শুধু তোমার জন্যে

মা,

বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছি তোমাকে চিঠি লিখবো। কারণ চিঠি পেতেই তুমি বেশি পছন্দ করো। লিখবো লিখবো করে আর কিছুতেই লেখা হয়ে উঠছে না। কেন জানি দূর আলাপনিতে তুমি ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারোনি। তবু দূরালাপনীতেই আমাদের কথা হতো বেশি।

তুমি এখন যেখানে আছো- নিঃসীম তিমিরাচ্ছন্ন মহাসাগরের পাড়ে এক নতুন দেশে, সেখানে কোনো নেটওয়ার্ক পৌঁছায় না তাই লিখতে বসা। যদিও জানি এ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছুবে কি না নিশ্চিত নই; কিন্তু কতবার বসি আর কতবার যে কাগজ কলম ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলি তার ঠিক নেই। তোমাকে তো বহুবার চিঠি লিখেছি তবে লিখতে বসে আজ কেন কষ্ট হচ্ছে মা!

যেদিন তুমি এই পৃথিবীর রৌদ্র জ্যোৎস্নার উচ্ছ্বাস ছেড়ে প্রিয়তম সন্তানদের ছেড়ে, ঘর-সংসার, আদরের গছপালা ছেড়েও চলে গেলে। সেদিন বুঝিনি সত্যিই তুমি চলে গেছো। কীভাবে বুঝবো- আমি যে বহুদিন ধরে তোমার কাছ থেকে দূরে। তাই এখনো মনে হয় ছায়াঘেরা, মায়াতে মোড়ানো আমাদের খুলনার বাড়িতেই আছো। দোতলার ঝুল বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছো। বসে বসে তোমার আত্মজনদের আসার অপেক্ষায় চেয়ে আছো অপলক। আমার চোখ থেকে যেদিন এ দৃশ্য মুছে যাবে সেদিনই বুঝব তুমি নেই। আয়নার সামনে যখনই দাঁড়াই, নিজেকে দেখি আর একা একাই কথা বলি নিজের সাথে। শুধু কি নিজের সাথে? তোমার সাথেও কথা বলি। এ জীবন তুমিই তো আমাকে দিয়েছ মা!

ক’দিন থেকে ঘুম আসে না কিছুতেই। হাতে একটা বই নিয়ে বিছানায় আসি। পড়তে পড়তে যদি ঘুম আসে। ঝুপ করে কারেন্ট চলে যায়। মোম জ্বালাই। আবার বিছানায় আসি। ঠিক তখনি পাানি খাওয়ার কথা মনে পড়ে। ইচ্ছেটাকে বাতিল করি। মনটা অস্থির হয়ে আছে। সারাদিন নানা কাজের ব্যস্ততা। শরীরের ক্লান্তি তো আছেই। মনে হয় বিছানায় গেলে মড়ার মতো ঘুমাবো; কিন্তু তার কিছুই হয় না। রাতে ঘুম না এলে নিজেকেই নিজের খুন করতে ইচ্ছে করে; কিন্তু আজ ওসব কিছুই হচ্ছে না। ছেলেবেলার দিনগুলো বিলি কেটে কেটে বুকের অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মা, তুমি আর বাবা দুকাপ চা নিয়ে বাঁধানো আম গাছের তলায় বসে আছো দুটো বেতের চেয়ারে। দৃশ্যটা আমার খুব মনে পড়ে। তোমরা তো দুজন কাজিন ছিলে তাই তোমাদের ছেলেবেলার কমন ঘটনার বিষয়ে গল্প করতে ভালোবাসতে। তোমাদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তখন দাদা আর আমাকে নিয়ে তোমাদের নির্ঝঞ্ঝাটের সুখি সংসার। সম্পদের প্রাচুর্য নেই কিন্তু শান্তির প্রাচুর্যে তোমরা সমৃদ্ধ। বাবা তোমাকে ডাকতো ম্যাডাম বলে। আমরা আড়াল থেকে মজা পেয়ে খুব হাসতাম। তোমার চাঁপাফুলের মতো গায়ের রং আর কাটাকাটা মুখের গড়ন আমার শ্যাম বরণ বাবার পাশে তোমাকে ঠিক লক্ষ্মী প্রতিমার মতো লাগত। বাবা আর তোমার সেই সুখি সুখি ছবিটা আমি স্বপ্নে খুব দেখতে চাই। সারাদিনে কতবারই তো চোখের মধ্যে ভাসে; কিন্তু রাতে ঘুমাবার পর মানুষ তো আর ইচ্ছে মতো স্বপ্ন দেখতে পারে না। আবার যা কখনো ভাবিইনি সে রকম দৃশ্য সে সব স্বপ্নের ভেতর ডুব-সাঁতার খেলতে থাকে। আবার কখনো যা নিয়ে সারাদিন ভাবছি স্বপ্নের কাছে পিঠেও তাকে পাই না। তোমাদের সেই ছবিটা আমি দু-একবার ছাড়া আর কখনো দেখিনি। সেও অনেক দিন আগে। স্বপ্নের জগত- সে এক রহস্যের জগৎ। তাই আমি কখনো ও নিয়ে মাথা ঘামাইনে। ভাবতে গেলে মাথা খারাপের জোগাড়। তবু স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে।

মা, তোমাকে নিয়ে এই তো কাল রাতে ভীষণ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি। সেই স্বপ্নের কথা জানাতেই তোমাকে লিখতে বসা। সকাল বেলা, সূর্যটা যখন সবে আকাশের পুব কোণটা জুড়ে উঠে বসেছে- আমার ক্লাসে যাবার সময়। হোমসের আঙিনায় এসে দেখি আমার একদল ছাত্রীর মাঝখানে ছোট্ট তুমি বসে আছো। আমি তো দেখে অবাক। দূর থেকে চিনতে পেরে তুমি ছুটে এসে আমার কোলে বসলে। কী অদ্ভুত কাণ্ড, আমি খুব সহজেই তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছি। আর তুমি অনর্গল কথা বলছ। মনে হলো এই স্বপ্ন আমি অনেকক্ষন ধরে দেখছি। স্বপ্ন দেখতে দেখতে খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর অনেকটা সময় পার হয়ে যায় এ স্বপ্ন না বাস্তব বুঝে উঠতে। কখন যেন চোখ ছাপিয়ে জলে বুক ভাসতে থাকে। সেই স্বপ্নের কথাটা তোমাকে জানাতে খুব ইচ্ছে করছে।

মা, তুমি গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতে, বলতেও। কী সুন্দর করে গান গাইতে তুমি। মজার গল্প শুনলে হেসে গড়াগড়ি তো, কষ্টের গল্প শুনে বুকের ভেতর থেকে কান্না চলে আসত তোমার। তুমি খুব ট্র্যাজেডি পছন্দ করতে। যে বার মোটামুটি সচেতন অবস্থায় তোমার সঙ্গে দেখা হলো, তুমি তখন একটু নরম হয়ে গেছো। বিছানায় শুয়ে আছো। খবরের কাগজ থেকে একটা কাহিনি পড়ে শুনিয়েছিলাম তোমাকে। গল্পটা এক মা ও তার একমাত্র ছেলের। গল্প ছেলেটাই বলছিল।

-আমার মায়ের ছিল এক চোখ কানা। চরম গরিবি হালে ছিল আমাদের বাস। মা এখান-সেখান থেকে শাক-পাতা জোগাড় করে এনে বাজারে বিক্রি করতেন। এর পরেও তিনি আমাকে স্কুলে পাঠাতেন। একদিন বাসায় ভুলে টিফিন রেখে আসায় মা টিফিন বাটি নিয়ে স্কুলে যান। এর আগে আমার মা কোনো দিন স্কুলে আসেনি। আমিও কোনো দিন মায়ের সঙ্গে কোথাও যেতাম না। কানা মাকে নিয়ে সবসময়ই বিব্রত বোধ করতাম। সেদিন স্কুলের ছাত্ররা প্রথম আমার মাকে দেখে। এরপর তারা আমাকে এমন খ্যাপাতে লাগল, আমার মনে হচ্ছিল মাটির সঙ্গে মিশে যাই। ‘কানির ছেলে-কানির ছেলে’ বলে ব্যঙ্গ করতে থাকে। আমি কোনো রকমে কানে হাত চাপা দিয়ে বাসায় চলে আসি। মাকে দেখে প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ি। ‘কেন তুমি আমার স্কুলে গিয়েছিলে? কে তোমাকে বলেছে যেতে? তোমার চোখ নেই, তোমার লজ্জা করে না? তোমার লজ্জা না থাকতে পারে, আমার তো আছে। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। কেন তোমার চোখ নেই? তুমি মরতে পারো না? এক চোখ নিয়ে কেন বেঁচে আছো? কেন বলো?

মা ছিলেন নিশ্চুপ। রাতে পানি খাওয়ার জন্য উঠলে দেখি মা নীরবে কাঁদছেন। আমি বুঝতে পারছি তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিঃশব্দে কাঁদতে যাতে আমি না জেগে যাই; কিন্তু আমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা জাগলো না। দিনে তাকে যা বলেছি ঠিকই বলেছি বলে নিজেকে বুঝালাম। এরপর আমি শপথ করলাম লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হতে হবে। এই গ্রাম থেকে চলে যেতে হবে। পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম প্রাণপণ। খুব ভালো রেজাল্ট করলাম। শহরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব ডিগ্রি নিলাম। ভালো চাকরি পেলাম। বিয়ে করে সুন্দর সংসার জীবন শুরু করলাম। আমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো। এর ভিতর আমি মা’র সাথে কোনো যোগাযোগ করিনি। আমার মেয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কাছে এসে বলল- ‘বাবা এক চোখ কানা এক ডাইনি এসেছে।’ আমি গিয়ে দেখলাম আমার মা। আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম- ‘কে আপনি, এখানে কেন? বেরিয়ে যান এক্ষুনি।’

মা তাড়াতাড়ি পথের দিকে পা বাড়াল। বলল, মাফ করবেন। ভুল ঠিকানায় এসেছি। ভাবলাম ভালোই হয়েছে, মা আমাকে চিনতে পারেনি। 

একদিন আমাদের স্কুলে রি-ইউনিয়নের চিঠি পেলাম, অফিস ছুটি নিয়ে গ্রামে এলাম। সেই ছোটবেলার গ্রাম। সব চেনা। অনেক কিছুই মনে পড়ছে। স্কুল যাওয়ার পথে আমাদের সেই জীর্ণ-শীর্ণ বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইতস্তত করে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। এ কবছরে বাড়ির দৈন্যদশা আরও বেড়েছে। ঘরের ভিতর ঠান্ডা মেঝেতে পড়ে আছে মা। তার হাতে ধরা একটা চিঠি। চিঠিটা হাতে নিলাম। সেখানে লেখা- ‘খোকা তোকে কতদিন দেখি না। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। অনেক কষ্টে ঠিকানা যোগাড় করে শহরে তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার ভুল হয়েছিল, যাওয়াটা ঠিক হয়নি। তুই খুব রাগ করেছিলি। আমি একটুও রাগ করিনি। তুই যা করেছিলি তাই স্বাভাবিক। আমার কানা চোখ তোকে লজ্জা দেয়; কিন্তু কানা না হয়ে আমার যে উপায় ছিল না। খুব ছোট বেলায় এক দুর্ঘটনায় তোর একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছিলেন এ চোখ কোনো দিন আর ঠিক হবে না। এক চোখ নিয়ে তোর সারা জীবন কাটাতে হবে। আমার ছেলে এক চোখ নিয়ে সারাটা জীবন কাটাবে আর আমি দুই চোখ নিয়ে বেঁচে থাকবো তা চিন্তা করতেই আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। অবশেষে ডাক্তারদের আমার সিদ্ধন্তের কথা জানালাম। তোকে এক চোখ দিয়ে আমি এক চোখ নিয়েই জীবন কাটালাম।’

সেদিন সোনামনি মা আমার, তুমি সেই গল্প শুনতে শুনতে হু হু করে কেঁদে উঠেছিলে। আমাকে জড়িয়ে কান্না সামলানোর চেষ্টা করছিলে। আমিও কেঁদেছিলাম তোমার সাথে। মায়েরা তো এমনিই হয়। তারপর দু’হাতে আমার মুখটা তুলে চোখের পানি মুছিয়ে বললে- ‘মাকে এমন করে কাঁদাতে আছে? যা একটু চা করে নিয়ে আয়।’ আমি তোমার চোখের সামনে থেকে সরতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আমি জানি তুমি আমার পাশে পাশেই আছো মা। আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না; কিন্তু তুমি আমাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছ। আমাকে চোখে চোখে রাখছ। যেমন করে ছোটবেলায় একদম চোখের আড়াল হতে দিতে না ঠিক তেমনি।

মা, তোমাকে লিখতে লিখতে কতবার চোখ ভিজে উঠছে। মাঝে মাঝে হু হু করে কান্নায় ডুবে যাচ্ছি। চোখ মুছে আবার লিখতে শুরু করি। লিখতে লিখতে অক্ষরগুলো নিজের চোখেই ঝাপসা হয়ে উঠছে। সেই ঝাপসা অক্ষরগুলো ধীরে ধীরে আরো বড় হতে থাকে। তারপর আরোও ঝাপসা হতে হতে এক সময় এই নিভৃত মফস্বলের ভোরের নিঃসঙ্গ রাস্তার মতো হয়ে যায়।

রাত থেকে কারেন্ট নেই। মোম জ্বেলে রেখেছিলাম। মোমের আলো জ্বেলে জ্বেলে নিভে গেছে কখন। দূরে কুমুদিনী হাসপাতাল গেটে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজলো। ভোরের আলো জানালা দিয়ে ঢুকছে শেষ কার্তিকের হিম হিম হাওয়ায় মিলেমিশে। ঠান্ডা হাওয়ায় আমার শরীর জড়সড় হয়ে পড়ে আছে তোমার চিঠির উপরে একটু উষ্ণতা পাওয়ার জন্য। কতদিন তোমার স্পর্শ পাইনে মা! বুকটা জুড়ে কেবল মরুভূমির মতো হাহাকার। তোমার জন্যে, শুধু তোমার জন্যে মা।

এ চিঠি পড়তে পড়তে তুমি যেন খুব বেশি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি ভালো থেকো মা।


ইতি
তোমার শ্যামা 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //