নিয়ন্ত্রণহীন বাজার, মানুষের নাভিশ্বাস

মূল্যস্ফীতি দেশের সাধারণ মানুষের জীবনচাকা টেনে ধরছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের লাগামহীন মূল্যে অসহায় হয়ে পড়ছে নিম্ন—মধ্যবিত্ত পরিবার। জুলাই মাসে সরকারি হিসাবে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে এখন পৌনে ১০ শতাংশে। আগে যে পণ্য একশ টাকায় কেনা যেত, এখন তা ১১০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কেউ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, কেউ আবার চলছে ঋণ করে। চরম এক অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে মানুষ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা আর সিন্ডিকেটের কারণে আজকের এই দশা। 

বাজারের চিত্র হলো, আগের দামে কেনা পণ্যও দোকানিরা বা বিক্রেতারা এখন অধিক মুনাফার লোভে নতুন দামে বিক্রি করছে। পেঁয়াজ, মুরগির মাংস, মাছ, কাঁচা তরকারির দাম দুদিন যেতে না যেতেই বৃদ্ধির মুখে। ডিম নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। প্রতি হালি ডিমের দাম বেড়ে এখন ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের একটি ডিম খেতে গুনতে হচ্ছে ১৫ টাকা। ডিম খাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মধ্যবিত্ত। ইলিশের ভরা মৌসুম, বাজারে ইলিশ যেন সোনার হরিণ। দাম নাগালের বাইরে। 

ডিমের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে মিরপুরের পিরেরবাগ বাজারের দোকানদার আবদুর রহমান বলছেন, বৃষ্টির কারণেই দাম বাড়ছে। বৃষ্টিটা কমে গেলে দামও পড়ে যাবে। তবে অন্য দোকানদারের ভিন্ন যুক্তি। তারা বলছেন, মুরগির খাবারের দাম, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম বাড়তি। 

দীর্ঘদিন থেকে মাছের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ইলিশের ভরা মৌসুমেও কমছে না মাছের দাম। বাজারে ৬০০ বা ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে ১২শ টাকায়। ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি বা তারও বেশি ওজনের ইলিশের কেজি ১৬শ থেকে ১৮শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে বাজারে রুই—কাতলার কেজি সাড়ে ৪শ থেকে সাড়ে ৫শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তেলাপিয়া মাছ বড় আকারের ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা, পাঙাশের কেজি ২শ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে গরুর মাংস হাজার টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২শ টাকা, সোনালি বা কক মুরগির কেজি ২৯০ থেকে সাড়ে ৩শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ৬০/৭০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। 

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) এক বছরের বাজার তথ্যে পণ্যের দাম গড়ে ১০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। তারা শাহজাহানপুর, মালিবাগ বাজার, কাওরান বাজার, বাদামতলী বাজার, সূত্রাপুর বাজার, শ্যাম বাজার, কচুক্ষেত বাজার, মৌলভী বাজার, মহাখালী বাজার, উত্তরা আজমপুর বাজার, রহমতগঞ্জ বাজার, রামপুরা, মিরপুর—১ নম্বর বাজার থেকে তথ্য নিয়ে থাকে। ২০২২ সালের ১৪ আগস্টের তুলনায় চলমান ২০২৩ সালের ১৪ আগস্টে এক বছরে পণ্যমূল্যের ব্যবধান বেশ বেড়েছে। তবে টিসিবির তথ্যের চেয়েও বাস্তবে পণ্য মূল্য আরও বেশি। টিসিবির তথ্য বলছে, এক বছরে চালের দাম কমেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী কেজিপ্রতি এক বছরে ২ থেকে ৪ টাকা কমেছে। কিন্তু বাজারে মোটা চালও ৫০ টাকার বেশি। আবার নাজিরশাইল মান ভেদে বাজারে এখন ৮২ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা টিসিবির দরের সঙ্গে মিলছে না। 

টিসিবি বলছে, খোলা ও প্যাকেটের আটার দাম এক বছরে গড়ে ৭.৩৭ শতাংশ থেকে ৯.৫২ শতাংশ বেড়েছে। আর আলুর দাম বেড়েছে ৩৫.৭১ শতাংশ। আলু ২৬ থেকে ৩০ টাকা ছিল। এখন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের বাজার তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গত বছর ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরের দেশি পেঁয়াজ এখন ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আমদানি পেঁয়াজ ৪০—৪৫ থেকে এখন ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

টিসিবির তথ্য বলছে, হলুদ ১৮০ থেকে ২২০ টাকায় এক বছর আগে বিক্রি হতো, এখন সেটা সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা প্রতি কেজি নিচ্ছে। দেশি আদা এক বছর আগে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজিতে নিত। সেই আদা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪শ টাকা প্রতি কেজি। মাছের দামও গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। বিভিন্ন ধরনের গুঁড়ো দুধের দাম ৭.১৯ শতাংশ থেকে ১৪.০৮ শতাংশ বেড়েছে। চিনির দামও প্রায় দ্বিগুণ। এক বছর আগে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হতো ৮৮ থেকে ৯০ টাকায়। এখন সেই চিনির দাম ১৪০ টাকা। গত বছরও ডিমের দাম বেশি ছিল। এখনো কমার কোনো লক্ষণ নেই। এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।

প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) ডিমের দাম বৃদ্ধির জন্য করপোরেট সিন্ডিকেটকে দায়ী করছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ডিমের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে সংগঠনটি। গত বৃহস্পতিবার সংগঠনের সভাপতি সুমন হাওলাদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ প্রান্তিক পর্যায়ের অধিকাংশ ছোট ছোট খামার বন্ধ হয়ে যাওয়া। এ কারণে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। আর এ খাতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায় সরকারি তদারকি না থাকায় পোলট্রি শিল্পে তাদের আধিপত্য বেড়েছে, যার খেসারত দিচ্ছে জনগণ।

এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, সিন্ডিকেট সবসময় সুযোগ খেঁাজে বাজারে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধির জন্য। আমরাও সদা সক্রিয় এই সব অবৈধ কারবারিকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে। তিনি বলেন, ডিম, ব্রয়লার মুরগি ও পেঁয়াজের মতো পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারসাজির বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। ভোজ্যতেল, চিনি ও গমের মতো অনেক পণ্য ৯০ ভাগই আমদানিনির্ভর। যা মাত্র কয়েকটি কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ পণ্যগুলো নিয়ে যাতে কোনো বাজারে কারসাজি না ঘটে তার জন্য আমরা সর্বদা সজাগ থাকি। তবে কোনো কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়াও সমাধান নয়। তিনি বলেন, তাতে সাপ্লাই ও ডিমান্ড ব্যাহত হলে ভোক্তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, অভিযান চালিয়ে হয়তো তাৎক্ষণিক সুবিধা মেলে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তাবান্ধব বাজার নিশ্চিতে আমদানি—রপ্তানি, ব্যাংক ঋণ আর ব্যবসা—বিনিয়োগের নীতি—কৌশল সাজানোর সময়ই মূল্যস্ফীতির আস্ফালনকে মাথায় রাখতে হবে। তারা বলছে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে মুদ্রানীতি পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে তার একটা বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতে আসবেই। 

সম্প্রতি ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, কখনো ভোজ্যতেল, কখনো চিনি অথবা পেঁয়াজ, আদা, ডিম, কাঁচামরিচ ইত্যাদি পণ্যের সরবরাহে সংকট তৈরি করে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে লুটে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, অনেক সময় সরকারের কিছু নীতিও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে অতি মুনাফার সুযোগ করে দেয়। আবার সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা একেবারেই কম। তাতে বড় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার নজির নেই বললেই চলে।

অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমদের মতে, সরকারের বাজার অব্যবস্থাপনা এবং বাজার পরিস্থিতির জন্য বিশেষ সিন্ডিকেট অনেকটা দায়ী। তিনি বলেন, করোনা আর যুদ্ধ পরিস্থিতি গোটা বিশ্বে সংকট তৈরি করেছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য যে চেষ্টা থাকার কথা, সেখানে ঘাটতি আছে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সজাগ হলে ব্যবসায়ীরা যা ইচ্ছা করতে পারতেন না। 

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য শুধু বিশ্ববাজারকে দায়ী করাটা ঠিক নয়। কারণ বিশ্ববাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম কমেছে। এখনকার মূল্যস্ফীতির কারণ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার—সংকট এবং দেশে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া। এখানে সরকারের বাজার অব্যবস্থাপনা আর সিন্ডিকেটের কারণে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //