবিষ্কারে মুগ্ধ মর্জিনা বেগম। 

আবু কালাম বাসায় এসে বাড়িঅলা আলাউদ্দিন মিয়ার তলব পান। তলব পেয়ে বুঝেছিলেন-অনেক দিন বাড়িঅলার মজমায় যাওয়া হয় না, সেই কারণে তলব। ছুটির দিন, সকালে নাস্তা করে বাড়িঅলা আলাউদ্দিন মিয়ার ড্রয়িংরুমে ঢোকেন আবু কালাম।

সকালের মজমায় আরও কয়েকজন ভাড়া মালিক উপস্থিত দেখে অবাক আবু কালাম। সন্ধ্যার মজমা কি ছুটির দিন সকালে বসছে? কিন্তু রুমের মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার কোনো আয়োজন নেই। সবার মুখ গম্ভীর। আলাউদ্দিন মিয়া নির্বিকার চিত্তে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে।

খবর শুনছেন? সাততলার ভাড়া মালিক তাকায় আবু কালামের দিকে।

মাথা নাড়ান- কি খবর?

উনি, আলাউদ্দিন মিয়াকে দেখিয়ে বলে, বাড়ি ভাড়া বাড়িয়েছে দুই হাজার করে মাসে।

সঙ্গে সঙ্গে আবু কালামের করোটির মধ্যে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র গতির আগুন লেগে যায়। বসা থেকে দাঁড়িয়ে আলাউদ্দিন মিয়ার মুখের কাছে এগিয়ে যান আবু কালাম, বিদ্যুৎ গ্যাস পানির দামতো বাড়ে নাই। আপনে গত বছর বাড়ি ভাড়া বাড়াইছেন এক হাজার টাকা। এ বছর বাড়াইলেন- ডাবল! ঘটনা কি? আমাগো মানুষ মনে অয় না? কি মনে করেন আপনে?

আপনে কি আমারে ভয় দেখাইতেছেন? বসা থেকে দাঁড়ায় আলাউদ্দিন মিয়া। 

ভয়? আপনে বাড়ি বানাইয়া ভয় দেখাইতেছেন, আমি টেকা দিমু-ভয় দেখামু না ক্যান। আমি ভাড়াই দিমু না। আপনে দেখি কী করেন?

চিৎকার করে আলাউদ্দিন মিয়া, আপনের সাহসতো কম না। আমার বাড়ি থাইকা আমারে ভয় দেখাইতেছেন? আমি আপনারে...

কি করবেন আপনে?

আবু কালাম পিছনে তাকিয়ে দেখেন, কেউ নাই। ড্রয়িংরুম ফাঁকা; কিন্তু মাথার মধ্যে ক্রোধের গাড়ি চলতে শুরু করলে ধাক্কা না খাওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে। এখানে মর্জিনা বেগম নেই, যে রাগে রিকশা থেকে যাবে। সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িঅলা। 

আপনারে আমি.... হঠাৎ আবু কালাম নিজেকে বারান্দায় আবিষ্কার করে, কেবল আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত নয়, মনে হলো কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে। তিনি নামছেন দ্রুত নিচের দিকে আর কয়েক সেকেন্ড পরই শরীর স্পর্শ করবে কঠিন ইটের শক্ত মেঝে। তিনি পড়ছেন তো পড়ছেনই... সঙ্গে সঙ্গে শুনছেন বাড়িঅলা আলাউদ্দিন মিয়া পৈচাশিক অট্টহাসি, শালার পুত ভাড়াটিয়া! আমার লগে ফুটানি দেখাইতে আসে হারামজাদা...। 

বিপরীতে পড়তেই নিচের দিকে থাকেন আবু কালাম। আবু কালাম পড়তে পড়তে বিস্ফোরিত চোখে তাকায়, শুধু রামপুরার নয়, গোটা ঢাকা শহরের বাড়িঅলারা বাঘের চোয়ালে হা মুখে-আবু কালামকে গ্রাস করবার অধীর আগ্রহে। 

তিন

শরীরে জ্বর হওয়ার কারণে সকালে উঠে আবু কালাম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অফিসে যাবে না । সকালে উঠে মর্জিনা বেগমের হাতে এক কাপ আদা চা খেয়ে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিল; কিন্তু ঝামেলা তৈরি করে মোবাইল। আর্তস্বরে মোবাইল বাজলে পত্রিকা থেকে চোখ রাখে মোবাইলের ওপর। বসের ফোন। 

হ্যালো স্যার? 

কোথায় আপনি?

স্যার বাসায়। আমিতো আধঘণ্টা আগে জানিয়েছি, আমার জ্বর...

আপনার জ্বর ঠিকাছে কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ফাইলটা কোথায়?

স্যার, আমার ড্রয়ারে।

জানেন কত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল? ফাইলে মাননীয় সই করার জন্য প্রস্তুত। অনেক তেল ঠেলে মেখে আমাকে এই অবস্থায় পৌঁছুতে হয়েছে। আর ফাইল আপনার ড্রয়ারে ঘি মেখে ঘুমুচ্ছে? তাড়াতাড়ি আসেন... ডিজি মোবাইল কেটে দেন।

আবু কালাম বাধ্যগত ছাত্রের উদাহরণে দ্রুত জামা প্যান্ট পরিধান করে অফিসের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হয়। দরজা থেকে বেরুবার মুখে স্ত্রী মর্জিনা বেগমের মুখে দেখেছে বিদ্রæপের কটাক্ষ ছুরির হাসি। রিকশা চলছে অফিসের দিকে। চারদিকে জ্যাম রিকশা গাড়ি আর ট্রাকের। মাথায়ও জ্যামটা ঢুকে যায় অবিরল স্রাতের গতিতে। রাস্তার ওপাশ দিয়ে দুই তিনজন হিজড়া আসে বিকৃত হাসিতে। 

স্যার, আমাগো একশো টেকা দেন!

তিনজনে ঘিরে দাঁড়ায় আবু কালামের রিকশা। মুখের ওপর কড়া মেকাপ। শরীরে পোশাক যাচ্ছে তাই। কাছে এসে দাঁড়াতেই বিকট গন্ধ পান আবু কালাম। দ্রুত পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা দিলে ওরা বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে চলে যায় অন্য রিকশার দিকে। আবু কালামের মনে হয় তেল চুবানো পিঠার মতো ফেটে যাচ্ছে দিনটা। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে ডিমভাজি করছে কাঁচা মরিচ আর কাঁচা পিয়াজের সঙ্গে। চারদিকে নতুন ডিম ভাজার হৈ হৈ গন্ধ আসছে... সঙ্গে দূর থেকে আসছে ট্রেনের শব্দ। 

মোবাইল বাজে, হ্যালো? 

অফিস কলিকের ফোন। বিরক্তির সঙ্গে মোবাইল কানে নেন আবু কালাম, হ্যালো?

আপনে আসছেন না কেন? 

আরে ভাই, আসার জন্য কি বিমান পাঠাইচো? আইতেছি রিকশায়। হালায় আবার আটকে গেছি রেলগেটের সিগন্যালে। ওদিকে ট্রেনের দেখা নেই। ট্রেন আসছে না আর হালার পো হালারা সিগন্যালের বাঁশ ফালাইয়া আটকাইয়া রাখছে।

ঠিক আছে, আমি ডিজিরে কইতেছি...

ডিজি! শব্দটা করোটির দেয়ালে ত্রিশ কিলোমিটার বেগে বাড়ি খায়। কেবল বাড়িই খায় না, বাড়ি খেয়ে দেয়ালের মধ্যে গর্ত হয়ে গেছে তিন ফিটের। ডিজি- এক একটা অধিদপ্তরের আব্বা! ডিজি খাইলে নিচের দিকের লোকেরা খায়, ডিজি ঘুমাইলে অন্যরা ঘুমায়, ডিজি নৃত্য করিলে সবাই কোমর দোলায়, ডিজি সাঁতার কাটিলে অন্যরা হাতে তালি দেয়, বাহা রে বাহ বাহ... চলছে ঘোড়া নদীর ওপর দিয়ে...।

শালার উজবুক, নিজের মনের মধ্যে উড়–ম ভাজতে থাকে আবু কালামের, ডিজি আসে, ডিজি যায়, মাঝখানের কিছু কই ক্ষমতার সোনার তক্তায় বসে চানাচুরের বাটিতে আমলকি ভর্তা চাটে আর চাটে। অফিসের অনেকের মতো আমিও এক পদে এগার বছর আছি, প্রমোশনের দাবি তুললেই ডিজি তিন হাত জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন, মন্ত্রণালয়ে ফাইল আটকে আছে।

তো?

ফাইল আসলেই হবে...

কি হবে?

সামনের পুকুরে ইলিশের চাষ।

ইলিশের চাষ?

চারপাশে জড়ো হওয়া কয়েক বছরের ক্ষমতার পাতি ডিজিরা মিঠাই মাখা মুখে হাসে। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরের বাতাসের কলও নড়ে। ডিজি বলেন, বুঝলা না? মন্ত্রণালয় থেকে প্রমোশনের ফাইল আসা মানে পুকুরে মাঘী পূর্ণিমায় ইলিশ চাষ বা উৎপাদনের মতো অলৌকিক ঘটনা। 

ডিজি! ডিজি বানায় কারা? 

মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় এক পাল কাক। উড়ে যেতে যেতে কা কা রবে হাসে, হালার মাকুন্দা আবু কালাম- এখনো জানোস না, ডিজি কারা বানায়? ডিজি বানায় রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদ ছাড়া দেশ একপাও চলতে পারে? পারে না। রাজনীতিবিদরা দেশের মা বাবা তালই মাওই...

সঙ্গে সঙ্গে আবু কালাম দেখতে পায় ট্রেনটা অনেক দূর থেকে হিস হিস আওয়াজ তুলে আজদাহা সাপের ফনায় এগিয়ে আসছে। ট্রেনটা যত কাছে আসে শুনতে পায় স্লোগান- আমার ভাই তোমার ভাই, তুফান ভাই তুফান ভাই। তোমার আমার মার্কা, চালতা মার্কা চালতা মার্কা। তুফান ভাই যেখানে, আমরা আছি সেখানে। তুফান ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র... 

কয়েক বছর আগে পত্রিকায় পড়েছে আবু কালাম চূড়ঙ্গামারীর ক্ষমতাসীন দলের নেতা তুফান মিয়া নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করে নিজেই বিয়ে করেছে। ইন্ডিয়া থেকে আসা গরুর আমদানির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে তুফান মিয়া। সেই গরুর নেতার চরিত্র পবিত্র! গলার মধ্যে বোয়াল মাছের কাঁটা ঢুকছে আবু কালামের। ট্রেনটা আসছে তীব্র গতিতে। 

কাছাকাছি আসতেই মনে হলো ট্রেনটার দিকে ছুটে যাচ্ছে দুই পাশে থমকে যাওয়া রিকশা বাস ট্রাকগুলো, ট্রেনটা মুহূর্তের মধ্যে বিশাল অজগরের হায়ের মধ্যে সবকিছু গ্রাস করে ছুটে যাচ্ছে অসীমের দিকে, শূন্যতার দিকে, অন্ধকার গোলকের দিকে। সবকিছুর সঙ্গে ট্রেনের সাপ মুখগহ্বরে ঢুকে যায় আমাদের আবু কালাম, রিকশাঅলা ও রিকশাসমেত। 

চার

পরের সকালে জ্বরাক্রান্ত আবু কালাম বিছনায় শুয়ে শুয়ে দেখতে পাচ্ছেন, বাসার সামনে একটা মিছিল। মিছিলের প্রত্যেকটা মুখ আবু কালামের। আবু কালাম উঠে বসে। মুখে স্মিত হাসি, আমি একলা না। আবু কালাম একলা না। 

আবু কালামরা... 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //