বেকারত্ব সম্মুখ যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে ভারতীয়দের

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে অশ্বিন মাঙ্গুকিয়ার ফোন বেজে উঠল। এটি ছিল তার ছেলে হেমিলের হোয়াটসঅ্যাপ কল। তিনি রাশিয়ার অধিকৃত পূর্ব ইউক্রেনীয় অঞ্চল দোনেৎস্কের একটি সামরিক শিবির থেকে কথা বলছিলেন। ২৩ বছর বয়সী হেমিল জানান, তার ভালো খাওয়া, পরা ও থাকার জায়গা জুটেছে। কিন্তু বাবা জানতেন, ছেলে অস্থিরতা লুকানোর চেষ্টা করছে। হেমিল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রথম সারিতে ছিলেন। তিনি রাশিয়ার একজন ‘সেনা সহায়ক’। যে কাজের জন্য হেমিল বিদেশে এসেছিলেন, এটি তার থেকে একদমই ভিন্ন।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যের সুরাট শহরে তার বাড়ি থেকে ফোনে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে অশ্বিন বলেন, ‘কলটি এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। সেই রাতে হেমিল ফোনকলটি কাটতে চাননি।’ এটাই ছিল তাদের শেষ কথোপকথন। দুদিন পর তারা আবার ফোন পান। অপর প্রান্তে হেমিল ছিলেন না। তেলেঙ্গানার যুবক ইমরান জানান, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হেমিল নিহত হয়েছেন। হেমিল তার পরিবারকে ফোন করার পরদিন (২১ ফেব্রুয়ারি) বাঙ্কার খনন করার সময় তাদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। ইমরানের কাছ থেকে অশ্বিন জানতে পারেন, তিনজন ভারতীয়কে ট্রাকে করে ওই সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে হেমিলকে রুশ সেনাবাহিনীতে একজন হেল্পার হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তাকে মাসিক ১,৮০০ ডলার বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা সুরাটের একটি ছোট কাপড়ের দোকানের উপর নির্ভরশীল পরিবারের জন্য এটি ছিল রীতিমতো ‘সমৃদ্ধির পাসপোর্ট’। হেমিলও ওই দোকানেই কাজ করতেন। হেমিলের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনেরা গত ১৪ ডিসেম্বর তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে মুম্বাই যান। সেখানে দুজন লোকএকজন পুরুষ এবং একজন নারী নিজেদের হেমিলকে নিয়োগকারী রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠানের লোক বলে দাবি করেন। তারা আশ্বস্ত করেন, তাদের ছেলে যুদ্ধ থেকে নিরাপদ থাকবে।

হেমিলের পরিবার জানায়, তাকে প্রথমে ভারতের চেন্নাই শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে দুবাই নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি পরিবারের লোকজনের কাছে ঠিকঠাকই মনে হয়েছিল। রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর যখন তাকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করা হয়, তখন এ প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ জাগে; কিন্তু ততক্ষণে হেমিল বা তার পরিবারের হাতে করার মতো কিছুই ছিল না। এরপর তাকে সম্মুখ যুদ্ধে মোতায়েন করা হয়- বাঙ্কার খনন এবং রুশ সৈন্যদের জন্য ভারী অস্ত্র পরিবহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অশ্বিন রাশিয়ার ভারতীয় দূতাবাস এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বেশ কয়েকটি ই-মেইল লিখে ছেলেকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনার জন্য তাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সরকার সময়মতো সাহায্য করলে হেমিল হয়তো আজ বেঁচে থাকত।’ ভারত সরকার গত মাসে স্বীকার করেছে যে তাদের অন্তত ২০ জন নাগরিক রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে ‘আটকে’ আছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

হেমিল একমাত্র ভারতীয় নন, যিনি অনলাইনে রাশিয়ায় ‘আর্মি হেল্পার’ চাকরির প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। চাকরির বিজ্ঞপ্তি ‘বাবা ভøগস’ ইউটিউব চ্যানেল থেকে পোস্ট করা হয়। ওই চ্যানেলের তিন লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় ধারণ করা চাকরির ভিডিও ইউটিউব চ্যানেলে অক্টোবরে পোস্ট করা হয় এবং তখন থেকে ৪২ হাজারেরও বেশি বার ভিডিওটি দেখা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে রাশিয়ান নাগরিকত্বের সম্ভাবনা এবং ছয় মাসের কাজের পর অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে যাওয়ার সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ইউক্রেনে লড়াই করার জন্য ভারতের মতো বেকারত্বপ্রবণ দেশগুলো থেকে সামরিক শ্রমিক বা ভাড়াটে সৈন্য সংগ্রহ করছে রাশিয়া। তাদের সম্মুখ যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্তত দুজন ভারতীয় এ লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন। এ ঘটনা প্রকাশের পর ভারতে ব্যাপক বেকারত্বের বাস্তবতাও উঠে এসেছে।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভারত এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশ থেকে দুর্বল বেকার পুরুষদের যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগ করার অভিযোগ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে নেপাল থেকে শত শত নিয়োগের কথা জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, যাদের মধ্যে অন্তত ১২ জন যুদ্ধে নিহত হয়েছে। 

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতে বেকারত্ব অন্যতম বড় সমস্যা। আর্থিক বিশেষজ্ঞ সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআই) জানিয়েছে, গত অক্টোবর মাসে ভারতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ১০ শতাংশ। বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে অর্থনীতিক পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করেছে বিভিন্ন সময়। সিএমআই জানিয়েছে, তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী শহরের তুলনায় গ্রামে কর্মসংস্থানের হার প্রায় আড়াই শতাংশ কম। যা ইঙ্গিত করে শহরে কাজের সন্ধানে অভিবাসী শ্রমিকের চাপ বাড়ছে। সরকারি হিসাব মতে, দেশটিতে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশ। তবে সেই রাজ্যগুলো থেকে রুশ বাহিনীতে বেশি লোকজন গিয়েছে, যেখানে বেকারত্বের হার গড় হারের চেয়ে বেশি। যেমন কাশ্মীরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। সেখানে বেকারত্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে ওই রাজ্য থেকে সহজেই চাকরির নামে মানব পাচার সম্ভব হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //