সাফল্য আর রেকর্ডের বরপুত্র জিনেদিন জিদান

ভালো খেলায়াড়দের ভালো কোচ হওয়ার রেকর্ড খুব কমই রয়েছে। সেখানে একেবারেই ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে জিনেদিন জিদানকে। একা হাতে কোচিং ক্যারিয়ারের কয়েক বছরে যা অর্জন করেছেন তাতে পেছনে ফেলেছেন অনেক রথী-মহারথীকে। ইনজুরি কিংবা কম যোগ্যতাসম্পন্ন খেলোয়াড় নিয়ে কীভাবে বুক চিতিয়ে লড়াই করে সাফল্য পাওয়া যায়, সেটি দেখিয়েছেন আলজেরিয়ার শরণার্থী শিবিবে বেড়ে ওঠা এই কিংবদন্তি।

ফ্রান্সের হয়ে খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হওয়ার রেকর্ড যেমন রয়েছে, তেমনি দলটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতেও রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা। আর এখন কোচ হিসেবে পৌঁছে গেছেন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। এই যেমন টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা ইতিহাসের একমাত্র কোচ তিনি। অথচ এরপরও লা লিগা জিততে না পারার আক্ষেপ ছিল জিদানের। 

টানা তৃতীয়বার ইউরোপসেরা হওয়ার পরও আফসোস করেছিলেন। সেটি রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হওয়ার প্রথম ধাপের ঘটনা। অনেকটা হঠাৎই দায়িত্ব ছেড়েছিলেন স্প্যানিশ জায়ান্ট ক্লাবটির। বিশেষ করে ইউরোপের মানুষজন ভালো সময় সঙ্গী থাকতেই মাঠকে বিদায় বলে থাকেন। জিদান যে তাদের মধ্যে এককাঠি এগিয়ে সেটি তিনি বারবারই প্রমাণ দিয়েছেন। কোচ হয়ে লা লিগা জিততে না পারাটাকে নিজের ব্যর্থতা মেনে নীরবেই সরে গিয়েছিলেন। তার চলে যাওয়ার পর যেন আরও বেশি দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবটি। যেখানে খেলোয়াড়ি জীবনের স্বর্ণালি সময় কাটিয়েছেন, সেই ক্লাবের ডাকে সাড়া না দিয়ে তো থাকতে পারেন না। যেমন করে পারেননি এক মৌসুম আগে।

আবারও রিয়ালের ডাক আউটে জিদান। সে কারণে অপেক্ষা ছিল এবার কোন কোন শিরোপা উপহার দেন দলকে। দ্বিতীয় দফায় রিয়ালের কোচ হয়ে ফেরার পর জানিয়েছিলেন এবার লিগ জয়ই তার দলের প্রধান লক্ষ্য। মৌসুম শুরুর আগেও সে কথা আরেকবার বলেছিলেন জিদান। যদিও দায়িত্বটা নিয়েছিলেন এক মৌসুম আগে শেষদিকে। লিগ জয়ের সেই আশা এবার পূরণ করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। ভিয়ারিয়ালকে হারিয়ে এক ম্যাচ বাকি থাকতে লিগ জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে রিয়াল মাদ্রিদের। জিদানের কাছে এই শিরোপা জয়ের আনন্দ মানে চ্যাম্পিয়ন লিগ জয়ের চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে।

অনুভূতিটা তার ছিল এরকমই, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ তো চ্যাম্পিয়নস লিগ; কিন্তু এই লিগ শিরোপা আমাকে আরও বেশি খুশি করেছে। কারণ লা লিগা দুর্দান্ত টুর্নামেন্ট। এখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে বার্সেলোনা আর অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের মতো দল রয়েছে। তাই এখানে শিরোপা জয়ের আনন্দটা ইউরোপ সেরার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়’। জিদান অবশ্য সাফল্যের পেছনে খেলোয়াড়দেরকেই পুরো কৃতিত্ব দিচ্ছেন। রিয়ালের শিরোপা উদযাপন হয়েছে ভালদেবেবাসের ফাঁকা মাঠে। এমন শিরোপা উদযাপন জিদানের কাছে অদ্ভুত লাগছে ঠিকই, কিন্তু সমর্থকদের কথা ভেবে কিছুটা হলেও দুঃখ পেয়েছেন। সাফল্যের পর জিদানকে তুলনা করা হচ্ছে পূর্বসূরি অনেক কোচের সঙ্গে। 

এই যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক কোচ স্যার অ্যালেক্স ফারগুসন। স্কোয়াড রোটেশনের মাস্টার ছিলেন তিনি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই স্কোয়াডে পরিবর্তন আনতেন, ম্যানইউতে তার সাফল্য তো ইতিহাসে লেখা আছে। কোচ হিসেবে পেপ গার্দিওলার কাছ থেকেও নাকি শিখেছেন জিনেদিন জিদান, এটি নিজেই স্বীকার করেন তিনি। গুণীরা জ্ঞান অর্জন করেন কাদামাটি থেকেও, এর পর সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়ে নিজেরাও কিংবদন্তির আসনে বসেন। জিদানের গল্পটাও তেমনই। 

কার কাছ থেকে কি শিখেছেন তা বলে গেছেন অবলীলায়। এতে যেন কোনো শঙ্কা কিংবা খেদ নেই তার। এর মধ্যে জিদানের দল সামলানোর ক্ষমতা সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন আগেই। প্রতিপক্ষের শক্তির জায়গা বুঝে ফরমেশনে পরিবর্তন এনেছেন প্রতিদিন। শুরু করেছিলেন ৪-৩-৩ ফরমেশনে। সেটা কখনো ৪-৪-২ হয়েছে। কখনো ৪-৫-১ হয়েছে, আবার প্রয়োজনে ৪-২-৩-১ করেছেন। সাফল্য পেয়েছেন এখানেই। জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান তার পূর্ণ নাম। গণমাধ্যমে আহ্লাদ করে ‘জিজু’ নামে সম্বোধন করা হয়। এখন নিশ্চিত করেই সেখানে জাদুকর যোগ করে।

যদিও এরই মধ্যে তাকে এই নামে ডাকা শুরু হয়ে গেছে। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে ফরাসি কিংবদন্তি যা করে চলেছেন সেটা জাদুবিদ্যার চেয়ে কম কিসে! ফুটবলার জিদান অধ্যায় শেষ হয়েছে ২০০৬ সালে। তার অনেক আগেই ফরাসি মিডফিল্ডারের নামের পাশে ’কিংবদন্তি’ শব্দটা জুড়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন, ২০০০ সালে ইউরো জিতেছেন। ফরাসি ফুটবলের একটা প্রজন্মের নায়ক তিনি। ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা জিতেছেন, জুভেন্টাসের হয়ে সিরি আ জিতেছেন। ফুটবলার জিদানের অর্জন যে কারো জন্যই ঈর্ষণীয়। আর কোচ হয়ে যা করছেন সেটাকে হয়তো ‘জাদু’ই বলতে হবে! বছর পাঁচেক আগে মাঠের ফুটবলে ধুঁকছিল রিয়াল মাদ্রিদ। 

একদিকে লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ ও নেইমারে উড়ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বার্সেলোনা অন্যদিকে ধারাবাহিকতার অভাবে রিয়াল মাদ্রিদ রীতিমতো দিশেহারা। জিদান তখন রিয়ালের ’বি’ দলের ম্যানেজার। রিয়াল মাদ্রিদের ‘বি’ দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতাই তখন সম্বল জিদানের। সেটা নিয়েই দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, সার্জিও রামোস, মার্সেলো, করিম বেনজেমাদের। মুখ বাঁকিয়ে হেসেছিলেন অনেকেই। অনভিজ্ঞ জিদান ভঙ্গুুর রিয়ালকে নিয়ে কতদূর কি করবেন? রিয়ালের মূল দলের দায়িত্ব নেওয়াকে জিদানের খেলোয়াড়ি জীবনের অর্জনগুলোকে খাটো করার মাধ্যমও মনে করছিলেন অনেকে। কিন্তু তার মাত্র আড়াই বছরের কোচিংয়ে ৯টি শিরোপা জিতল রিয়াল! তার মধ্যে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ তিনটি আর লা লিগা দুটি। চ্যাম্পিয়ন্স 

লিগ টানা 

তিনবার 

চ্যাম্পিয়ন, 

যা অনেকের 

কাছেই অবিশ্বাস্য। দেওয়ার আর কিছু বাকি নেই বলে ২০১৮ সালের মে মাসে রিয়ালের কোচের পদ থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করেছিলেন সর্বজয়ী জিদান। রিয়াল কর্তাদের বহু অনুরোধের ফলে ১০ মাস পর যখন আবারও কোচ হয়ে ফিরলেন তখনো ক্লাবটির ভঙ্গুর দশা। জিদান ফেরার আগেই লিগ শিরোপার দৌড় থেকে ছিটকে পড়েছিল মাদ্রিদের জায়ান্টরা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে পিএসজির বিপক্ষে উড়ে গিয়ে রিয়াল দেখিয়েছিল কতটা নাজুক অবস্থা তাদের। জিদান কোচ হয়ে বলেছিলেন, আবারও গোছাতে সময় লাগবে তার। সময় নিয়ে দলটিকে যে দুর্দান্তভাবে তৈরি করেছেন তার প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে। ১৯ ম্যাচে একটি করে শিরোপা জেতা একজন কোচের জন্য কতটা দুর্দান্ত হতে পারে সেটিও দেখিয়েছেন জিদান। এমন কীর্তির পর জয়তু জিদান না বলে কি উপায় আছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //