স্বাধীনতার ৫০ বছরে ক্রীড়াঙ্গনে যত সাফল্য

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীকে ক্রিকেটের পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে হাফ সেঞ্চুরি। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের সম্মানজনক শিখরে আরোহণ করেছে। ৫০ বছরে যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০ গুণ এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৫ গুণ, সেখানে ক্রীড়াক্ষেত্রে সফলতার গল্প বলতে গেলে বারবারই হোঁচট খেতে হয়। 

বাংলাদেশের খেলাধুলা নিয়ে একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৮৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে নিয়াজ মোরশেদ দাবায় উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার বিরল সম্মানের অধিকারী হন। স্বাধীনতার ১৬ বছর পর দাবায় সেই বিস্ময়কর সাফল্য বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিল। নিয়াজের সেই তুঙ্গস্পর্শী সাফল্যের ৩৪ বছর পরও, হতাশ বাংলাদেশ থমকে আছে মাত্র পাঁচজন গ্র্যান্ডমাস্টারে। সেখানে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ভারত পেয়েছে ৬৭ জন গ্র্যান্ডমাস্টার! ক্রীড়ায় বাংলাদেশের সাফল্য অবশ্য কম নয়; কিন্তু সময়ের পাল্লায় সেটিকে নিতান্তই অপ্রতুল মনে হবে। কারণ যতটা এগিয়ে যাবার কথা ছিল ততটা হয়নি। বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে ক্রিকেট। ১৯৮৬ সালে এশিয়া কাপে খেলার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। এই সময়ে দলীয় অর্জনের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া আর যুবাদের বিশ্বজয় অন্যতম। তবে ব্যক্তিগত অর্জনে সবার আগে থাকবেন নিয়াজ মোরশেদ। তার ঠিক পেছনেই থাকবেন মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান।

যে সকল অর্জনে গর্বিত বাংলাদেশ

সুবর্ণজয়ন্তীতে পেছন ফিরে তাকালে অনেক হতাশার মাঝেও চোখে পড়বে একাধিক উজ্জ্বল মুখ। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ আসর অলিম্পিক গেমসে পদক এখনো হয়ে আছে সোনার হরিণ। তবে এশিয়ান গেমসে কাবাডি আর ক্রিকেটের হাত ধরে এসেছে স্বপ্নের পদক। সোনার পদক এসেছে কমনওয়েলথ গেমসে শুটিংয়েও। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সে কারণেই হতাশাই সঙ্গী হয়েছে বারবার। আক্ষেপের অন্য নাম হয়ে বছরের পর বছর ধরে থেকেছে দেশের ফুটবল। এক সময়ের এক নম্বর খেলাটি তার সোনালি অতীত ফেলে এখন হতাশা বাড়াচ্ছে। সর্বশেষ ২২ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা হয়নি। সামনে যে হবে তেমন কোনো ইঙ্গিতও নেই। 

তৃতীয় জনপ্রিয় খেলা হিসেবে হকিকে ধরা হলেও খেলাটি কর্মকর্তাদের চেয়ার টানাটানির ফলে এখন ধুঁকছে। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে শুটিং, দাবা, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, গলফ, আর্চারি থেকে এসেছে সাফল্য। তবে যা একটু স্বস্তির পরশ হয়ে এসেছে ক্রিকেট মাঠের সাফল্য। ২৫ বছর আগে আইসিসি ট্রফি গোটা বাংলাদেশকে গেঁথেছিল বিনি সুতোর মালায়। লাল-সবুজের দেশ একজোট হয়ে সামিল হয়েছিল বাধভাঙ্গা আনন্দ মিছিলে। সামনে ভালো কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে এখনো ঘুমাতে যায় দেশের মানুষ।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের আগে ও পরে সবচেয়ে বড় অর্জন আর অহংকারের নাম স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে কোনো দেশেই ফুটবল দল নেই, যেটি রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ নামের এই ব-দ্বীপের প্রথম অর্জন হিসেবে তাই ধরা হয় ফুটবলকেই। 

১৯৭১ সালের ১৩ জুন যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। ফুটবল পায়ে মুক্তিযুদ্ধে এক হয়েছিলেন ৩১ মুক্তিযোদ্ধা। ফুটবল দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বাই ও বিহারে ১৪টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছে জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বাধীন একদল স্বপ্নবাজ তরুণ। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম ও একমাত্র ফুটবল দল এই বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধকালীন আকাশবাণীতে (কলকাতা রেডিও) বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত খেলোয়াড়দের মুজিবনগরে রিপোর্ট করতে ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপরই ৪০ ফুটবলার মুজিবনগর ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকেই বাছাই করা হয় ৩০ ফুটবলার। গড়ে তোলা হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। নেপথ্যে ছিলেন ম্যানেজার তানভীর মাজহার ইসলাম তান্না ও সাইদুল রহমান প্যাটেল। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদিয়া একাদশের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ম্যাচ শুরুর আগে বাজানো হয় জাতীয় সংগীত, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...। অনেক নাটকীয়তা শেষে মাঠে গড়ানো সেই ম্যাচে স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে প্রথম গোলটি করেন মোহাম্মদ শাহজাহান। যদিও স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর জন্য পরদিন চাকরিচ্যুত করা হয় নদিয়া জেলার ডিসিকে। ফুটবল দল গড়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিলেন এই দেশের ফুটবলাররা। সব মিলিয়ে ফুটবল পায়ে সাড়ে তিন লাখ রুপির তহবিল গঠন করে এই দল। সর্বকনিষ্ট খেলোয়াড় ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) সভাপতি কাজি সালাউদ্দিন। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এখনো পায়নি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বাধীনতা পুরস্কার! যা নিয়ে হতাশা রয়েছে পুরো দলের মধ্যে। পাশাপাশি কেউ কেউ ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। সেসব নিয়ে অনেকেই সোচ্চার থেকেছেন বর্তমান সময়ে।

জলের বুকে মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল একটি দল হিসেবে খেলে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রেখেছে। তবে সেখানে ব্যক্তিগতভাবে কারো নাম উঠলে সেটি হবে অরুন নন্দীর। যিনি জলের বুকে দাগ কেটে গড়েছিলেন দারুণ একটি বিশ্বরেকর্ড। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে পানিতে নেমে রেখেছিলেন অনন্য ভূমিকা। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে কলকাতার কলেজ স্কয়ারে সাঁতারে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন বাংলাদেশের সাঁতারু অরুণ নন্দী। ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে গড়েছিলেন সেই সময়কার বিশ্বরেকর্ড। ভাঙেন যুক্তরাষ্ট্রের বি সিমুনের ১৯৩২ সালে গড়া ৮৯ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট সাঁতারের পুরনো রেকর্ড। অরুণ নন্দীর সেই প্রদর্শনী সাঁতার থেকে তোলা অর্থ জমা দেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। বিশ্বরেকর্ড গড়ার পর এক লাখ রুপি পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল তাকে। যার পুরোটাই তিনি তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত বাংলাদেশের তহবিলে। ১৯৭১ এর সেই উত্তাল দিনে কলকাতার শরণার্থী অরুণ বন্দুক হাতে নয়, জলের বুকে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। পদ্মা-মেঘনায় সাঁতরে বেড়ে ওঠা এই মানুষটির ছিল অবিরাম সাঁতরে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা দিয়েই যুদ্ধকালীন গোটি বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেন তিনি। স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে সুর্যোদয়-সুর্যাস্ত সব এক করে লড়ে যান জলের বুকে। রক্ত বমিও থামাতে পারেনি তাকে! ১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর চাঁদপুরের বাগদী গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি মহান মুক্তিযুদ্ধে রাখেন অসামান্য ভূমিকা। ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন নিজের রেকর্ড গড়া কলকাতায়। সেখানেই ১৬ নভেম্বর বোনের বাসায় মারা যান অকৃতদার এই মানুষটি। সঙ্গে নিয়ে গেছেন অনেক কষ্ট অবহেলা আর অপ্রাপ্তি!

১৯৭২ সালে ফুটবলের পথচলা শুরু 

বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের খেলা ফুটবল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন তারই প্রমাণ দেয়। ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরুর পর বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সদস্য পদ বাংলাদেশ পায় ১৯৭৪ সালে, স্বাধীনতার তিন বছর পর। তবে এর আগেই দল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত মারদেকা কাপ দিয়ে ফুটবল ম্যাচটি খেলার দুই বছর আগেই গঠিত হয় বাংলাদেশ ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাফুফে। এরপর বাংলাদেশ দল প্রথমবারের মতো ফুটবলের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অংশ নিয়েছে ১৯৮৫ সালে। সেরা প্রাপ্তি অবশ্য এসেছে আরও চার বছর পর ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্টস গোল্ডকাপে বাংলাদেশের লাল দলের জয়ের মাধ্যমে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্জনের চেয়ে বেশি হতাশার গল্প রচিত হচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবলে।

বিশ্বে পরিচিতি এনে দিয়েছে ক্রিকেট

ক্রিকেটকে ধনী আর অলস মানুষের খেলা হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকেন অনেকে। সে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে এই খেলাটিকে প্রতিষ্ঠা করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। সেখানে অগ্রনায়কের ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনের কাণ্ডারী শেখ কামাল। স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে ইউসুফ আলী ও মোজাফফর হোসেন খানকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিবি)। দেশের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু হয় ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর ১৯৭৪-৭৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে ক্লাব ক্রিকেটের লিগ শুরু হয়। ১৯৭৫-৭৬ মৌসুম শেষে বিসিসিবি সে সময়ের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) কাছে সহযোগী সদস্য পদের জন্য আবেদন করে। তখনই বিসিসিবি আমন্ত্রণ জানায় মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবকে (এমসিসি)। এমসিসির ট্যুর রিপোর্টের পরই আইসিসির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্য পদ পায়। এর ঠিক ২০ বছর পর পূর্ণাঙ্গ সদস্য পায় ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখে ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে। সেবার ৪ ম্যাচের দুটি জয়, দুটিতে হারের মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় টাইগাররা। এরপর ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপের ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা শুরু। ১৯৯৭ সালে কেনিয়া, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ডকে পেছনে ফেলে ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয় করে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলে টাইগাররা। তবে প্রথম বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয়ার পরও বলা যায় খুব বেশি এগুতে পারেনি। 

২১ বছর ধরে টেস্ট খেলেও প্রত্যাশিত উন্নতি যেমন হয়নি, উল্টো মাঝেমধ্যেই পড়তে হচ্ছে লজ্জার মধ্যে। ওয়ানডেতে সমীহ করা দলে পরিণত হলেও টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ যেন এখনো নবীনই হয়ে আছে। মেয়েরা ২০১৮ সালে এশীয় নারী ক্রিকেটের প্রথম শিরোপা জিতেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই মূল পুরুষ জাতীয় দলের। সর্বোচ্চ সাফল্য বলতে ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা। ভারতের সঙ্গে সেই সেমির যুদ্ধে পরাজয়ে ভাঙ্গে ফাইনাল খেলার স্বপ্ন। এর আগে ও পরে মোট ছয়বার বিশ্বকাপ খেললেও একবারের জন্য শেষ চারে পৌঁছাতে পারেনি। তবে ২০০৭ সালে সেরা আটে জায়গা করাও বড় সাফল্যের মধ্যে পড়ে। এরপর ২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিল লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। ২০১২, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠলেও ক্রিকেটের শিরোপা অধরাই থেকে গেছে বাংলাদেশের। প্রথমবার পাকিস্তানের কাছে আর পরের দুইবার ভারতের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এখানেই মেয়েদের চেয়ে পিছিয়ে ছেলেরা। তবুও খেলাধুলায় যতটুকু পরিচিত তার বেশিরভাগই এসেছে এই ক্রিকেটের সৌজন্যে।

তৃতীয় জনপ্রিয় খেলা হকি

জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসাব করলে ফুটবল-ক্রিকেটের পরই রয়েছে হকি। বাংলাদেশ বোধকরি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি, যে দেশে ফুটবল-ক্রিকেট আর হকি প্রায় সমান জনপ্রিয় খেলা। সময়ের প্রবাহমানতায় যদিও জনপ্রিয়তা কমে গেছে স্টিক-বলের খেলাটির। অথচ ৭০, ৮০ আর ৯০-এর দশকে হকি ছিল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলার একটি। সম্ভাবনাও ছিল তাই বেশ। তখন বিশ্বে ভারত আর পাকিস্তানের জয় জয়কার। এই দুই দেশ হকির বিশ্ব পরাশক্তি ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া আর জাপান তখন বাংলাদেশের খুব কাছাকাছিই ছিল। একটি পরিসংখ্যানে তার প্রমাণ মেলে, ১৯৮৫’র এশিয়া কাপে পাকিস্তানের কাছে ৭-০ আর ভারতের কাছে ৮-১ গোলে পর্যুদস্ত হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। আর সেখানে চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানের সঙ্গে সমান তালে লড়ে শেষ মুহূর্তে গোল হজম করে মাত্র ১-০ ব্যবধানে হার মেনেছিল বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে প্রথমবার এশিয়া কাপের আসর বসেছিল বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ঘাসের মাঠে প্রথম এশিয়া কাপে ভারত ও পাকিস্তানের বিশ্ব মানের তারকাদের নৈপুণ্যের দ্যুতি দেখে বাংলাদেশের মানুষের হকি প্রেম আরও বেড়ে গিয়েছিল। হকি চর্চা বেড়ে গেলেও সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা আর উদ্যমকে কাজে লাগিয়ে হকিতে উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়নি। ২০১৭ সালে এশিয়া কাপ ও ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হকি আয়োজন করে বাংলাদেশ। তবে এখন আর কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়ার সঙ্গে পেরে ওঠে না বাংলাদেশ।

উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ

এ যেন অবিশ্বাস্য এক অর্জন আসে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। ১৯৮৭ সালে উপমহাদেশের প্রথম দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। এরপর বাংলাদেশ আরো চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছেন। তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন নিয়াজ। যে সময় বিশ্ব দাবা সংস্থা (ফিদে) তাকে মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টারের মর্যাদা দেয়, সে সময় এশিয়ার ৫ম গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন তিনি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত টানা চার বছর ছিলেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। দেশের দাবাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পুরস্কার স্বরুপ ১৯৮৯ সালে পেয়েছিলেন স্বাধীনতা পুরস্কার।

এরপর যতটা উন্নতি হওয়ার কথা দাবায় ততটা হয়নি। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ হিসেবে অবধারিতভাবে উঠে আসে নিয়াজের নাম। 

অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয়

জাতীয় দলের চেয়ে বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলগুলো সবসময়ই সমীহ জাগানিয়া। তার বড় প্রমাণ রাখে অনূর্ধ্ব-১৯ দল। ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি পঠিত কথা ছিল, উনিশের হাত ধরে বিশ্বজয়। যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। এটি যে কোনো স্তরের ক্রিকেটে বাংলাদেশের জন্য প্রথম বিশ্বকাপ জয়। ১৯৯৭ সালের পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ট্রফি জয়ের ঘটনাও ছিল এটি। ফাইনালে চারবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে হারিয়ে আকবর আলী-পারভেজ হোসেন, শরিফুল ইসলাম, তানজীব হাসানরা গড়ে নতুন এক ইতিহাস। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে নিশ্চিত করেই এই অর্জনকে সবার ওপরে রাখতে হচ্ছে। ভারতকে পরাজিত করে সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়ার পর বিরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে ছেলেদের। বাংলাদেশও যে বিশ্বকাপ জিততে পারে সেটি প্রমাণিত হলো।

বনেদি টেস্ট পরিবারে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু

ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার খুব কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায় বাংলাদেশ। আইসিসি ট্রফি জয়ের দুই বছরের মাথায় বিশ্বকাপ খেলার তারও এক বছর পর ক্রিকেটের বনেদি পরিবারের সদস্য হয়ে যায় বাংলাদেশ। সে কারণেই ২৬ জুন, ২০০০ সালটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীদের। দশম দেশ হিসেবে আইসিসির পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা পেয়ে সাদা পোশাকের অভিজাত অঙ্গনে পা রাখে লাল-সবুজ প্রতিনিধিরা। এরপর একই বছরের ১০ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে মাঠে নামে বাংলাদেশ। আর ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি প্রথম টেস্ট জেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তারপর থেকেই হতাশার শুরু। ম্যাচের পর ম্যাচ হার কিংবা ড্রয়ের আক্ষেপ শেষে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল কাক্সিক্ষত সেই জয়ের দেখা। পাঁচ বছর দুই মাস, ৩১ হার, ৩টি ড্র আর অনেক প্রতীক্ষার পর আসে আরাধ্য জয়। এরপর ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে হারাতে পারলেও ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এখনো জয় পায়নি।

সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান মোহাম্মদ আশরাফুল

টেস্ট ক্রিকেটে ছোট ছোট অর্জনের মধ্যেও বুক চিতিয়ে বলার মতো অর্জন মোহাম্মদ আশরাফুলের। অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রান ছাপিয়ে গেছে এই লিটল মাস্টার অভিষেক টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেঞ্চুরি করায়। নিজের ভুলের কারণে এক পর্যায়ে ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে নিন্দিত ও ধিকৃত হলেও টেস্ট অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান আশরাফুল ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম তারকা। এ নন্দিত উইলোবাজের পর ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো শতকটি গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ জেতানো ইনিংস হিসেবে পরিগণিত। ২০০১ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষেও টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেঞ্চুরি করে বসেন আশরাফুল। 

সত্যিকার নায়ক ও অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা

ব্যক্তিগত সাফল্য, অর্জন ও কৃতিত্বকে মানদন্ড হিসেব করে ধরলে হয়তো সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহীমের চেয়ে পিছিয়ে থাকবেন; কিন্তু দল হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পেছনে যার নাম সবার আগে উঠে আসবে তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজা। সন্দেহাতীতভাবেই দেশের ক্রিকেট অগ্রযাত্রায় একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সত্যিকার দিন বদলে পালা সূচিত হয় তার অধিনায়কত্বের সময়টিতে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকেই যা শুরু হয়। তারপর ঘরের মাঠে প্রথমে পাকিস্তান, পরে ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো তিন-তিনটি পরাশক্তির বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ বিজয়ে মাশরাফিই ছিলেন টিম বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন। বৈশ্বিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা। সেই মিশনে মাশরাফিই ছিলেন টাইগার দলপতি। তাই দেশের ক্রিকেট ও ক্রীড়াঙ্গনে নড়াইল এক্সপ্রেসও এক বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে। সেখানে সত্যিকারের নায়ক এই মাশরাফি।

নাম্বার ওয়ান সাকিব আল হাসান

সাকিব মানেই দর্শকদের মধ্যে আলাদা একটি উত্তেজনা, যা এখনো চলমান। দলীয় খেলা থেকেও ক্রীড়াঙ্গনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আকাশ ছোঁয়া সাফল্য আছে সাকিব আল হাসানের। এই দেশ বরেণ্য ও সব্যসাচী ক্রিকেটার এরই মধ্যে দেশের ক্রিকেটকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। আইসিসি র‌্যাংকিংয়ে একটানা প্রায় ১০ বছর বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তকমাধারী এই বাহাতি। এছাড়া ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্টেরও যোগ্য দাবিদার ছিলেন সাকিব। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি ৭ দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পঞ্চাশের বেশি স্কোর করা সাকিব বিশ্বকাপে ৬০৫ রান করার পাশাপাশি ১১ উইকেট শিকারীও। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন অলরাউন্ড কৃতিত্ব আর কারো নেই। বিশ্বকাপের মত বিশ্বআসরে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স চাট্টিখানি কথা নয়। এছাড়া টেস্ট (৬ বার), ওয়ানডে (২৩ বার) আর টি-টুয়েন্টি (৯ বার) মিলে ৩৮ বার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচ সেরার অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারি সাকিব। তিন ফরম্যাটে বেশিবার ম্যান অব দ্য ম্যাচের তালিকায় সাকিবের অবস্থান ১৫ নম্বরে। 

ক্রিকেটে নারী জাগরণ

অবহেলিত হলেও সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় টাইগ্রেসদের। এরপর একটুএকটুকরে ধীরলয়ে এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাছাইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ৯ উইকেটে হারিয়ে একদিনেরআন্তর্জাতিকের মর্যাদা পায় দল। তবে সেরা সাফল্যটি এসেছিল ২০১৮ সালে। সাকিব আল হাসান কিংবা মাশরাফি বিন মুর্তজারা যা পারেননি তাই করে দেখিয়েছেন সালমা খাতুন আর জাহানারা আলমরা। ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ শিরোপা জেতে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে অনন্য উচ্চতায় পা রাখে মেয়েরা। 

হতাশার ফুটবলে আছে অর্জনও

একটি সময় দেশের এক নাম্বার খেলা হলেও এখন আর সেই অবস্থা নেই। প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে এক পশলা বৃষ্টির মতো করেই যে ফুটবলের সাফল্য এসে থাকে। সেটি আবার দীর্ঘ সময় বিরতি দিয়ে পেয়ে থাকে বাংলাদেশ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ১৯৯৫ সালের মিয়ানমারে চার জাতি চ্যালেঞ্জ কাপে ট্রফি জয়। নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৯৯৯ সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে ফুটবলে প্রথম সোনা পায় ফুটবল দল। ২০০৩ সালে জয় করে সাফ ফুটবলের শিরোপা। ২০১০ সালে এসএ গেমস ফুটবলেও স্বর্ণ জেতে বাংলাদেশ। মেয়েদের মধ্যে ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ নারী সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল। তবে হতাশার খবর হলো র‌্যাংকিং এ দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। তবুও আশার বসতি গড়া।

আধুনিক আবাহনীর জন্ম

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিক ক্রীড়ামনস্ক মানুষ একজনই ছিলেন, তিনি শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধু জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাত ধরেই ১৯৭২ সালে আবাহনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বাধীনতার আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছে মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্সের মতো ক্লাব দলগুলো। ঢাকার মাঠে তখন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা মোহামেডানের। সাদা-কালো শিবিরের সেই জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাল ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এক দল। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার শাহাদাতবরণের পরও আবাহনীর চলার পথে সমস্যা হলেও সেটি সমাধানের পর্যায়ে রয়েছে কিন্তু সেটি পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এরপর কাজী সালাউদ্দিন থেকে করে আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, শেখ আসলাম, মোনেম মুন্নাদের তারকা হয়ে ওঠা এই আবাহনীর জার্সিতেই।

ফুটবলের ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর!

রাজনীতির মারপ্যাঁচে ফেলে দেশসেরা ফুটবলারদের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে জেল খাটিয়েছেন ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় থাকা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সরকার। হাস্যকর যুক্তিতে লজ্জাকর এক ঘটনার জন্ম হয়েছিল ২১ সেপ্টেম্বর। সে সময়কার ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) প্রিয় দুই দল মোহামেডান-আবাহনীর খেলা দেখতে হাজির হয়েছিল হাজার হাজার দর্শক। উত্তেজনাপূর্ণ সেই ম্যাচে মোহামেডান এগিয়ে ছিল ১-০ গোলে। এ সময়ই এক গোলের দাবিতে মাঠের রেফারির সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন আবাহনীর খেলোয়াড়রা। উত্তেজনা ছড়ায় গ্যালারিতে, পাশাপাশি মাঠের আশপাশের শহরগুলোতেও। মাঠের উত্তেজনা থামলেও পরে সেখান থেকেই জন্ম হয় আরেক ঘটনার। খেলা শেষে সে সময়কার আবাহনীর খেলোয়াড়রা ফিরে গিয়েছিলেন নিজের বাড়ি কিংবা ক্লাবে। রাতের বেলা সেখান থেকেই ঘেরাও করে কাজী সালাউদ্দিন, কাজী আনোয়ার, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু ও গোলাম রব্বানী হেলালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ-সেনার সমন্নয়ে যৌথ বাহিনী। হাতে হাতকড়া পরিয়ে সামরিক আদালতে তোলা হয় দেশের সেরা ফুটবলারদের। ১৭ দিন জেল খাটতে হয়েছিল দেশের ফুটবলের কিংবদন্তি কাজী সালাউদ্দিনকে। শোনা যায়, জেল থেকে বের হয়ে দেশের সব স্মারক আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি! 

প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা মুন্নার হাত ধরে

স্বাধীনতার ২৪ বছর পর ফুটবলে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ। ১৯৯৫ সালের সেই সময়টিতে দেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। কিন্তু আফসোসের নাম শুধু আন্তর্জাতিক ফুটবল শিরোপা। স্বাধীনতার পরের সময়টিতে ২২ টুর্নামেন্ট থেকে খালি হাতে ফেরার পর শিরোপার আক্ষেপটি মিটেছিল মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে মিয়ানমারে চার জাতি টুর্নামেন্টে। স্বাগতিক মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল স্বাগতিকদের কাছে ৪-০ গোলে হেরে। শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জয় নিয়ে ফাইনালে সেই মিয়ানমারকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ দল। গ্রুপ পর্বে বড় হারের দুঃখ ভুলিয়ে নিজেদের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়ে ২-১ গোলের এক ঐতিহাসিক জয় তুলে নেয় শিরোপও জিতে নেয় লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। 

প্রথম সাফের শিরোপা জয়

প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের আট বছর পর আসে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের সাফের শিরোপা। ১৯৯৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরে অংশ নেয়নি বাংলাদেশ। দুই বছর পর দ্বিতীয় আসরে প্রথমবার খেলতে নেমেই তৃতীয় হওয়ার পর ১৯৯৯ সালে চতুর্থ আসরে হয় রানার্সআপ; কিন্তু তিনটি আসর শেষেও শিরোপা জিততে না পারাটি ছিল চরম হতাশার। অবশেষে ২০০৩ সালে ঘরের মাঠে ঘুচল সেই আক্ষেপ। গ্রুপ পর্বে নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটিনকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে রোকনুজ্জামান কাঞ্চনের গোলে ৭৭ মিনিটে এগিয়ে গেলেও ৮১ মিনিটে সেই গোল শোধ দেয় ভারত। খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ালে ৯৮ মিনিটে মতিউর মুন্নার ২০ গজ দূর থেকে করা গোল্ডেন গোলে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে মালদ্বীপের বিপক্ষে সেই ম্যাচেও কাঞ্চনের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল স্বাগতিকরা। কিন্তু সেখানেও সমতা ফিরিয়ে ম্যাচকে টাইব্রেকারে নিয়ে যায় মালদ্বীপ। সেখানে ৫-৩ গোলে দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে পরাজিত করে এখন পর্যন্ত একমাত্র সাফের শিরোপা জয় করে রজনী কান্ত বর্মনের দল। 

কাতারকে হারিয়ে এশিয়ান গেমসে ইতিহাস

২০১৮ জাকার্তা ও পালেম্বাং এশিয়ান গেমসে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ অলিম্পিক দল। ফুটবলের সবচেয়ে বাজে সময়টি বোধ হয় গত দশকেই কাটিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। ভুটানের কাছে হেরে লম্বা সময় নির্বাসন, টানা তিন সাফের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়, ঘরোয়া ফুটবলের জনপ্রিয়তায় ধসসহ নানা কারণে ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় দর্শকরা। চরম দুঃসময়ের মাঝেই এশিয়ান গেমসের দ্বিতীয় পর্বে উঠে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ২৩ ফুটবল দল। গ্রুপ পর্বে কাতারের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেন জামাল ভূঁইয়ার দল। গোলটিও আসে এই ডফেন্সিভ মিডফিল্ডারের পা থেকে।

ব্যক্তিগত অর্জনের যত গল্প

ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে শাহ আলমের ইতিহাস

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হওয়াটা যেন স্বপ্ন থেকে বেশিকিছু এখন বাংলাদেশের কাছে। অথচ দু’ দু’বার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা স্প্রিন্টার হয়েছিলেন মো. শাহ আলম। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ১০.৮০ সেকেন্ড ও ১৯৮৭ সালে দিল্লিতে ১০.৭৯ সেকেন্ড রেকর্ড সময় নিয়ে সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলেন। যদিও শাহ আলম তার ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক মিটেও স্বর্ণ পেয়েছিলেন। এককভাবে নয়, রিলেতে ১৯৮৪ সালে কলম্বো সাফ গেমসে চার গুণিতক ১০০ মিটারে বাংলাদেশ দলের সদস্য হিসেবে স্বর্ণ জিতেছিলেন এই কিংবদন্তী। কিন্তু তার বিদায়টি হয়েছিল ট্র্যাজেটিক। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিজেই দিলেন নিজেকে ছুটি। ১৯৮৯ ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ব্রোঞ্জ জিতলে তাতে পূরণ হয়নি হ্যাটট্রিক ‘দ্রুতমানব’ খেতাব জয়ের স্বপ্ন। ১৯৯০ বেইজিংয়ে এশিয়ান গেমসের জন্য যখন নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন, গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার পথে ২৯ মে ট্রাকের ধাক্কায় নিভে যায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা অ্যাথলেটের প্রাণ। ঠিক ২০ বছর পর আরেক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মাদ্রাজ সাফ গেমসে ২০০ মিটারে সোনাজয়ী স্প্রিন্টার মাহবুব আলম। সেই দুর্ঘটনার ঘাতক ছিলও ওই এক ট্রাক! 

মোশাররফের প্রথম পদক জয়

মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে বাজিমাত করেন মোশাররফ হোসেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এশিয়ান গেমসে পদক জয় করেন। ১৯৮৬ এশিয়ান গেমসে মোশাররফ ব্রোঞ্জপদক জয় করেন। সে বছরই সিওলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে প্রথমবার অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। আর সেই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৯ সালে তিনি পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। সিউল এশিয়াডে বক্সার মোশারফ হোসেন লাইট হেভিওয়েট ৮১ কেজিতে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ওটিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তিগত পদক। 

মুজিবর রহমানের সোনার হাসি

মুজিবর রহমানের সোনার হাসি হাসে ১৯৮৪ সালে। নেপালের কাঠমান্ডুতে সে সময়কার সাফ গেমসের প্রথম আসর। ২০০ অ্যাথলেট নিয়ে যখন সোনা জিততে না পারার হতাশায় ডুবতে বসেছিল বাংলাদেশ, তখনই সতীর্থদের আলো দেখালেন এক অ্যাথলেট। ট্রিপল জাম্পে স্বর্ণ জিতলেন মুজিবর রহমান মল্লিক। গেমসে প্রথম স্বর্নজয়ীকে পেল বাংলাদেশ। শুধু একটি নয়, একই আসরে আরেকটি সোনাজয়ী ইভেন্টের অংশীদার ছিলেন মুজিবর রহমান। ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতেও সোনা জিতেছিল বাংলাদেশ। সাইদুর রহমান ডন, শাহ আলম ও আফতাব মোল্লার সঙ্গে চতুর্থ সঙ্গী ছিলেন মুজিবর রহমান। 

আতিকুর, নিনি ও শাহানার বাজিমাত

কমনওয়েলথ গেমসের শুটিংয়ে বাংলাদেশ সোনালি সময় পার করে এসেছে। ১৯৯১ সালের আসরে দেশের প্রথম নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন শুটার কাজী শাহানা পারভীন। কমনওয়েলথের আগে সে সময়কার কলম্বো সাফ গেমসেও পদক জিতেছিলেন এই তারকা নারী শুটার। এর আগে দুই শুটার আতিকুর রহমান আর আব্দুস সাত্তার নিনি ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমস পিস্তল শুটিংয়ে স্বর্ণ পদক জয় করেন। তখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবলের রমরমা বাজার। হকির জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। তবে ক্রিকেটে ততটা সফল হতে পারেনি। কমনওয়েলভুক্ত দেশ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা, ভারত, নিউজিল্যান্ডের নামি শুটারদের পিছনে ফেলে আতিক আর নিনির স্বর্ণ জয় ছিল সেই সময়ের আলোচিত ঘটনা ও বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচিত। 

বিমলের অর্জন-বিসর্জনের গল্প

বিমল চন্দ্র তরফদার দেশের অ্যাথলেটিক্স এ বড় নাম। শাহ আলমের অকালপ্রয়াণে স্প্রিন্টে বাংলাদেশের আধিপত্য কমে যাবে কি না, এমন একটি সন্দেহ ছিলই। সেই সংশয় কেটে গেল ঢাকার মাঠে ১৯৯৩ সাফ গেমসে ১০.৬১ সেকেন্ড সময়ে নতুন রেকর্ড গড়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ন জিতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনলেন ১৯ বছরের তরুণ বিমল চন্দ্র তরফদার। এরপর ১৯৯৮ আটলান্টা অলিম্পিকে অংশ নিতে গিয়ে আর দেশেই ফিরলেন না। যদিও পরিবার নিয়ে তিনি এখন নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।

শুটিংয়ে সর্বশেষ বড় সাফল্য আসিফের

আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনির পর ২০০২ সালে আরও একবার কমনওয়েলথ শুটিংয়ে স্বর্ণ পদক জয়ের অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করেন আসিফ হোসেন খান। যদিও বয়স ছিল তাঁর মাত্র ১৫। বাংলাদেশ গেমসে শুটিংয়ে তৃতীয় হওয়া এক কিশোরকে নিয়ে ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে খেলতে গিয়েছিল। কেউ ভাবেওনি আসিফ হোসেন খান নামের সেই কিশোর দেশের হয়ে ইতিহাস গড়বেন! কিশোর বয়সের চাঞ্চল্য, চাপকে পাত্তা না দিয়েই ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে পেছনে ফেলে ৬৯১.৯ স্কোর করে কমনওয়েলথ গেমসে শুটিংয়ে স্বর্ন জিতেছিলেন আসিফ। কমনওয়েলথের পর ইসলামাবাদ সাফ গেমসে স্বর্ন জয়ও বড় সাফল্য। ২০০৬ সালে পুলিশের কাছে মার খাওয়ার পর শুটিং থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। যে বিন্দ্রাকে হারিয়ে কমনওয়েলথে স্বর্ন জিতেছিলেন তিনিই ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ন জিতেছিলেন।

অপরিচিত গলফে সিদ্দিকুর রহমানের বাজিমাত

বাংলাদেশের মানুষেল কাছে গলফ ধনীদের খেলা হিসেবে পরিচিত। সেই খেলাতেই সিদ্দিকুর রহমান নামের একজন এসে বাজিমাত করলেন। খেলাটির নিয়মিত যাঁরা খোঁজখবর রাখতেন তাঁরা হয়তো জানতেন যে এই গলফ খেলেই বিলিয়নিয়ার হয়েছেন টিইগার উডস নামের এক মার্কিন গলফার। এক টুর্নামেন্ট জিতলে ন্যূনতম আয় করা সম্ভব সেটিই জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্যাডিবয় থেকে পেশাদার গলফার সিদ্দিকুর রহমান। ২০১০ সালে ব্রুনাই ওপেন জিতে হইচই ফেলে দেন সিদ্দিকুর। তাঁর সেই শিরোপায় দেশের মানুষের কাছে নতুন করে জন্ম নেয় গলফ নামক খেলাটি। প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে ব্রুনাই এশিয়ান ট্যুর জিতেছিলেন। ৫৪ হাজার ডলার পুরস্কারের পর ২০১৩ সালে ভারতের দিল্লিতে জেতেন হিরো ইন্ডিয়ান ওপেন। ২ লাখ ২৫ হাজার ডলার প্রাইজমানির পর দেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ২০১৬ রিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন সিদ্দিকুর রহমান। 

স্বর্ণ জয়ে ইতিহাস মাবিয়ার

বাংলাদেশের ভারোত্তোলনে বড় নাম মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। ২০১৬ সালের এসএ গেমসে তার কল্যাণেই ভারতের মাটিতে বেজেছিল জাতীয় সংগীত। সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে এক অ্যাথলেটের অঝোরে কান্না নাড়িয়ে দিয়েছিল পুরো বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়। কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে সাফল্যের হাসিতে না হেসে সে সময় কেঁদেছিলেন মাবিয়া। ৬৩ কেজি শ্রেণিতে ভারোত্তলনে প্রথম নারী হিসেবে জিতেছিলেন স্বর্ণ। পদক, দেশ আর জাতীয় সংগীতের মূর্ছনায় আবেগকে মানাতে পারছিলেন না। সারা জীবনের দুঃখ, কষ্ট আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ের চিত্র হয়ে উঠেছিল মাবিয়ার সেই কান্না। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার স্বর্ণ জিতে সেই সাফল্যের ধারা ধরেও রেখেছিলেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। 

সরাসরি অলিম্পিকে রোমান সানা

দেশের দ্বিতীয় অ্যাথলেট হিসেবে আর্চার রোমান সানা সরাসরি অলিম্পিকে খেলার টিকিট পেয়েছিলেন। দেশসেরা এই আর্চার ২০১৯ সালে বিশ্ব আর্চারিতে ব্রোঞ্জ জিতে হইচই ফেলে দেন। সেই অভাবনীয় সাফল্য তাকে পৌঁছে দিয়েছিল এবার ২০২১ সালে টোকিং অলিম্পিক গেমসের সরাসরি খেলার সুযোগ। রোমান যে আসছেন তার বার্তা পাওয়া যাচ্ছিল গত কয়েক বছর ধরেই। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে এশিয়া কাপ স্টেজ-২ ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে রিকার্ভ এককে প্রথমবার স্বর্ণ জয়। ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে ঢাকায় প্রথম আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে ইলিমিনেশন রাউন্ডের রিকার্ভ ডিভিশনের পুরুষ দলগত ইভেন্টে সানোয়ার হোসেন ও তামিমুল ইসলামকে নিয়ে এবং মিশ্র দলগত ইভেন্টে বিউটি রায়কে নিয়ে স্বর্ন দিয়ে ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন রোমান। ২০১৯ সালে এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ পুরুষ এককে রৌপ্য পদক জেতেন। ২০১৯ সালের জুনে আসে সবচেয়ে বড় সাফল্য। নেদারল্যান্ডসে ওয়ার্ল্ড আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে সরাসরি জায়গা পান টোকিও অলিম্পিকে। এরপর ২০২১ সালের মে মাসে লোজানে ওয়ার্ল্ড আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের স্টেজ-২ এর রিকার্ভ মিশ্র দ্বৈত ইভেন্টে দিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে জিতেছেন রৌপ্য পদকও। সে কারণে অন্যদের চেয়ে রোমান সানা একেবারেই আলাদা।

দাবার রানীর ব্রিটিশ জয়

তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে অনন্য এক ইতিহাসে নিজেকে নিয়ে গেছেন রানী হামিদ। তাকে বলার হয় দাবার রানী। এরপর দেশের আর কোনো নারী দাবাড়ু এই কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। ৭৬ বছর বয়সেও আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দাবার অঙ্গন। এছাড়া ২০তম জাতীয় চ্যাম্পিয়শিপ জিতেছিলেন। ১৯৮৩ সালে লন্ডনে ব্রিটিশ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ১৯৮৫ সালে ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার হিসেবে খেতাব পান রানী। ১৫ বার জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ আলোর পথের যাত্রী। তার দেখানো পথ ধরেই এগিয়েছে দেশের নারী, পা রেখেছেন ক্রীড়াঙ্গনে। 

গিনেস বুক অব রেকর্ডসে টেনিসের রাজকন্যা লিনু

জোবেরা রহমান লিনুকে ডাকা হয় দেশের টেবিল টেনিসের রাজকন্যা। এই কিংবন্তী টানা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন গিনেস বুক অব রেকর্ডসে। লিনু রেকর্ড ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের কোনো নারীরই টানা ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড নেই। ২০০১ সালে তিনি জিতেছিলেন ১৬তম শিরোপা। সেই অর্জনের স্বীকৃতি স্বরুপ গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তার নাম উঠেছিল ২০০২ সালে। ১৯৭৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। শুধু কি টেবিল টেনিস, সাইক্লিংয়েও বেশ দক্ষ লিনু। ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৮০ সালে জাতীয় সাইক্লিং-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। 

প্রথম আন্তর্জাতিক পদক

বক্সিংয়ের মাধ্যমে যেমন বাংলাদেশ প্রথম এশিয়ান গেমসে পদক পেয়েছিল, তেমন তার আগে এই ডিসিপ্লিনের মাধ্যমেই ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিক পদক। আবদুল হালিম জাকার্তায় লাইট ফ্লাই ওয়েটে ১০৫ পাউন্ড ওজন শ্রেণিতে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন বাংলার মোহাম্মদ আলী খ্যাত এই বক্সার। 

প্রথম পেশাদার ফুটবলার সালাউদ্দিন

দেশের ফুটবলে সবচেয়ে বড় তারকার নাম কাজি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। প্রথম পেশাদার ফুটবলার হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। তিনি ১৯৭৫ সালে হংকংয়ের প্রফেশনাল লিগে অংশ নিয়েছিলেন এফসি ক্যারোলিন ক্লাবের হয়ে। এরপর দেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে বিদেশের ক্লাবে খেলেছেন সাবিনা খাতুন। ২০১৫ সালে তিনি মালদ্বীপের ঘরোয়া ফুটবলে খেলেছেন।

ফিফার নির্বাহী কমিটিতে বাংলাদেশের নারী কিরন

বাংলাদেশের প্রথম সংগঠক হিসেবে ফিফার নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন মাহফুজা আক্তার কিরণ। তিনি প্রথমবার ফিফার কাউন্সিল মেম্বার হয়েছিলেন ২০১৭ সালে। ভোটে হারিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান প্রতিপক্ষকে। দ্বিতীয়বার তিনি ফিফার সদস্য নির্বাচিত হন ২০১৯ সালে। দ্বিতীয়বার তিনি হারিয়েছেন উত্তর কোরিয়ান প্রতিপক্ষকে। সংগঠক হিসেবে এটি দারুণ একটি অর্জন বাংলাদেশের জন্য।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //