বালুচ লংমার্চে জ্বলছে পাকিস্তান

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মলগ্ন থেকে আঞ্চলিক আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের এজেন্ডায় বেশ কয়েকটি প্রদেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এর মধ্যে রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। কিন্তু তারপরও বালুচ, পশতুনসহ বেশ কয়েকটি জাতিসত্তা নিজস্ব আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রাম জারি রাখে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বেলুচিস্তানের অধিবাসীরা নিজেদের বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তারা পাকিস্তানের রাজধানী অভিমুখে এক অভূতপূর্ব লংমার্চের কর্মসূচি পালন করে বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান সেনা সমর্থিত সরকার পাকিস্তানের ক্ষমতা হারানো দল ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের নেতা-কর্মীদের মতো এই লংমার্চকে নৃশংসভাবে দমন করেছে। নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ লংমার্চটি যখন রাজধানী অভিমুখে যাত্রা করছিল, তখন সরকারের পেটোয়া বাহিনী তাদের ওপর বর্বরতা চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পাকিস্তান সেনা ছাউনি থেকে চালানো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের চরম দমন-পীড়নের কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ইমরানকে কারাগারের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রেখেছে। তার দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি সাবেক বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরানের দলটির নির্বাচনী প্রতীককেও বাতিল করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। পাকিস্তানের বিচার বিভাগ এত অন্যায়ের মধ্যে ন্যায়ের পক্ষে থেকে সেই ষড়যন্ত্রকে আপাতত রুখতে পেরেছে। নিঃসন্দেহে বেলুচিস্তানের হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতার এই লংমার্চটি সামরিক শাসককে বেশ একটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। পাকিস্তান এখন নানামুখী বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। 

বহুদিন ধরে চলা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বালুচ সমাজ অনেক দিন থেকেই ফুঁসে ছিল। সেখানে প্রতিবাদের উপহার ছিল গুম হয়ে যাওয়া! এ রকম একটি ভয়ার্ত পরিবেশে মানুষকে প্রতিবাদে সংঘবদ্ধ করা একটি দুরূহ কাজই বটে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কয়েকটিতে সাম্প্রদায়িক আর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনে পিষ্ট হওয়া জনগণও জানে কাজটি কত কঠিন। মাহরাঙ বেলুচ ঠিক সেই কঠিন কাজটিই করেছেন। অবশ্য তিনি একা নন। তার মতো অনেক বেলুচ নারী অবিশ্বাস্য এক প্রতিবাদের সুনামি তৈরি করেছেন বেলুচিস্তানে। সেখান থেকে ‘লংমার্চ’ করে তারা এসেছিলেন ইসলামাবাদ। যদিও কয়েক দিন আগে জলকামানের তোড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হলো। কিন্তু নির্বাচনী উত্তেজনা ছাপিয়ে পাকিস্তান জুড়ে বিস্ময়ের ঢেউ তুলেছে বেলুচ নারীদের এই বিশাল কাফেলা।

প্রশ্ন উঠেছে, দমবন্ধ করা একটা সমাজে কীভাবে পারলেন মাহরাঙ হতাশায় ডুবে থাকা লাখো মানুষকে জড়ো করতে-----যা দমনপীড়নে ক্লান্ত দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গায় প্রায় অসম্ভব হয়ে আছে? মাহরাঙ জীবনের সবচেয়ে বাজে বছরটি কাটান ২০০৯ সালে। সেই বছরটিতে তার বাবা আব্দুল গাফফারকে অপহরণ করে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল বেলুচ লিবারেশন আর্মির সঙ্গে গোপন সংযোগের। 

এ রকম অভিযোগ নতুন নয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বেলুচ অঞ্চলে সশস্ত্র স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য প্রায় সব বেলুচকে সন্দেহের চোখে দেখে। এমনকি শিক্ষিত তরুণীরাও এই সন্দেহের তালিকার বাইরে নেই। এ রকম নজরদারির নির্মম শিকারের বলি হচ্ছে সেখানকার সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। অপহরণের দুই বছর পর মাহরাঙ বেলুচের পিতাকে রাস্তায় পাওয়া যায়। তবে জীবিত বাবাকে তিনি রাস্তায় পাননি। মাহরাঙ রাস্তায় পেয়েছিলেন মৃত বাবার নিথর দেহ। সেই শরীরে ছিল ভয়ঙ্কর নির্যাতনের চিহ্ন। তখন থেকেই মাহরাঙ রাস্তায়। 

মাহরাঙের এই প্রতিবাদ শুধু বাবার হত্যার ঘটনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি চাইছেন বেলুচদের প্রতি চলমান দমন-পীড়ন-হত্যা-গুমের অবসান। এই প্রতিবাদের মাঝেই ২০১৭ সালে তার ভাইকেও এক দফা তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মাহরাঙের এক ধরনের সৌভাগ্য যে, বাবার মতো মৃত্যুর পরিণতি বরণ করতে হয়নি তার ভাইকে। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে ছাত্রাবস্থা থেকে সোচ্চার মাহরাঙ। সেটারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ বালুচদের এই লংমার্চ। 

বলে রাখা দরকার, পাকিস্তানের বিশাল এলাকা বেলুচিস্তান। দেশটির আয়তনের প্রায় ৪৪ ভাগ। ভূ-রাজনৈতিকভাবে এই অঞ্চলের অসীম গুরুত্ব রয়েছে। মাটির নিচের বিস্তর খনিজ এই অঞ্চলের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসলামাবাদ বহু আগেই জাতীয় প্রয়োজনে এই খনিজের ব্যবহারের বিষয়টি নির্ধারণ করেছে। অন্যদিকে এখানকার মানুষ চাইছে খনিজের ওপর প্রথমে তাদের হিস্যা নিশ্চিত হোক। এই খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও ব্যবহারের জন্য তাদের চাই আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। তাই নিয়ে চলছে ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকদের বিরোধ। এই বিরোধই বিস্তৃত করেছে সশস্ত্র সংগ্রাম। আর সেই সশস্ত্রতা রোখার নামে বিচার-বহির্ভূত অপহরণ-গুম বেড়েছে। বহুকাল ধরে এ অঞ্চল সহিংসতার এই দুষ্টচক্রে পড়ে আছে। এর মধ্যে চীন ও ইসলামাবাদ মিলে অর্থনৈতিক করিডর গড়ার ঘটনা সেখানকার নিরাপত্তাহীনতাকে চরমে পৌঁছে দিয়েছে। শুরু হয়েছে এক কালো অধ্যায়। 

এই বালুচ লংমার্চ যদি পশ্চিমা বিশ্বের কোনো একটি দেশে হতো, তাহলে কোনো একটি রঙের নামে সেটি দুনিয়ার নজর কাড়ত। তখন লংমার্চের ওপর চালানো হামলার নিন্দায় সরব হতো আন্তর্জাতিক মহল। কিন্তু পাকিস্তানের মতো একটি অগণতান্ত্রিক ও সামরিক পেশাকের শাসকদের কাছে এ রকম শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনের কোনো মূল্য নেই। সামরিক শাসকদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দপ্তর আইএসআই সব সময়ই বালুচ এবং পশতুনদের শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধকে নৃশংসভাবে দমন করেছে। বহুদিন ধরেই বৈশ্বিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই অঞ্চলকে যুদ্ধ এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বহুদিন ধরেই নিজেদের নিরাপত্তার অধিকার চেয়ে আসছে। অঞ্চলটির প্রভূত খনিজের ওপর চীন আর পাকিস্তানের লোভাতুর দৃষ্টির বলির পাঁঠা হতে চাইছে না আর। কিন্তু ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের চালানো নির্বিচার গণহত্যায় যেমন পশ্চিমারা বধিরের ভূমিকায় নেমেছে, বেলুচিস্তানও একই ধরনের আচরণের শিকার হচ্ছে। দখলদারিত্বের জন্য গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিরা খনিজের জন্য নৃশংসতার শিকার বালুচরা এ রকম বধিরতার শিকার হবে আর কত দিন?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //