বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা

নারী খেলোয়াড়দের নিপীড়ন ঘোচাতে আইন প্রণয়ন জরুরি

নারী ক্রীড়াবিদ, সংগঠকদের প্রস্তাবে নারীদের ক্রীড়ার বিকাশ ও উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সোয়া চার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা।

তবে এ সংস্থার নারী ক্রীড়াবিদদের নানা ধরনের নির্যাতন বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ায় খবর প্রকাশ পেয়ে থাকে। নারী ক্রীড়াবিদরা যৌন হয়রানির শিকার হলে ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকদের ব্যানারে নিপীড়নের প্রতিবাদ হলেও, সংস্থাটি নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন নারী ক্রীড়াবিদরা। তারা নিপীড়নের বিপক্ষে আলাদা সেল বা কমিটি গঠনের দাবি তুলেছেন। 

ক্রীড়াঙ্গনে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, রয়েছে মানসিক নিপীড়নও। নারী ক্রীড়াবিদদের পোশাক, চাল-চলন, বিয়ে, পরিবার নিয়ে কটু মন্তব্য করেন ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেকেই। নারীদের ক্ষেত্রে মাঠে ভালো পারফরম্যান্স করার পরও, অনেক সময় শুনতে হয় বাজে মন্তব্য। এই মানসিক পীড়নের ফলে অনেক সময় নারী ক্রীড়াবিদরা অনুশীলন ও খেলায় স্বাভাবিক পারফরম্যান্স করতে পারেন না। এই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জেন্ডার শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি। নিপীড়নবিরোধী সেল অনুপস্থিতির কারণে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কার্যকর ভূমিকা নেই মহিলা ক্রীড়া সংস্থার।

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে নারী ভারত্তোলকের যৌন হয়রানির অভিযোগের ঘটনায় ক্রীড়াঙ্গনে তোলপাড় হয়েছিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ধিক্কার-সমালোচনা করেছিল। সাবেক ক্রীড়াবিদ ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা কামরুন নাহার ডানার নেতৃত্বে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনও হয়েছিল। সমগ্র দেশে এই ঘটনা যখন আলোচনায়, তখন সামান্য প্রতিবাদ-মানববন্ধনও করেনি বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, যা রীতিমতো বিস্ময়কর! যে সংস্থা এই নিপীড়নের বিপক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করার কথা, সেখানে চলছে উল্টো নীরবতা পালনের সংস্কৃতি। 

ডানার মতো সাবেক সভাপতি রাফিয়া আক্তার ডলি, সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা ফেরদৌস আরা ডলি, মাহফুজা আক্তার কিরণও মনে করেন নিপীড়নবিরোধী একটি সেল মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় থাকা প্রয়োজন। 

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারী নির্যাতনের ঘটনা নীরবে-নিভৃতে ঘটে। কয়েক বছর পর পরই দু’একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। গত বিশ বছরের মধ্যেই কয়েকটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। ক্রীড়াঙ্গন নিপীড়ক মুক্ত কামনা দুই বার স্বর্ণ জেতা ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত বলেন, ‘আমরা নিপীড়ন মুক্ত ক্রীড়াঙ্গন চাই। অবশ্যই ক্রীড়াঙ্গনে নিপীড়নবিরোধী একটি সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। মাঝে মধ্যে ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন হয়, সাধারণ শাস্তি বহিষ্কার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। একটি সুনির্দিষ্ট সেল ও আইন থাকলে, অনেকে অনৈতিক কাজ করার সাহস পাবে না। এই বিষয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।’

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা প্রকৌশলী ফিরোজা করিম নেলীর নিপীড়ন সেলে নিয়ে ভাবনাটা একটু ভিন্ন রকম। 

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মাঝে মধ্যে যে অভিযোগ বা ঘটনার কথা শোনা যায়, সেগুলো কোনো না কোনো ফেডারেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়। সেই অভিযোগ খণ্ডানো এবং তদন্ত করার দায়িত্বটা নিজ নিজ ফেডারেশনেরই।’ 

যে ফেডারেশনে এই অভিযোগে ওঠে, সেই ফেডারেশনের প্রভাবশালীর ব্যক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ছায়ায় এমন ঘটনা ঘটে বলে ধারণা ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের। ফলে সেখানে ভুক্তভোগী নারীর সঠিক বিচার পাওয়ার আশা করা অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

ক্রীড়াঙ্গনে নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটেছিল সাঁতারে। নির্যাতনের শিকার হয়ে এক নারী সাঁতারু অল্প বয়সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। সাঁতার ফেডারেশন তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছিল। সেই তদন্ত কমিটির একজন সদস্য ছিলেন সাবেক সাঁতারু লায়লা নূর। 

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিপীড়ন বিরোধী সেলে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার তেমন ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। কারণ ফেডারেশনের কোনো ঘটনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নেই। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ফেডারেশনের একটি অধিভুক্ত সংস্থা। ফলে আইনত ও গঠনতান্ত্রিকভাবে ফেডারেশনের বিষয়ের ওপর অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারে না।’ 

সাবেক তারকা সাঁতারু নিবেদিতা দাস মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। নারী নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনা এই অধিদপ্তর দেখভাল করে থাকে। তার সেই দায়িত্বের জায়গা থেকে উপলব্ধি যে, ‘একজন নারী ক্রীড়াবিদ ভুক্তভোগী হলে, সে মহিলা অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন। অনেক সময় অভিযোগ করার মতো মানসিক-শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্য এমনকি ইচ্ছেও থাকে না। মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নিপীড়নবিরোধী সেল থাকলে, নারী ক্রীড়াবিদ সেই সেলকে জানালে তারা পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সহায়তার সুযোগ করে দিতে পারে।’

সাবেক টেবিল টেনিস তারকা জোবেরা রহমান লিনু বলেন, ‘ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই এ রকম একটি সেল থাকা দরকার। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনও এটা করতে পারে। তবে প্রাথমিক উদ্যোগটা মহিলা ক্রীড়া সংস্থারই নেওয়া দরকার। অলিম্পিক, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেল করলেও, সেখানে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার প্রতিনিধিত্ব থাকবে।’ 

তারকা সাঁতারু ও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাথলেট কমিশনের সদস্য মাহফুজা খাতুন শিলা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন হয়রানি শুধু শারীরিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাইবার বুলিংয়ের বিষয়টিও বিবেচনাযোগ্য। মহিলা ক্রীড়া সংস্থা অন্য দেশের ক্রীড়া আইনে নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি পর্যালোচনা করে একটি সুন্দর সুপারিশমালা অলিম্পিক বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে দিতে পারে।’

জেলা পর্যায়ে মানসিক নিপীড়নের সংখ্যা বহুগুণ। তিন দশক ধরে সিলেট জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে কাজ করা মারিয়াম চৌধুরী বলেন, ‘মেয়েরা খেলতে আসলে বাজে কথা শুনতো। এতে অনেক মেয়ে খেলা থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে অভিভাবকদের বুঝাই। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে যদি জেলায় জেলায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার জন্য সচেতনতা ও মানসিক নিপীড়নবিরোধী সেল থাকত, তখন এটা আরও কার্যকর হতো।’ 

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা প্রকৌশলী ফিরোজা করিম নেলীর সামগ্রিক বিষয়ে বলেন, ‘ভুক্তভোগী খেলোয়াড় অভিযোগ না করলে অথবা অবহিত না করলে তো, আমাদের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তারপরও এ রকম সেল ক্রীড়াঙ্গনে থাকা প্রয়োজন। এই বিষয়ে আমরা সামনের নির্বাহী কমিটির সভায় আলোচনা করব।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //