কত জনমের সাথী

যুবতীর লাশ পড়ে আছে মণ্ডল বাড়ির আঙিনায়। বয়স বাইশ-তেইশ কিংবা পঁচিশ। পুকুরপাড়ে মরে পড়ে ছিল। কখন-কীভাবে মরেছে কেউ জানে না। সকাল-দুপুর কেউ-কেউ বিকেলেও হেঁটে যেতে দেখেছে তাকে। মানুষ যে আকস্মিক মরে যায়, মরে যেতে পারে, এ কথা সকলেই জানে। আজকাল কেউ অবাক হয় না। তার বেলায় তো নয়ই। অভিভাবকহীন মেয়েমানুষ। নষ্ট খারাপ মেয়েছেলে।

অবশ্য গ্রামের সকলে জানে, একসময় ফাতিমার ঘর ছিল। পরিচয় ছিল। ছিল সোনার সংসারও। কীভাবে কী হলো? একদিন রাস্তায় নেমে গেল সে। এর জন্য যে মানুষ সর্বৈব দায়ী তার মুখের ওপর কেউ কথা বলতে পারে না। তেমন আগ্রহ আর সাহস কারও নেই। পৃথিবী এমনই। কে কোথায় বেঁচে থাকে নাকি মরে পড়ে আছে, কারও দেখার, জানার কোনো কৌতূহল থাকে না; কিন্তু ভরসন্ধ্যায় পাকালু বুড়া ঝোপঝাড়ে বসে দুটি বিড়ি খায়, পেটভর্তি হাগে; তারপর নেমে আসে ঠগের পুকুরপাড়। সবুজঘোলা ঠাণ্ডা পানির দু-একটা ঝাপটা মেরে মাথা ঘুরে পেছনে ডানদিকে তাকায়। পাড়ের উঁচুতে গাছকলাইয়ের নিচু ঝোপ, তারই ফাঁকে কোনো মেয়েমানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। বেগুনি রঙের শাড়ি সন্ধ্যার আলোছায়ায় প্রগাঢ় ধূসর-কালো। সে কিছুই বুঝতে পারে না। কে কেন পড়ে আছে নাকি কোনো পেতনি-শাঁকচুন্নি? তারপর আকস্মিক বিকট চিৎকার ছড়িয়ে দেয় পাড়াময়।

সেই লাশ টেনে-ধরে আনা হয়েছে এখানে। আতিয়ার মণ্ডল মেম্বার মানুষ। সরকারি দল করে। ক্ষমতার দাপট যেমন, কর্মতৎপরতাও কম নয়। তখন সকলের উৎসুক-কৌতূহল দৃষ্টি ভিড়ের ফাঁকফোকরে হামলে পড়ে। সেই মেয়েমানুষ আর কেউ নয়...ফাতিমা। মেম্বার যথারীতি পুলিশের কাছে মানুষ পাঠিয়ে দেয়। সন্ধ্যারাত থেকে একটি লাশ দুয়ার-আঙিনায় পড়ে থাকলে চারপাশ কেমন ভার ভার লাগে। বাতাসও স্থির-স্থবির ক্রমশ গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। মানুষের চোখে-মুখে ফ্যাকাশে গুমোট বিষণ্ণ ছবি। অথবা কে জানে সে-সবের রঙ কী? ফাতিমার গায়ের রঙ গোরা, অর্থাৎ ধবধবে ফরসা; পানপাতা মুখচ্ছবি। সেখানে অদ্ভুত আভা। আকস্মিক কারও নজর পড়লে মন কোনো তেপান্তর মাঠ কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক বেলাভূমিতে ভেসে যেতে চায়। এখন সেই মানুষ মৃত দেহকাঠামো মাত্র। সন্ধ্যার মলিন আঁধারের মতো পাঁশুটে ম্লান। হিম-শক্ত-কাঠ শরীর। ঠোঁটের ডানপাশ থেকে কোনো ফাঁক খুঁজে জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। রক্তের দাগ কষ বেয়ে শীতল কালো। সকলের সন্দেহ, যে মানুষ সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় হেঁটে বেড়ায়, বাস ধরে শহরের রাস্তায় ঘোরে; কেউ মেরে না গেলে এমন পরিণতি হয়? এ হত্যাকাণ্ড। তারপর সেই সিদ্ধান্ত আইন-আদালতের কাজ। কারও অনুমান সন্দেহে কী আসে যায়? পুলিশ এলোমেলো দেড় ক্রোশ পথ মাড়িয়ে আসে। শরীর ঢেকে রাখা কাপড় তুলে একপলক দেখে নেয়। বীভৎস! পৃথিবীতে অনেক কষ্টে বেঁচে থাকা মানুষের শবদেহ নাকি কুৎসিত হয়। এখন এই লাশ নিতে হবে সদরে।

সালিমের প্রথমে আপত্তি। সে কোথাও যাবে না। সদর তো সদর বাজারেও না। ভোররাতে ঘুম চেপে ধরা চোখ দুটি জোড়া লেগে আছে। ক্লান্তি-আলস্যে কুঁইকুঁই বিশ্রামকাতর শরীর-মন। তাই হাঁকডাক শুনেও সাড়া দেয় না। নিশ্চুপ শুয়ে থাকে। আবুল মিয়া ঘুলঘুলি জানালা দিয়ে দু-একবার তাকায়। জোরে জোরে গলাখাঁকারি। শ্লেষ্মার দলা আবছা-অন্ধকারে ছুড়ে দেয়। রাতের ছায়াঘোর কেটে যাচ্ছে। পুব-আকাশের দেয়ালে দু-একটি তারা নিভতে বসে। ঘরের ভেতরে অন্ধকার। সালিম সেই অন্ধকারের বিছানায় শুয়ে আছে। একা। অন্য কেউ নেই। থাকলেই-বা কি? গাঁ সুদ্ধ মানুষজন জানে ছাড়াছাড়ি শেষে অনেক বদলে গেছে সালিম। নেশা ভাঙ চলে। চোলাই মদ খায়। কেউ-কেউ আঙিনায় দু-এক সন্ধ্যা মেয়েমানুষ হাঁটতে দেখে। সে কি ফাতিমা? কে জানে হয়তো সে, অথবা নয়; তবে তার মতো লাগে। অন্ধকারের দৃষ্টি। সবকিছু ঝাপসা। আর সে-সব নিয়ে কে আর ভাবে? তবু কথা হয়। মানুষ কথা বলে। সে-সবের সত্যাসত্য জানা নেই, হয়তো মিথ্যে নয়; মেম্বারের সন্দেহ। তার কানে কথা ওঠে। একদিন তাই সালিমকে সাবধান করা হলো। কড়া ভাষায় ধমকানি। একঘরে করা হবে। পুকুরঘাটে যেতে পারবে না। দোকানে সওদাপাতি বন্ধ। কেউ কথা কইবে না। গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। বাপের ব্যাটা সালিম। লুঙ্গি দু’হাতে হাঁটুর উপরে তুলে মেম্বারকে উলটো শাসিয়ে দেয়।

‘একঘরা করি মোর বালের আঁটি বান্ধেন তোরা। সেইদিন নাই মেম্বার। টাউন হয়া যাছে সব। সিন্মা হল বসিছে। মার্কেট হছে অফিস হছে আরও...!’

‘স্বভাব ভালো হইলে কি তুই বউ ছাড়া হইস রে? তোর পাপোতে সব শ্যাষ হইচে। তোউবা-তোউবা!’

জোঁকের মুখে লবণ পড়লে যে অবস্থা সালিমের মুখ-চোখ অন্ধকার। জবান বন্ধ। বেচারা! আড়াই-তিন বছর ঘুরতে না ঘুরতে দু’জনের ছাড়াছাড়ি। তখন ঘটনা পাড়াময় ছড়িয়ে পড়ে। বউটি কাঁদছিল। সে আর্তনাদ এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ফাতিমার দু-চোখের অশ্রুধারা কাঞ্চনের সরু স্রোতধারায় মিশে যায় বুঝি।

এখন সালিম অন্ধকারে শুয়ে আছে। সুখি না দুঃখী কিছু বোঝা যায় না। সুখি মানুষের শোবার ধরন নাকি আলাদা। আবুল মিয়া একটি বিড়ি ছুড়ে দেয়। সালিম টের পায়। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ম্লান আঁধারের মধ্যে সাদা বিড়ি চকচক করতে থাকে।

‘দারগা ডাকাছে।’

‘কাঁয়? দারগা? বালটা ফির এ্যাঠে কী করোছে? মুই কি চুরি করিছু?’

‘লাশ নিবা হবি মর্গোত।’

‘লাশ? মুই পারিম না। যায়া ক গাওপিঠের বেদনা...বিষ।’

‘আর কাঁহো নাই তো।’

‘তুই যা তো আবুল। গেলু? শালা নিন্দাবাও দেয় না।’

‘মোর...ঠ্যাকা? দারগা পাঠে দিছে। সরকারি কাম।’

‘নিন্দাবা দি তো। মুই সরকারের চাকরি করো না।’

‘কাল সাঁঝ থাকি পড়ি আছে লাশ। কাঁয় নিগাবি তাইলে?’

‘শহিদুলোক ক!’

‘ওঁয় তো শ্বশুরবাড়ি। থাকিলে ফির তোক কও ফাতিমার লাশ নিগাবার?’

‘কাঁয় মইরছে...ফাতিমা? ক্যাংকা করি? কতথন?’

‘তুই জানি না নাকি রে!’

‘এক ফোঁটাও নহায়। হায় আল্লাহ!’

সালিম ধড়ফড় করে উঠে বসে। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মুহূর্তখানেক কান ঝাঁকিয়ে চুলকোয়। মেঝেয় পড়ে থাকা বিড়ি কুড়িয়ে নেয়। বালিশের তলায় ম্যাচ খোঁজে। পায় না। আবুল ঘুলঘুলি দিয়ে ঘরের ভেতর আবছা ছায়া দেখে।

‘বেইরা না বা হে!’

‘শালার ম্যাচটা যে কুনঠে রাখিচু!’

সালিম দরজার হুড়কো খুলে বেরোয়। দেয়ালে সাঁটানো আয়নায় হাতের স্পর্শ, শুকনো আর অসম্ভব ঠা-া; কত স্মৃতি বিজড়িত। ভোরের আলোছায়ায় ওতে নিজের চেহারা দেখার সাধ হয়। কেমন চেহারা তার? সে কতদিন নিজের মুখ দেখে না! দেখতে লজ্জা লাগে। ভয় হয়। আজও তাই। সে আয়নার সামনে দাঁড়ায় না। একটু আগে ফজরের আজান হয়ে গেছে। আছ্ছলা-তু খাইরুম মিনান্নাউ-ম। নিদ্রা হতে নামাজ উত্তম। তার জেগে থাকা কি... ঘুমই কি! ঈশ্বর-মৃত্যু-পরকাল কোনোকিছু ভাবনা নেই। এ জগতের সবকিছু মিথ্যা। একজন কষ্ট করে অন্যজন মজা পায়। কেউ করে পাপ কেউ করে সাফ। সব ঝুট। অনেক ভালো হয়ে থেকেছে। কী পেয়েছে সে? ধোকা...প্রতারণা...কষ্ট। এখন নিজেকেই বড় ঘৃণা করে সে। নিজের কাছে...অস্তিত্বের দিশায় বড় এক জিজ্ঞাসা তার বেঁচে থাকা।

সে আবুলের হাত থেকে ম্যাচ নিয়ে বিড়ি জ্বালায়। প্রচ- টান শেষে গরগর করে ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর বেগুন-মূলা ক্ষেতের দিকে গিয়ে বসে। অনেকক্ষণ ঝাঁজালো গন্ধে বাতাস ভেজায়।

‘ক্যাংকা করি মরিছে হেহ্?’

‘তুই আগোত এত্তি আইসেক সালিম।’

সহসা তলপেট মোচড় দিয়ে ওঠে। আমাশা খেয়ে ফেলল। হোটেলের খাওয়া আর সহ্য হয় না। বউ থাকলে...! সে উঠে পড়ে। টাইম নাই। কৌতূহলী মন ছটফট করতে থাকে। কী করে ফাতু মরল? পরশুদিন সন্ধ্যায় রাস্তায় দেখা। সেই রাতে কাছে ছিল। এখনো ওর শরীরের গন্ধ নাকে লেগে আছে।

‘সব কথা শুনাইবার যো এ্যালা নাই। দারগা ডাকাছে।’

‘আ রে থো তোর দারগা। কান পচি গেইল। তা মোক ক্যানে ডাকাছে? কাঁহো মারি থুইছে নাকি রে?’

‘ঘটনা বোধায় ওইংকাই। বগরতলার খালটাত পড়ি আছিল। পাকালু বুড়া সাঁঝোত কি তনে ওই ভিটাত যায়া দেখিচে। বুড়া চেঁচায়া ফিট।’

‘কাঁয় মারিবে?’

‘শুধু মারে নাই। সবায় কছে আরও কিছু করিছে। চলেক টপ করি।’

সালিমের শরীর ঠা-া হয়ে আসে। সেদিন রাতে দু’জনের অনেক কথা হয়। একদা কত কাছাকাছি ছিল! কত আপন কত স্মৃতি! আজকাল কত দূর! আশ্বিনের নতুন হিম হিম সন্ধ্যায় ঘরে এনেছিল ফাতিমাকে। অনেক স্বপ্ন আর সাধ মনের অলিগলিতে গানের সুর তোলে। এবার...এবার তার এলোমেলো পিছুটানহীন জীবন ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রাখবে। একজন নতুন মানুষ। জীবনপথ চলার সাথী। কারেন্টের হাট আর হাটখোলায় গেঞ্জির দোকান জমে উঠেছে। বেচাবিক্রি ভালো। ভয় কী? দু’জনের বেশ চলে যাবে। কতগুলো দিনরাত, কতশত ভাবনা-উন্মাদনা আর নতুন আবিষ্কারের নেশায় পেরিয়ে গেল। চাঁদের আলো উঁকি দিল ভাঙাচুরা চালের ফাঁকে। তারপরও রাত কত ছোট, কত দ্রুত ফুরিয়ে যায়; শরীর-মনের প্রেম শেষ হয় না। ফাতিমাকে খুব ভালোবাসত সে। এখন? কে জানে! অনেককিছু আর বুঝতে পারে না। মন বড় অবুঝ। অথচ দিন চলে গেছে কত না নির্ভরতায় কত না আশ্রয়ে। কোনো কোনোদিন হাটে দোকান ঘুরে ঘুরে সুবাসিত তেল-স্নো-রেশমি চুড়ি-চুলের বাহারি ফিতা কিংবা ক্লিপ কিনে নেয়। ফাতিমা সাজলে ফিলমের হিরোইনের মতো লাগে। ওই রাতে অচেনা আবেগ বাচাল করে তোলে তাকেও। ছোট ছোট দুষ্টুকথা আনন্দ-হাসি ছড়িয়ে আলোয় ভরে রাখে সারাঘর। ফাতিমার সঘন নিঃশ্বাস আর ভালোবাসায় জীবনকে নতুন করে দেখা হলো। বেঁচে থাকার নানান হতাশা-গ্লানি-ক্ষোভ ভুলে যায়। বাউন্ডেলে বিবাগী মন হয়ে ওঠে সংসারি। ফাতিমা হিসাবের কথা বলত। এটা-ওটা নানান কাজের কথা। টিউবওয়েলের পাড় ঘিরে দেওয়ার কিংবা সঞ্চয়ের তাগিদ। ক্ষ্যাপাত তাকে। সালিম হাসে।

‘তোর খালি খালি টাকা জমানির প্যাঁচাল। ক্যানে মুই কি মরি যাছু?’

‘কিসের মধ্যে কী আনেন মুখোত! ভবিষ্যতের কথা ভাবমেন না? আইজ নহায় দুইজন। দুইদিন পর মানুষ বাড়িবে, তখন...?’ তু

‘হায় রে ফাতু...ফাতু রে তুই এ্যাতো কিছু ভাবিস?’

সে আবেগে বউকে জড়িয়ে ধরে। নিজের প্রশস্ত বুকের মধ্যে আগলে নেয়। জীবনের হাজার চাওয়া-পাওয়ার কঠিন হিসাব-অঙ্ক জানে না। কোনোকিছু বোঝে না। ছোট থেকে বড় হয়েছে পরের আশ্রয়ে। কোনোদিন কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। পৃথিবীতে আপন কেউ নেই। সেই আক্ষেপ মিশে যায় তেপান্তর বাতাসে। ফাতিমা এলো জীবনে। এখন সেই তার সবকিছু। একান্ত আপনার পৃথিবীতে আপন মানুষ। একদিন তার নরম কোলজুড়ে সন্তান আসবে। নিজের অনাদর অবহেলার জীবনে যে অকথিত বেদনা-বিক্ষোভ সব ভুলে যাবে। সন্তানের ছোট্ট প্রাণ পূর্ণতায় ভরিয়ে রাখবে। কোনো অপমান কোনো আক্ষেপ আর থাকবে না। তাই ফাতিমাকে ঘিরে জীবনকে নতুন করে দেখা আর পাওয়ার অনাস্বাদিত পুলক জেগে থাকে।

দিনরাতের কঠোর পরিশ্রম আর চড়াই-উতরাই ঠেলে সামান্য সঞ্চয়ে গেঞ্জির ছোট এক দোকান শুরু করেছিল। প্রথম প্রথম সপ্তাহের দু-দিন ভারযষ্টিতে মালামাল তুলে হাটে বসে। নির্দিষ্ট একচালায় পসরা সাজায়। অসীম ধৈর্য আর অমায়িক ব্যবহার সম্বল। বেচাবিক্রি ভালো হয়। মানুষের আস্থা-সুনামও জোটে। অবশেষে অস্থির-চঞ্চল জীবনে ধীরে ধীরে নেমে আসে সুস্থির বাতাস। অস্তিত্বের মায়াডোরে কাঙাল মনে ভালোবাসা এলো। সেই নিয়ম যেনবা সোনার খাঁচায় দিনরাত্রি বেঁধে রাখা। সুখে ছিল সে। মনে আনন্দ।

ফাতিমা তার জন্য অপেক্ষা করে। সূর্য ডোবার পর গোধূলি আকাশ ধূসর হয়ে যায়। ঘরের আশপাশ ঝোপঝাড় ক্ষেত-আইলের ধার বড় চঞ্চল করে তোলে জোনাকির মালা। ঘুগরে-ঝিঁঝিঁ আর উচ্চিংড়ের কানভারী আওয়াজ। সন্ধ্যার শেষ-অবসরটুকু মুছে যেতে যেতে বাতাসেও বুঝি কারও ফিসফিস ভেসে বেড়ায়। গ্রামের দক্ষিণ শেষপ্রান্তে সুখের নিবাস। অল্প কিছু দূরে আদা-হলুদের ক্ষেত। সেগুলোর লম্বা পাতা অদ্ভুত সুগন্ধ ছড়িয়ে রাখে। তার পেছনে ডোবার মতো ছোট ঠগের পুকুর, দেড়-দুই ফুট উঁচু পাড়ে চেনা-অচেনা গাছগাছালি; বিশাল ঝাঁকড়া এক হিজল। তারই কোনো শাখায় ঝুলে শান্তি খুঁজেছিল সখিনা। স্বামীর মাতলামি মারধরের চেয়েও বড় অশান্তি পেটের আগুন। একরাতে তাই আগুন নেভাতে পেরেছিল। এসব গল্প শোনা ফাতিমার।

কখনো চোখের সামনে হেঁটে বেড়ায় সখিনার দুই মেয়ে। প্রায় উদোম শরীর। বড়টি বুকের ওপর দু-হাত রেখে কোনো অচেনা লজ্জা ঢাকার চেষ্টা নেয়। ফাতিমার খুব মায়া জাগে। কোনোদিন একচালার নিচে ডেকে এনে খেতে দেয়। পুরনো গেঞ্জি বের করে। একটি-দুটি কথায় গল্প-আলাপ। বিশুষ্ক চোখে খেতে খেতে কথা বলে মেয়েদুটি।

ফাতিমার মন পোড়ে। মানুষের এত কষ্ট কেন? তারপর একলা সময়। এটা-ওটা কাজে দিন পেরিয়ে গেলে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত; ঠগেরপাড়ে বাতাস হেঁটে বেড়ায়। হিজলের ডালপালা শন শন আওয়াজ তোলে। ফাতিমার মন কারণ-অকারণ সতর্ক সাবধান। ভয় ভয় লাগে। গ্রামে সন্ধ্যা হতে হতেই গভীর রাত। চিরিনদীর কিনার ঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিম বোর্ডের রাস্তা। সেটি ধরে হাট-ফেরতা মানুষজন ঘরে ফেরে। কখনো চাঁদের আলো...ঝকঝকে জোছনা।

কখনো টর্চ বা হ্যাজাকের আলো দেখতে দেখতে পথ চিনে নেয়া। তাদের কথোপকথন অস্পষ্ট শোনা যায়। ফাতিমা কত কথা ভাবতে ভাবতে প্রতীক্ষায় থাকে। এই বুঝি আঙিনায় পদশব্দ শোনা যায়। এমনই একদিন বেশ দেরিতে ঘরে ফেরে সালিম। সেদিন শহর গিয়ে মালপত্তর কেনা হয়। আবুলের পাল্লায় পড়ে সন্ধ্যায় সিনেমা দেখা। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত। নিজেকে তার ছায়াছবির নায়ক ভেবে নিতে সাধ জাগে। মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি। কী করছে ফাতিমা? তাকে চমকে দেওয়ার মতলবে ভারী গলায় বলে ওঠে,-

‘এ্যাই ফাতিমা...ফাতিমা রে, ঘরোত আছি? কী করোছি? ’

কোনো সাড়া নেই। নিশ্চুপ রাতের হাজার পতঙ্গ শব্দ থেমে গেছে। বাতাসে আচমকা ঢেউ। গাছের পাতার ঝিরিঝিরি গান। কারও কি নিঃশ্বাস পতনের জোর শব্দ কানে লাগে? সালিম মনে মনে খুব হাসে। বউ ভয়ে কাঠ। সালিম আবার অচেনা স্বরে ডাক দেয়।

‘এ্যাই ফাতিমা...ফাতিমা রে, মুই আইচু। দরজাটা খোলেক ক্যানে!’

আকস্মিক কী হয়? ঘরের আলো বুঝি দ্রুত কেঁপে ওঠে। সালিম চমকে-থমকে দুই-পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। মাথার ওপর কিসের ছায়া? বাতাসে বেজে ওঠে কোন ঝাঁজালো কণ্ঠ?

‘কোন শালার পুত রে...জবাই করি থুইম এ্যালা। হারামজাদা মোক ভয় দেখাছে?’

ফাতিমা মাথার ওপর দু-হাতে বঁটি তুলে দাঁড়িয়ে। এই বুঝি নেমে এলো ক্ষুরধার কোপ। সালিমের আর্ত-চিৎকার।

‘আ রে মুইরে মুই...মজাক করছিনু।’

‘এ্যাইলা তোমহার কাম! ছি ছি ছি মুই ডরোতে কাঁপিছি বা...আল্লা আল্লা!’

ফাতিমা আঁচল সরিয়ে বুকে থুত থুত করে থুতু ছিটোয়। রাতের দেয়ালে কোত্থেকে ভেসে আসে ভয়-ভয় আনন্দ-উচ্ছল হাস্য-কলরোল। সালিম সামনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ফাতিমাকে।

‘ভয় পাইছি? টাউন গেইছিনু। শালার আবুলটার তনে সিনামা দেখপা হইল। আন্ধন-বাড়ন হইছে? ক্ষিদা নাগছে।’

‘নিজে নিয়া খান। বাপরে বাপ! ডরে মোর বুকটা এ্যালায়ও কাঁপেছে।’

‘ডরোর কি আছে রে ফাতু? মুই তো আইছু।’

‘এ্যালায় তো কইমেনই।’

ফাতিমা হাসে। সালিমের সারাদিনের এদিক-ওদিক ছুটোছুটির ক্লান্তি আনন্দে ভেসে যায়। বড় ভাগ্যবান সে। অনেক পুণ্যফলে এমন একজন সাথী পেয়েছে। হাজার জনমের সাথী।

‘এ্যাকলা এ্যাকলা সিনামা দেখার হাউস কততো!’

‘অপবার তোক নিয়া যাম।’

‘হুঁ!...মিছা কাথা।’

‘আ রে নহায়, সত্যি...সত্যি নিয়া যাম।’

সেই ফাতিমা পরে কত অন্ধকার কি চাঁদনি রাত উপেক্ষা করে কোথায় কোথায় হেঁটে গেছে। তার আর কোনো ভয়-ডর ছিল না। জীবনের নানাবিধ প্রয়োজন আর অস্তিত্বের তাগিদ বাধ্য করেছিল সবকিছু এড়িয়ে যেতে। অথবা হারাবার যার কিছু নেই তার আবার ভয় কি?

সালিমের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। সে তখন রিকশাঅলা। প্রতিদিন ভোররাতে শহরে যায়। শহরের পথে পথে সচ্ছল সওয়ারি নিয়ে ঘোরে। নিজেকে কখনো পশু মনে হয়। লাঙল টেনে চলা বলদ। কখনোবা এই সমাজ সংসারে অহেতুক সভ্যতা-মনুষ্যত্ব খুঁজে অহেতুক হয়রান। হায় মানুষ আজও তুমি বর্বর...অসভ্য প্রাণি! সে যখন পরিশ্রম ক্লান্ত ঘরে ফিরে আসে, নিজেকে মেঝেয় আছড়ে ফেলতে ইচ্ছে জাগে। ফাতিমার হাজার স্মৃতি। রিকশা লোহার চেইন পেঁচিয়ে খুঁটির সঙ্গে তালা বেঁধে রাখে। সে শুধু জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আর সংসারের আনন্দটুকু বেঁধে রাখতে পারল না। নিজের ওপর ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে অসম্ভব ঘৃণা মিলেমিশে একাকার হতে থাকে। কখনো মেঘজল করুণা। তখন কোনো কোনো সন্ধ্যারাতের আঁধার বাঁকে ফাতিমাকে দেখা যায়। বোর্ডের রাস্তা ধরে দূরে কোথাও হেঁটে চলে। মোড়ের বটগাছ ঝাঁকড়া দৃষ্টি তুলে সাক্ষী হয়ে থাকে। তাকে ডেকে ফেরাবার কোনো ক্ষমতা কোনো অধিকার সালিমের নেই। ফাতিমা যে আর আপন মানুষ নয়। সালিম নিষেধ করবার কে?

কোনো এক গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দুপুরে অধিকার খুইয়ে বসে সে। তার মাথার ঠিক ছিল না। কয়েক বছর হয়ে গেল একটি বাচ্চা দিতে পারল না ফাতিমা। দিনশেষে কোনো রাতে বুকের খুব কাছে এসে বলল না সেই সনাতন কথা। সালিম বাপ হবে। গ্রামের বর্ষীয়ান দাই দেখিয়েছিল। বুড়ি ফাতিমাকে ঘরের আবছায়ায় টেনে নিয়ে শরীরের এদিক-ওদিক হাতড়ে কিছু খোঁজে। তারপর বিরসবদনে মতামত। ফাতিমার বাচ্চা হবে না। বন্ধ্যা নারী। সালিম তখন আঙিনার পশ্চিম কোণায় গাছের গুঁড়িতে বসে বিড়ি টানে। একটু একটু করে হাজার স্বপ্নের নাগরদোলা নীলচে ঢেউ হয়ে বাতাসে মেশে। তারা দূর-বহুদূর ভেসে যায়। একটি কথায় সবকিছুর ছন্দপতন।

আকাশপরির মতো অপরূপ সুন্দর একজন তার বউ, অথচ সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম; সেই না পারা যে তারও লজ্জার। স্বপ্নভঙ্গ অসম্ভব যন্ত্রণার। তাই কি ধীরে ধীরে সকল মায়া-ভালোবাসা কমে যায়? কে জানে সত্য কী, অথবা সে-সব মিথ্যে; অন্য কোথাও অন্যকিছু গোপন পাপের মতো মুখ লুকিয়ে জেগে থাকে। একটি কু-লিত সাপ গর্তের মুখে চোখ রেখে যেমন বাইরে তাকায়, সে কী দেখে, কী খোঁজে, অথবা কিছুই দেখে না, কোনো সত্য নয়, সহসা নিজেকে বারবার দংশন করে যায়; অতীতের সুখময় দিনকালে দৃষ্টি রেখে আশীবিষে মৃতের মতো ঘুমিয়ে থাকে। হায় জীবন!

ব্যবসা খারাপ। গ্রামের মানুষ শহরমুখী হতে শুরু করেছে। রেলস্টেশনের উত্তরে বিশাল জায়গাজুড়ে উপজেলা কম্পাউন্ড। সারাদিন পুরনো ঘরবাড়ি ভাঙচুর গর্ত খনন আর শ্রমিকের হাজার চিৎকার-কোলাহলের মধ্য দিয়ে নতুন বিল্ডিং মাথা উঁচু উঠে দাঁড়ায়। কতই-বা দূরত্ব হাটখোলা?

ওখানের জনাকীর্ণ কলরোল বাতাসের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এখানে আছড়ে পড়ে। যেমনভাবে হাজার জৌলুস পালে বাতাস লাগায়। বিশাল মার্কেট উঠতে থাকে। সালিমের বাঁধা খদ্দের একে একে ছুটতে শুরু করে। তারা চলে যায় অন্যখানে। মানুষের পছন্দ চাকচিক্য আড়ম্বর। আনন্দ-ফূর্তি ভালো লাগে। সালিমের মনে স্বস্তি ক্রমশ কমে যায়। একটু টানাটানি একটু অভাব এসে দাঁড়ায় খোলা আঙিনার মধ্যখানে। কোনোকিছু ভালো লাগে না। উদাসী বাতাস খিটখিটে ঢেউয়ে নেচে নেচে মাথা আউলে বেড়ায়।

ফাতিমা দাইবুড়ির মুখে সেই কথা শোনার পর মিইয়ে গিয়েছে। সবসময় বিষাদ ক্লান্তি মুখচ্ছবির পরতে পরতে মিশে থাকে। কোনো হাসি নেই। কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই। মনের গহিনে রোরুদ্যমান কান্নার জলছাপ আকাশপ্রান্তে মেঘ হয়ে থাকে। কোনো স্ফুরণ কোনো বৃষ্টি নেই। সালিমের অবসাদগ্রস্ত শঙ্কাকুল দৃষ্টি কী দেখে? কতটুকু দেখে রাখে? কী করার আছে তার? সে শুধু মায়ায় জড়ানো ভালোবাসা প্রলাপ। কখনো হতবিহ্বল খেদ। অবুঝ রাগ-অনুরাগ। অবশেষে সব তার নসিবের দোষ। কোনোদিন সকল কাজ ফেলে ঠগের পাড়ে হিজলের নিচে নিশ্চুপ বসে থাকে। আচমকা দমকা বাতাসে কত কথা কত স্মৃতি ভেসে বেড়ায়। সেখানে অপমান-কান্না-ক্ষোভ আর অসহায় আর্তির নিশ্চুপ কথামালা। জন্মের সময় মা মরেছে। বাপ কোন দুঃখে, কিসের ছলনায় কোথায় চলে গেল কেউ জানে না।

তাকে ছেড়ে যেতে একটুয়ো মায়া হলো না বাবার? তারপর জীবন যেমন গড়াতে গড়াতে এগিয়ে যায় কিংবা এইসব দিনরাত্রি, সালিম বেঁচে থাকে এতিমখানার কোনো প্রকোষ্ঠে। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা মাথা দুলিয়ে আরবি পড়ে। আলিফ যবর আ...বে যবর বা। একদিন সেই নাটকের যবনিকা। অবশেষে অর্থশালী মানুষের একপাল ছাগল চরাতে চরাতে বাঁশির সুরে সুরে উদাস দুপুর তেপান্তর হলে বুঝে নেয়, আর নয় এবার নিজের অভিযাত্রা। ওইটুকু জীবনে কম অভিজ্ঞতা হয়নি! বুকের গহিনে কম অপমান দানা বাঁধেনি! একটিই জীবন। তাই মনের কোনে গোপন সাধের সুর। তার একটি সন্তান থাকবে। নিজের জীবনের সকল গ্লানি সকল ক্লেশ মুছে যাবে। মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে তাকে। কখনো কখনো সেই দিনক্ষণের স্বপ্ন বিমূর্ত ছবি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। অনাস্বাদিত পুলকে অদ্ভুত ঘোর দু-চোখের দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। মানুষের অবাক-বিস¥য় চাহনি। সালিমের আত্মশ্লাঘায় উদ্দীপ্ত গোধূলির সাজ; কিন্তু...সব মিছে কল্পনা। রূপকথার গল্পকাহিনি। এদিকে ফাতিমার বিষণ্ণ চোখ, যেখানে হাজার বছরের কান্না মেঘজল হয়ে থিরথির কেঁপে যায়। সেখানে কি কোনো ঝড় নেই? সালিম কী করে সেই ঝঞ্ঝা থামায়? সে যে ফাতিমাকে বড় ভালোবাসে। তাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারে না।

কারেন্ট হাট আর স্টেশন হাটখোলা বাজার। সপ্তাহের চার দিন। এর মধ্যে একদিন হাটখোলা বন্ধ হয়ে গেল। সাত দিনে দুইদিন দোকান। সালিম দুপুরে ভারযষ্টি সাজিয়ে হাটে যায়। নির্ধারিত চালার নিচে বসে। বাঁশের খুঁটির টানায় গামছা-গেঞ্জি-মোজা-জাঙিয়া ঝুলিয়ে রাখে। মেঝেতে শীতল পাটি, হাতের কাছে বাচ্চাদের সার্ট-প্যান্ট আর অন্যান্য তৈরী পোশাক। তারপর তীর্থের কাকের মতো গ্রাহকের অপেক্ষা। আশপাশে একটি-দুটি করে দোকান সাজে। বাঁশবনের কাছে জিলেপি ভাজে মহিদুল। বাতাসে ম-ম সৌরভ। সালিম কোনোদিন এক-আধপোয়া কিনে নেয়। ফাতিমার জন্য যত্ন করে রাখে। ওদিকে কাঁকড়া নদীর বালিয়াড়ি থেকে ভেসে আসে শীতল বাতাস। মন জুড়ে শুধু স্বপ্ন-কল্পনা-তৃপ্তির অবগাহন। আচমকা কী হয়ে যায়, ব্যবসায় মন্দা; দুশ্চিন্তার বলিরেখা ফুটে ওঠে কপালের ভাঁজে। এমনই কোনো কুক্ষণের শেষ-দুপুরে কোত্থেকে এসে বসে দু-জন মানুষ। তারা এটা দেখে, জেনে নেয় ওটার দর; অবশেষে গল্প-আলাপ।

‘হামরা হরিপুর থেইক্যা আসছি। তুমার বিবির এলাকা বনগাঁও-র লোক।’
‘তা আগে কবেন তো...কুটুম মানুষ। একটু বসেন চায়ের কথা কই। কী নেমেন? ভালো গেঞ্জি আছে। জাঙিয়া?’
তারা চায়ে চুমুক দেয়। সালিম বুঝতে পারে না, এরা তাকে কীভাবে চেনে? সে মনভোলা। অনেক সময় চেনা মানুষকেও স্মরণে রাখতে পারে না। কখনো সবকিছু গোলকধাঁধা অন্ধকার। সে ওই ভাবনায় না গিয়ে দুটো টাকা রোজগারের প্রত্যাশায় আশ্বস্ত হতে থাকে। এটা বের করে দেয়। ওটা খুলে দেখায়। কাপড়ের মান, রঙ আর স্থায়িত্ব নিয়ে কথা বলে। কথা...কথা বাড়ায়। একটি-দুটি কথা। এর মধ্যেই জানা যায়, গত বছর চেরাডাঙি মেলায় নাকি দেখা হয়েছিল। সালিমের মনে নেই। কথায় কথায় সন্ধ্যা নেমে আসে। পশ্চিম আকাশের বিশাল সূর্য লাল ডিমকুসুম হয়ে কাঁকড়ার বুকে নেমে যায়। সালিমের সারা বুকে বিষ জমতে থাকে। ক্রমশ মাথায়। হায়! সেই কথা না জানলে কী এমন ক্ষতি হতো?

‘হামি পিয়ারির বাসায় থাকতাম। তার তো মা-বাপ ছিল না। অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। পিয়ারি উর দাদা-দাদির কাছে মানুষ।’
‘হ্যাঁ ফাতিমা এতিম। মোরও বাপ-মা নাই।’
‘দুলাভাই আপনে বড় মনের মানুষ গো। এমন অসহায় মেয়েকে শাদি করলেন, যার বেহা হওয়ার কথা নয়।’
‘মানে?’

‘ক্যানে আপনে জানতেন না, পিয়ারিকে তিনজন লোক তুলে লিয়ে গিয়েছিল? রাশিদাকেও। একি পাড়ার মেয়ে। সে তো মরে যায়। লাশটা শড়ের গাছে ঝুলে ছিল। লোকে বলে নিজেই নাকি গলায় দড়ি...অবশ্য ইসব আগের কথা।’
সালিম কী বলে? কোন অসম্ভব তপ্ত তরল সিসা কানে চলে যেতে থাকে তার? উৎকট বীভৎস বিষ। সারা শরীর পুড়ে যায় বিষের আগুনে। তার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। বুকের মধ্যে শূন্য আঙিনা, সেখানে খাঁ-খাঁ হাহাকার, সেই বিরানের এখানে-ওখানে মুখ উঁচু ঝিঁ ঝিঁ-উচ্চিংড়ে-ঘুগরের তারস্বর চিৎকার। সে সামনে কিছু দেখতে পায় না। বাজারের মানুষজন সংগীতময় কলতান স্তব্ধ নিশ্চুপ। কী হলো তার? সে মরে গেছে।

তারপর কোথা থেকে কী হয়, সালিম খুব স্বাভাবিক, কত যত্নে সাজিয়ে তোলা পসরার একটি একটি কাপড় আর প্যাকেট এলোমেলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাস্তায় নেমে ফিরে চলে। সেটি কোন অতীত প্রত্নতাত্ত্বিক অন্ধকার বিস্মৃত রাস্তায় নিজেকে সঁপে দেওয়া। সে পথ হারিয়ে ফেলে। গোলকধাঁধার প্যাঁচপেচে চোরাকাদামাটি। তখন আকাশে চাঁদ উঠেছে। কি চমৎকার জোছনা! সেই বিশাল চাঁদ সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে চলে। কোনো হাহাকার আর প্রপঞ্চ কাহিনি শুনিয়ে যায়। বারবার চক্রাকারে ঘুরে আসে কাহিনির অবশেষ।


ফাতিমা স্কুলে যায়। ওর ডাক নাম পিয়ারি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। রাশিদা অন্তরঙ্গ বন্ধু। একসঙ্গে ক্ষেতের আইলে আইলে পথে পথে হেঁটে যায় আধ মাইল। স্কুলের মাঠে শপথবাক্য। ‘আমি ওয়াদা করিতেছি যে, মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখিব। দেশ ও দশের...।’ জাতীয় সংগীত। ‘আমার সোনার বাংলা...আমি তোমায় ভালোবাসি।’ একটির পর একটি ক্লাস। ফাতিমা পড়াশোনায় ভালো ছিল। তারচেয়ে রূপ। স্কুল শেষে ফেরার পথ। সূর্য অনেক তির্যক নেমে গেছে। রাস্তার মোড়ে কয়েকটি রেইনট্রির ছায়া। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে শহিদুল। কালো কুচকুচে ঢ্যাঙার পরনে জিনসের প্যান্ট, চোখে অন্ধকার চশমা; সিগারেট টানে। কয়েকজন সঙ্গে ভিড় করে জটলা। ফাতিমা মাথানিচু রেখে রাশিদার হাত ধরে দ্রুত হেঁটে যায়। কোথাও তাকায় না। শহিদুল একদিন কী সব কথা বলে, ফাতিমা থমকে দাঁড়ায়; তারও কিছু কঠোর কথা বাতাসে ছড়ায়। শহিদুলের দেঁতোহাসি ভিড়ের উচ্চনাদে ভয়ংকর। সেই থেকে ফাতিমা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাশিদার হাত টেনে ওই মোড় পেরিয়ে আসে। আজেবাজে কথা থামে না। একদিন ওড়নায় টান। ফাতিমা হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। সে আর স্কুলে যায় না। যেতে পারে না। আতঙ্ক-ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে সকালবেলা।

এরপরের গল্প যতটুকু না কল্পনার, তারচেয়ে ভয়ংকর অসূয়াকাতর প্রতিশোধের আগুন জ্বেলে দেয় বুকে। সালিমের উদ্ভট কল্পনা একাকী আকাশে প্রহসনমত্ত কোনো বিকৃত ছবি দেখে যায়। হাজার রকম বীভৎস-কুৎসিত অথবা বেদনার নীল বিষ। সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে। কোথাও শান্তি নেই। একটু কি বিষ পাওয়া যায় না? কী তার জীবনের মূল্য? পরাজয়ের চেয়ে প্রতারণা বড় জ্বালা। সে প্রতারিত জীবনের ইতি টেনে নেবে। তখন ফাতিমার কী হবে? একজন কিশোরী, যে নিজের দোষে নয়, মানুষের অপরাধে কলুষিত হয়েছে; তার তো কোনো দোষ নেই। কলুষিত মানে অপবিত্র? আচ্ছা পবিত্রতা কী? সালিম কোনো গোলকধাঁধার পাকে ডুবে যেতে থাকে, সেখানে কপিশ অন্ধকার, সেই অন্ধকারের কোনো সীমা নেই, কোনো তল নেই, নিচে আরও নিচে, গভীর থেকে গভীরে নেমে যায়। তারপর সেই ছায়াছবি, তিনজন বীভৎস-ভয়ংকর দানব কাউকে ধরে রাখে। তারা একে একে...আলোছায়া-অন্ধকার শালবন চিৎকার-আর্তনাদ আর উল্লাসী শীৎকারে ভেসে যায়। বাতাসের ঢেউয়ে কোনো অচেনা গাছের শাখায় থেকে থেকে দুলে ওঠে রাশিদা। আহ রাশিদা কেন? সে কেন সকল অপমানের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়? অপরাধীকে বাঁচিয়ে রাখে? অজ্ঞান ধুকপুক বুকে রক্তাক্ত বোধহীন কী দেখে যায় ফাতিমা? আজ সে কোন মায়জাল বিছিয়ে রাখে? সালিম মোহমায়া সম্মোহিত শিকারের মতো এগিয়ে যায়...এগিয়ে যায়। নদীর বুকে কী সব ভাবনা আর আক্ষেপে বিস্রস্ত জোছনায় প্রতিচ্ছায়া তার? ফাতিমাকে যে খুব ভালোবাসে সে। তারপরও দিশাহীন অস্থির মনের প্রান্তে জেগে থাকে ক্ষত। জ্বলে ওঠে অচেনা ক্ষোভ। প্রতারিত অস্তিত্বের অক্ষম হাহাকার বিষাদ দৃষ্টির মায়া ছাড়িয়ে আকাশদিগন্তে নেমে যায়। কার কাছে নালিশ করে? কখনো কোনো স্বপ্নাবেশে নিজেকে মহৎ ভেবে নেয়। সে কি এতই ক্ষুদ্র, এক দুর্ঘটনাকে আকাশ-পাতাল তলিয়ে দেখে? ফাতিমার কোনো অপরাধ নেই। সে দুঃস্বপ্নের এক কালো রাত। দিনের আলোয় সব মুছে গেছে।

চিরিনদীর দক্ষিণে চিকন রাস্তার ধারে ধারে গাছকলাইয়ের সারি। সেখানে আবছায়া জোছনার মায়াজাল। আকাশে কি মেঘ করে উঠেছে? কেউ কি কোনো পরাজয়ের গোপন দুঃখ কাহিনি ফিসফিস বলে যায়? মন যে অকারণ কোন বিষণ্ন দোলায় ভেসে যায়, মন মানে না; কোনো কথা শোনে না। সালিম কী করে? মুখের ওপর অচেনা মুখোশ বসিয়ে আঙিনায় দাঁড়ায়। সে ভেঙে পড়বে না। বুকের মধ্যে রোরুদ্যমান জলপ্রপাত কিছুতেই বুঝতে দেবে না। অতীতের দিনকাল তেপান্তর হাহাকারের কোনো পিছুডাক শুনবে না। তারপরও ফাতিমাকে অসহ্য লাগে। ফাতিমা এগিয়ে আসে। বউ তার গুমোট চেহারা দেখে হালকা রসিকতা করতে চায়। অনেকদিন পর, সেই দাইবুড়ির ঘোষণার আহত বিকেল পেরিয়ে গেছে; সালিমের কিছু ভালো লাগে না। কোথায় যেন মিহি দেয়াল দৃষ্টিসীমার মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এতদিন যা দেখে এলো, আরও যত স্বপ্ন দেখা বাকি, সব ভুল...মিথ্যে মায়া মরীচিকা। আজ রাত মন বেভুল কামনার শূন্য খাঁ-খাঁ। মন যে প্রতারিত পরাজয়ের বিষাদছায়া-হতাশা-রাগে আত্মঘাতি হতে চায়। বেঁচে থাকা দিনকালের গহিনে অতৃপ্তি আর প্রতিশোধের বিষকাঁটা ডুবে যেতে থাকে। ডুবে যায়। কি তার জীবন! ধোকা খাওয়া বেঁচে থাকা। ফাতিমা তাকে ঠকিয়েছে, সে ভালো নয়, কেউ নয় তার...কেউ নয়।

তারপর দিন গড়াতে গড়াতে হয়তো ফিকে হয়ে আসে ক্ষত। প্রলেপ পড়ে মনের সকল গর্ত খাদে। কানাগলিতে জেগে ওঠে বাতাসের বাসন্তিক ঢেউ। আর কেন নিজেকে অহেতুক খনন? এই তো ফাতিমা আছে, আকাশপরি বউ তার, তাকে যে খুব ভালোবাসে। সে তাকে জড়িয়ে অন্ধকার সেই শালবাগান আর কল্পিত হাজার ছবি মুছে দিতে পারে। সেই হাটখোলা সন্ধ্যা আর অচেনা মানুষের গালগল্প কবর দিয়ে রাখে। মানুষ পুরোনো কবর খনন করে না। আলোর মধ্যখানে টেনে আনে না অশরীরী প্রেতাত্মা।
অথচ মিঠেল সেই রাতের মাস দেড়েক পর, এক দুপুর, যখন প্রচণ্ড তাপদাহ; তার মাথার স্থিরতা থাকে না। দাউ দাউ করে জ্বলছে হাটখোলা। শহর থেকে এসেছে ফায়ার ব্রিগেডের চারটি গাড়ি। তারপরও জ্বলে-পুড়ে সব শেষ। কোনোকিছু রক্ষা পায় না। লালগাড়ির পাইপে পানির ফোয়ারা। সালিম নদীপাড়ের জলকাদায় ভিজতে ভিজতে কত কথা ভেবে নেয়। আজ হাটে এসে বসবার কি দরকার ছিল? প্রায়শ তো নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকে অথবা ঠগের পুকুরপাড় ছায়ান্ধকার হিজলতলায়। তার কোন শাখায় ঝুলে পড়েছিল সখিনা? কতটুকু কষ্ট পেলে মানুষ সাহসী হয়ে যায়? কতটুকু দুর্বল হলে কেড়ে নিতে পারে নিজের প্রাণ? হায়! সালিম সাহসী হতে পারল না। সে খুব ভিতু আর একা। আর সেই নিঃস্বতার সব দায় ফাতিমার। কোনো ক্রন্দন নয়, দুঃখ নয়, মনের সকল অক্ষমতা বিক্ষোভ আর ক্রোধে বিস্ফোরিত হয় সেদিন। সে কী এক কথায় মেরে মেরে অজ্ঞান করে ফেলে ফাতিমাকে। প্রতিবাদ করেনি বউ। আত্মরক্ষার্থে হাতদুটো উঠিয়ে বিস্ফারিত চোখে শুধু রুদ্র রূপ দেখে যায়। সালিম আসলে কতটা ভয়ংকর।


সালিমের মনে পড়ে, পরদিন সকালে ফাতিমাই আবার তার জন্যে পান্তা সাজিয়ে বসে থাকে। এক-দুইবার আলতো স্পর্শে ডেকে যায়। সালিমের গভীর ঘুম। একসময় লঙ্কা পোড়ার গন্ধে চোখ মেলে বসে। আঙিনায় রোদ-বাতাসের লুকোচুরি। ফাতিমা দাওয়ায় নিশ্চুপ বসে আছে। ফসলের ক্ষেত মাড়িয়ে সামনের কোনো দূর পরিসীমায় নিবদ্ধ দৃষ্টি। সেখানে কি বিষাদের খেলা? সালিম জানে না। ফাতিমার চোখ-মুখ-গাল ফুলে গেছে। সালিম চোখ ধরে রাখতে পারে না। নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। খেতে বসে না। ঘর থেকে বের হয়ে সোজা হাটখোলা। তখনো ছাইয়ের গাদায় লুকিয়ে আছে গোপন আগুন, যেভাবে মনের গহিনে; বউকে মারল কেন? কেন অমন পশু হয়ে গেল? জবাব হয়তো আছে, গ্রাহ্য কি না কে জানে; সব তো ঠুনকো ওজর। তাই সাহস নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে পারে না। শক্তি নেই খুঁচিয়ে তোলা অতীত গহ্বরে ঝাঁপ দেওয়ার। গতকাল তো হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনকাল। অতীতের সেই বালুচরে আর হাঁটবে না। এখন জীবিকার সরল পথ দরকার। তারপরও মন ব্যস্ত অস্থির। সারাদিন অকারণ কেটে যায় এদিক-ওদিক অগোছালো প্রহর। জীবন কাঠ-কয়লা-ছাই।

সন্ধ্যা শেষে রাত। আবছায়া সবকিছু গভীর হতে শুরু করেছে। সালিম ক্ষেতের আইল বেয়ে ঘরে ফেরে। ঘরে সকল শান্তি...মনে শান্তি নাই। মনের শান্তি না হলে সেই ঘরে কিসের ছায়া সহায়? এত ভাবনার টানাপড়েনে ধক করে জেগে ওঠে কোনো ছায়াচিত্র। সে কেন হাত তুলল? অমন করতে পারল? এই বদ্ধ অন্ধকার ছাড়া কালকের লজ্জা...এই পোড়ামুখ যে লুকোনো যায় না। ফাতিমা উন্মুক্ত আবছায়া দাওয়ায় বসে আছে। সালিম দেখে শুধু ছায়া, একজন মানুষ; তার সারা জীবনের সাথী। মানুষের ছায়ায় মানুষ নড়ে উঠে। ফাতিমা কোনো কথা বলে না। সে ঘরের মেঝেয় মাদুর বিছিয়ে দেয়। একে একে বাসনকোসন আর খাবার সাজায়। সালিমের প্রচণ্ড ক্ষুধা। কত রকম ক্ষুধা। তারপর রাতের কোন প্রহরে দূরত্ব অতিক্রম শেষে মরিয়া হয়ে ওঠে, কোনো সম্বিত পায় না, সবকিছু বুঝি ঘুমঘোর, কে যেন কানে কানে বলে যায়, জিততে হবে...জিততে হবে। কে কার প্রতিপক্ষ? সে কোনো বাধা মানে না। ফাতিমা শেষে নিশ্চুপ পড়ে থাকে। চোখ বেয়ে ঝরে যায় নোনাজল। সালিম চমকে উঠে। আসলে সে পশু ছাড়া কী? কেন গায়ে হাত তুলল? অথচ কতদিন কতরাত ভেবেছিল, কোনোদিন কটু কথা বলবে না। নিজের কাছে আরও একবার অতিক্ষুদ্র হয়ে যায় সে।

‘মোক মাফ করি দি বউ, মোর মাথার ঠিক আছিল না। কি কর আর কি না কর, কিছু উদ্দিশ পাঁও না। আর কী করি যে কি হইল...মোক মাফ করি দি ফাতু...ফাতু রে।’
ফাতিমা নিশ্চুপ। কোনো কথা বলে না। এলোমেলো কাপড় গুছিয়ে আঙিনায় দাঁড়ায়। আকাশে তখনো একলা চাঁদ অপলক তাকিয়ে আছে। সালিমের অপাঙ্গ দৃষ্টি খুঁজে নেয় কোনো ছায়া। গাছের ছায়ায় আবছায়া চাঁদনি আলো, এক আকাশপরি টিউবওয়েল পাড়ে গিয়ে বসে; তার ফরসা মুখ-কাঁধ-হাত কোনো রূপকথা তেপান্তর জাগিয়ে তোলে পুনরায়। ফাতিমা অনেকবার বলেছে, জায়গাটা কোনোকিছু দিয়ে ঘিরে দিতে। বেআবরু একাকী প্রান্তর। দেওয়া হলো না। সালিম পারে না। অক্ষমতার বিষকাঁটা বুকে খচখচ যন্ত্রণা তোলে। আক্ষেপ আর দুশ্চিন্তার ভারী জগদ্দল পাথর চেপে ধরে নিঃশ্বাস।

ফাতিমা ফিরে আসে। সালিম ততক্ষণে বিড়ি জ্বালিয়ে ভক ভক ধোঁয়ায় ডুবে আছে। ফাতিমা, তার বুকের সঙ্গে লেপটে থাকা বউ, যেন তাকে চেনে না; এককোণায় দূরে গুটিসুটি শোয়। সালিম কী করে? সেই অভিমান যে তার বুকেও বেজে চলে। কেন এমন হলো? কার দোষে? তার ডানহাত অগোছালো খুঁজে নেয় কোনো কোমল উষ্ণতা।

‘সউগে মোর দোষ। মুই বাঁজা। তোমহার শখ মিটিল না। এত্তি দোকানঘর পুড়ি গেইল। আর মুই হে ডাং খানু।’
‘দোষ তোর নহায় রে ফাতু, মোর কপালের দোষ; নসিব নসিব। আর রাগ করি থাকিন না।’
সালিম তবু ধরে রাখতে পারল না তাকে। একদিন দুপুরে সব মীমাংসা হয়ে গেল। আকাশে প্রচণ্ড রোদ। দাবদাহ। আগুনে ঝলসে উঠেছে ইরি ক্ষেত। কোথাও দূরে ধিক ধিক শ্যালো মেশিনের কালো ধোঁয়া গুঞ্জন। সালিমের মন পোড়ে। কখনো অচেনা কোনো অন্ধকার জঙ্গল ভেসে ওঠে চোখের কোণায়। কয়েকজন মানুষ। তারা বীভৎস উল্লাসে মেতে থাকে। শ্যাওড়া গাছের আবছায়া শাখায় দোল খায় অদেখা কিশোরী। সেই ছবি অস্পষ্ট-ঝাপসা, অথচ বিকট বিষবাষ্প বিছিয়ে রাখে মনে। শ্যালো মেশিনের অপর প্রান্তে স্বচ্ছ জল নেমে যায়। মাটির সোঁদা গন্ধে বয়ে চলে শীতল ছোঁয়া। সালিমের বুকে খাঁ-খাঁ রোদ। আগুনে পুড়ে যায় সকল স্বস্তি। শান্তিছায়া। সে তখন কৃষি মজুর। মানুষের জমিতে লাঙল চষে...রোপা গাড়ে...নিড়ানি দেয়। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে কৌটোয় টাকা জমায়। পরম যত্নে রেখে দেয় কুলঙ্গির আধারে। অনেক তো হলো, এবার রবি মুনশির রিকশা কিনে নেবে। হাজার দুয়েক টাকা আরও দরকার। কত জোগাড় হলো? এরপর শহরের রাস্তায় রিকশা চালাবে। আবার টাকা জমাবে, আবার বসাবে দোকান; মিলবে নতুন ঠিকানা। একবার পুনরায় খুঁজে নেবে হারিয়ে যাওয়া জীবন আর স্বস্তি; কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনো উপায় হলো না। জীবনের শতরকম অতৃপ্তি, প্রতারণার বিষকাঁটা দহন, সন্দেহের বুক খচ খচ জ্বালা, এসব নিয়ে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত প্রয়াস; সে দুর্বল মানুষের মতো হাঁপিয়ে ওঠে। বৃদ্ধ হয়ে যায় মন।

একদিন ঘরে ফিরে খুঁজে পাওয়া গেল না সেই কৌটো। কুলঙ্গি খাঁ-খাঁ শূন্য। কোথায় গেল? কে নিল টাকা? সালিম অস্থির খুঁজে বেড়ায়। ঘরের মধ্যে আবছায়া-অন্ধকার চারকোন, চোকির নিচ, বাক্সপ্যাটরা, ডেকচি-কলস আর যা কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেনি, বাদ থাকল না সে-সবও। তার এদিক-ওদিক অস্থির হাতড়ে বেড়ানোর মধ্যে কী আতঙ্ক ছিল? ফাতিমা আঙিনার দক্ষিণে নিশ্চুপ ভয়ার্ত দাঁড়িয়ে শুধু দেখে যায়। তারপর যে দু-একটি কথা, না সে জানে না। সালিম কী করে? একসময় দৃষ্টিতে বিষাদ সাজিয়ে ঠগেরপাড়ে গিয়ে বসে থাকে। টাকা চুরি গেছে। অনেক কষ্টের সম্পদ। একটি স্বপ্ন বুকে নিয়ে রক্ত ঘাম করে আসছিল। পুনরায় আরও একবার সবকিছু শুরু করার মতো মন কোথায়? তবু ভোর-সকালে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। অনেকখানি হেঁটে ঘুগরাতলি কদমগাছের ছায়া। সেখানে নিশ্চুপ-বিষাদ বসে থাকে অনেকক্ষণ। মানুষের শ্রম বাজার। কেউ যদি ডেকে নেয়। আজকাল কাজ পাওয়া যায় না। ক্ষেতের কাজ প্রায় শেষ। কারেন্ট হাটের ওখানে নতুন ভাটা। সেখানে যোগাযোগ করেছে পরশু দিন। মালিক কাজে নেয়নি। আজ সেখানে ভাটায় আগুন দেওয়া হয়েছে। চিমনি বেয়ে ধূসর-সাদা ধোঁয়া আকাশে উঠে যায়। সালিমের বুকে আগুন জ্বলে। মন পোড়ে। সেই দহনের জ্বালা জানে না কেউ। সেখানে কোনো ধোঁয়া নেই। এইসব হাজার ভাবনার মধ্যে আচমকা জেগে ওঠে টাকার কথা। কীভাবে চুরি হলো? মনের গহিনে কোন কান্না বেজে ওঠে? সালিম জানে না।

সেই শোক সামলে উঠতে না উঠতে আকস্মিক বন্যা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একনাগাড়ে ঝিমঝিম বৃষ্টি। কাজের সব পথ বন্ধ। আশপাশে পানি খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। তার ডগায় ভেসে ওঠে ক্ষেতে রোপিত ইরিচারা। মেঘলা আকাশের প্রান্তে নেই দিন-রাতের চিহ্ন। কত দিন কে জানে। সালিমের অস্থির ছোটাছুটি। কোথাও কোনো কাজ নেই। ঘরে যতটুকু চাল-ডাল শেষ হলো সেও। একদিন সারাদিন দু-জনে উপোষ। ফাতিমার মুখের দিকে তাকানো যায় না। সেই বিষাদ-মলিন মুখচ্ছবিতে অচেনা হাহাকার। সালিমের বুকে কান্না নতুন রূপে আছড়ে পড়ে। কোথায় সেই হাটখোলা আর নিষিদ্ধ কথোপকথন? সে ভাবতে চায় না। সে যে নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে। তার বুকের আকাশজুড়ে একলা এক চাঁদ, চাঁদের গায়ে কলঙ্ক; তবু তো আলো দেয়। কোমল-স্নিগ্ধ, রাতের বাতাসে জেসমিন সুবাসে মিলেমিশে একাকার। সে পরদিন ক্লান্ত শরীর নিজেকে বন্যার পানি ভেঙে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে জিএম হাই স্কুল মাঠে। সরকারি দলের মানুষজন খিচুড়ি দেয়। সে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার সময় গোনে। অবশেষে সময় সময়ে গড়িয়ে শেষ-দুপুরে মেলে কিছু। পলিথিনের ব্যাগে কেজি দুয়েক চাল আরও। আড়াইশ’ ডাল আর লবণ। মনে স্বস্তির বাতাস। অন্তত দুটি দিন খেতে পারবে। ফিরতি পথে মনজুড়ে কত ভাবনা এলোমেলো দোল খায়। আজ ফাতিমার মুখে নিজ হাতে খাবার তুলে দেবে। কত দিন হায় একটু হাসি দেখে না সালিম! তারপর সেই আগে যেমন দু’জনে কাছাকাছি নিজেদের জড়িয়ে রাখে, নিশ্চুপ ভালোবাসায় জেগে জেগে মুখর কেটে যায় রাত, তেমন করে আরও একবার পুনরায় বেঁচে থাকার সাধ; কিন্তু সময় বুঝি তার জন্যে অন্য এক কাহিনি লিখে রেখেছিল। অপেক্ষায় ছিল কোনো অনাহূত বিস্ময়।

অনেকখানি জলকাদা ঘেটে দেড় মাইল পথ। কত ধৈর্য ধরে রাখে সালিম। আজ তেমন বৃষ্টি নেই। কখনো হালকা ঝিপঝিপ কখনো রোদ। আকাশে শেষ-দুপুরের তির্যক-কোমল আলো। মন ফুরফুরে মৃদু বাতাস। সে পলিথিনের ব্যাগ দুটি হাতবদলের ভার সহ্য করে নেয়। ক্ষুধা ক্লান্তি আসে। সে তবু মুখে কিছু দেয় না। ফাতিমার মুখচ্ছবি মনে পড়ে। বিশুষ্ক চেহারায় নিশ্চুপ দৃষ্টি কী কথা বলে যায়? সালিমের অস্থির মন। পথ ফুরোয় না। জলরঙ সাদা ব্যাগে জ্বলজ্বল করে হলুদ খিচুড়ি। মোটা ভ্যাপসা গন্ধ লাল চাল। মনের গহিনে আবেগ আপনমনে আনন্দে গড়াগড়ি যায়। অবশেষে উত্তরের ঝোপঝাড় আর জলাবদ্ধ বেত সীমানা পেরিয়ে উঁচু বারান্দায় ওঠে, আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে স্থির; চৌকির ওপর সযত্নে ঢেকে রাখা ভাত-তরকারি। ফাতিমার চোখে-মুখে অচেনা কোনো প্রগাঢ় প্রভা। সালিমের হাত থেকে আলগোছে পলিথিন ব্যাগ পড়ে যায়। আধপচা চাউল আর খিচুড়ি আঙিনার কাদায় গড়িয়ে পড়ে। কোত্থেকে তখন দুটো মুরগি একগাদা ছানাসহ সে সব ঠোকরাতে থাকে। সালিমের বুঝতে বাকি থাকে না, কোত্থেকে এসেছে থালা ভর্তি খাবার। কাঁসার থালাবাটি ঝকঝক করে বিকেলের আলোয়। চোখের দৃষ্টিসীমায় অসহ্য লাগে তার। মেম্বার কয়েক দিন ধরে ঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করছিল। সেধে সেধে প্রস্তাব রাখে, বউ আঁতুড় ঘরে; ফাতিমা যদি একটু বাসার কাজ করে দেয়। সালিম জবাব দেয়: ‘না’। মানুষ ভালো নয় মেম্বার। অনেক গলদ। কলিম মিয়া পাড়ার দক্ষিণ প্রান্তের গরিব মজুর মানুষ, তার মেয়েকে ঢাকায় কাজ দেওয়ার নাম করে পাঠিয়ে দিল; সে আর দু-বছরেও ফিরে এলো না। মেম্বারের বউ ভালো। ফাতিমার সঙ্গে গল্পসল্প করে। পাড়ার এদিকে এলে খোঁজখবর নেয়। সালিমের কোনো আপত্তি নেই, বরং সেই সখ্যতায় নীরব সমর্থন আছে। দাইবুড়ির ঘোষণার পর কেমন মিইয়ে যায় ফাতিমা। একটু-আধটু গল্প-আলাপে কষ্ট ভুলে থাক। ফাতিমা তবে সেই বাড়ি গিয়েছিল। মেম্বার আস্ত এক বদমাশ। ফাতিমা গেল কেন? সালিমের মাথা ঘোরে। অস্থির লাগে। ভালোমন্দ বোঝবার ক্ষমতা নেই। সারাদিন মাথায় রোদ-বৃষ্টি আর গুমোট গরম। এসবের মধ্যে দু-মুঠো খিচুড়ির জন্য দীর্ঘ লাইন। আধপচা চাল-ডাল। নিজের প্রতি সহসা অসম্ভব ঘৃণা জমে ওঠে তার।
‘ভাত কুনঠে পালু?’
‘মেম্বারের বাড়ির থন আনিছু।’
‘তুই ওমহার বাড়িত কামোত গেছিলু?’
‘নহায়, বেটিছইলটা বিপদে পড়িছে, তাই...যাবা নাগিবে না? এ্যাকি পাড়াত থাকো।’
‘ফলনার দরদ উথলি উঠিছে না? শালির বেটি...সাতভাতারি মাউগ!’
‘গাল দেন না মোক। ভাত-তরকারি আনিছু...খায়া নেন। কাল থাকি না খাওয়া।’
কথা বলে ফিক করে হেসে উঠে ফাতিমা। কোনো দিন এমন উকিল-জেরার মুখে পড়েনি। শোনেনি অশ্রাব্য গালাগাল। সালিম অনেক শান্ত মানুষ। তাকে খুব ভালোবাসে। এখন মাথা গরম, কিন্তু একটু পর ঠা-া হলে চেহারায় আদর-হাসি ঝরে পড়বে নিশ্চিত। ফাতিমার শুকনো চোখ-মুখে আবেগ থরো থরো হাসি। আর সেই হাসি কাল হয়ে গেল। সালিম আচমকা চুলের গোছাটা ধরে তাকে এক ঝটকায় বারান্দায় ফেলে দেয়। সজোরে লাথি দিয়ে করে বসে চরম উচ্চারণ। তারপর হতভম্ব। সে কী করল? কী বলল সে? যার বুকে বুক ঠেকিয়ে জীবনকে আবিষ্কার করে নিল তারই মুখে পদাঘাত! উন্মুক্ত আঙিনায় দু-চারজন মানুষ জমে উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ এগিয়ে এসে ক্রোধ-উন্মত্ত সালিমকে চেপে ধরে সরিয়ে নেয়। সে তখনো চিৎকার দিয়ে বলে যায়।
সেই ফাতিমা মারা গেছে। তার লাশ পুলিশ সদরে নিয়ে যাবে। কাটাছেঁড়া হবে। স্বাভাবিক মৃত্যু তো নয়, আত্মহত্যা, নয়তো কেউ মেরে রেখেছে। এমন যে হবে, সালিম আশঙ্কা করেছিল। যাদের ঘর-বসত রাস্তায় তাদের মৃত্যুও যে সেখানে। অপঘাতে। মন তবু মেনে নিতে চায় না এই পরিণতি। সালিম বিড়ি শেষ করে ছুড়ে দেয় টিউবওয়েলের পাড়ে। হেডবিহীন মরচে ধরা টিউবওয়েল আর প্ল্যাটফরম এখন শুধুই স্মৃতি। ফাতিমা যখন ঘরে ছিল, এই তো মাস কয়েক আগে; এই জায়গা ঝকঝক করত। উজ্জ্বল চকচকে আঙিনা। এখন আগাছার ঝোপঝাড়। পাড়ার বদ ছেলেমেয়েরা তো আছেই, বয়সি নারী-পুরুষও দিনে-রাতে কোন ফাঁকে হেগে যায়। বাতাসে সবসময় দুর্গন্ধ ভুরভুর ভেসে বেড়ায়। কী ছিল আর কী হয়েছে! সে আবুলের দিকে দৃষ্টি রাখে। চোখের অদ্ভুত সংযোগ। সেখানে কোনো কথা নেই অথবা হাজার নিশ্চুপ কাহিনি। আকাশ সাদা হয়ে আসছে। পুব-কোনায় শুকতারা বেহায়ার মতো ঝিলমিল করে। একজন মানুষ মরে পড়ে আছে। তার ভাবান্তর নেই। হতভাগ্য মানুষ। সালিম সপ্তর্ষিম-লকে খুঁজে পায় না। জীবনে অনেক প্রশ্নের যেমন সমাধান মেলে না, জবাবহীন গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়; বুকের গহিনে তেমন অস্থির ছটফট ঢেউ। জীবনের রঙিন সময়টুকু নিজের শোকাকুল শব বয়ে বেড়াতে হয়।
‘এ্যাংকা যে হবি তা মুই আগোতে বুঝা পাইছিনু। যাক একদিক দিয়া ভালে হইছে।’
‘সবকিছুর তনে তুই দায়ী। ঘরোর বাইর তো করলু তুই। কোন দোষ করিছিল ওঁয়!’
‘আ রে সেদিন মোর মাথা গরম হয়া আছিল। আর তোমরা ক্যানে ওর হাত ধরি টানি নিগাইলেন? ক্যানে? মানুষ রাগোতে কত কাথা কয়। তাও তো মুই তোবা করনু। তোমরা কী কইনেন, ফলনা-টেসকু, না, তালাক হয়া গেইছে। আ রে মোর মাউগ, মুই ডাঙ্গো পিটো গাইল দাও, ফের মুইহে তো বুকোত নিম নাকি! শালার কী কয়, ধম্মের আইন; অমন আইনের মুখোত্...।’
‘বাদ দি যা হবার হইছে। এ্যালা টপ করি চলেক দারগা সেই কতত্থোন থাকি অস্থির হয়া আছে।’
‘ওঁয় বানচোত মোর তনে বসি আছে না কি? মুই কি জানো?’
‘তোর দুঃখ বোঝো সালিম। বাপ মা মরা ছইল ফাতিমা তোর জেবনের কতটা ছিল মুই জানো; কিন্তু কী করিবু ক...সবে নসিব! এইবার সব দাগা ভুলি নতুন করি ঘর বান্ধেক। কী আর হবি পুরানা দিনোক ধরি থাকি?’
সালিম কিছু বলে না। তার চোখদুটো জ্বালা করে। আবুল পাছে অন্য কিছু ভেবে নেয়, তাই কলসের পানিতে খুব করে ঘষে ঘষে মুখ ধোয়। তারপর অজান্তেই দরজার পাশে দেয়ালে সাঁটানো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আর হাতেপায়ে চমকে ওঠে; ফাতিমার স্মৃতি। সেই বিচ্ছেদ ঘটনার কয়েক মাস আগে, তখন তার দোকান ছিল; অনেক কিছু কিনে নিয়ে আসত। স্নো-পাউডার-আলতা-নেইলপলিশ, চুলের ফিতে আর খোঁপার কাঁটা; ফাতিমাকে অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় লাগত। একদিন নতুন আয়না থেকে কাঁচ খুলে দেয়ালে সেঁটে দেয় সে। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধত। আহা কি সুখময় দিন ছিল!
সালিমের বুক চিরে আচমকা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।


রাত পেরিয়ে পরদিন। সালিম ভোর-সকালে মেম্বারের বাড়ি হাজির। কোনোদিন এখানে পা রাখেনি। আতিয়ার মণ্ডল মানুষ ভালো নয়। পৃথিবী এখন অন্যরকম। মন্দ মানুষগুলোই সমাজের মাথা। বৈঠকখানায় কয়েকজন বসে আছে। সালিম বেঞ্চের এককোণায় বসতে পারে। মাথা ঝিমঝিম ভার। বোধহীন-আউলা দৃষ্টি। শ্রুতি ভন ভন। সারারাত আঙিনায় বসে কেটে গেছে। কত কথা কত স্মৃতি কত অনুতাপ কাহিল করে দেয়। তার মধ্যে ফিরে পাওয়া-না-পাওয়ার দোলাচল আশঙ্কা। ফাতিমাকে যখন নিয়ে যায় তারা, কিংবা চলে যায় সে, সালিমের কোমর ভেঙে গেল। এখনো শরীর টলমল। বড় অস্থির লাগে। হাতের আঙুল থিরথির কাঁপে। বোধ করি এখানে মেঝেতেই আছড়ে পড়ে যায়, কিন্তু না, যথাসম্ভব শক্ত হয়ে বসে থাকে সে। কতক্ষণ কেটে যায় বুঝতে পারে না। একসময় মেম্বার বুক চাপা রঙিন গেঞ্জি গায়ে ঘরে আসে। তাকে বড় বেঢপ দেখায়। সালিমকে দেখে পান চাবানো চেহারা আরও জটিল-কুটিল হয়ে পড়ে। সালিমের সেদিকে নজর নেই। সে কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে বলে বসে ফাতিমাকে নিতে এসেছে। মেম্বার বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এক সাপ যেন লকলকে জিহ্বায় শিকারের স্বাদ বুঝে নেয়। তারপর সেই চেহারায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠে রহস্যময় হাসি। হেসে হেসেই তর্জনী দিয়ে বারকয়েক গোঁফ নাড়ে।
‘ফাতিমা? ফাতিমা তোর কে?’
‘কী কছেন মেম্বার সাব, ফাতিমা মোর বউ। এইটা কি নতুন করি কহিবা হবে।’
‘হারামজাদা তালাক দিবি আর এখন বউ।’
‘মুই তালাক দিছু কাঁয় কহিছে? মুখ ফসকে রাগের মাথাত কত কথা বেইর হয়; ওইটা ফির তালাক হয়? হবার নাকি?’
‘শোনেন কথা, ব্যাটা শরিয়ত বোঝে না। আল্লার আইন মানে না। না ফরমান কাফের।’
‘ওইলা বড় বড় কাথা নিজের ঠে থোন মেম্বার চাচা। মুই পড়ালেখা জানো না...ওইলা বোঝও না। ফাতিমা মোর বিয়া করা বউ। সংসারে নানান ঝগড়া-ফ্যাসাদ হয়...ফির মিল-মহব্বতও হয়। ওইলা নিয়া কাউচাল করেন না। মোর বউটাকে বেইর করি দেন, মুই খুশি হয়া চলি যাম।’
‘কি!...কে আছি রে, ফাতিমাক ডাকা তো, যদি যাবা চায় তো আলদা কথা।’
ফাতিমা এসেছিল। চোখে-মুখে অচেনা বিষাদ কিংবা গোপন কোনো আতঙ্ক। সে কি ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের ঘোরে আছে? কেউ ভয় দেখায়? সালিম কী করে? একটি রাত, যেনবা একটি জনম; লক্ষ যোজন দূর থেকে নিজেদের চিনে নেওয়া। সালিম বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। কোথাও কি দৃষ্টিসীমায় একটুয়ো ব্যথা নেই? যন্ত্রণাকাতর বিরহ চিহ্ন? ফাতিমা দরজার চৌকাঠে ডানহাত রেখে মাটির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। কী দেখে সে? কোনো অতীত, স্বপ্নের দিনকাল, আদরের স্মৃতি? সালিমের বিশুষ্ক চোখ, বোবা ভাষা হাজার গল্প বলে যায়; যে কাহিনি যুগের পর যুগ দু-জন মানুষের একান্ত নিজেদের। সেই চোখে একবারও চোখ রাখে না ফাতিমা। অথবা কে জানে কোনো আতঙ্ক-ভয় রাখতে দেয় না। জোর নেই এমন অনুচ্চারিত শব্দে জানায়, সে যাবে না। তালাকের পর আর ঘর করা সম্ভব নয়। ধর্ম আছে...সমাজ আছে...আছে পরকাল। ইহকালে আবার একচালার নিচে থাকতে হলে হিলা বিয়া করতে হবে। অন্যের সঙ্গে ঘর। সেখান থেকে তালাক পেলে তবেই নিকায় বসতে পারে। ফাতিমা তা চায় না। সালিম বরং ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করতে পারে। ইত্যাদি। মেম্বার অপাঙ্গে মিটমিট হাসে। ঘরের চারকোণায় ছড়িয়ে থাকে কোনো শয়তানি বাতাস। তামাকের ধোঁয়া। সালিম কিছু শোনে না। তার চোখে কারও উপস্থিতি নেই। মহাশূন্যের মতো শূন্য অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। কেউ নেই, সে আর শুধু ফাতিমা; শত জনমের সাথী। তার কানে প্রত্মতাত্ত্বিক অচেনা কোরাস স্তব গুনগুন বেজে যায়। সে অন্যকিছু শোনে না, কোনোকিছু জানে না; সম্মোহত কোন জাদু আকর্ষণে এগিয়ে যায়...এগিয়ে যায়। একটু স্পর্শ করার দুর্মর সাধ। ফাতিমা এত কাছে দাঁড়িয়ে আছে, তার সামান্য ছোঁয়া, একটু জড়িয়ে ধরা; অথচ সালিম পারে না। তার শক্তি নেই। সমস্ত শরীরজুড়ে কোন স্থবিরতা নেমে আসে? সে বারবার নিজেকে তুলে ধরে...উঠে দাঁড়ায়। তারপর সহসা খুব কাছে গিয়ে ফাতিমাকে জড়িয়ে নেয়। তখন বৈঠকখানায় আট-দশজন মানুষ হই-হই রই-রই করে চেপে ধরে। তার দৃষ্টির সামনে থেকে কে বা কারা ফাতিমাকে সরিয়ে নিতে থাকে। কত আচম্বিত কত দ্রুত ঘটে যায়, দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে; অবশেষে শূন্য মহাশূন্য। সালিম কীভাবে আর নিজেকে সান্ত¡না দেয়? তার হাত-পা শিথিল ঝুলে পড়ে। সেই ভালো ফাতিমা ভালো থাক। নিজের প্রতি অসম্ভব করুণা আর ঘৃণার মহাকাব্য নিয়ে ফিরে যায় সে। কোথায়? তার কোনো ঠিকানা নেই। সে রাস্তায় হেঁটে চলা এক কুকুর। তার ঘর-বসত কিছু নেই। একদা কোন মায়ালোকে দু-দিন স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নঘোর কেটে গেছে। ঘোর লাগা ঘোরে জীবন অন্ধকার। সে সকালের বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দেয়।
সপ্তাহ দু-এক যায়নি অনেক বেপরোয়া ফাতিমা। একসময়ের ঘরের কোনে বসে থাকা গৃহবধূ অন্যরকম। বেআবরু। সালিম সব বোঝে। জেলাবোর্ডের রাস্তায় দু-একবার দেখা হয়। মানুষ দু-জন দু-প্রান্তে আচমকা দাঁড়ায়। নিজেদের দিকে তাকিয়ে কী খোঁজে? চোখের ভাষায় নিশ্চুপ কী কথা বলে যায়? কেউ হয়তো জানে অথবা জানে না। সালিমের সর্বাঙ্গে ব্যথা। সেদিন আতিয়ার মেম্বারের বৈঠকখানায় বেশ মারধর হয়। নিজেকে একা রক্ষা করতে পারে না। তারপর কে কখন ধাক্কা মেরে পুকুরপাড়ে ফেলে রাখে জানে না। তখন কোথায় ছিল ফাতিমা? সালিম সবকিছু প্রাপ্য ভেবে তবু বিশুষ্ক দৃষ্টিতে ফাতিমাকে খোঁজে। হায় সে ছিল না! রাস্তায় নেমে আসে সেইদিন সেই সময়। তার বুকের কোণায় কোন অভিমান না কি সেই হাটখোলা আর সন্ধ্যার বাতাসে ফসিল গল্প-আলাপ, তার বুকে দীর্ঘশ্বাস জাগিয়ে তোলে। সে কোনো অচেনা বালিয়াড়িতে নিশ্চুপ শোকগাঁথা শুনে যায়। আত্মঘাতী ভয়ংকর প্রহর। আজ দু-জনের পথ পৃথক হয়ে গেছে।
সালিম এতকিছুর পরও চুপ করে থাকেনি। ফাতিমা সেদিন যখন বাসস্ট্যান্ডের পথ ধরে মধ্যদুপুর অতিক্রম করে যায়, নির্জন-নিরিবিলি রাস্তা, ফিরিয়ে নেওয়ার মতো কোনো কথা নয়, সালিম শুধু বলে, একটু ভালোভাবে যেন চলে। ফাতিমা কোনো জবাব দেয় না। একপলক দৃষ্টি রেখে রাস্তার অন্যপ্রান্তে সরে যায়। সালিম সে-সময় মন অকারণ অতীতের সৌরভে বিব্রত বিবশ। ফাতিমা ভালোই আছে। নতুন নতুন শাড়ি-গহনা আর সুগন্ধির জৌলুস সর্বাঙ্গে তার। সালিম কী দিতে পেরেছে? কোনোদিন কোনোকিছু? তার বুকে অচেনা মাৎসর্যের জ্বালা। নিষ্ফল হাহাকারে ভাসিয়ে দেওয়া মন। এই মেয়েটি তার কত আপন ছিল, জীবনের সঙ্গী; আজ অনেক দূরের। সালিম কি এমন সুখে রাখতে পারত না? কে জানে, হয়তো পারত, কিংবা...সে কোনো কপিশ গোলকধাঁধায় নেমে যায়। সেখানে চারদিকে মায়াবী মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। একান্ত নিজের স্বপ্নমায়া। আকাশদিগন্তে সাদা মেঘের ভেলা। কয়েকটি শালিক রাস্তার ওপর নেচে বেড়ায়। তাদের দৃষ্টিতে বিষাদ গান। সালিমের সব শেষ হয়ে গেছে। একদা তার ভালোবাসায় ছিল, বিশ্বাস ছিল, কাছে টেনে ধরে রাখবার শিহরণ আর আবেগ ছিল; আজ সে-সব আর নেই। এখন অচেনা শূন্যতা বুকের গহিনে হেঁটে বেড়ায়? সে রোদের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া, দূরে সরে যাওয়া ছায়া অপলক দেখতে থাকে আর পলাতক স্বার্থপরের মতো ভেবে নেয়, ফাতিমা তার বউ ছিল, তার অহংকার; আজ বিব্রত সময়ের অন্ধ সুড়ঙ্গে হাবুডুবু খায়। সালিম কি হাত বাড়িয়ে দেবে? সে জানে না।
মেম্বার ফাতিমার জন্য পাড়ার একপ্রান্তে একচালা উঠিয়ে দিয়েছে। সেই ঘরের চারপাশে বাঁশ-বেড়ার সীমানা প্রাচীর। পাড়ায় চটুল মুখরোচক নানা কথা নানা গুঞ্জন একদিন ফিকে হয়ে আসে। সালিম শুধু বিষাদ চোখে সবকিছু দেখে যায়। সে প্রত্যক্ষদর্শী। একমাত্র সাক্ষী। নিজের প্রতি ধীরে ধীরে নিদারুণ বিতৃষ্ণা জমে উঠে তার। সকল মেয়েদের প্রতি ঘৃণা আর অবিশ্বাস। সে সবের কোনো অর্থ নেই জেনে-বুঝেও বৃত্ত থেকে বেরোতে পারে না। বেরোতে চায় না। ভালো লাগে না কোনোকিছু। বেঁচে থাকা অসহ্য তামাশা তার। তারপর সেই বাসস্ট্যান্ডে উপেক্ষার এক দুপুর, অনেক সাধাসাধি শেষে নিজেকে নোংরা-কুৎসিত উদোম করে ফেলে সে।
সেই রাতে অন্ধকার চুপি চুপি ফাতিমার একচালায় গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখার সাধ নাকি বাংলা মদের নেশা; সেখানে কেউ ছিল না। অনেকক্ষণ তবু তালাবদ্ধ ঘরের সামনে বসে দু-চোখে কাউকে হাতড়াতে থাকে। এভাবেই কোনো অবসরে স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যায়। বড় সুখস্বপ্ন জাপটে ধরে। তারপর ভোররাত নাকি মধ্যপ্রহর কারও কোমল স্পর্শে চমকে ওঠে। চোখ মেলে দেখে সেই সে আপনজন, আজ কেউ নয় তার, ফাতিমা খুব কাছে বসে আছে। সালিমের নেশার ঘোর কাটে না। উদ্বাহু ব্যাকুল জড়াতে চায়।
‘‘এইঠেনা মরিবার তনে আইসছেন? কী আছে মোর গোড়ত্? নাকি কী কবার চান?’
‘তুই চল ফাতু মোর ঘরোত চল। মোর সোনাবউ, ঘরোত চল।’
‘এ্যালাও কি মুই তোমহার মাউগ আছু যে যাইম। যান ঘরে চলি যান। মানুষে টের পালি সব যাবি!’
‘কী যাবি...যাবি কী? মুই কাউর খাউ না যে...আর মোর যাবারই কী আছে!’
তার ঘোর কেটে যায়। আসলে কোনো ঘোর কি না কে জানে। সে ফাতিমাকে ভুলতে পারে না। সবসময় বুকের পাশে শূন্য খাঁ-খাঁ লাগে। এই কঠোর দিনকাল, সে বেঁচে আছে, সকলের মতো নিশ্বাস নেয়, তবু যেন কী নেই, কোথায় কোন হাহাকার মৃত্যুর ডাক দেয়। সে কেন এমন করল? কেমন করে নিভিয়ে দিল ঘরের প্রদীপ? এখন বিরান আঙিনায় কোনো সুখ নেই। কোনো শালিক এসে বসে না পেয়ারা গাছে। সালিম বিড়ির ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কোন সে অতীত দিনের ছবি খুঁজে নেয় আর ভেতরে ভেতরে ডুকরে কাঁদে। ফাতিমা ভুলে গেছে।
সালিম সারাদিন শহরে রিকশা চালায়। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় গায়ে মাখে না। আপন মনে যত্ন নিয়ে সওয়ারিকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। তার নিজের কোনো ঠিকানা নেই। যতটুকু রোজগার, মুনশির হোটেলে খেয়ে নেয়; আবার পথ চলা। শহরে যখন রাত নামে, ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে, সে কোনো রিকশা-স্ট্যান্ডে হুডের মধ্যে নিজেকে সঁপে দেয়। কোনোদিন ঘরে ফিরে আসে। তখন অনেক রাত। কত প্রহর মেপে দেখার ইচ্ছে হয় না। আগের মতো সেই যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ অঙ্কের অর্থ কী? কেউ তো আর অপেক্ষায় নেই। তার ঘর-আঙিনায় এখন কান্নাভেজা বাতাস খেলা করে। তারপর সময় যেমন ক্ষতের ওপর প্রলেপ ফেলে, সবকিছু হয়তো ভাগ্যের লিখন; এই ভাবনায় দুর্বোধ্য পাপের মতো পরজন্মের স্বপ্নে বিভোর হয়। সেখানে সে কোনো ভুল করবে না। হঠকারি করবে না। জীবনকে বাজি রেখে চলবে না। ফাতিমাকে কিছুতেই হারাবে না। এইসব কল্পনায় বিভোর ছায়াচিত্র আঁকে। কোনোদিন ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাসের প্রলম্বিত বিষাদ সময়। হারানো দিনের সুখস্মৃতি আর অপূর্ণ জীবনের হাহাকার ভেসে বেড়ায় মনের জানালা থেকে জানালায়। পুনরায় কি নতুনের মতো সবকিছু শুরু করা যায় না? এই-ই হয়...নিজের প্রতি ঘেন্না ধরা জীবনেও কোনো সময় পারিজাত স্বপ্ন জেগে ওঠে। তখন শত শত আকাক্সক্ষা অকারণ হয়ে যায়। রিকশা ঘরের পাশে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখে। মন যে অগোছালো বেপরোয়া। তাকে বাঁধা হলো না।
সেইরাতে ফাতিমা ঘরে এসে নিজেকে মেলে ধরে, সালিমও কেমন ভালোবাসা কাঙাল নাকি বুভুক্ষু; প্রচণ্ড কামুক হয়ে যায়। তেমন আর কথা নয়, সময়কে মর্মে মর্মে গেঁথে নিয়ে সে কেবলই ভাবে ফাতিমা একান্ত আপনার, একেবারে নিজের; কিন্তু ফাতিমা ভোর ভোর রাতে বের হয়ে যায়। সালিম সকালে ঘুম থেকে জেগে আবিষ্কার করে, সব মিথ্যে মায়া মরীচিকা। আশ্চর্য করুণ সকালের বাতাস। ধীর মন্থর বুকে এসে স্পর্শ করে। ঠগের পাড়ে মাথা উঁচু হিজল গাছের শাখায় বুঝিবা কোনো দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে থাকে। সালিম বোঝে অন্যের কারণে নয়, নিজের দোষে সবকিছু ধ্বংস করেছে সে। ফাতিমা আর তার নেই, সে এখন সকলের। মন তবু টানে। তার সকল দোষ বেখেয়াল ভাবনার আঙিনায় জেগে থাকে হারানো দিনকাল। মন কাঙাল আরও একবার খুব কাছে পেতে চায়। কেন এমন হয়? অবাধ জোয়ারের মতো ঢেউ খেলে বারবার, ফাতিমা যে এই জনমের নয়, কত কত জনমের সাথী।
ফাতিমা মরে গেছে। সালিমের ভেতরে ধীরে ধীরে শোকের ডালপালা বের হতে থাকে। আচমকা দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী। সে কোনোদিকে না তাকিয়ে রিকশার চেইন তালা খুলে পথে নামে। আবুল পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। ঠগেরপাড় পশ্চিমে ছোট কুলগাছ। আকণ্ঠ জল পিপাসায় মাথানিচু তার। বর্ষায় পানি জমে থই থই হলে স্পর্শ পায়। এখন মধ্যখানে সামান্য পানি রেখে চারপাশ খটখটে চৌচির। ফাতিমা সেখানের ছায়ান্ধকারে মুখ থুবড়ে মরে পড়েছিল।
‘মুই চাওনি যে লাশ তুই নিয়া যা; কিন্তুক কাঁহো নাই। দারগা সাহেব তোর কথা কইলে। কী আর করা, তুই কিন্তুক মোর দুষ ধরিবু না।’
‘শশালা এ্যালায় চুলকাছে না! চল টপ করি চল।’
‘তুই রাগিছি দেখেছু রে!’
‘কী কইল দারগা? ক্যাংকা করি মইল? কাঁহো মারি থুইছে নাকি?’
‘কবার পারে না। তোর সাথে কথা কবার পারে। ভালো করি কবু, অনেকদিন হছে তালাক হয়া গেইছে। স্বভাব ভালো না মাগির।’
সালিম অসম্ভব নিষ্পৃহ। নিজেকে এখন চুপ রাখতে পারে। এই দুনিয়ায় অনেককিছু দেখা হলো। অনেকখানি শেখা। তবু মনে হয়, একবার চিৎকার করে গ্রাম কাঁপিয়ে দেয়। ওই আতিয়ার মেম্বারই মেরেছে ফাতিমাকে। তার ঠোঁট নড়ে না। জটলা দেখা যায়। পুলিশের খাকি পোশাক। চেয়ারে বসে আছে কয়েকজন। উষার আভায় হ্যাজাক নিভু নিভু ম্লান। তার সামনে মাদুরের ওপর পড়ে আছে লাশ। সাদা থান শরীরে চেপে বসে গেছে। সালিমের বোধহীন দৃষ্টি। বুকের গহিনে অদ্ভুত খাঁ-খাঁ। আঙিনায় শূন্য বাতাস। ফাতিমা এভাবেই সরে গেল। আর এসবের জন্য সেই দায়ী। সেদিন নিজেকে কেন ধরে রাখতে পারল না? আজ আরও একবার সকল দোষ নিজের কাঁধে তুলে নেয় সে। তার পাপ...মহাপাপ। তার কোনো ক্ষমা নেই।
পুলিশ দু’জন রিকশার পাদানিতে লাশ তুলে দেয়। সে সময় দারোগা দু-চার কথা জিজ্ঞেস করে। কত দিনের সংসার? কেন তালাক দিল? রিপোর্ট না করে কোথাও যাবে না। ইত্যাদি। সালিম মাথা এপাশ-ওপাশ...উপর-নিচ জবাব দেয়। আসলে কোনো কথা বলে না। মন তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের সীমা পেরিয়ে গেছে। অবশেষ কিছু নেই। আজ নিজেকে চরম স্বার্থপর বুঝে নেয়। তাই বেঁচে থাকার পৃথিবীতে নতুন ঘোরে জড়াতে চায় না। তার চোখ ভিজে আসে। অনধিকারের মতো সাধ হয়, একবার না কি শেষবার ফাতিমার মুখ দেখে। কে রাখে মনের খবর? তখন লাশ মোটা পাটি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। ফাতিমা ওই পাটির ওপর শুয়ে থাকত।
সালিম জটলার মধ্য দিয়ে রিকশা বের করে। যখন গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে এসে যায়, ভোরের আলো ভালোভাবে ফুটতে শুরু করে। পুব আকাশে উজ্জ্বল রুপোলি আলো ছড়াতে থাকে। সালিমের দৃষ্টি ঝাপসা অন্ধকার। সে বারবার শিহরে ওঠে। ফাতিমা বুঝি পা-দানি থেকে উঠে বসেছে। আবেগময় সোহাগি চোখ। সালিমের গলা জড়িয়ে কী কথা বলে যায়? ‘বড় সাধ ছিল গো...আমাদের সন্তান হবে, আঙিনায় হেঁটে বেড়াবে, তার কোমরের ডোরে সাতফোঁটা কাঁচপাথর, দুপুরের আলোয় ঝিকমিক করবে, ছোট ছোট আদুরে বোল, আমার দু-চোখ ভরে খুশি; সে তোমার ভালোবাসা। আমাদের প্রেম।’ সালিম চমকে ওঠে। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে। সব তার কল্পনা। সে কী-সব ভাবে? অকারণ আবেগ আর স্বপ্নের ঢেউ। ফাতিমা ছিল...ফাতিমা নেই। হায় কী হয়ে গেল! কেন এমন হলো? কেন? তারপর কোনো অচেনা ঈশ্বরের কাছে আকুল আবেদন। কোনো দিন কোনো কিছু চায়নি। আজ মন ব্যাকুল স্বার্থপর হতে চায়। এই জনমে না হোক, কোনো এক জনমে আবার যেন ফিরে পায় ফাতিমাকে। পুনরায় শুরু করবে নতুন জীবন। সেখানে কোনো ভুল কোনো ক্লেদ থাকবে না। তার দু-চোখ বেয়ে লোনাজল গড়িয়ে আসে, প্রথমবার, মুছে ফেলতে হাত তোলে; কী ভেবে আর পারে না।
লাশ যথাসময়ে মর্গে পৌঁছোয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পুলিশের কেউ একজন ষাট টাকা ভাড়া বুঝিয়ে দেয়। সালিম নড়ে না। লাশকাটা ঘরের উত্তরে মাটির উঁচু ঢিপি। তার এককোণায় চুপচাপ বসে থাকে। কেন...কে জানে! যেন অনন্তকাল বসে আছে। সন্ধ্যা নেমে আসে। লখিন্দর ডোম ভেতরে কাজ করে। কচ কচ খট খট শব্দ। সকালে ডাক্তার আসার কথা। সালিমের পেছনে বাঁ-দিকে স্বর্ণচাঁপা গাছ। আলোছায়া শাখায় বৃন্তে বৃন্তে ফুলের সমারোহ। আকাশের তারা হয়ে জেগে থাকে। অতীত দিনের হাজার ছবি। মেঘলা আকাশের মতো হেসে-কেঁদে তেপান্তর ভেসে যায়। কোন মায়ালোকে কেউ জানে না। মৌন-নিশ্চুপ প্রগাঢ় সময়। সালিমের দু-চোখে অন্ধকার জ্বলজ্বল। তারপর সহসা অকারণ জল এসে আবছা বিবর্ণ-মায়া।
তখন হাজার ফুলের মাতাল সুবাসে চারপাশ ভরে যেতে থাকে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //