নিখোঁজ

চারপাশে ছায়া ছায়া অন্ধকার। স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, মাথার ওপর ধূসর প্রাণহীন আচ্ছাদন, ঠিক আকাশ নয়। এটা কি স্বপ্ন, না কি সত্যি? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শরীরটা কেমন হালকা আর বোধহীন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন শূন্যে ভাসমান। শূন্যে ভাসমান শরীরকে ঠিক নিজের ইচ্ছামতো নাড়ানো চাড়ানো যায় না। তারপরও বেশ কসরত করে সে সেই শরীরটাকে ধীরে ধীরে টেনে তোলে। বসবার পর পা দুটি টান টান করে মেলে দিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, কোথাও কোনো পথ নেই। চারদিকে পানি আর পানি। সে পানি পরিষ্কার নয় আবার ঘোলাও নয়। সে হাত বাড়িয়ে সেই পানি ছোঁয়ার চেষ্টা করল; কিন্তু অদ্ভুত পানি! মেঘের মতো, ছোঁয়া যায় না। এরকম একটা জায়গায় সে কীভাবে এলো? কিছুই মনে করতে পারছে না। স্মৃতি কেবলই ধাক্কা খাচ্ছে। তার শরীরটা সামান্য দুলছে এটা বুঝতে পারছে সে। আশপাশে মনে হচ্ছে আরও অনেক মানুষ তারই মতো। তারা কেউ কোনো কথা বলছে না; কিন্তু সে কাউকে দেখতে না পেলেও তাদের কথা না শুনলেও তাদের অস্তিত্ব অনুভব করছে। তারা সবাই অধীর আগ্রহে কিসের যেন প্রতীক্ষায় সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখান থেকেই একটা সুড়ঙ্গ মতো পথ নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। সামান্য আলো ভেসে আসছে সেদিক থেকে। সেই অস্পষ্ট আলোর রেখার দিকে তাকিয়ে আছে সেও। এভাবে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে বোঝা গেল না। হঠাৎ দেখা গেল একজন দূত বড় একটা খাতা হাতে এসে দাঁড়িয়েছেন ওই টানেলের মাথায়। তাঁকে বেশ ব্যস্ত মনে হচ্ছে। দ্রুতহাতে কিছুক্ষণ খাতার পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখলেন। তারপর একের পর এক করে নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। তার ডাক শুনে প্রতিক্ষীতরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো একজন একজন করে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে।
এক সময় ডাক এলো, বিপ্লব রহমান, বিপ্লব রহমান!
নামটা কানে পৌঁছতেই সবকিছু মনে পড়ে গেল তার। বিপ্লব রহমান! এটা তো তারই নাম।
তার একটা নাম ছিল, একটা পরিচয় ছিল, একটা সংসার ছিল আর তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও কত কত মানবিক সম্পর্ক। হ্যাঁ, সবকিছু, সবকিছু মনে পড়ে গেল তার মুহূর্তে।
সে হাত তুলে স্কুলের ছাত্রের মতো ওই ডাকে সাড়া দিল কিন্তু সামনে এগোলো না এক পাও।
কি হলো, যাও! এই পথ ধরে ওপরে চলে যাও, নির্দেশ করলেন দূত।
সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, না।
না মানে! চমকে উঠলেন দূত, এমন কথা যেন তিনি কস্মিনকালেও শোনেননি। কি বললে তুমি?
আমি এই মুহূর্তে যেতে পারব না।
কেন?
আমি তালিকাভুক্ত নই।
আমি যতদূর জানি এই বইয়ের তালিকায় তোমার নাম আছে।
আমি ওই তালিকার কথা বলছি না।
তাহলে?
আমি আমার দেশের কথা বলছি।
ওই হামেশা উৎপাতের দেশে আবার কি হয়েছে?
আমি এখনো তালিকাভুক্ত হই নাই।
কেন, আমরা যতদূর জানি তোমাদের দেশে তোমার নামে একটা ভোটার আইডি কার্ড ছিল, তোমার একটা ট্রেড লাইসেন্স, একটা টিন নাম্বার ছিল। এখন কীভাবে বল যে তুমি সরকারের তালিকায় ছিলে না! এই হলো তোমাদের এক দোষ, কথায় কথায় অজুহাত দেখিয়ে বিদ্রোহ করতে চাও।
আপনি ভুল বুঝছেন দূত। আমি কোনো অজুহাত দেখাতে চাইনি।
তাহলে তুমি কি বলতে চাচ্ছ?
একথা সত্যি, যতদিন আমি জীবিত ছিলাম ততদিন আমার একটা আইডেনটিটি ছিল, সে কথা তো আমি অস্বীকার করছি না। আর এই আইডেনটিটি তৈরি করতে আমাকে জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সেটা ভুলে যাই কী করে? ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা নিখোঁজ হয়ে যান। একজন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের পরিবারের প্রতিটি জীবিত সদস্যকে যে কি দারুণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর দুঃসহ ক্লান্তিকর অপেক্ষার মধ্যে কাটাতে হয় সেটা আমার চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে বলেন?
তোমাকে তোমার বাবার পেশাটা কে নিতে বলেছিল?
কেন, ওটা নিয়ে কি আমি ভুল করেছি?
দূত একটু বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন- না, ঠিক ভুল না!
জানেন, আমার মা আমাকে বলেন, আমি নাকি বাবার মতো হয়েছি। দখলদারিত্ব, অন্যায়, অনিয়ম সহ্য করতে পারি না। এটা ভেবে আমার ভেতরে ভেতরে খুব গর্ব হয়। আমি তো একটা স্বাধীন দেশে বাস করি। আমার বাবাতো তাও করতেন না। তিনি সেই পরাধীনতা, শোষণ, বঞ্চনা মেনে নিতে পারেননি। তার কলম ছিল প্রতিবাদে সোচ্চার। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পরও তিনি গোপনে নিয়মিত তার সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে গেছেন। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। মা তখন অন্তঃসত্ত্বা। আমি তখন তার গর্ভে; কিন্তু সেদিকে বাবার খেয়াল কই? রাতদিন খবরের পেছনে ছোটা। রাতে প্রেসে বসে একাই সব কাজ করে যাওয়া। ঠিক ওরকম পাগলপারা সময়ের এক রাতে বাবাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল। বাবাকে আমরা আর খুঁজে পাইনি।
বাবাকে মানুষ হয়তো এখনো মনে রেখেছে। দেশ তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছে; কিন্তু আমার মা, আমার মা ভেতরে ভেতরে এখনো বাবার অপেক্ষায় থাকেন। মাঝে মাঝেই আমাকে বলেন, ‘কতজন তো বধ্যভূমি থেকেও ফিরে আসে তাই না বিপু? তোর বাবা দেখবি একদিন রাতে আবার ফিরে এসেছে’।
আমি জানি না। আমি এই কথার কোনো উত্তর জানি না। তবে কি জানেন, একটা বয়স পর্যন্ত আমিও বাবার জন্য অপেক্ষা করতাম। আর পাঁচটা পিতৃহীন সন্তানদের মতো বাবা শুধু আমার কাছে একটা ধারণা ছিল না। বাবা যেন আমার কাছে ছিল জীবন্ত এক সত্তা। সংগ্রামের প্রতীক। তারুণ্যে আমি সেই সংগ্রামকে বার বার ছুঁয়ে দিতে চেয়েছি। শৈশবে আমি আমার গোটা বাবাটাকেই ছুঁয়ে থাকতে চেয়েছি। কতদিন ভেবেছি, আমি বাবার হতে ধরে বেড়াতে যাবো। তার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়াব। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ সিনেমার শেষ দৃশ্যটা, যেখানে অপু তার সন্তানকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে! বড় হয়ে যাওয়ার পরও ওই দৃশ্যটা আমার ভেতরে হাহাকার হয়ে রইল। আমার চাচাতো-মামাতো ভাই-বোনেরা যখন তাদের বাবার কাঁধে চড়ত, আমারো ভীষণ ইচ্ছা করত; কিন্তু আমাকে কে কাঁধে চড়াবে! বাবা বলে খুব জোরে ডাকতে ইচ্ছা করত। যদি ডাকে সাড়া দেন!
আচ্ছা, এখানে কি আমাকে কাঁধে চড়িয়ে আনা হয়েছে, নাকি টেনে হিঁচড়ে? এ জীবনে আমার আর কাঁধে চড়া হলো না। এমনকি মৃত্যু যদি হয়ে থাকে তাতেও না।
আমি এখন একজন মিসিং পার্সন। পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। আপনি নিশ্চই মৃত মানুষ আর নিখোঁজ মানুষের মধ্যে পার্থক্যটা বোঝেন?
বুঝব না কেন?
তাহলে বুঝেন, আমার বাড়ির মানুষ, আমার স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন এরা আমাকে দিশেহারার মতো হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি এখন জীবিত মানুষের তালিকাতে নেই, আবার মৃত মানুষের তালিকাতেও নেই। তাহলে কী করে আপনারা আমাকে এই টানেল পার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন?
কিন্তু হে মানুষ, তোমার দেশের তালিকায় থাকুক আর না থাকুক, এ কথাতো সত্য যে তুমি আর...!
তার কথা শেষ করতে না দিয়েই আমি চেঁচিয়ে উঠি, কিন্তু তার প্রমাণ কোথায়? পৃথিবীর কেউ জানে না যে আমি এখনো বেঁচে আছি, কী মরে গেছি। আমার প্রতি, আমার আত্মার প্রতি আমার আত্মীয় পরিজন এখনো শেষ শ্রদ্ধা জানায়নি। আমার আত্মার শান্তির জন্য তারা কোনো স্বগীয় স্তোক উচ্চারণ করেনি। ক্ষমা করুন আমায় দূত; আমি এখন, এই মুহূর্তে যতক্ষণ না আমার দেশ, আমার পরিবার আমাকে মৃত বলে মেনে না নিচ্ছে ততক্ষণ আমি আপনার এই আদেশ পালন করতে পারব না। আপনার নির্দেশ মতো জীবন-মরণের মাঝে ঝুলে থাকা ওই সেতু আমি পার হতে পারব না।
কিন্তু মানুষ, তুমিতো দেখতে পাচ্ছো এখানে কী ঘটছে!
আমি দেখতে পাচ্ছি, অপনারাও তো দেখতে পাচ্ছেন, তাহলে এতটা নির্দয় কিভাবে আপনারা আমার ওপর হতে পারেন! হে দূত! আমার মৃত্যুর পর আমি জীবিত কি মৃত সে কথা জানার অধিকার আমার পরিবারের, আমার সমাজের থাকবে না! কেন একজন নিখোঁজ মানুষ হিসেবে আমাকে সবাই বিবেচনা করবে? কেন সবাই ভাববে যে আমি আমার সব দায় দায়িত্ব অস্বীকার করে হারিয়ে গেছি!
আর দুদিন পর আমার মেয়েটার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। আপনি ভাবতে পারছেন আমার পরিবারের ওপর কী বিপর্যয় নেমে এসেছে! এই অবস্থায় আমি আপনার নির্দেশ মতো সাঁকোর ওপারে যেতে পারি না, কিছুতেই না।
তাহলে তুমি এখন কি চাও?
আমি জানাতে চাই। এমনকি আমি নিজেও জানতে চাই, আমি কি বেঁচে আছি, নাকি মরে বেঁচে আছি, নাকি...!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //