ইংরেজ ভদ্দরলোকের মতে ‘নাইস কাপ অফ টি’

রেসিপির বইগুলো যদি দেখেন, কোনটাতে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম পাবেন না, যেটা বলছে এটাই চা বানানোর নিয়ম। যদিও বা দুই একলাইন খুঁজে পান, সেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলা সম্পর্কে কোনো ঠিকঠাক নির্দেশনা দেয় না।

এটা আশ্চর্য হওয়ার মতো, এ জন্য না যে, চা এদেশের (ইংল্যান্ড), পাশাপাশি আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সভ্যতার অন্যতম প্রধান বিষয়, বরং চা বানানোর সব থেকে ভালো উপায় নিয়েও থাকার কথা সহিংস বিরোধিতা।

যখন নিখুঁত এক কাপ চায়ের জন্য আমি আমার নিজস্ব রেসিপিটি দেখি তখন আমি এগারোটা দুর্দান্ত পয়েন্ট পাই। এই ১১ পয়েন্টের মধ্যে সাধারণ নিয়ম হিসেবে দু-তিনটা সবাই মেনে নিলেও, অন্তত আরো চারটা নিয়ম ভীষণভাবে বিতর্কিত। এখানে আমার নিজস্ব এগারো নিয়ম রয়েছে, যার প্রত্যেকটিকে আমি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি:

সবার প্রথমে, আপনার লাগবে ভারতীয় বা সিলোনিস চা। চায়নার চায়েরও এমন গুণ রয়েছে যা আজকাল আর অবহেলা করা উচিত নয়- সস্তা, আর দুধ ছাড়াই খাওয়া যায়- তবে এতে তেমন কোনো উদ্দীপনা নাই।  এটা খাওয়ার পরে কেউ বুদ্ধিমান, সাহসী বা আরো আশাবাদী বোধ করে না। যে লোকই ‘নাইস কাপ অফ টি’ কথা বলেছে, সে সর্বদা ভারতীয় চাকে বুঝিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, চা বানানো উচিত পরিমাণে কম- একটা কেটলিতে। হাঁড়িভর্তি চা সবসময়ই স্বাদহীন, অন্যদিকে আর্মি চা, যা ব্যারেল ব্যারেল তৈরি হয়, গ্রীজ আর হোয়াইটওয়াশের মতো স্বাদ দেয়। চায়ের পাত্র বা টিপট চীনামাটি বা মাটি দিয়ে তৈরি করা উচিত। সিলভার বা ব্রিটানিয়া দিয়ে তৈরি টিপটগুলোতে চা হয় বাজে রকম। এনামেলের তৈরি পটগুলো আরো খারাপ। যদিও আশ্চর্যের কথা হলো কাঁসার টিপট (আজকাল বিরল) ততো খারাপ নয়।

তৃতীয়ত, চায়ের পাত্র আগে গরম করে নেয়া উচিত। জলের সাথে পাত্র গরম করার স্বাভাবিক পদ্ধতির চেয়ে আগে চুলার ওপরে পাত্র রেখে আরো ভালো চা করা সম্ভব।

চতুর্থত, চা হবে কড়া। আপনি যদি একটা টিপট প্রায় ভর্তি করে চা বানান, তবে ছয় চা চামচ চায়ের পাতা নেয়া সঠিক হবে। সপ্তাহের প্রতিদিন না হলেও বিশেষ সময়গুলোতে, আমার মতে একটা কড়া চা বিশটা পাতলা চায়ের চেয়ে ভালো। সমস্ত সত্যিকারের চা প্রেমিক কেবল তাদের কড়া চা পছন্দই করেন না, যতো বছর পার হয় ততো তাদের চা আরো কড়া হতে থাকে- এই সত্যকে মাথায় রেখে বৃদ্ধ বয়সী পেনশনভোগীদের জন্য অতিরিক্ত রেশনের স্বীকৃতি দেয়া হয়।

পঞ্চমত, চা পাতা সরাসরি পাত্রের মধ্যে ঢালা উচিত। চা পাতাকে বন্দী করে রাখার জন্য কোনো স্ট্রেনার, মসলিন ব্যাগ বা অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। কিছু দেশে উচ্ছিষ্ট চা পাতাগুলো ধরার জন্য টিপটগুলোর নলের নিচে ছোট্ট ঝুড়ি/ছাঁকনি ঝোলানো থাকে যা প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিকারক। একজন মানুষ উল্লেখযোগ্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই যথেষ্ট পরিমাণ চা পাতা খেতে পারে, আর চা পাতা যদি পাত্রের ভেতরে ছাড়া না পায় তাহলে তা কখনো ঠিকভাবে নিষিক্ত হয় না।

ষষ্ঠত, চা পাতাকে কেটলির কাছে নিয়ে যেতে হবে। উল্টোটা নয়। চা মেশানোর মুহূর্তে জল অবশ্যই ফুটতে থাকবে, অর্থাৎ, আগুনের ওপর থাকবে। কিছু লোক আবার বলে, একমাত্র সেই জল ব্যবহার করা উচিত যা কেবল ফোটাতে আনা হয়েছে, তবে আমি কখনো তেমন তফাত দেখি নাই।

সপ্তম, চা তৈরির পরে, নাড়াচাড়া করা উচিত, আরো ভালো করে নাড়া উচিত, পাত্র ভালো করে ঝাঁকানোর পর, পাতাগুলো স্থির হতে দেয়া উচিত।

অষ্টম, একটা ভালো ব্রেকফাস্ট কাপ থেকে চা খাওয়া উচিত- এটা নলাকার ধরণের কাপ, চ্যাপ্টা, অগভীর ধরণের নয়। এই ধরনের কাপে বেশি চা আঁটে আর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়। অন্য কাপগুলোতে চা খাওয়া শুরুর আগে দেখা যাচ্ছে ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

নবম, চায়ের জন্য যে দুধ ব্যবহার করা হবে, তা থেকে ননী আলাদা করে ফেলা উচিত। যে দুধ খুব বেশি ননীযুক্ত তা সবসময় চায়ে একটা বাজে স্বাদ আনে।

দশ, চায়ের কাপে প্রথমে চা ঢালতে হবে। এটা অন্যতম কন্ট্রোভার্সিয়াল পয়েন্ট এখানে। ইংল্যান্ডে সব বাড়িতে দুটি ধারনা চলে আসছে। একদল মনে করে, আগে দুধ ঢালতে হয় কাপে, একদল মনে করে আগে চা ঢালতে হয় কাপে। তবে আমি আমার যুক্তিতে অনড়। কারণ দেখাই। চা আগে ঢেলে দিয়ে, অল্প অল্প করে দুধ দেয়া যায় এবং দুধ কতটুকু দরকার তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্য পদ্ধতিতে তা সম্ভব নয়।

শেষ পর্যন্ত, চা- যদি কেউ রাশানদের মতো না খায় তবে- চা খাওয়া উচিত চিনি ছাড়া। আমি খুব ভালো করেই জানি যে আমি এখানে সংখ্যালঘু। তাও, আপনি যদি নিজের চায়ের মধ্যে চিনি মিশিয়ে তার নিজস্বতা নষ্ট করেন তবে কীভাবে আপনি নিজেকে একজন সত্যিকারের চা-প্রেমিকা বলে দাবি করতে পারেন? চিনির মতো তো মরিচ বা লবণ মেশানোও সমান যুক্তিযুক্ত হবে। চা তিক্ত হওয়ার কথা আর বিয়ার তেতো। যদি আপনি চিনি মিশিয়ে একে মিষ্টি বানায়ে ফেলেন, তখন আর চায়ের স্বাদ নিচ্ছেন না, আপনি কেবল চিনির স্বাদ নিচ্ছেন; আপনি সাধারণ গরম জলে চিনি মিশায়ে একই রকম একটা কিছু বানিয়ে খেতে পারেন।

কিছু লোক জবাব দেবে যে তারা চা পছন্দই করে না, কেবল গরম আর উজ্জীবিত হওয়ার জন্য তারা এটা খান এবং তিক্ত স্বাদ এড়াতে তাদের চিনি প্রয়োজন। এইসব বিভ্রান্ত লোকদের আমি বলবো: চিনি ছাড়াই চা খাওয়ার চেষ্টা করুন, এই ধরেন পনেরো দিন। দেখবেন, আপনি খুব সম্ভবত আপনার চাকে আর মিষ্টি করে নষ্ট করতে চাইবেন না।

চা খাওয়া সম্পর্কে কেবল এগুলো বিতর্কিত বিষয় নয়, তবে পুরো বিষয়ের গভীরতা কতো তা দেখাতে এগুলো যথেষ্ট। এছাড়াও চা কে ঘিরে চারপাশে রহস্যময় সামাজিক আদব কায়দা রয়েছে। (উদাহরণস্বরূপ, আপনার পিরিচে ঢেলে চা খাওয়া কেন বেয়াদবি হিসাবে বিবেচিত হয়?) এবং চাপাতি সম্পর্কে আরো অনেক লেখা যেতে পারে কিভাবে তা ভাগ্যের কথা বলে, দর্শনার্থীদের আগমনের পূর্বাভাস দেয়, খরগোশদের খাওয়ানো, পোড়া নিরাময় এবং কারপেট পরিষ্কারের মতো সহায়ক কাজ করে। পাত্র গরম করা এবং একদম ফুটতে থাকা জল ব্যবহার করার মতো এই বিবরণগুলোতে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া উচিত।

‘এ নাইস কাপ অফ টি’, জর্জ ওরওয়েল, ১২ জানুয়ারি ১৯৪৬


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //