অভিজিৎ সেনের গল্প

আমি যাব নিমপুর। তাহলে কথা উঠতে পারে এ রাস্তায় কেন? সোজা সদর শহর থেকে বাসে উঠে নিমপুর যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তাটা ধরলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। প্রাসঙ্গিক দু-চারটে কথা তাহলে বলতেই হয়। যে সরকারি চাকরি আমি করি, তাতে মাসে বারো-চৌদ্দ দিন এই থানার গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয় আমাকে। আমার চাকরি নতুন। সব গ্রাম, সব রাস্তা এখনো চেনা হয়ে ওঠেনি। আমি শহরে বড় হয়েছি।

আমি জানতাম, শহরের রাস্তা কিংবা এলাকা চিনতে হলে পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। ছোটবেলায় তিন-চার ঘণ্টা একনাগাড়ে হেঁটে কলকাতার রাস্তাঘাট, মনীষীদের মূর্তি, পার্ক, জলাশয়, হেরিটেজ বিল্টিং- এসব চিনেছি। এখন গ্রামে চাকরি করতে এসে আমি জানলাম, গ্রামের বাড়িঘর, মন্দির, মসজিদ, দিঘি, নদীনালা এবং অবশ্যই মানুষজনকে চিনতে হলে, জানতে হলে আমাকে অবশ্যই সাইকেলে করে ঘুরতে হবে।

এই নতুন চাকরিতে আমার সে রকম একটা সুযোগ হয়েছে। সাইকেলই আমার প্রধান বাহন। কখনো কখনো জিপ গাড়ি চেপেও আমি গ্রামে আসি। সে কদাচিৎ, যদি ওপরঅলা সঙ্গে থাকেন। আবার বৃষ্টি-বাদলের সময় কখনো হয়তো গরুর গাড়ি কিংবা মোষের গাড়িতে চেপেও পাঁচ-সাত কিলোমিটার পর্যন্ত জার্নি করতে হয়। কিন্তু অন্য সময় গ্রামের রাস্তায় সাইকেলই হচ্ছে সেরা বাহন। বাসের মাথায় সাইকেল উঠিয়ে যতদূর সম্ভব পাকা রাস্তায় যাওয়া যায়, গিয়ে আমি নেমে পড়ি। বাসের খালাসি আমার সাইকেল নামিয়ে দেয়। তারপর গ্রামে ঢুকে পড়ি, ঘুরে বেড়াই।

শহর থেকে যে রাস্তাটা এই থানার পশ্চিমপ্রান্ত ঘেঁষে, কখনো বা খানিকটা থানার ভেতরে ঢুকেও এগিয়ে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে মাইল কুড়ি এগিয়ে এসে আমি নেমেছিলাম যে জায়গার নাম খিরাইল। সকালের দিকে দুটো গ্রামের টহল শেষ করে আমি পুবমুখী রাস্তা ধরে ভেতরের দিকের গ্রামের পথে এগিয়ে চললাম। এ রাস্তায় আগে কখনো আমি আসিনি। তবে ভাসা-ভাসা একটা ধারণা অবশ্য ছিল।

জেনে গিয়েছিলাম এ রাস্তা ধরে মাইল পাঁচেক সাইকেল চালালে একটা খাড়ি পাওয়া যাবে। সেটা পার হয়ে মাঠের মধ্য দিয়ে অনেকটা রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে গেলে প্রথমে পড়বে অর্জুনপুরা, তারপর আমাতি, হাজিপুর আর গোটা তিনেক গ্রাম-মাঠ পার হলেই আমার উদ্দিষ্ট নিমপুর। আমাতি এবং হাজিপুরে আমার কাজ আছে। সব হিসাব-নিকাশ ঠিক থাকলে আমি নিমপুর গিয়ে পৌঁছাব সন্ধ্যা নাগাদ। তা ছাড়া শহরে ফেরার শেষ বাসটা আমাকে ধরতে হবে। আর যদি আমি শহরে ফিরতে পারি, তাহলে আগামীকাল ঘাপটি মেরে বাসায় বসে নিজের লেখাপড়া করতে পারি। আমার ট্যুর রিপোর্টে পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার বাস জার্নি এবং সাত-আট কিলোমিটার সাইকেল জার্নি দু-এক দিনে দেখাতে হবে। তা না হলে পরিশ্রম আর খরচে পোষাবে না।

নিমপুরে খাড়ির পাড়ে এসে যখন পৌঁছালাম, বেলা তখন প্রায় তিনটা। খাড়িটার পাড় খাড়া হয়ে এসেছে। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য একটা পুরোনো খেজুরগাছে ফেলানো আছে। দশ-বারো হাত খাড়িটার গভীরতাও অনুরূপ। জল অবশ্য নিচের দিকে হাত দুই-তিন হবে বলে মনে হলো আমার। তাও এ বছর পরপর কয়েকটা কালবৈশাখী হয়েছে বলেই। সাইকেল স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড় করিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম- এই খেজুরগাছের সাঁকোর ওপর দিয়ে মানুষ সাইকেল নিয়ে যায় কী করে! কাছাকাছি কোনো গ্রাম আর লোকজন দেখা যাচ্ছে না।

কী করি এখন? শেষ পর্যন্ত হতাশ গাছের ছায়ায় বসে পড়লাম। দেখা যাক, কেউ না কেউ আসবেই। এ জায়গার মাটির বৈশিষ্ট্য আছে। শক্ত এঁটেল মাটির অঞ্চল। সে কারণেই খাড়ি অপ্রশস্ত ও গভীর। দুদিকে তাকিয়ে আমি কোনো ঢাল খুঁজে পেলাম না। অগত্যা অনেকক্ষণ অন্যের অপেক্ষায় বসে আছি। বসে বসে সিগারেট টানতে থাকলাম।

হঠাৎ খাড়ির ওপারে অনেক দূরে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। আমাতি-অর্জুনপুরার পুবের মাঠটা খাড়ি থেকে ধাপে ধাপে ওপর দিকে উঠে গেছে। এখানকার জমির বৈশিষ্ট্য এমনই। খাড়ির পাড় থেকে মাঠ যেখানে শুরু হয়েছে, সেখান থেকে প্রতিটা জমির খণ্ড তার আগের জমি থেকে অন্তত এক বিঘত থেকে এক হাত উঁচু। এভাবে জমি ধাপে ধাপে উঠে আমাতি-অর্জুনপুরার রাস্তাকে স্পর্শ করেছে। আমি দেখলাম সাইকেল আরোহী একজন মানুষ সেই রাস্তা থেকে মাঠের আলের রাস্তায় নামল।

খাড়ির এপাড়ে আমি যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে না হোক, ষাট ডিগ্রি কৌণিক উচ্চতা থেকে লোকটি অতি দ্রুত নেমে আসছে। এই বৈশাখ মাসে আলের রাস্তা পরিষ্কার এবং সাইকেল চালানোর উপযোগী। অবশ্য গত মৌসুমে ধান কেটে নিয়ে যাওয়া মাঠের আলের রাস্তাতেও সে নামছে সুবিধামতো। এসব রাস্তায় চলতে হলে শুধু খেয়াল রাখতে হবে আলের বিচিত্র গতিমুখ এবং অবিশ্বাস্য রকমের বাঁককে। কিন্তু সাইকেল আরোহী এই পথে অভ্যস্ত। তীব্র গতিতে সে আলপথে নেমে আসছে প্যাডেলে প্রায় চাপ না দিয়েই। মাঝে মাঝে অবশ্য তাকে নামতে হচ্ছে এবং বার দুয়েক মনে হলো, সে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। কিন্তু না, সেও বোধ হয় তার ভারসাম্য রাখার কসরত।

এভাবে আমাতি-অর্জুনপুরার রাস্তা থেকে খাড়ি অবধি আসতে তার আট-দশ মিনিট মাত্র সময় লাগল। আমি মনে মনে হিসাব করলাম আঁকাবাঁকা আলপথে মোট রাস্তা সে পার করেছে অন্তত তিন থেকে চার কিলোমিটার। যে গতিতে সে নিচের দিকে নেমেছে, তাতে এমন হওয়াই সম্ভব। হিসাব করে আমর দুশ্চিন্তাই বাড়ল। যদি ওই আগন্তুক, যে অবশ্যই এই খেজুরগাছের সাঁকোর ওপর দিয়েই খাড়ি পার হবে, আমাকে অনুগ্রহ করে সাইকেলটা পার দেয়- ও, এই ষাট ডিগ্রি কৌণিক উচ্চতায় অন্তত তিন কিলোমিটার রাস্তা আমাকে উঠতে হবে! প্রবল গতিতে প্যাডেল করে অন্তত ধীরে এগোতে হবে এবং সময় লাগবে অন্তত দেড় ঘণ্টা!

ব্যাপারটা বুঝে খুব আতঙ্ক হলো আমার। আক্কেলও হলো। যদি পরিকল্পনাটা উল্টো দিক থেকে করতাম অর্থাৎ যদি বাসে নিমপুর এসে সাইকেল রাস্তায় নামিয়ে আমাতি-অর্জুনপুরা আসতাম, তাহলে কত সুবিধা হতো!

কিন্তু আক্কেল তো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এখন তো খাড়ির পাশে বসে আছি আধা ঘণ্টা ধরে। যথার্থই ‘অপার হয়ে বসে আছি।’ বেলা দ্রুত পড়ে আসছে। বাড়িতে বলে এসেছি, আজ ফেরার সম্ভাবনা কম। ব্যাপারটা যেন সেদিকেই গড়াচ্ছে।

লোকটি সাইকেল থেকে ওপারে নামল। ধুতির খুঁট একটু উঁচু করে গুঁজে দিল সে। পায়ের কেম্বিশের পামশু খুলে একটা একটা করে এপারে ছুড়ে মারল। পাতলা গড়নের লোকটি সাইকেলের সিটের নিচের বড় মাঝামাঝি জায়গায় ডান হাত দিয়ে ধরে ঝুলিয়ে নিল। তারপর এতটুকু ইতস্তত না করেই ওই খেজুরগাছের সাঁকো বেয়ে তরতর করে এগোতে লাগল। আমর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলেও সে কিন্তু নির্বিঘ্নে এপারে চলে এল।

আমি তাকে কিছু অনুরোধ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তার চেহারায় সচ্ছল মধ্য চাষির লক্ষণ। তা ছাড়া ভীষণ ব্যস্ত মানুষ সে, এমনও মনে হলো। এপারে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে পামশু পায়ে গলিয়ে সাইকেলে উঠে বসল লোকটি। আমার দিকে একবার তাকিয়েছে কি তাকায়নি, খিরাইলের রাস্তায় সে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে দিল।

এই প্রথম শহরে বড় হওয়ার কারণে আমার আফসোস হলো। আমার আর কিছু বলা হলো না। এও এক শহুরে সংকোচ বোধ হয়। এমন একজন অচেনা মানুষকে তো আর অনুরোধ করা যায় না যে, আমার সাইকেলটা একটু ওপারে দিয়ে আসুন না, ভাই!

গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের যতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে আমি এখন একটা কিংবা দুটো বাঁশ একত্র করে যে সাঁকো বাঁধা হয়, তার ডাইনে কিংবা বাঁয়ে যদি এড়বড়ে আর একটা বাঁশের সাপোর্ট থাকে এবং সে হেতু যদি ভীষণ নড়বড়ে হয়, যদি আশঙ্কাজনকভাবে দোলও খায়, আমি ভারসাম্য রেখে এক হাতে সাইকেল ঝুলিয়ে দিব্যি ওপারে চলে যেতে পারব। কিন্তু পাশে ধরার মতো কিছুই নেই, এমন একটা ডাইনির বাহনের মতো মরা খেজুরগাছের ওপর দিয়ে আমি হাতে সাইকেল ঝুলিয়ে কীভাবে পার হব! কখনো হয়? অতএব এই নির্জন খাড়ির ধারে আমি ‘অপার’ হয়ে বসে রইলাম।

পারে যাওয়া বা পার হওয়া বড় সাধারণ ব্যাপার নয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে দুটান দেওয়ার পর একটা দার্শনিক ভাবালুতা আমার ভেতর জেগে উঠল। সমুদ্র নয়, নদী নয়, কেমনমাত্র একটা সামান্য খাড়ি যাতে জল দুহাতও গভীর নয়। সেই খাড়ি আমি পার হতে পারছি না। সব পথের জন্যই একজন পথপ্রদর্শক লাগে পারের জন্য একজন পারের কর্তা লাগে, তা সে পারাবারই হোক অথবা এই খাড়ি। আমার পারের কর্তার এখনো দেখা মেলেনি, তাই অপার হয়ে বসে আছি। পারের কর্তা চাই, পারের কড়িও তাকে গুনে দিতে হবে।

এই চাকরিতে যোগ দেওয়ার প্রথম দিকে একদিন একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। হাট থেকে গরু কিনে ফিরছিল দুটি অল্প বয়সের ছেলে। সম্ভবত তাদের সঙ্গের অভিভাবক পিছিয়ে পড়েছিল। শীতের নদীতে জল খুবই অল্প। ছেলে দুটি পারাপারের বাঁশের মাচানে উঠল না। তার বদলে হাত দশেক জায়গা জল ভেঙে গরু নিয়ে ওপারে গিয়ে উঠল তারা। জল তাদের হাঁটুর ওপরে উঠল না। কিন্তু তারা ওপারের ঘাটোয়ালের চোখ এড়িয়ে যেতে পারল না। ঘাটোয়াল তাদের পথ আটকল। ছেলে দুটি কিছুতেই পয়সা দেবে না। তারা তো 

ঘাটোয়ালের বাধা মাচানের ওপর দিয়ে যায়নি, তবে কেন দেবে পয়সা? আমি ছেলে দুটির পেছন পেছন আসছিলাম। তবে ওদের মতো জলে না নেমে মাচান- সাঁকোর ওপর দিয়েই নদী পার হয়েছিলাম। বিরোধ দেখে আমি বললাম, ‘সত্যিই তো ওরাতে গরু নিয়ে জল ভেঙে এপারে এল, তবে পয়সা দেবে কেন?’ হিন্দুস্তানি ঘাটোয়াল বলল, ‘পয়সা দিতে হবে, স্যার। এ ঘাট আমি সরকারের কাছ থেকে পয়সা দিয়ে ইজারা নিয়েছি। জল ভেঙে গেলেও পারানি দিয়ে যেতে হবে। এটাই নিয়ম। এরা হয়তো এখনো সেটা জানে না। তা ছাড়া ঘাটের পারানি কেউ ফাঁকি দেয় না, স্যার।’ কথা-কাটাকাটির মধ্যে ছেলে দুটির অভিভাবক ও তার একজন সঙ্গী চলে এল। অভিভাবকের গলায় দুগাছা তুলসীর মালা। সব শুনে ছেলে দুটিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘হারামজাদা, ঘাটের পয়সা আলাদা করে দিয়ে দিলাম না তোদের, অ্যাঁ?’ ছেলেরা বলল, ‘আমরা তো নদী দিয়ে হেঁটে পার হলাম! পয়সা দেব কেন?’ অন্য ব্যক্তি বলল, ‘না, বাবা, তা হয় না। পারের কড়ি ফাঁকি দেওয়া যায় না।’ তারা ঘাটোয়ালকে পয়সা দিয়ে চলে গেল।

আমি যেন ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা। একটা সামাজিক সৎ আচরণবিধিকে ধর্মীয় অনুশাসনে বেঁধে অলঙ্ঘ্য করা। আরও বহু অভ্যাস ও নিয়মকে বিবেকের শৃঙ্খলায় বাঁধা হয় ধর্মীয় অনুশাসনের মোড়কে। সাধারণ ও সাধারণ নয়, এমন যাবতীয় মানুষকে এই বিবেক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক বা ইতিহাস-পূর্বকাল থেকে আবদ্ধ রেখেছে। গভীর ধর্মীয় তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় দ্বিতীয় বয়স্ক মানুষটির কথা বিস্তারিত করা যায়। যদি পারের কড়ি ফাঁকি দেও, যদি তোমার সঞ্চয়ে পারের কড়ি না থাকে, তোমাকে অপার হয়ে নদীপারে বসে থাকতে হবে!

হঠাৎ আমার মাথার ওপরে একজোড়া শালিক কোথা থেকে এসে হাজির হলো। শুধু হাজির হওয়া নয়, দুটোতেই উড়ে উড়ে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। আমি যে গাছের নিচে বসে আছি, তার পেছনের দিকে একটা আগাছার বৃদ্ধি দক্ষিণ দিকের খাড়ির পার ধরে এগিয়ে গেছে। পাখিদের সতর্ক চিৎকারে আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পেছনে তাকালাম। পেছনে তাকাতে আমার নড়াচড়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। আমি স্থির হয়ে রইলাম প্রায় দম বন্ধ করে। আমি আমাদের বাংলাদেশের সাপ মোটামুটি চিনি। 

কিন্তু যে সাপটি পেছনের ঘন আগাছার ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে, তাকে চিনতে আমার একটু সময়ই লাগল। অত মোটা দাঁড়াস সাপ আমি জীবনে আর কখনো দেখিনি। পাঁচ-ছয় ইঞ্চি করে যদি ওর প্রস্থচ্ছেদ করা হয়, একেক টুকরোর ওজন অন্তত এক কিলো করে হবে। দশ ফুটের মতো লম্বা সাপটার ওজন কম করে পনেরো- ষোলো কিলোগ্রাম তো হবেই। সাপ আমার বাঁ দিক ঘেঁষে, আমার থেকে চার- পাঁচ হাত দূর দিয়ে শালিকদের চিৎকার, ঠোক্কর উপেক্ষা করে চলে গেল। সম্ভবত সে ঝোপের মধ্য দিয়ে খাড়ির নিচের দিকে নেমে গেল। হয়তো সেও ওপারে যাবে। আমি অনেক সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। 

হঠাৎ একদল গোরু এসে হাজির হল। অন্তত দশ-এগারো জোড়া গোরু। আমি সেখানে বসে আছি গোরুগুলো সে দিকের রাস্তা ধরেই এল। দশ-এগারো জোড়া গোরু বলছি এই কারণে যে তারা জোড়া জোড়া করেই বাঁধা, একই দড়ির দুই প্রান্ত দিয়ে দুই গোরুকে হ্রস্ব করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সবগুলো গোরুই একরকম দেখতে। 

সবগুলোর গায়ের রঙই একেবাওে নির্দোষ সাদা। সবগুলোর খাড়া সিং। গোরুগুলোর সঙ্গে দু-জন লোক আছে। তারা ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে যে পথে সাপটা গিয়েছিল, সেই পথে তারা নেমে গেল। একটু পরে কলসি ও বিন্না ঘাটের জঙ্গলে তারাও অদৃশ্য হয়ে গেল। 

আমার মনে  হল, তা হলে এই ঝোপ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ওপারে যাওয়ার একটা পথ আছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম যে গোরুগুলো কোন জায়গা দিয়ে ওপারের মাঠে ওঠে। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখলাম যে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর দিয়ে গোরুগুলো ওপারের মাঠে উঠে যাচ্ছে। 

আমি জানতাম যে ওরা কোথায় যাচ্ছে। কাছেই রাজশাহীর নওগাঁর সঙ্গে বিস্তৃত সীমান্ত আছে। গোরুগুলো ওপারে চালান হয়ে চলে যাবে। জায়গাটার ধুলো আর গোরুগুলোর গায়ের ভারী গন্ধ ছড়িয়ে আছে, তাতে কেমন একটা গোধূলির আবহ মূর্ত হয়ে উঠল। আমি চট করে হাতের ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়িতে বিকেল চারটে বেজে পয়ত্রিশ। আমি হতাশ হয়ে সাইকেলটার স্ট্যান্ড সরিয়ে দুহাতে হাতল ধরলাম। 

এই অবেলায় গ্রামে ঢোকার আর কোনো মানে হয় না, বিশেষত যেখানে কোনোদিন যাইনি। তাছাড়া রাত্রিবাসের সমস্যা হবেই, বিপদেরও পরে যেতে পারি। ফিরতি পথে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে সাইকেলে উঠতে যাব, এমন সময়ে কোলাহল করতে করতে সেদিক থেকে সাত-আটটি ছেলেমেয়ে সাইকেল চেপে সেখানে এসে নামল। দশ-এগারো থেকে পনেরো-ষোলো বছর বয়স হবে তাদের। তারা স্কুলের পোশাক পরা। মেয়েদের পরনে সবুজ পার সাদা শাড়ি। তারা সবাই কাঁধের ব্যাগ এবং জামা কাপড় সামলে সাইকেল হাতে ঝুলিয়ে দিব্যি পোল পার হয়ে ওপারে চলে গেল!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শহরে বড়ো হয়ে ওঠার কারণে আরেকবার ধিক্কার দিয়ে সাইকেলে ওঠার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই ফেরার পথের দিকের ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠের অসংলগ্ন ও জড়ানো কথা কানে এল। একটু পরেই এক জোড়া আদিবাসী স্ত্রী-পুরুষকে দেখলাম এগিয়ে সাঁকোর দিকে এগিয়ে আসতে। পুরুষটির বয়স হবে পঞ্চাশের সামান্য এদিক-ওদিক। কিন্তু অতিজীর্ণ চেহারা তার, উপরন্তু নেশায় একেবারে অচল অবস্থা প্রায়। মহিলার বয়স পয়তাল্লিশের এদিকেই মনে হল। আদিবাসীদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী।হাত দুখানা বেশ বলশালী। চেহারা বেশ শান্তু প্রকৃতির। নেশায় ভারসাম্যহীন পুরুষটির একখানা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। 

পুরুষটি আমাকে দেখে থমকে থামল। স্ত্রীর হাত ছাড়িয়ে আমার দিকে আসতে চাইল, মহিলাও সম্ভবত একটু দম নেওয়ার জন্য তার হাত ছেড়ে দিল। পুরুষ আমার কাছে এসে ভালো করে আমার মুখ দেখল, তারপর একগাল হাসল। নির্বোধ অসংলগ্ন হাসি। ‘বিটির বাড়িং গিইনু’, লোকটির কণ্ঠে একটা অজুহাত যেন, বলল, ‘বেহান ছাড়ল নাই, হেঁ-হেঁ-।’ আঞ্চলিক টান তার কথায়, ‘বইল্লো খাও- আরো খাও- আরো আরো খাও- হেঁ-হেঁ-’। 

এতোগুলো কথার পর আমার তো একটা কথা বলতেই হয়। বললাম, ‘ঠিকইতো, বিটির বাড়ি গেলে বেহান ছাড়বে কেন?’ -‘অ্যাঁই’, বলে সে তার স্ত্রীর দিকে তাকাল, যেন তাকে সমর্থন করার মতো একজন মাতব্বর এতক্ষণে পেয়েছে সে। মাথা নাড়তে লাগল এমনভাবে, যার মানে হল ‘তবেই বোঝো’। আমি সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরা অবস্থাতেই একটা সিগারেট ধরালাম। গল্পকার হিসেবে আমার তৎক্ষণাৎ মনে হল এ লোকের সঙ্গে কথা বলা উচিত। সাঁওতাল আমাকে সিগারেট ধরাতে দেখে আবার ‘হেঁ-হেঁ-’ করে হাসল। আমি প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে তার হাতে দিলাম। 

তারপর তার কাঁপা হাতে দেশলাই না দিয়ে ধরিয়েও দিলাম। প্রবল দুই টানে সে ফুসফুস ভরে ধোঁয়া টানল, সারা মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ল। মহিলা ধমকের সুরে তাকে সাঁওতালিতে কিছু বলল, সম্ভবত তাড়া দিল এবং এসবের ফাঁকে চোরা চোখে একবার আমার দিকে তাকাল। আমি তার মনোভাব অনুমান করে বললাম, ‘তুমিও নেবে নাকি একটা, হিলী? সে কিছু বলার আগেই তার পুরুষ, যে এতক্ষণে মাটিতে বসে পড়েছে, বলল, ‘হাঁ-হাঁ, দাও একটা, নিশা খাও আর যা-ই খাও, ধোঁয়ার সমান কেও লয়, হেঁ-হেঁ’। মহিলা, যাকে আমি ‘হিলী’ অর্থাৎ বউদি সম্বোধন করেছি ‘হাঁ-না’ কিছুই অবশ্য বলল না। 

আমি দেশলাই বাক্সের উপর একটি সিগারেট চেপে ধরে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম ‘ধর।’ সে ওপারের দিকে চোখ রেখেও আমার বাড়িয়ে ধরা সিগারেট দেশলাই নিল। সিগারেট ধরিয়ে তেমনিভাবেই দেশলাই ফেরত দিল এবং এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘ই মাতালকে লিয়ে ওধারে যাওয়া একটা ঝামেলি বটে।’ কিন্তু ভারী পরিতৃপ্তির সঙ্গে সে ধূমপান করছিল। আসলে আমার মনের প্রশ্নটাই সে যেন প্রকারান্তুরে বলে ফেলল। 

এই জীর্ণশীর্ণ নেশাগ্রস্থ টুপভুজঙ্গ হওয়া মানুষকে কী করে ওপারে নিয়ে যাবে, সেটা দেখার জন্যই যেন আমি আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি হলাম। সিগারেট শেষ করে মহিলা হাত ধরে টেনে তার পুরুষকে উঠিয়ে দাঁড় করাল। আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল- ‘আসিগো মানুষ-’। সাঁকোর কাছে গিয়ে তারপরে সে যা করল, তা আমার সমস্ত সম্ভাব্য কল্পনাকেও অতিক্রম করে গেল। 

পুরুষটার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিচু হয়ে তাকে পিঠে তুলে নিল অক্লেশে। সাঁওতাল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে একবার ফের ‘হেঁ-হেঁ’ করে সলজ্জ হাসল। মহিলা তার হাত দুখানা গলায় ঠিকমতো জড়িয়ে নিয়ে পা দুখানা শক্ত করে কোমরে টেনে আটকালো। শাসিয়ে তাকে কী যেন বললও সে। 

সাঁকোর কাছে গিয়ে তারপরে সে যা করল, তা আমার সমস্ত সম্ভাব্য কল্পনাকেও অতিক্রম করে গেল। পুরুষটার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিচু হয়ে তাকে পিঠে তুলে নিল অক্লেশে। সাঁওতাল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে একবার ফের ‘হেঁ-হেঁ’ করে সলজ্জ হাসল। মহিলা তার হাত দুখানা গলায় ঠিকমতো জড়িয়ে নিয়ে পা দুখানা শক্ত করে কোমরে টেনে আটকালো। শাসিয়ে তাকে কী যেন বললও সে। 

সাঁকোর উপরে উঠে বাঁ হাতখানা ডানার মতো ছড়িয়ে দিল সে। ডান হাতখানাও কতকটা ছড়ালো সে কিন্তু সে হাতকে সতর্কও রাখলো সে পিছনে সামলাতে। তারপর খেজুর গাছের সাঁকোর গাঁটে গাঁটে সতর্ক দৃঢ় পা ফেলে ওপারে হেঁটে চলে গেল। পুরুষকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে এই প্রথমবার পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সেই নারী এবং সুন্দও দাঁতের জোড়াপাটি দেখিয়ে হাসলও, বলল- ‘যাইগো, মানুষ।’ আমার ভেতরে কিছু একটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। 

বেলা শেষ হয়ে আসছে, অচেনা জায়গায় রাত্রে কোথায় থাকব, এ সময় গিয়ে আদৌ কোনো কাজ হবে কিনা, এসব বাস্তবিক সমস্যার কথা আমার আর মনেই পড়ল না। দু-পা এগিয়ে গিয়ে আমি হেঁকে বললাম- ‘দাঁড়াওগো মানুষ, আমিও যাব!’ কোলেও ব্যাগ, যার ভেতরে আফিসের কাগজপত্র আছে, সাইকেলের হাতলে ঝুলিয়ে নিলাম। পায়ের জুতো খুলে কেরিয়ারে আটকে নিলাম। 

প্যান্টের ঝুলে গোটা তিনেক ভাঁজ ফেলে সাঁকোর মুখে এসে দাঁড়ালাম আমি। তারপর শরীর ও মন একাগ্র করে ডানহাতে সাইকেল ঝুলিয়ে খেজুর গাছের সাঁকোর উপরে উঠে দাঁড়ালাম। যে কাজ আগে কখনো তুমি অভ্যাস করনি, সে রকম কোনো সাহসিক কাজ যদি তোমাকে করতেই হয়, তাহলে কী করবে তুমি? আমার কাছে জ্বলন্ত উদাহরণ ওই শাড়িপরা স্কুলের মেয়েগুলি, ওই দশ-এগারো বছরের বালক এবং বিত্রমাদিত্যের মতো কাঁধে জ্যান্ত বোঝা নিয়ে ওই সাঁওতাল মহিলা, সবাই যেন একযোগে আমাকে বলে উঠল- ‘সেটা প্রথম বারেই তোমাকে করে ফেলতে হবে! আমরাও সেইভাবে করেছি।’

আমি প্রথম পা পাড়াবার সঙ্গেসঙ্গেই আমার বাঁ হাতখানা খানিকটা শূন্যে উঠে নৌকোর হালের ভূমিকা পালন করতে শুরু করল স্বয়ংক্রিয় ভাবেই। হ্যাঁ, কেউ আমাকে শেখায়নি, তবু আমার যেন জানাই ছিল এভাবেই ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। আমি ওই ভাবেই এগাতে শুরু করলাম। একপা-দুপা করে এগোলাম। মাত্র তো দশ-বারোটা পদক্ষেপ। প্রতি পদক্ষেপে দূরত্ব সংক্ষিপ্ত হতে লাগল আর আমার উত্তেজনা বাড়তে লাগল। শেষে যখন মাত্র বার দুয়েক পা ফেলা বাকি, সাফল্যের উত্তেজনায় আমার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল।

আমি মাত্র কয়েক হাত দূরে সেই সাঁওতাল আর তার স্ত্রীকে দেখলাম। তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলা আমার অবস্থা বুঝে, আমার উত্তেজনায় নিজের শরীরকে আবিষ্ট করে সাঁওতালিতে চিৎকার করে উঠল ‘নোনডে হিজুকমে-জলদি?’ সে আমাকে বাকি রাস্তাটুকু দ্রুত পার হতে নির্দেশ দিচ্ছিল। মরিয়া হয়ে আমি সাইকেল হাতে ঝুলন্ত অবস্থাতেই ওপারের জমি লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিলাম। সেটাই আমার কাছে সফল হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল। ভয়াবহ সংকটে ক্রিকেটের ব্যাটসম্যন যেমন উইকেট বাঁচাতে ঝাঁপ দেয়, আমিও ওপারের সীমায় ঠিক সে ভাবে আছড়ে পড়লাম।

আমার হাঁটুর নীচের অংশ খাড়ির শূন্যতায়। হাত থেকে সাইকেল ছুটে গিয়ে হড়হড় করে নেিচর খাড়িতে নেমে যাচ্ছে। আমি ওই অবস্থাতেই সাইকেলের সামনের চাকাটা ধরে ফেললাম এবং টেনেও তুললাম। তারপর উঠেও দাঁড়ালাম। তারা তখনে দাঁড়িয়ে আছে, আমার বিজয়ের সাক্ষী! মহিলা জিজ্ঞেস করল- ‘কুনঠি যাবেন গো তুমু?’ আমি বললাম- ‘তোমাদের সঙ্গে যাব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //