জেতা বাজির হার

প্রথমবার বেহাইর বাড়ি এসে আরও নতজানু হয়ে থাকলেন মকবুল হোসেন। একসময়ের ডাকসাইটে শিক্ষক। স্কুলে যার দাপটে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ভয়ে নিশ্চুপ থাকত, এখন তিনিই জড়সড়; মিঁউ মিঁউ ধ্বনি তোলেন। একেই বলে নিয়তি। দাবার বোর্ড চোখের সামনে এলোমেলো লাগে। অস্বচ্ছ-ঝাপসা চৌষট্টি ঘরের ছকচিত্র। শেষ মাঘের শুকনো ঠান্ডা বাতাস মনে এসে অচেনা ঢেউ জাগায়। তিনি ইচ্ছে করেই হারেন। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। দাবা কম জানেন না। তিন-চার চালেই কিস্তিমাত করার জুড়ি মেলাভার। তিনি তবু হেরে যান। সকাল কিংবা বিকেলের বাতাসে জয়ধ্বনি অট্টহাসি হয়ে জেগে ওঠে। ইথারে ভেসে ভেসে দূর আকাশে ছড়িয়ে যায়। প্রতিপক্ষের জয়োল্লাসে তিনিও হাসেন। আনন্দে নয়, আনন্দ মরে গেছে; ভরসা পান। প্রতিপক্ষ আর কে? আস্থার জায়গা খোঁজেন।

রিনা সব বোঝে। সে নিশ্চুপ সয়ে যায়। বাবা অঙ্কের শিক্ষক। সবকিছু হিসাব করে চলাই ধর্ম। জীবন হলো সরল অঙ্ক, রুট-অভার, ফার্স্ট ব্র্যাকেট, সেকেন্ড-থার্ড, এর-গুনন-ভাগ-যোগ-বিয়োগ; তারপর উত্তর। প্রত্যেক অঙ্কের নিজস্ব নিয়ম বা সূত্র আছে। নিয়ম-অনিয়ম হলে অঙ্ক শুদ্ধ থাকে না, হতে পারে না; তবে বাবা কোথায় অনিয়ম করলেন? রিনার কখনো ভালো লাগে না। মনের মধ্যে ছটফট অস্বস্তি দগদগে ঘা তুলতে থাকে। ঘায়ের ক্ষত চুলকোয়, আস্তরণ পড়ে; আবার চুলকায়। অস্থির করে। মনের কোণায় হয়তো রক্তপাতও হয়... নাকি অশ্রু? তিন দিনে সবকিছু অসহ্য হয়ে ওঠে তার। সেদিন বিকেলের সূচনায় সূর্যের তীর্যক রশ্মি অপাঙ্গে তাকিয়ে আছে। ধুপছায়া আকাশ। বাতাসের মৃদু ঢেউয়ে দোলায়মান কসমস ফুলের ডগা, ডালিয়ার হলুদ-খয়েরি চেহারা হেসে হেসে চঞ্চল; রিনার কণ্ঠে ঝরে পড়ে অচেনা খেদ।

‘আজ কিন্তু তুমি কিছুতেই হারবে না বাবা। প্রত্যেকবার হেরে যাও। আমি বুঝি তুমি ইচ্ছে করেই হারো। আজ তোমাকে জিততেই হবে। বাবা শুনছ?’

মকবুল দৃষ্টি তুললেন। অঙ্ক তার খেলার বিষয়। ছাত্রজীবনে প্রত্যেক বছর স্কুলের পরীক্ষায় একশ’ নম্বর পেয়েছেন। মেয়েও অঙ্ক ভালোবাসে। নিজের মনের মতো করে শিখিয়েছেন। সেও কোনোদিন পরীক্ষায় কম নম্বর পায়নি। আজ সেই মেয়ের দৃষ্টিতে রংধনু খেলা। আনন্দ-বিষাদের জলছবি। মকবুল খুব ধীরলয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিলেন। জীবনে এই একটি ভুল। জেতা বাজি হেরে গেছেন। তার বুকের গহিন থেকে তেপান্তর দীর্ঘশ্বাস ফোঁস করে বেরোতে চায়। সামলে নেওয়া ছাড়া আর কি করা যায়? রিনার দিকে আবার তাকালেন। চোখে-মুখে যথাসম্ভব মৃদু হাসি। অনেক আদরের মেয়ে তার। সেই অমোঘ উজ্জ্বলতা প্রশ্রয় নাকি অসহায় আত্মসমর্পণের দায় বুঝতে পারে না রিনা। সেও একপলক বিস্ময় চোখে বাবাকে বোঝার চেষ্টা নেয়। অনেক বদলে গেছে প্রিয় মানুষ। কেন এত দ্রুত বদলে যায় সবকিছু? তার দৃষ্টি সেখানে থেকে অন্যদিকে ঘুরে আসে। 

বিশাল ছাদের দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে একলা মাথা উঁচু নারিকেল গাছ, কার্নিসের কোণায় ছড়িয়ে দিয়েছে দু-চারিটি চিরল পাতা, শিখরদেশে ঝিরিঝিরি বাতাস ঢেউ, প্রথম প্রথম এসব খুব ভালো লাগত রিনার। এখন মন টানে না। মন মরে গেছে। সে বিকেলের বাতাসে ছোট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। এই পানসে জীবন। সকালে ওঠো, কাজ কর, এর ওটা তার সেটা, স্কুল, নিজের দিকে তাকাবার ফুরসত নেই। কখনো একটু অবসর একটু স্বস্তির জন্য মন কাঙাল হয়। মানুষের জীবন...উপায় নেই। কয়েকদিন ধরে এই সময়ে নিয়মমতো টেবিলে গরম জলের পট, নেসক্যাফের ডিব্বে, কফিমেট, সুগার ব্লক সাজিয়ে রাখে। এটিই ভালো লাগে। বাবা তিন-চার দিন আগে এসেছে। সেই আনন্দ-খুশি মন ফিরে এলো। রিনা আনমনে নাকি সচেতন পুনরায় প্রতিধ্বনি তুলে দেয়। 

‘আজ তুমি কিছুতেই হারবে না বাবা। প্রত্যেকবার হেরে যাও। আজ জিততে হবে।’

মকবুল নিচে বাগানের ফুল দেখছিলেন। ওপরেও ছাদবাগান আছে। প্রায় সময় গাছ আর ফুলের দিকে দৃষ্টি ধরে রাখেন। একটি-দুটি ঘর আর একচিলতে আঙিনার কোণায় ছোট্ট বাগান। পৃথিবীর আকাশে স্বর্গভূমি। সেখানে নানা রঙের ফুল ফুটে থাকবে। সৌরভে মৌতাত হয়ে উঠবে বাতাস। মনের আঙিনায় হাজারও দৃশ্যছবি ঢেউ জাগিয়ে বলে দেয়, এই পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বরের কোমল স্পর্শ আর মায়া। তিনি তেমন ছোঁয়া পান নাই। যতটুকু ধরে রেখেছে মায়াডোর। সেই কারণে কখনো কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তার ঘর নেই, আঙিনা নেই; ফুলের বাগান সে তো হাজার আকাঙ্ক্ষায় স্বপ্নমায়া তেপান্তর। আজ পঁচিশটি বছর মেঝেতে পড়ে থাকেন। বাবার রেখে যাওয়া পুরনো বাড়ির দেয়ালে যেমন শ্যাওলা জমে ওঠে, সেই ঘরদোর চার খণ্ডে ভাগ হয়ে যায়; তিনি দুটি কক্ষ পেয়েছেন। এও তার পরম ভাগ্য। স্যাঁতসেঁতে ভেজা আর হিম-কুয়াশায় ঠান্ডা। একটি কক্ষে দুই মেয়ে আর তাদের মা। অন্যটিতে একমাত্র পুত্র। মকবুল বাইরের পুব-দক্ষিণ অবারিত বারান্দায় বিবিধ জিনিসপত্রের একপাশে মাদুর পেতে শুয়ে থাকেন। তেত্রিশ বছরের সঙ্গী আয়েশা আকতার মেয়েদের দেখে রাখেন। যে মানুষটি বুকের সঙ্গে লেপটে থাকে কিংবা একদা তেমন ছিল, আজ ধীরে ধীরে প্রলম্বিত দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। কাচের দেয়াল... তবু সান্ত্বনা যে মনের ব্যবধান হয়নি। এই অবসরে এসব ভাবতে ভাবতে আচমকা মনে পড়ে। কেমন আছে আয়েশা? এখানে আসার সময় বারবার বলেছে, ‘এক রাত থেকে চলে আসবে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি বেশিদিন থাকতে নেই।’ তিনি বারণ রাখতে পারেন নাই। একদিন নয়, তিন-চার দিন শেষ হতে চলল। কী করবেন? মন মানে না। মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে ইচ্ছে হয়। অন্য এক কাজও আছে, যে জন্য আসা, মূল কাজ, সমাধান করতে পারবেন কিনা কে জানে; মন তবু আশায় বুকে বাঁধে। আশাই তো জীবন অস্তিত্বের সুর-বেসুরো গান। 

রহমান সাহেব এখনো দোতলা থেকে ওপরে আসেননি। এসে যাবেন। তখন শুরু হবে কয়েক গেম। তারপর আকাশে গোধূলির লালিমা। মাথার উপর দিয়ে দু-চারটি পাখি দূর সীমানায় নীড়ে ফিরে যায়। সন্ধ্যের ছায়া নেমে আসে। তাদেরও ডানায় ক্লান্তি ভর করে। কেউ নতুন উদ্যমে উজ্জীবিত হয়। রহমান বেহাই চেসবোর্ড গুটিয়ে অন্য আলোচনা শুরু করেন। মন ভালো থাকলে আরও কত কি! বাজারদর। ব্যবসা। শেয়ার বাজার। রাজনীতি। অতীত দিনকালের আনন্দ-হাসি-সুখময় গল্পমালা। মকবুলের সুখের কোনো স্মৃতি নেই। মানুষের মন সুখ স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না, দুঃখগুলো দাগ কেটে রাখে; তারপরও কিছু আনন্দ তো আছে। তিনি তাই শোনেন আর ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘বাহ্’ বলে যান। এই কয়েকটি দিন। বেহাই আনন্দে থাক। পৃথিবীর সকল মানুষ আনন্দ-সুখে থাক। তিনি দু-একদিন পর ফিরে যাবেন। এখানে এসে বেহাইকে সঙ্গ দিতে হয়। মকবুলের মনেও কিছু স্বস্তি আসে। মেয়েকে দু-চোখ ভরে দেখেন। তার আদরের কলিজার টুকরা। কখনো দু-চোখ ঝাপসা হয়ে পড়ে। অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। ছেড়ে দিয়েছেন নিজের যত সুখ-আনন্দ। তাই ইচ্ছে করে হেরে যান। প্রতিপক্ষকে কয়েক চালেই ফেলে দিতে পারেন। পওন আর বিশপ কিংবা রুকের দুই চাল, সেইসঙ্গে নাইটের লাফ। নাইট হলো ঘোড়া। ঘোড়ার আড়াই ধাপ। বেহাই সারেন্ডার হওয়ার পথ পাবেন না, কিন্তু তেমন করেন না মকবুল। জীবনে কখনো কখনো মানুষকে ইচ্ছে করে হেরে যেতে হয়। এ তার পরাজয় নয়, অন্যরকম প্রাপ্তি; অনন্য বিজয়। মকবুল তেমনই কোনো বিসর্জন সান্ত্বনা মনের গহিনে হাতড়ে তৃপ্তি নিতে চান। রিনার পছন্দ নয় জানেন। তার মনে হয়, এ বাবার পরাজয়। একদিন-দু-দিন কাউকে খুশি করা যেতে পারে, প্রতিদিন নয়। কেন বাবা হেরে যায়?

একদিন আকস্মিক শখের বশে দাবা খেলা শেখা। শোনা যায়, মহাভারতের যুদ্ধে সৈন্যদের যে বিভাজন করা হয়েছিল, ইতিহাসে তার পরিচিতি চতুরঙ্গ; এই চতুরঙ্গ থেকে দাবার উদ্ভব। পারসিকরা পরবর্তীতে যার নাম দেয় সতরঞ্জ খেলা। এ হলো রাজরাজড়ার অবসর বিনোদন কিংবা যুদ্ধবিহীন রাজ্য জয়ের কৌশল। মকবুল তখন অনেককিছু জানার আগ্রহ নিয়ে দিনরাত পার করেন। একদিন খেলতে খেলতে নেশা হয়ে গেল। কলেজে দু-বছর চাম্পিয়ন হলেন। অবশেষে কোনোমতো বিএ পাস করে চাকরি, পরে বিয়ে সংসার; কোথায় ভেসে গেল দাবা স্মরণ নেই। তারপর এখানে এসে সব বুঝি নতুন করে জাগরূক হয়ে যায়। এই খেলার মধ্যে রয়েছে লোভ দেখিয়ে ফাঁদ পাতা আর চতুর কৌশল। মরিটাইম কিংবা হ্যালোসার ট্র্যাপ কত কি! টেনশন বাড়ানো আর কমানোর চক্রজাল। মন আঁকুপাঁকু করে দুটি শক্ত চালে প্রতিপক্ষকে কিস্তিমাত দেখিয়ে দেন, কিন্তু...।

মকবুল হোসেন আবার মেয়ের দিকে তাকালেন। রিনার চোখে-মুখ বিষণ্ণ আবছায়া। রাতে কিছু চিৎকার শুনেছেন। মঈনের উচ্চস্বর আর বেফাঁস উচ্চারণ। রিনার নিবুনিবু কণ্ঠও সেখানে মিশে ছিল। মঈন না উচ্চ বংশীয় আর শিক্ষিত ছেলে? মকবুল দিশা পান না। কী করবেন? একবার কি এগিয়ে যাবেন? সে কি করে হয়? অবশেষে বুঝে নিলেন ভুল করেছেন। এই ভুল শোধরাবেন কীভাবে? এই অপরাহ্ণের ছায়া ছায়া আলোতে তার চেহারাতেও প্রগাঢ় প্রচ্ছায়া নেমে আসে। অস্ফুট বলে উঠলেন, 

‘মা রাতে আবার কী গণ্ডগোল হয়েছে?’

‘এ তো নিত্যদিনের কাহিনী বাবা। এসবে কান দিও না।’

‘জামাই কি দুই লাখ টাকায় খুশি হলো না?’

‘তোমার টাকা দেওয়াই উচিত হয়নি বাবা। লোভী মানুষ।’

‘এ তুই কী বলছিস মা!’

‘ঠিকই বলছি। গত দুই মাস থেকে এখানের কিন্ডারগার্টেনে কাজ করছি। মাস শেষে যে দশ হাজার পাই, সেটাও বলতে গেলে কেড়ে নেয়। আমার একটু সাধ নেই বাবা? আমার ইচ্ছে করে না, তোমাদের জন্য কিছু দেই?’

মকবুল চুপ করে গেলেন। কী আর বলবেন? মেয়ের চোখে অশ্রু নেই; কিন্তু বুকের গহিনে কত যে কান্না, তার ঢেউ সমুদ্রের জোয়ারের মতো তার বুকে এসে ধাক্কা দিয়ে গেল। রিনার বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড় বছর হতে চলল। প্রথম কয়েকটি মাস উৎফুল্ল বাতাস ঢেউ দোলা দিয়েছে। মকবুলের শ্যাওলাপড়া আধভাঙা ঘরেও দখিনা বাতাস। জামাই খুব ভালো মানুষ। টাকার ওপর থেকে থেকে চকচকে-কড়কড়ে-ময়লা-পচা কাগুজে নোটের মতো ব্যবসায়ী মন মন্দ করেনি। চোখে ভাসা ভাসা হাসি। মকবুল ভরসা পেয়েছেন। অথচ আজকাল কেন জানি মনে কু-বাতাস আছড়ে পড়ে। রিনা মাস দেড়েক আগে একদিন আঙিনায় এসে দাঁড়াল। মেয়ের সেই আনন্দ-উচ্ছল মুখচ্ছবিতে বিষাদের হালকা ছায়া। উত্তরের আকাশে আষাঢ়ে মেঘ। তখন জানা হয়নি। অনেকদিন পর মেয়ে এসেছে। তাকে আদর করে পছন্দের কী কী কিনে আনতে হবে সেই হিসাব আর পকেটের ওজন মাপছিলেন। কোনোমতো সবকিছু হয়েও যায়। দুপুরের বাতাসে রান্নাঘর থেকে ইলিশের ম-ম সুবাস ভেসে আসে। মনে অকারণ আহ্লাদ। আহা! কত দিনপর...দিন নয় বছর। সন্ধ্যেয় শোনেন অমোঘ ঘোষণা। জামাইয়ের ব্যবসা ঠিকমতো চলছে না। লাখ তিনেক টাকা দরকার। ধার হিসেবে আবদার। মকবুল চমকে গেলেন। বুক ধড়ফড় করে বেজে ওঠে। এক-দুই হাজার টাকা রোজগার হয় না, এত টাকা; কোথা থেকে আসবে? কোনোদিন এমন সময় আর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন দুঃস্বপ্ন দেখেন নাই। এখন কী করবেন? কীভাবে সমাধা হবে? সারারাত অন্ধকার দেয়ালে অসহায় মাঝির মতো এদিক-ওদিক নৌকো বাইলেন, কোনো কূল-কিনারা পেলেন না। পাবেন কী করে? কোনো সূত্র বা উৎস তো নেই। অবশেষে কী-সব হাবিজাবি ভেবে ভেবে দু-চোখ লাল করে ফেললেন। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। টাকা-পয়সা ধন-সম্পদ থাকলেই মন বড় হয় না মানুষের। অথচ ভেবেছিলেন, রিনা নিত্য অভাব আর টানাটানির সংসার থেকে মুক্তি পাবে। তাই যখন সম্বন্ধ এলো, তেমন করে ভাবেননি, সাদাসিধে অল্প খোঁজখবর নিয়ে রাজি হয়ে গেলেন; মেয়ে অন্তত সুখের মুখ দেখবে। অভাব থাকবে না, কিন্তু এখন কী হলো? কোথা থেকে আসবে টাকা? জীবনে এক লাখ টাকা ভালো করে গোনা হয়নি। আর তিন লাখ! ভুল...ভুল হয়ে গেছে। ভুল সম্বন্ধ ভুল বিয়ে। সেদিন ব্যস্ত দিন শেষে সন্ধ্যেরাতে যখন ফুলে ফুলে সাজানো কারে রিনা উঠে বসে, মেয়ে তার শাড়ি ঠিকমতো সামলাতে পারে না; তিনি নিশ্চিত ছিলেন পরের ছেলে-শ্বশুর-শাশুড়ি-নতুন আত্মীয়স্বজন ঘরদোর সব সামলে নেবে। অমন ঘরে আত্মীয়তা করে তিনি জিতেছেন। কে জানত, বিয়ে হলো জুয়া, এখানে একপক্ষ পরাজিত হয়, হবেই, খুব কম ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ বিজিত বা ড্র করে। এমনও ঘটে। তাদের কোনো সমস্যা থাকে না। বিয়ে দুটি মানুষের মধুর বন্ধন, কখনো আনন্দময় কারও আজীবন যন্ত্রণা; কিন্তু একবার যখন হয়ে যায়, ফেরার পথ থাকে না, হয়তো থাকে অথবা না, কেউ নিয়তির লিখন মেনেই পায়ে কাঁটা নিয়ে বাকি জীবন তেপান্তর পার করে দেয়। রিনার বেলায় কী করবেন?

‘বাবা তুমি কিন্তু আজ হারবে না। আমি বসে থাকব।’

মকবুল আচমকা জেগে ওঠে পুনরায় বিকেলের আলোয় ফিরে এলেন। রিনা সবকিছু সাজিয়ে রেখেছে। এবার নিচে নেমে যাবে অথবা নারিকেল গাছের পাতার ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। শহরের দক্ষিণপ্রান্তে এক নদী, অপরদেশে জলবাঁধের কারণে এখন প্রায় শুকনো খাল; তারপরও কখনো বাতাসে হিম হিম শীতলতা বয়ে আনে। ভালো লাগে। মকবুল সামনে তাকিয়ে কী ভেবে ক-মুহূর্ত স্থির-নিশ্চুপ রইলেন। অনেক কথার মন দোলাচল। মানুষ সবসময় নিজের ইচ্ছেমতো কোনোকিছু করতে পারে না। তাকে আশপাশ পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে এগোতে হয়। এই তো অঙ্ক। জীবন সংসারের হিসাব-নিকাশ। আবেগ আর জেদ দিয়ে তাই সব কাজ করা যায় না। সেই সময় আসেনি, আদৌ আসবে এমন হয়তো নয়; অথবা এসে গেলেও করতে পারবেন সেও ঠিক জানা নেই। এসবের কী দরকার? তিনি রিনার মুখে চোখ রেখে দ্রুত জবাব দিলেন। মেয়েকে কেন এত পাণ্ডুর-ফ্যাকাশে লাগে?

‘আজ থাক মা। আর একদিন সত্যি সত্যি জিতে দেখাব। কই তোর শ্বশুর এখনো এলেন না?’

‘আমি জানি বাবা, তুমি তিন-চার চালেই হারাতে পারো। কলেজজীবনে মেডেলগুলো এমনি এমনি পাওনি। কেন ছাড় দাও? আমার কথা ভেবে?’

‘ঠিক তা নয় মা, বেহাই সাহেব ভালো খেলেন। তুই যা মা, নিচে যা, মঈন ফিরে আসার সময় হলো বোধহয়।’

‘সে রাত এগারো-বারোর আগে কোনোদিন এসেছে? ...তুমি কিন্তু আজ জিতে দেখাবে, বলে দিলাম; নইলে রাগ করব। ভীষণ রাগ করব।’

‘আজকাল বেহাই অনেক ভালো খেলছেন মা।’

‘ভালো না ছাই। বকবকিয়া মানুষ। সারাদিন কথায় কথায় নিজের বাখ্যান। হাতি মারলাম... বাঘ মারলাম।’

‘এভাবে বলতে নেই রিনা। কখনো বলিস না। সুখী মানুষ। কেউ শুনে ফেললে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যাবে।’

‘লঙ্কা পোড়ার বাকি আর রইল কোথায় বাবা?’

আকস্মিক বাতাস থেমে গেল। আকাশ দিগন্তে ভারি ছায়ামেঘ। মকবুল বুকে ধাক্কা খেলেন। মেয়ে তার কী বলে? লঙ্কা পোড়ার বাকি আর রইল কোথায়, এর অর্থ কী? ভাবনার কোনো খেই পেলেন না অথবা সুযোগ। রিনা নিচে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, রহমান সাহেব উঠে আসছেন। অ্যালুমোনিয়ামের পাতে মিনা করা নকশি ছড়ি ডানহাতে চকচক ঝলসে যায়। মকবুল উঠে দাঁড়ালেন। উজ্জ্বল মানুষদের সম্মান দেখাতে হয়।

‘কী বেহাই সাহেব কফি খেয়েছেন?’

‘না ভাই, আপনি না এলে কী করে খাই? মজা পাই না তো।’

‘তাই তাই, সঙ্গী না হলে চলে?...বউমা কফিটা বানিয়ে দাও আমাদের।’

‘জি বাবা।’

রিনা ধীরপায়ে এগিয়ে এসে কাপে গরম জল ঢেলে নেয়। বাতাসে বাষ্প। রহমান চেয়ারে বসে চেসবোর্ড মেলে দেন। চেন্নাই থেকে আনা বোর্ড। শৌখিন মানুষ। কৃস্টাল গ্লাসে তৈরি গুটি। প্রতিটির নিচে ম্যাগনেট। একদিকে দাঁড়িয়ে যায় কিং-কুইন-বিশপ-নাইট এবং রুক, বাংলায় যার পরিচিতি রাজা-মন্ত্রী-হাতি-ঘোড়া-নৌকো। সামনের সারিতে আটজন সৈন্য বা পওন। সেগুলোর শরীর থেকেও সূর্যের আলো তীব্র বিচ্ছুরিত হতে থাকে। এবার মকবুল তার রাজবাহিনী ধীরে ধীরে গুছিয়ে নেন। কালচে-খয়েরি গুটিতে ফ্যাকাশে আলোছায়া। ম্লান বিকেলের মতো স্থির-গম্ভীর। প্রতিপক্ষের চেস পিসেস বলাকার মতো শুভ্র সাদা। বাতাসে কফির সুবাস। তিনি সহসা মেয়ের দিকে চোখ রাখেন। গভীর থমথমে মুখছবি। নিষ্প্রাণ মাছের চোখ। রিনা কি কিছু বলতে চায়? তিনি বুঝতে পারেন, অথবা পারেন না কিংবা বুঝেও বোঝেন না এমন ভাব ধরতে হয়। মেয়ের সকল কথা শোনা হয় না, যায় না; একদিন শুনবেন। সেই দিন আসবে কি? শোনা সম্ভব হবে? 

‘বাবা তোমাকে জিততেই হবে।’

শ্রুতিতে বেজে চলে শব্দ ঝংকার। অভিমান-রাগ কিংবা ভালোবাসা নির্দেশ। মকবুল হোসেনের উপায় নেই। চোখ-মুখ বিষাদ। জীবনে কত জেতা বাজি হেরে গেছেন। অন্যকে জিতিয়েছেন। আজও বারবার হেরে যান। কেন? এই জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর নেই। পৃথিবীতে কেউ শুধু হেরে যাওয়ার জন্য জন্ম নেয়, অন্য কেউ একজন জিতবে বলে; সেই হেরে যাওয়া মানুষ পুনরায় কি জিতে যেতে পারে? কি জানি? এমন যুক্তিতর্কের কোনো দোহাই নেই। হেরে যাওয়ার মধ্যেও হয়তো কোনো জিত থাকে। সেই ভরসায়, আহা সেই আদরে, মেয়ের জন্য একদিন জিতবেন তিনি। ঠিক একদিন। সে-সময় হয়তো কখনো এসে দাঁড়াবে, এখন সেই-সময় নয়; কিংবা কে জানে। তিনি কোনো অন্ধকার গোলকধাঁধায় ডুবে গেলেন। আকাশের মৃদু আলোয় মন একলা চিল হয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল।

‘কি হলো বেহাই সাহেব, কী ভাবছেন? চাল দিন।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ অবশ্যই। বাব্বা প্রথমেই ঘোড়ার আড়াই ধাপ!’

‘আজ আপনাকে কয়েক কিস্তিতে পটকে দেব। দিশা পাবেন না। হে হে হে!’

‘আপনি কিন্তু অনেক পাকা খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন।’

‘কি যে বলেন ভাই সাহেব! আপনার সামনে নস্যি। শুনি আপনি নাকি কলেজে দাবায় চাম্পিয়ন ছিলেন। সেই চাল দিন না।’

‘ভাই সাহেব সে তো অনেক আগের রূপকথা। এখন কি সেই বয়স আর বুদ্ধি রয়েছে?’

‘কেন বুদ্ধি কোথায় খোয়ালেন? এনজিওর কাজে বুদ্ধি শেষ? অনেক টাকা তো কামাই করেছেন।’

‘এনজিওর চাকরি কি আর সুখের ভাই সাহেব? দিনরাত গাধাখাটুনি। শেষ বয়সে মাস্টারি করে বুদ্ধিজ্ঞান সব লোপ পেয়ে গেল।’

‘তাই! আপনার বুদ্ধিজ্ঞান চলে গেছে? হা হা হা! আমার তো সংসার করতেই জীবন শেষ। কত বছর হলো ঘর-সংসারের?’

‘তেত্রিশ বছর চলমান।’

‘বলেন কি! বেশ অল্প বয়সে বিয়ে করেছেন তবে।’

‘ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সে।’

‘আহা টোনাটুনির সংসার...হা হা হা!’

বাতাসে হাসির শব্দ ভাসতে ভাসতে দিগন্তের প্রান্তসীমায় মিশে যেতে থাকে। মকবুল বুঝি ফিরে যান সেই সে কালে। আহা কত স্মৃতি! কত না আনন্দ আর স্বপ্ন দেখা জীবন! স্কুলে যান। ক্লাসে অঙ্ক কষেন। ব্লাকবোর্ডে সাদা চক ঘষে ঘষে সংখ্যার পর সংখ্যা সাজিয়ে কোনো জলছবি আঁকেন অথবা কবিতা রচনা। গাণিতিক সংখ্যার মধ্যে কি জাদু মায়া! এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সবকিছু অঙ্কের সূত্রে গাঁথা। কোথাও ব্যত্যয় হলে সকল ছন্দপতন। এতকিছু জানা সত্ত্বেও নিজের জীবনে কোনো কবিতা লেখা হলো না। সেখানে শব্দ নেই, ছন্দ খেই হারিয়ে ফেলেছে, নিয়ম অনিয়েমের ঘোরপ্যাঁচে; অগোছালো এলোমেলো। কোথায় কখন যে অঙ্কের সূত্র ভুল হয়ে যায়, অথবা ভুল করিয়ে দেওয়া হয়; এও বুঝি স্রষ্টার ইচ্ছে। তারপরও জীবন চলে যায়, মানুষ বেঁচে থাকে; তিনি পরিচিত একান্ত বারান্দা থেকে নিশ্চুপ সরে দাঁড়ালেন। সেই বিকেলে তার সারা শরীর রক্তাক্ত। প্রচণ্ড মার খেয়েছেন। তখন রূপা দুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কোনো নিষ্ফল প্রতিবাদ রেখে যায়। সেই ভালোবাসা নিষ্ফলা সম্বল হয়ে রইল। মকবুল কি সত্যি খুব ভালোবেসে ছিলেন? রূপা যখন দিন কয়েক পর তার মেসে এসে কাতর অনুনয় করে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার, আর সেই প্রস্তুতি ছিল, মকবুল বিস্ময়ে অনড় হয়ে থাকলেন; কাপুরুষ মন। কেন সাহস হলো না? কোনোকিছু পেতে গেলে তো ঋজু হতে হয়। আন্তরিক ধৈর্য দরকার। তিনি কি তখন নিজেকে দুর্বল আর পরাজিত ভেবে নিয়েছিলেন? কে জানে সেই গোপন সত্য। তিনি জেতা বাজি হেরে গেলেন।

আজ অনেক বছর পর গোধূলির আকাশে একঝাঁক সবুজ রং টিয়ে যখন ‘টিঁ-টিঁ’ শব্দ তুলে কামরাঙা গাছের সবুজ পাতায় মিশে যায়, মন কেন হারানো দিন জাগিয়ে তোলে? প্রত্যেক মানুষের বুকেই তো পুরনো কোনো গল্প থাকে, সেখানে দিনে দিনে ধুলোর আস্তরণ পড়তে পড়তে লেখাগুলো আর পড়া যায় না। যায় কি? আয়েশা তো পাগলের মতো ভালোবাসে। একটি মানুষ সুখে-দুঃখে-বিশ্বাসে নিঃশ্বাসের মতো জড়িয়ে থাকে, সেই তো কত জনমের সাথি; মকবুলের এ হলো পরম পাওয়া। মানুষ জীবনে কিছু হারিয়ে ফেললে কিছু তো পেয়ে যায়। তার তুলনা নেই। কোনো নিক্তিতে ওজন হয় না। সব প্রকৃতির খেলা। তিনি রিনা-মিনা আর সুজয়ের মতো তিন সন্তান পেয়েছেন। এদের মধ্য দিয়েই জীবনের সকল খেলায় জেতার বড় সাধ। তাই যখন রিনার সন্বন্ধ এলো, অনেক বড় ঘরের একমাত্র পুত্র, শহরের কেন্দ্রে চলমান হার্ডওয়ার দোকান, আর কী চাই; তিনি ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। অবশ্য সবকিছু একসঙ্গে বসে আলোচনার উপসংহার। মেয়ে তার চোখের আলো, তারও নিজের জীবন আছে, একটি সুখী সংসার হোক; এই তো কামনা।

বিয়ের কোনো শর্ত ছিল না। উভয় পক্ষের দেখাশোনা আর মতামত শেষে দিন তারিখ। আকস্মিক সবকিছু ঠিক থাকার পরও তিন লাখ টাকার আবদার। মকবুল সেই দাবি রক্ষা করতে বাড়ি বন্ধক রাখলেন। প্রতি মাসে সুদ। আঠারো শতাংশ সরল সুদ। পনেরো তারিখের মধ্যে সুদ দিতে হবে, অন্যথায় ষোলো তারিখে সুদ আসলের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে; ঋণের খেলা আর শুভঙ্করের ফাঁকি বড় অদ্ভুত কারসাজি। কোনো অবলম্বন না থাকলে উপায় কি? কুড়ি বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। মকবুল কত বছর বাঁচবেন? কুড়ি বছর তো অবশ্যই নয়। কে জানে সেই ঋণের দায় সুজয়ের কাঁধে ছেড়ে যাবেন কি না! হাজারও চিন্তা-দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারেন না। সময় বুঝি অসিত রাত্রির গহ্বর হয়ে গিলে ফেলতে চায়। এই কয়েক সপ্তাহ রাতদিন স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে শুধু টাকা দেখেন। মানুষ টাকা গোনে। তিনি স্পর্শ করতে হাতে ধরতে পারেন না। কোথায় পাবেন টাকা? অবশেষে নারায়ণের কাছে থেকে আবারও দুই লাখ টাকা ঋণ। সেই টাকা নিয়ে এসেছেন। একবুক আশা নিয়ে যখন বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ান, মুখের হাসি যে কত কৃত্রিম আর অগোছালো সব বুঝে ফেলে রিনা। মেয়ে তার অনেক বুদ্ধিমতী। ফোঁস করে বলে বসে, -

‘সুজয়ের ভবিষ্যৎ এভাবেই শেষ করে দিলে বাবা?’

‘সেটা কেন মা? সুজয় পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরি পেলে আর কষ্ট থাকবে না। তুই ভরসা রাখ।’

‘সবে তো অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। কীভাবে কী হবে? তোমরা বড় ভুল করলে বাবা।’

‘এসব আর ভাবিস না মা। যত মুশকিল তত আসান।’

সেই টাকা মঈনের হাতে তুলে দেওয়া হলো। রহমান বেহাই বাড়ি ফিরে যেতে দিলেন না। মকবুলও থেকে গেলেন দু-তিনটি দিন। মেয়েকে কাছে কাছে দেখতে বড় ভালো লাগে। আসলে তিনি তখন পালিয়েও বেড়াচ্ছেন। কার কাছে থেকে? নিজের কাছে থেকে নিজের পলায়ন। এ যে অস্তিত্বের পলায়ন। তারপর কত না অভিনয়। এটা-সেটা গল্পগুজব আর পরিশেষে সতরঞ্জের খেলা। বেশ জমে উঠেছে দাবা। বেহাই প্রতিদিন জিতে জিতে মাদক নেশায় আপ্লুত। মকবুল ছাড়া পান না, আগামীকাল করে করে, কিন্তু আর কত দিন? গত রাতে মঈনের উচ্চকণ্ঠ আর রিনার দু-চারটি কথা শুনেছেন। সংসারে এমন কথা হয়; কিন্তু সেই সুর যেন ঠিক মেলে না; অন্যরকম লাগে। মনে শঙ্কা জাগিয়ে তোলে। মকবুল বিছানায় বসে শ্রুতির মনোযোগ সতর্ক করে রাখেন, আর তখন চারদিক সব বুঝি নিশ্চুপ হয়ে যায়; সড়কে জেগে থাকে রাত-শ্রমিকের চিৎকার কোলাহল। সামনেই পাইকারি বাজার। ট্রাক থেকে মালপত্র আনলোড করার ব্যস্ততা রাতের দেয়ালে আছড়ে পড়ে। ভোর সকালে একবার ভেবেছিলেন, রিনাকে জিজ্ঞেস করবেন, করেও ছিলেন, জবাবে তেমন কিছু ছিল না যাতে মন প্রসন্নতা ফিরে পায়। এইসব ভাবনার মধ্যে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে। বেহাইকে গতকাল বলে রেখেছেন। এবার দিন কয়েকের জন্য রিনাকে নিয়ে যেতে চান। রহমান সব শুনে বলেন.-

‘আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নাই। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। কোথায় যাবে কি যাবে না, এসব তাদের সিদ্ধান্ত। মঈনকে বলেন।’

‘আচ্ছা।’

মকবুল ওই একটি কথার মধ্য দিয়ে বুঝে গেলেন, বেহাই সাহেবরও সংসারে আর দাপট নেই। বয়সি হয়ে গেলে ঘরের আসবাবের মতো ‘এই আছি এই নেই’ জীবন। কাউকে দুটো কথা বলার কিংবা শাসন করার যত ক্ষমতা দেখা যায়, আসলে সব ফাঁকি, কথা কিছু আরও বলার ছিল, এবং জানার; সে আর হলো না। কোন্ কথায় কী হয়, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, আর কেন? তিনি দূর গোধূলি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাদা-কালো চৌষষ্টি ঘরের দিকে মনোযোগ দিলেন। এক গেম খেলা হয়ে গেছে। বেহাই জিতেছেন। রিনা দক্ষিণে নারিকেল গাছের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো কখনো অপাঙ্গে তাকিয়ে খেলা দেখে নেয়। মকবুল প্রতিপক্ষকে বেশ ঘামালেন। এ যেন কাছের আকাশে দুটো ঘুড়ির খেলিয়ে খেলিয়ে ভোকাট্টা। তিনি মনে মনে হাসেন। মানুষকে কত অভিনয়ই না করতে হয়। এবার দ্বিতীয় খেলা। রহমান কালচে-খয়েরি পিসগুলো নিয়েছেন। একে একে সাজিয়ে নিলেন সবকিছু। মকবুল শ্বেতশুভ্র গুটিগুলো নিজ নিজ জায়গায় বসিয়ে বললেন, -

‘বেহাই সাহেব, আগামীকাল সকালে যেতে হবে। বেশ কদিন থাকলাম। আপনার আতিথেয়তার তুলনা নেই। একদিন আপনারাও আসুন।’

‘কালই যাবেন? আর দুটো দিন থাকুন। বাড়ি গিয়ে কী করবেন? চাকরি তো আর করেন না।’

‘সংসারে কাজ থাকে না? রিনাও যেতে চায়।’

‘মঈন কী বলে?’

‘তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলে নাই।’

‘তবে?’

‘আপনি অনুমতি দেবেন। আপনি হলেন পরিবারের কর্তা।’

‘সেই তো সেই তো। আচ্ছা।’

‘আপনি কিন্তু চেসে বেশ পাকা হয়ে উঠেছেন।’

‘হা হা হা! বেশ। চাল দিন। তিন-চার চালে কিস্তিমাত করে দেব।’

‘ইনশাআল্লাহ।’

মকবুল যখন তার বড়েকে D4-এ নিয়ে গেলেন, রহমান নিজের বড়েকে D5-এ। মকবুল তেমন মনোযোগ দিলেন না। এই খেলা প্রতিপক্ষকে খেলিয়ে নিতে হয়। লোভ জাগিয়ে ফাঁদে ফেলা হলো সফেদ কৌশল। বেহাই অবশ্যই D4-এর বড়ে খাবেন। বাস্তবেও হলো তাই। প্রতিপক্ষের চেহারায় প্রথম উজ্জ্বল হাসি। মকবুল এবার তার নাইট অর্থাৎ ঘোড়া বের করলেন। আড়াই ধাপ লাফিয়ে নিয়ে গেলেন C3-তে। রহমানও তার ঘোড়াকে G6-এ বসালেন। উদ্দেশ্য E4 বড়েকে নিরাপত্তা দেওয়া। মকবুল তার একটি বড়েকে F3-তে এগিয়ে দিলেন, যাতে বেহাই E4 দিয়ে মেরে ফেলতে পারেন। এ হলো দ্বিতীয় লোভ জাগিয়ে তোলা। এবারও একই ঘটনা। খেলা চলছে, চলতে চলতে দু-একটি ধাপ পেরিয়ে গেল। আকাশে গোধূলির তির্যক আভা। রিনা একবার ঘুরে গেল। সে সব শুনছে। মকবুলের নজরে কোনোকিছু এড়িয়ে যায় না। কেউ বুঝি মনোযোগের কেন্দ্রে সতর্ক করে দেয়। মকবুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় কখনো দোলাচলে দিশাহীন কখনো স্থির। সারাজীবন তো হেরে গেলেন, আজ একবার মেয়ের মুখে একচিলতে হাসির জন্য জিততে পারেন না? অবশ্যই পারেন।

রহমান E4 দিয়ে মকবুলের F4 বড়ে মেরে দিলেন। এবার মকবুল সেই বড়েকে মন্ত্রী দিয়ে খেলেন। প্রথম এবং সামান্য একটি বিজয়। রহমান হেসে বললেন, -

‘বেশ। মশা মারতে কামান দাগা। এই দেখুন তবে...।’

রহমান তার মন্ত্রী দিয়ে মকবুলের D4 বড়ে খেলেন। মকবুল এবার আক্রমণে। তিনি হাতি বের করে প্রতিপক্ষের মন্ত্রীর দিকে অর্থাৎ E3-তে দাঁড়ালেন। এ হলো ভয় দেখানো। যুদ্ধ জয়ের অন্যতম কৌশল। অবশ্য নিছক ভয় দেখানোও নয়। রহমান তাই মন্ত্রীকে B4-এ নিয়ে গেলেন। মকবুল আর কোথাও দৃষ্টি দিলেন না। তার মন্ত্রী ঝুঁকির মধ্যে থেকে গেল। তিনি লং ক্যাসলিং করে পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুতি নিলেন মাত্র। তৈরি হলো ফাঁদ। এবার অপেক্ষা। প্রতিপক্ষ কী করেন? রিনা এগিয়ে এসে কাপে জল ঢেলে আবারও কফি তৈরি করছে। তার দৃষ্টি আলগোছে চেস বোর্ড ছুঁয়ে স্থির চঞ্চল। মকবুল মেয়ের দিকে একবার তাকালেন। রিনার ভাবলেশহীন দৃষ্টির কোনো গভীরে শাসন কিংবা মায়াজাল। মকবুলের বুকে জোয়ারের ঢেউ। বিস্তীর্ণ বালিয়াড়িতে ঝিরিঝিরি বাতাস। তিনি এবার ঘোড়াকে C3 থেকে সরিয়ে B5-এ রাখতেই রহমান G4-এর হাতি দিয়ে F3-র মন্ত্রী মেরে দিলেন। তারপর অট্টহাসি। 

‘আপনার মন্ত্রী গেল বেহাই সাহেব।’

‘সে কি! সাংঘাতিক চাল দিলেন তো।’

‘আপনি নাকি চাম্পিয়ন! কোথায় সেই খেলা? একদিনও তো জিততে পারলেন না ভাই।’

মকবুল নিশ্চুপ। কোথা থেকে কী হয়ে গেল অথবা কোথা থেকে কী হয়ে যায়। আজ তার মনে পুলক। মেয়ে যে তাকে জিততে বলেছে। তিনি কি হারতে পারেন? তিনি লক্ষ্য রেখেছেন, প্রতিপক্ষের রাজার মুভ করার জায়গা নেই, কেননা মকবুলের নৌকো D1 থেকে পুরো কলাম কভার করে আছে। সামনে বাধা। সুতরাং তিনি এবার B5 থেকে ঘোড়াকে আড়াই ধাপ সামনে C7-এ নিয়ে গিয়ে মৃদুস্বরে বললেন,-

‘চেক।’  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //