অর্ধশতক পর মানহীন তেল বাজারজাত থেকে সরে আসছে বিপিসি

অবশেষে মানহীন তেল বাজারজাত করার পথ থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এত দিন পেট্রোল, অকটেন এবং ডিজেলের মান সনদ গ্রহণ না করেই বিক্রি করেছে সরকারি সংস্থাটি। এবার মান রক্ষার পর নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সনদ গ্রহণ করতে নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। আর বিপিসি মান সনদ গ্রহণ করেছে কিনা তা আগামী এক মাসের মধ্যে জানাতে বিএসটিআইকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। 

দেশে ব্যবহৃত প্রধান তিনটি জ্বালানি তেল অকটেন, পেট্রোল এবং ডিজেল। এর মধ্যে চাহিদার চেয়েও বেশি পেট্রোল এবং অকটেন দেশেই উৎপাদিত হয়। কিন্তু দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের উপজাত (কনডেনসেট) পরিশোধন করে পাওয়া এ দুই জ্বালানির একটিও আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় মানদন্ডে উত্তীর্ণ নয়। এই দুই জ্বালানির পাশাপাশি আমদানিনির্ভর ডিজেলে নিম্নমানের পেট্রোল মিশিয়েও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা হয়। এতে তেলচালিত গাড়ির এবং কৃষিক্ষেত্রে সেচ পাম্পের যন্ত্রের কার্যক্ষমতা ও জীবনসীমা কমছে। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও। 

আইন অনুযায়ী, বাজারজাত করার আগেই পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেলের মান পরীক্ষা করে বিএসটিআই থেকে সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিপিসি কখনোই এ মান পরীক্ষা করায়নি এবং সনদ নেয়নি। ফলে স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক সময়েও মানহীন ও ভেজাল তেল সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি।

এ নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে সাম্প্রতিক দেশকালে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর মানসম্পন্ন তেল সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তিন আইনজীবী। গত ২৭ জানুয়ারি আদালত বিপিসিকে বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান সনদ গ্রহণ করে বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছেন। দুই সংস্থাকেই আগামী এক মাসের মধ্যে তা নিশ্চিত করে হাইকোর্টকে জানাতে হবে। বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান এবং বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন। 

এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে বিপিসি এবং পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জ্বালানি বিভাগ। বৈঠকে মানসম্পন্ন তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়। একই সঙ্গে আগামীতে মান রক্ষা করে তেল সরবরাহ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দুই সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, ‘দেশের খনিগুলো থেকে প্রাপ্ত কনডেনসেট হতে উৎপাদিত জ্বালানিতেলের গুণগতমান অবশ্যই বিএসটিআইর মানসম্মত হতে হবে। কোনোভাবেই মানহীন তেল বাজারজাত করা যাবে না। বৈঠকে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, গ্যাসক্ষেত্রগুলোর কনডেনসেট ফ্রাকসনেশন প্ল্যান্টে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কিন্তু এগুলো শুধু ফ্রাকসনেশন (উপজাত থেকে জ্বালানি পণ্য তৈরি) করছে। নির্দিষ্ট মানদ- রক্ষা করে পরিশোধনের ক্ষমতা এগুলোর নেই। এ জন্য যে আধুনিক প্রযুক্তির মেশিনারিজ ব্যবহার করা দরকার, সেগুলো কোনোটিতেই নেই। ফলে নিম্নমানের তেল আসছে বাজারে। এখন প্ল্যান্টগুলোকে আধুনিক মেশিনারিজ স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানসম্মত তেল সরবরাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

দেশে পেট্রোল বাজারজাতকরণে জ্বালানি তেলটির অন্তর্জাত উপাদান অকটেন নাম্বার অন্তত ৮৭ মাত্রায় রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এটি ৮০’র বেশি থাকে না। একইভাবে আদর্শ অকটেন তেলে অকটেন নাম্বার অন্তত ৯৫ থাকতে হবে। কিন্তু ফ্রাকসনেশন প্ল্যান্ট বা পাম্প অথবা অন্য কোনো পর্যায়ে ভেজাল মেশানোর কারণে সেটি পান না ক্রেতারা। 

বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি খাতের তিনটি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি রিফাইনারি (কনডেনসেট ফ্রাকসনেশন প্ল্যান্ট) পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট গ্রহণের পর প্রক্রিয়াজাত করে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, সলভেন্ট, মোটর স্প্রিট, কেরোসিন সুপিরিয়র অয়েল, মিনারেল তারপেনটাইনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করে। বর্তমানে বিপিসি ১২টি বেসরকারি রিফাইনারিকে ৬ হাজার ২৪৫ ব্যারেল কনডেনসেট দেয়। এগুলোর কয়েকটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন, ভেজাল মেশানো এবং অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। কয়েকটির কার্যক্রম সরকার স্থগিতও করেছিল। কিন্তু পরে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

বেসরকারি রিফাইনারিগুলো পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট নিয়ে তা পরিশোধনের পর বিপিসির কাছে বিক্রি করে। কিন্তু কয়েকটি বেসরকারি রিফাইনারি কনডেনসেট প্রক্রিয়াজাত না করে সরাসরি বিভিন্ন অয়েল ফিলিং স্টেশনে ও চোরাকারবারিদের কাছে বিক্রি করে।

জানা যায়, পেট্রোবাংলা রিফাইনারিগুলোতে প্রতি লিটার কনডেনসেট ৪৪ টাকায় বিক্রি করে। প্রতি লিটার কনডেনসেট প্রক্রিয়া করে প্রাপ্ত পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রিতে রিফাইনারিগুলোর মুনাফা (প্রফিট মার্জিন) ৭ টাকা। কিন্তু এই কনেডেনসেট চোরাইপথে তেল ভেজালকারীদের কাছে বিক্রি করলে তারা ২৫ টাকা পর্যন্ত লাভ করে। অন্যদিকে, ফিলিং স্টেশনগুলো প্রতি লিটার তেল বিক্রি করে ৩ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা পায়। কিন্তু কনডেনসেট মিশিয়ে ভেজাল জ্বালানি তেল বিক্রিতে লিটারে ১৯ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। সবচেয়ে বেশি ভেজাল হয় অকটেন ও পেট্রোলে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //