সংকট

অনেক দিন হলো আকতারের সঙ্গে দেখা নেই। আকতারের বাড়িতে গেলে আফরোজা তার খোঁজ জানতে চাইলে খবির ওর কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। বেশ কিছু দিন হলো সে বাড়ি ফেরে না। আকতারের দুর্গত পরিবারের সঙ্গে সেই রাতটা খবিরকে থাকতে হলো। বাড়িতে ফেরার উপায় ছিল না। মধ্যরাতে গভীর ঘুমে চারপাশ যখন তলিয়ে আছে খবির তখন সন্দিহান। আকতার যদি আর ফিরে না আসে। শিশু সন্তান নিয়ে আফরোজার অবস্থা কেমন হবে? তার পাওনা টাকা ফেরত না পেলে কী যে অবস্থায় পড়বে সে?

রাত সব কিছু নীরব করে দিয়েছে। মা-কে না বলে বাড়ির বাইরে রাত কাটানো। মায়ের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? সে আফরোজার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। আলো-আঁধারি দৃষ্টিতে হেঁয়ালি। 

আফরোজা বেশ কিছুদিন বরবিহীন রাত কাটাচ্ছে। দোলন ভাবির একই অবস্থা। বজলু ভাই হঠাৎ করে নেই হয়ে গেল। অদ্ভূত চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি।

তখন মাঠ জরিপের কাজ চলছিল। ঘটনাটা যে ভাবগাম্ভির্যে বর্ণনা করেছিল। খবির তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। কী সুন্দর চেহারা, চোখ দুটি গভীর মায়াবী। পেটানো দেহ, মাথা ভর্তি চুল। না হলে কি দোলন তাকে বিয়ে করে। দোলন শহরের এক সমৃদ্ধ ব্যবসায়ীর মেয়ে। দোলন ছন্নছাড়া যুবককে বিয়ে করলে তা নিয়ে হইচই পড়ে যায়।

মেঘমুক্ত আকাশ তাদের ঢেকে রাখে মহাজাগতিক পাত্রে। আকতারের বাড়িটা প্রাচীরে ঘেরা। কিছুদূরে তার বাপের ভিটা। বড় দু’জন ছোট ভাইকে নিয়ে বাপের ভিটাতে বাস করে।

আকতার টেকনিক্যাল কলেজ থেকে পড়া শেষে চাকরির চেষ্টা না করে পেশা হিসেবে ব্যবসা বেছে নেয়। গ্রামে তার আলাদা মর্যাদা আছে। শিক্ষিত, টাকাওয়ালা, আলাদা বাড়ি করা চাট্টিখানি কথা। দক্ষিণে দুটি বড় ঘর, পাকা বারান্দা, টেবিল-চেয়ারে খাবার আলাদা জায়গা। পুবের ঘরে খবিরের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। উঠানে মাটির চুলা, ছাপড়া রান্না ঘর।

হঠাৎ করে আসার কারণে আফরোজা চনমনা হয়ে ওঠে। তাকে দেখে তার চঞ্চল হওয়ার কারণের মাঝে লুকিয়ে ছিল আকতারের উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা। খবির এমন সময় এসেছে যখন আকতার বাড়িতে থাকবে তা নিশ্চিত। তার ফিরে যাওয়ার উপায় নেই তা বুঝতে পেরে আফরোজা উঠনে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়। আপনেকে কী দিয়ে খাওয়াব যে, ঘরে তেমন কিছু নেই। বাজার করার ট্যাকাও শ্যাষ।

খবির অস্বস্তিতে পড়ে। তার ধারণা ছিল আকতার কাজ শেষে বাড়িতে ফিরবেই। কী এমন হয়েছে যে তার কোনো খোঁজ নেই। 

উঠানে মাটির চুলা এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে দপ করে জ্বলে ওঠে। আগুনের আলোয় আফরোজা চুড়ির শব্দে রান্না করতে থাকে। শিশুটি ঘুম ভেঙে কাঁদতে থাকে। 

বাবু কাইন্দো না, এই যে আমি।

শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রান্না ঘরে ফিরে আসে। তারা একসঙ্গে রাতের খাবার খায়। ডিম, আলু ভর্তা। যেমন ক্ষিদে পেয়েছে। অনেক খেতে পারতো। আফরোজা কীভাবে চলছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। 

রাত কত, তা অনুমান করা যাচ্ছে না। অচেনা পরিবেশে ঘুম আসে না। শেয়াল ডাকছে। একটা ডাকলেই হলো। অন্য সবাই অপেক্ষায় থাকে। সিগারেটে টান দিয়ে জানালার বাইরে চাঁদের আলো ভরা আকাশ দেখে। ধানের মাঠ, বাঁশ ঝাড়, দীঘির চারপাশ ঘিরে নারিকেল-সুপারি খেজুরের গাছ। সারি ধরে কিছু মানুষ গ্রামের অন্য প্রান্তে চলেছে।

আপনে কি ঘুমাইছেন?

দরজা খুলে খবির আফরোজাকে দেখে। সে বারান্দায় বসে আছে। 

ঘুম আসে না।

এখানে বসেন।

আফরোজার পাশে বসে খবির সিগারেট ফোঁকে।

আপনে সত্যি জানেন না ও কোয়ানে?

ভাবি আমি সত্যি জানি না। সাতদিন আগে দেখা হয়েছিল। এখানে কতদিন আসে না?

তা হলো গিয়ে দশ দিন হবিই।

দশ রাত আফরোজা স্বামীসঙ্গহীন। আজ এগারোতম রাত। খবির বিরক্ত হলো।

আপনি কীভাবে চলছেন?

আমি ভাই যেভাবেই চলি না ক্যান, ও ভালো থাকলেই হলো।

খবিরের মার কথা মনে পড়লো। সারারাত না খেয়ে জেগে কাটাবে। মার জন্য ওর খুব কষ্ট। 

অ্যাকা থাকি বাচ্চাকে বুকে নিয়ে। এদিকের অবস্থা ভালো না। আপনে জানালায় ছিলেন তখন দেখেননি ওই মাঠ দিয়ে একপাল লোক গেল? ওরা রেতে বাহিনী।

খবির রেতে বাহিনীর নাম শুনেছে। কমিউনিস্ট বিচ্যুত অস্ত্রধারী। তবে তারা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কোনো ক্ষতির কারণ হয় না। ওরা কাজ করে ওদের নিজস্ব নিয়মের মধ্যে। এদের মধ্য থেকে অনেকে বড় ধরনের সন্ত্রাসী ডাকাত পরিণতি পরিগ্রহ করেছে। 

আপনাকে কখনো ওরা বিরক্ত করেনি?

একনো না। এলাকায় ওর একটা ভালো নাম আছে। তাই তো আমার কুনু অসুবিধা হয়নি।

আপনেকে একটা কতা বুলবো?

কী কথা বলুন।

আপনের জন্যি আমার জু পোড়ে।

খবির ‘জু পোড়া’ শব্দের অর্থ জানে না। আফরোজার প্রকাশে পরিবেশ বদলে যেতে থাকে।

খবির আফরোজাকে জিজ্ঞেস করে, আকতার ভাইকে আপনি খুব ভালোবাসেন, তাই না?

আফরোজা বুক থেকে বড় শ্বাস বের করে বলল, মাইয়্যা লোকের ভালোবাসা আপনেদের পুরুষ লোকের কাছে কুনু দাম আছে? না হলি আজ এগারো দিন বৌ ফেলি কুনু ব্যাটাছাওয়াল থাকতি পারে?

আফরোজার প্রশ্নের উত্তর ভেবে সে যা পায় তার মমার্থ হলো একা থাকা বড় যন্ত্রণার। সে তার মার একাকীত্বের ছটফটা অন্তর দিয়ে অনুভব করে। বাবাকে যখন খুন করলো তখন সে প্রাইমারি স্কুল শেষ করেছে। বড় বোন তোতা স্কুল ফাইনাল দেবে। বাবা ছিলেন গরিবের ডাক্তার। পাস করা বড় ডাক্তার। তার সঙ্গে যারা ডাক্তারি শুরু করেছিল তাদের এখন বড় পসার। রওশন চৌধুরী সাইকেল চালিয়ে রাতে বাড়ি ফিরত। সবাই বোঝে মদ খেয়ে টাল হয়ে আছে। তার চিকিৎসা তুলনাহীন। সমস্যা হচ্ছে তাকে পাওয়া যায় না। ডাক পেয়ে কোথায় যায় কে জানে। মাঝে মাঝে গায়েব হয়ে যাওয়ায় লোক সকল তাদের অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে। এ সব কথা ওদের কানে আসতো। খবির মার ভাবনায় ব্যথিত। মা কখনো বাবাকে কোনো প্রশ্ন করেনি। আফরোজার পাশে বসে মাকে নিয়ে ভাবনা। মন কী যেন এড়িয়ে যেতে চায়। দেহ আর মনের বিরোধ আপাত লাগলেও তার মূলে প্রভাব রাখে আফরোজা, যৌবনবতী নারী। আকতারের বৌ একটি সন্তানের মা, আরেক জনের কন্যা, যার সান্নিধ্যে মায়ের ভাবনা ভেবে নারী সত্তার স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক অভিঘাতে অস্থির।

কেন পারবে না? আমি তো পারি।

ওমা কী যে বলেন। আপনে আবার কবে বিয়ে করলেন?

আমি তো বিয়ে করিনি।

তা হলি অ্যাকা থাকতি পারেন বুললেন যে। 

দু’জনের কথকথা হেঁয়ালিময় হয়ে ওঠে। বাড়ি উঠান রান্নাঘর, প্রাচীর ঘিরে ঝিঙ্গে, ডুমুর গাছ, বারান্দায় বসে থাকা দু’জন।

আপনে একনো বিয়ে করেননি ক্যান? ওর কাছে আপনেদের সব কতা শুনেছি। আপনের আব্বাকে ওরা খুন করল ক্যান?

খবির ভারাক্রান্ত হতে থাকে। সেরাতে রওশন চৌধুরী বাড়ি ফিরে ছেলে-মেয়ে, বৌ নিয়ে খেতে বসেছে। বৃষ্টি ঝরছিল। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। 

পরে জোরে ধাক্কা। কোনো রোগীর কেউ এসেছে হয়তো। 

গুলশানারা উঠে যায়। বাড়ির দরজা খুলে ভয়ে চিৎকার করে। ততক্ষণে মুখোশধারী অস্ত্র হাতে দু’জন ঘরের বারান্দায় খেতে বসা রওশন চৌধুরীর বুকে গুলি করে। ছেলে মেয়ের মাঝখানে রক্তে ভেসে লুটিয়ে পড়ে। 

খবির তার স্মৃতিতে যে আবিল অন্ধকার বয়ে বেড়ায় তা শুধু ওর মা ছাড়া কেউ জানে না। তার অগোছালো উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকার মাঝে কোনো তাড়না নেই।

এখন আফরোজার সান্নিধ্যে সজাগ হয় নিজের দেহে হাত বুলায়। বিড় বিড় করে বলে আমি এখনো বেঁচে আছি। দেহের জৈব সজীবতা হিংসার জন্ম দেয়। আফরোজাকে দেখে। আচমকা তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে উঠনের মাঝখানে এনে দাঁড় করায়। খবির উন্মাদ নাচে মেতে ওঠে। আফরোজা বাকরুদ্ধ। খবির তার কোমর ধরে নাচের মুদ্রায় নিতে আগ্রহী হয়। গ্রামের বিয়ে বাড়িতে নাচ-গান হয়। সেই প্রবণতায় আফরোজা নাচে।

আফরোজাকে উঠানে নিয়ে নাচের তাণ্ডবে ম্যাড়মেড়ে জঙ্গম অবস্থা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিতে চায়। আফরোজা ঠ্যাস দিয়ে বসে। খবির দাঁড়িয়ে থাকে। সহসা আফরোজা কঁকিয়ে ওঠে। 

খবির ভাই আর পারছি না।

ভাবি আমি আসলেই জানতাম না। তা না হলে এমন আচমকা কি আসতাম কখনো না।

আর্থিক দুর্গতির চেহারা কেমন হয়, তা খবির জানে। খাওয়ার সময় সে যা অনুধাবন করেছে। এখন তার আফরোজার জন্য মায়া হয়। 

আপনে কেমন পুরুষ গো। কিছুই বুঝেন না। 

সংক্ষুব্ধ আফরোজা জোরে শ্বাস নিতে থাকে। খবির তার বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাসে মানিয়ে নেয়। শিশু সন্তান কেঁদে ওঠে। 

এই যে সুনা।

আফরোজা ঘরে ছুটে যায়। খবির ক্লান্তবোধ করে। শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে না। কপালে হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। গরম লাগছে। টিনের চালে টপ টপ বৃষ্টির শব্দ। খবির কারোর উপস্থিতি টের পায়। 

২.

সকাল ৭টার কিছু পর খবির বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢোকে। গুলশানারা এক ঠাঁই রাত কাটিয়েছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুক মোচড় দেয়। রওশন চৌধুরী না বলে রাত কাবার করে ফিরতো। গুলশানারা বিপুল অভিমানে কষ্টে ভেঙে পড়লেও রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবেগে দু’চোখ বেয়ে জল ঝরতো। রওশন জড়িয়ে ধরে চুমু দিলে মুখ গুঁজে ডুকরে কাঁদত। এখন খবিরকে কি সে বুকে জড়িয়ে ধরবে? 

খবির মায়ের পাশে যেয়ে আলতো করে বলল, মা মাফ করে দাও। 

তুই তোর বাপের মতো হয়েছিস। গুলশানারা ধরা গলায় আরও বলল, আমার ভয় হয় কবে তোকেও।

মা ব্যাটার এখনকার বিরূপতা বা সখ্যতা সকালকে প্রলম্বিত করে। 

সারাবেলা একটানা ঘুমিয়ে উঠল। খবির চিন্তাহীন অনুভবে মাকে খুঁজল। আজকেই তা’হলে শেষ দিন। ভোরে পশ্চিম আকাশে সূর্য। আর কতক্ষণ, সবই এখন ধ্বংস হবে। মাকে খুঁজে পেল না। এখন তো কাউকে পাওয়া যাবে না। কেউ কাউকে চিনবে না। ভোরে পশ্চিম আকাশে সূর্য। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের তেজ নেই বলে খবির সেদিকে চেয়ে এমন ভাবনায় তড়পায়। মাকে দেখে বিহ্বল তাকিয়ে থাকে। 

কীরে তোর কী হয়েছে? গুলশানারা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে।

কেন তুমি কিছু বুঝতে পারছো না?

না কী বুঝবো?

দেখছো না সকালে পশ্চিম দিকে সূর্য।

এসব কী বলছিস তুই? তোর হয়েছে কী? আর কিছুক্ষণে সন্ধ্যা হবে।

বিকেলের শেষ রেশ মুছে গেল। খবিরের স্মরণ হলো, সকালে এক নাগাড়ে ঘুমিয়েছে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ঘুম ভাঙলে ভেবেছে সকাল। 

গুলশানারা সন্দিহান হয়ে ছেলেকে পরখ করে। 

রাতে তুই কোথায় ছিলি?

ওইযে আমি যার কাছে টাকা পাই। রাতে ট্রেন ছিল না তাই।

তুই এভাবে আমাকে না জানিয়ে বাইরে রাত কাটাবি না।

আর হবে না।

মা যে কী ভাবে সংসার চালাচ্ছে। আকতারের সঙ্গে ব্যবসা করতে অনেক টাকা ধরা খেয়েছে। মার হাতে কোনো টাকা দিতে পারে না। গুলশানারা ছেলেকে কিছু বলে না। 

সংসার চালানো নিয়ে বজলু ভাইর সেই বর্ণনা, যা শুনে খবির হতবাক হয়ে তার মুখের দিক চেয়েছিল। বজলু ভাইর কথা সং-এর সার হলো সংসার।

বাজার করার পয়সা নেই, ঘরে একটি দানাও নেই। ফিটফাট হয়ে বেরলো। শার্ট ইন করা প্যান্ট, চওড়া বেল্ট। দেখতে স্মার্ট। তহশিল অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে আসা একজন লোক। এক হাতে বাড়ির পোষা বড় মোরগ, অন্য হাতে পাটের ব্যাগে সরিষার তেলের বোতল, কাচের বয়ামে ঘি, সুগন্ধি চাল। বজলু মওকা পেয়ে যায়।

কী ভাই কেমন আছেন?

লোকটি তাকে চেনে না। তার পোশাক-আশাক চেহারা, লোকটি তাকে ভরসায় নিয়ে বলল, জরিপ অফিসে কাজ। ক্যামনে যে অফিসারের সঙ্গে দেখা করি?

কী কাজ? জমি নিয়ে? রেকর্ডে নাম লিখাতে হবে?

হ তাই।

আপনি এখানে থাকেন। আপনার কাজের কী করা যায় কথা বলে দেখি।

বজলু জরিপ অফিসে ঢোকে। বেশ কিছু সময় পর বেরিয়ে আসে।

অফিসারের সঙ্গে কথা হয়েছে। এগুলো কী?

আমার বাড়ির জিনিস। তাকে দেব তাই আনছি।

আমাকে দিন, উনার বাড়িতে দিয়ে আসি। আপনার নাম ঠিকানা বলেন। আপনি এখানে থাকেন, আমি আসছি।

বজলু মোরগ ব্যাগ হাতে রোমাঞ্চে বিগলিত। আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধন্যবাদ দেয়। খবির বজলুর সংসার চালানোর পন্থায় নিজের অবস্থানের কথা ভাবে। বিজ্ঞানে স্নাতক। উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেও চাকরি বা মাস্টার্স পড়ার তাগিদ পায় না। বাবার মৃত্যু আর সহেলীর অবহেলা, খবির ভেতরে অনেক বদলে যায়। মাঝে মাঝেই মাকে দুশ্চিন্তা, যন্ত্রণার মাঝে ফেলে উধাও হয়। 

পাশের বাড়ির জানালায় সহেলীর আবছা মুখের দিকে চেয়ে স্থির হয়ে যেত। ঘন সন্ধ্যায় আলো জ্বেলে পড়তে বসতো। বইয়ের পাতায় আলোর বিচ্ছুরণ সহেলীর মুখের চেহারা নিত্য রহস্যে ঢেকে দিত। খবির সহেলীর প্রেমে পড়ে। সহেলীর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় থাকলেও নীরবতা তার শতসিদ্ধ। খবির সহেলীকে নিজের বলে ভাবার প্রেরণায় একটি কবিতা লেখে।

 সন্ধ্যায় ডানা মেলে জোনাকি বাহার

 লজ্জাহীন ভালোবাসা 

 অমির অমৃতে

 রাতে ফোটে শালুক

 তোমার রসের সাগরে।

কবিতাটা লিখে খবির পাগল প্রায়। 

ওর সম্বিৎ ছিল কি সেই রাতে একাকী বাড়ির ওই ঘর, খাট বিছানা, জানালা ঠিকরে চাঁদের আলো, বাস্তবতার নতুন অবস্থা। পরিপূর্ণ নারী দেহ, রেফারেন্স পয়েন্টে যে গন্ধের কোনো অস্তিত্ব নেই তেমন গন্ধ। পার্থিব মুক্ত অন্য দোলন, দেহের গভীর থেকে টেনে নিচ্ছে। তৈরি করছে ফুটাচ্ছে, শুষে নিচ্ছে। সহেলীকে নিয়ে কবিতা লিখার রাতে অনুভূত অভিজ্ঞতা, আফরোজার সঙ্গে সেই রাতে যা ওই প্রথম। সব কিছুর প্রথম স্মরণে কোনো তাগাদা দেয় না।

আকতারের সঙ্গে ব্যবসায় বেশ উপার্জন হতে থাকে। সহেলী ধনী ঘরের ছেলেকে বিয়ে করে সঙ সেজে জেঁকে বসে। উপার্জিত অর্থে উদ্বেলিত হয়ে সহেলীকে ভুলেও ভুলতে পারে না। দোলন বেশ ভালোই জানে সহেলী তাকে পাত্তা দেয় না। 

আকতারের সঙ্গে ব্যবসা না করলে আফরোজার দেখা পেত না। যে অভিজ্ঞতা আফরোজা তাকে দিয়েছে, এখন সে স্মরণ করে দোলন ভাবির ইঙ্গিত। মার প্রতি দোলনের আক্রোশের জায়গাটা খবির ঠিক ধরতে না পারলেও ওর মন ইশরাই ব্যক্ত করে ভিন্ন ভাষ্য। খবির নিজের প্রতি বিরক্ত হয়।

গুলশানারা দোলনকে পছন্দ করে না। তার ধারণা দোলন খবিরকে নষ্ট করবে। তাগড়া জোয়ান ছেলেটা আত্মভোলা। সে যে কেন আকতারের সঙ্গে ব্যবসায় জড়ালো। তবুও ভরসা অন্য পথে পা না মাড়ায়। আকতারের ডান চোখের সাদা অংশে একটা কালো বিন্দু। দু’জনার কাছে দু’ভাবে প্রতিভাত। খবিরের কাছে আকর্ষণীয়। গুলশানারা দেখে অন্য সর্বনাশ।

সহেলীর তীব্র তিরস্কৃত প্রত্যাহারে খবির পনের দিন উন্মাদ সময় কাটিয়েছে। দোলন তখন তাকে বেশ সময় দিয়েছে। বজলু খবিরকে বিশেষ স্নেহের আবেগে ডাকে। মানুষটা অনেক কিছু করতে পারতো, তাই সে কিছুই করলো না। ভালো ছাত্র ছিল। গান অভিনয় আড্ডা। জীবন পরিচালনে ভিন্ন পন্থা বজলুকে করেছিল বিরোধপূর্ণ বিতর্কিত। দ্বিতীয় মা, যে পুরুষকে বিয়ে করলো, তার পুত্রকে নিজের করে নেয়ার অপারগতায় বজলু অভিমানে ভেঙ্গে খানখান হলো। কেউ জানলো না বুঝলো না।

খবির সহেলী বিহনে বিলোল। ঠেলা গাড়ির চাতালে চিৎ হয়ে আকাশের অসীমতায় হারিয়ে একের পর এক সিগারেট ফোঁকে। দোলন সেখান থেকে টেনে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। 

তোমার কী হয়েছে যে মনে হচ্ছে সব শেষ?

ভালো লাগছে না তাই।

আমি জানি।

কী জানো?

সহেলী।

ওর কথা না বললে হয় না।

একটা মেয়ের জন্য কোনো পুরুষের জীবন শেষ হওয়ার না।

খবির দোলনের বাহুতে মাথা রেখে কেঁদে ওঠে। বাবার মৃত্যুতে মার বুকে মুখ রেখে জ্ঞান হারিয়েছিল। এখন দোলনকে জড়িয়ে কেঁদে হালকা হয়। 

বজলু একদিন হঠাৎ উধাও। খবির শহর খুঁজে তার কোনো খবর দিতে পারেনি দোলনকে। দোলনের অপেক্ষা অনিশ্চিত দীর্ঘ হতে থাকে। ধনী বাবা খোশাল মাঝি মেয়ের দুর্গত সময়ে কোনো খবর নিল না। দোলন তার লুকিয়ে রাখা সোনার গহনা একে একে খবিরের হাতে তুলে দেয়। গহনা বিক্রির টাকায় আর কতদিন চলবে। কিছু টাকা খবিরকে দেয় ব্যবসায় খাটানোর জন্য। সেই সুবাদে খবিরের নিত্য সঙ্গ দোলন তার দাবি হিসেবে ভাবতে থাকে। বজলুর অন্তর্ধানে দোলনের চাহিদার জায়গায় খবিরকে রেখে যত কৌশল সে ব্যবহার করে তাতে কাজ হয় না। আক্রোশ বাড়তে থাকে।

আকতার নিয়মিত লাভের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার অবস্থার নিয়ামক থাকে না। খবির দোলনকে এড়িয়ে চলে। 

 ৩.

আকতারের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর খবির নিজেকে পরিত্যক্ত ভাবতে থাকে। দিনগুলো পচা ডিমের মতো ঘোলাটে লাগে। তবু বেঁচে থাকার তাড়নায় আশা নিয়ে খোশাল মাঝির আড়তে যায়। আকতারের খোঁজ কেউ দিতে পারে না। খোশাল মাঝির আড়তে আকতার ভুসি মাল জোগান দিত। লেনদেন অনিয়মিত হয়ে পড়ায় আকতারের পাওনা না দিয়ে ঘোরাতে থাকে। খবিরের সঙ্গে সে যোগাযোগ করে না। আজ সে জানতে পেরেছে খোশাল মাঝির কাছে আকতার কোনো টাকা পায় না। এ কথা শোনার পর বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে সে একা। মা গেছে খালা বাড়ি। 

খবিরকে ঘিরে গুলশানারার অনেক স্বপ্ন, আশা। মা ওকে বলেছে, তুই ভালো রেজাল্ট করলি, এমএসসি পড়লি না। লেখা পড়া ছাড়া তোর আর কী করার আছে। তুই ব্যবসার কী বুঝিস। আকতারের সঙ্গে সুবিধা করতে পারবি না। তোকে এক হাটে বেচে আরেক হাটে কিনতে পারে।

দোলনের সঙ্গে তোর মেলামেশা আমার ভালোলাগে না। ওই ধাংড়ি মেয়ে তোর পেছনে লেগেছে কেন? বজলু কি আর কখনো ফিরবে?

বারান্দায় বসে অসংখ্য তারার ঝকমক আকাশের দিকে চেয়ে বাবার চেহারা দেখার অগ্রহের কথা মাকে বলতো। গুলশানারা খবিরের বিরাজে রওশনকে পেত। ওর বাবার সম্প্রসারণ খবির। তোতার বিয়ের পর বাড়িতে মা ব্যাটা দু’জন মাত্র। মাকে ছেড়ে তাও আবার না জানিয়ে বাড়ির বাইরে থাকলে মার অবস্থা কেমন হয় তা সে মর্মে উপলব্ধি করে।

তোতার সঙ্গে খবিরের সখ্যতা ভাই বোন বন্ধু যেন। হঠাৎ করে তোতার বিয়ে হয়ে গেল। তোতার বর আমেরিকায় পিএইচডি করছে। ছুটিতে এসেছিল। তোতাকে দেখে তার পছন্দ হয়। হবে না কেন? ওর ঠোঁটের দিকে তাকালে মনে হবে লাল তেলাকুচা।

খবিরের মাথায় তোলপাড় চলছে। সে ভাবছে। এখন সে কোন পথে এগোবে। আবার কি পড়া-লিখা শুরু করবে। দোলনের কথা মনে হলে ও হতোদ্যাম হয়ে পড়ে। দোলনকে কীভাবে মোকাবেলা করা যায়। 

বাড়িটা ফাঁকা। আশপাশের বাড়িগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। দোলন বাড়ির দরজায়। খবির ধাক্কার শব্দে বুঝতে পারে। না হলে এত রাতে কে হবে। মা বাড়িতে নেই সে খবর দোলনের জানা।

দোলনকে বিপ্রভ দেখাচ্ছে। 

খবির বিরস গলায় বলল এত রাতে তুমি?

না এসে গতি নেই।

খবিরের বুক ধড়াস করে ওঠে। 

তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তা বুঝি। আমি যে কীসের ভেতর পা বাড়িয়েছি। তুমি চিন্তা করো না। একটা কিছু অবশ্যই হবে। 

তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। সত্যি করে বলবা? বজলুর ব্যাপারে তুমি কিছুই জানো না?

খবির ভ্যাবাচ্যাকায় পড়ে। আফরোজার একই প্রশ্ন। খবিরকে ওরা কী ভাবে দেখছে। 

আমরা ভাগ্যই বলে থাকি। তুমি বজলু ভাইকে বিয়ে না করলে এমন কি হতো?

তাই বলে বাপ পর হয়ে যাবে?

সেটাই তো কথা। আমি ভেবে পাই না এমন কেন হয়। তোমার বাপ থাকতেও নেই। আমার কথা আর কী বলবো। 

খবির কুয়ার দিকে যেয়ে দাঁড়ায়। বাইরের জগৎটা ধাতব পাতের মত চকচক করছে। কুকুর কোক পাখি ডেকে চলেছে। রাতটা অন্য রকম লাগছে। খবিরের মনে হচ্ছে এমন রাত যা অচেনা অনুভবে ভরে দিচ্ছে। খবির দোলনের কাছে এসে বলে, তুমি নিজে কিছু তো করতে পার। পড়া লিখা কম করনি। স্কুলে পড়ালেও আয় করতে পারবে। 

আমাকে চাকরি দেবে কে?

আমি চেষ্টা করতে পারি।

তোমার নিজের জন্য কর না কেন?

করছি তো। ব্যবসা করছি না। 

আমাকে এড়িয়ে চলে কি পার পাবে? অন্য ভাবেও তো আমাকে সহযোগিতা করতে পার।

দোলন হাঁটুতে থুঁতনি রেখে উবু হয়ে বসে। খবির দোলনকে ভক্তিভরে মাথা নিচু করে। দোলন ফুঁসে ওঠে।

তুমি আমার সঙ্গে ভণ্ডামো কর ক্যান?

এ তুমি কী বলছো।

কথার রেশ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। দু’জন দু’ভাবে ভাবলেও ভাবনার স্বরূপ একই রকম। দোলনের চুলে বুনো গন্ধ। খবির অসুরিক শক্তিতে বলিয়ান। শঙ্খচূড় সরিসৃপ দেহ, মনে হবে একাকার। দেহঘামের উৎস খবির পেয়ে যায়। দোলন অভিজ্ঞ লাভে বস্তু জগতের বৈরী বিরোধ সম্পর্কে ধারণা খবিরের দাপটে পাল্টে ফেলে। মনে হয় সময় ওরা দু’জন ছাড়া আর কিছু না। 

মৃদু স্বরে বললো তুমি জয়ী।

কী করে কোথায়?

কুরুক্ষেত্রে।

প্রধান ফটকে জোরে ধাক্কা। আকতার খবিরকে ডাকে।

দোলন কাপড়টা শরীরে জড়িয়ে নেয়। আকতার কে?

আমার ব্যবসায়ী পার্টনার। 

এত রাতে?

তাই তো ওর কাছে টাকা পাই।

দরজা খুলবে?

কী করি? দেখি কী করা যায়।

দরজা খুললে আকতার ওকে ঠেলে ঘরের ভেতর ঢোকে। খবির দোলনের জন্য বিচলিত। আওলা শাড়ির আড়ালে দোলনকে দেখে আকতার থমকে যায়। তার জামায় ছোপছোপ রক্ত। হাতে একটা বড় ব্যাগ। 

এটা রেখে দ্যান। পরে নিয়ে যাব।

আপনার এ কী অবস্থা? খবির ভয়ে আতঙ্কিত। 

ও কিছু না। সব এমনই।

আকতারের তোতলামো ভাবটা নেই। সে বেরিয়ে যায়।

ব্যাগটা ইঙ্গিতে দোলন জিজ্ঞেস করে এটাতে কী আছে?

জানি না।

আমাকে দাও। দোলন খুলে দেখে টাকার বড় নোটের বান্ডিল। অনেক টাকা।

এত দেখছি টাকা।

কই দেখি তো।

দোলন উজ্জীবিত। কাটানো সময়ের আনন্দময় রেশ টাকা ভর্তি ব্যাগের ভেতর আরও চাঙ্গায় সজীব। ব্যাগটা খবিরের কাছে না রেখে নিজের আয়ত্তে নেওয়ার ফন্দি আঁটে। 

চাচি দেখলে অন্য কিছু ভাবতে পারে।

অন্য রকম মানে?

এত টাকা কোথায় পেলে। কী জবাব দেবে?

তা হলে?

আমার বাড়িতে আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তোমার ভাই আর কখনো ফিরবে না। তা আমি জানি।

কী করে জান? কোনো খবর পেয়েছ?

নারীরা অনেক কিছু বুঝতে পারে যা তোমরা বোঝ না।

টাকার ব্যাগ পাওয়ার বিষয়ে বুঝতে পেরেছিলে?

তা না, তবে একটা কিছু ঘটবে তা মনে হচ্ছিল।

ঘটলও তো তাই।

তোমার মতো বীরের ভয় কী। এটা আমি নিয়ে যাই। কাল তুমি আমার ওখানে আসলে দু’জনে যা হয় করব।

খবিরের মাথা হালকা লাগে। দোলন চলে গেলে সে যেমন ছিল তেমন ভাবে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

দোলনের চিৎকারে জেগে ওঠে। উঠানে দোলন তাড়পাচ্ছে। খোশাল মাঝিকে খুন করা হয়েছে। 

দোলন টাকার ব্যাগের কথা চেপে যায়। খবিরকে বলল- আমাকে ও বাড়িতে নিয়ে চল। একা যাওয়ার শক্তি পাচ্ছি না। রাতে তোমার কাছে যে এসেছিল তার নাম আকতার?

রাতে তুমি এসেছিলে আমার কাছে।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //