কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের নেপথ্যে

সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। ওই সিদ্ধান্ত ‘অসাংবিধানিক’ নয় বলে রায় দিয়েছেন আদালত। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলের রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া এবং আগামী বছর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের আদেশ দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কার্যত বিশেষ মর্যাদা না থাকলে খুব সহজেই অন্য অঞ্চলের মানুষ জম্মু-কাশ্মীরে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে ভোটাধিকারও পাবে। কার্যত আঞ্চলিক জনমিতি বা ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব হবে। ফলে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটিও খুব বেশিদিন তার এ অবস্থা ধরে রাখতে পারবে না। আশঙ্কা রয়েছে, উন্নয়নের মানে জম্মু-কাশ্মীরে কাশ্মীরিদেরই সংখ্যালঘু করে ফেলা হবে আগামী দুই-তিন দশকের মধ্যে।

গত ১১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল সংক্রান্ত মামলার রায় দেন। সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সেখানে ৭টি বিষয়ে আদেশ রয়েছে। যার মধ্যে প্রধান হলো- ‘৩৭০ অনুচ্ছেদটি অস্থায়ী বা সংবিধানে স্থায়ী মর্যাদা অর্জন করেছে কিনা?’ সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছেন, অনুচ্ছেদ ৩৭০ একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর জম্মু ও কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নেই। ‘প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত বৈধ’- এ কথাও জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যেহেতু বিধানের ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল, তা অস্থায়ী, তাই প্রেসিডেন্ট তা বাতিল করার অধিকার রাখেন। জম্মু ও কাশ্মীরের গণপরিষদ বাতিল করার পরও প্রেসিডেন্ট এটি করতে পারেন।’ এ ছাড়া জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দিতে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি সঞ্জয় কৌল তার রায় ঘোষণায় জানিয়েছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধানের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যে দৈনন্দিন শাসন নিশ্চিত করা এবং ৩৭০ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যটিকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করা। রায় প্রদান শেষে একটি ‘সংবেদনশীল’ উপসংহার লিখেছেন বিচারপতি কৌল। তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর উপত্যকা একটি ঐতিহাসিক ভার বহন করে এবং আমরা জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছি। সেনাবাহিনীর কাজ শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নয়। সেনাবাহিনীর প্রবেশে রাজ্যে একটি নিজস্ব বাস্তবতা তৈরি হয়েছে- পুরুষ, নারী ও শিশুদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।’

তবে কাশ্মীর নিয়ে সাংবিধানিক-অসাংবিধানিক-রাজনৈতিক খেলা নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা জারি রাখতে একটা কাশ্মীর ভারতের জন্য ভীষণভাবে দরকার ছিল। আর এ কারণে শুরু থেকেই সেখানকার রাজনীতিতে কখনোই কাশ্মীরিদের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সাংবিধানিক খেলাটাও এর বাইরে নয়। সত্য পাল মালিক জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল থাকাকালে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে বিধানসভা ভেঙে দেন। এক মাস পর জারি করা হয় প্রেসিডেন্টের শাসন। পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের শাসন অনুমোদন করা হয়। পরের বছর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে তা আরও ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়। ওই বছরের ৫ আগস্ট প্রেসিডেন্ট জম্মু-কাশ্মীর সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করেন, যোগ করা হয় সংবিধানের ৩৬৭(৪) নম্বর অনুচ্ছেদ আর সংবিধানের ৩৭০(৩) নম্বর ধারায় রাজ্যের সংবিধান সভার বদলে হয়ে যায় ‘রাজ্যের বিধানসভা’। 

একই দিনে পার্লামেন্টে একটি বিশেষ বিল পাস করা হয়, যার ফলে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ জম্মু-কাশ্মীরে কার্যকর হওয়া বন্ধ হয়। একই সঙ্গে পূর্ববর্তী জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে ভাগ করা হয়। সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে দীর্ঘদিন লকডাউন করে রাখা হয়েছিল। সামনে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক মহল এবং বিশ্লেষকরা। রায়ের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরকে। সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার আগেই পিডিপি সভাপতি মেহবুবা মুফতি এবং ওমর আব্দুল্লাহর বাড়ির দরজা বন্ধ করে পুলিশ এবং তাদের বেআইনিভাবে গৃহবন্দি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কেন্দ্রীয় সরকার এই পদক্ষেপের পেছনে যেসব যুক্তি দেখিয়েছে, তার মধ্যে প্রধান ছিল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই জম্মু-কাশ্মীরে ভোট হবে এবং ফেরানো হবে রাজ্যের মর্যাদা। তাদের যুক্তি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ একটি অস্থায়ী বিধান ছিল। যেহেতু গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তাই পরিষদকে সেই পদটি গ্রহণ করতে হয়েছিল। তা না হলে, এই বিধানটি কখনোই সংশোধন করা যেত না। একই সঙ্গে দাবি করা হয়েছিল, অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রত্যাহার করার বিষয়টি সরকার ‘সংবিধান’ মেনে করেছে এবং এই পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল, জম্মু-কাশ্মীরের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, সেখানে পর্যটনসহ অন্যান্য বাণিজ্যের লাভের কথা মাথায় রেখে।

৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ অনুচ্ছেদ যোগ হয়েছিল ভারত ও কাশ্মীরের নেতাদের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে। কাশ্মীরের ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল এ ধারাগুলো। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর ভারতের অংশ হওয়াটা কাশ্মীরে গণভোটের মাধ্যমে বৈধতা পাওয়ার কথা; সে কথাও ভারত রাখেনি। অথচ ওই মৌলিক ধারাগুলোকে এখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ‘অস্থায়ী’ বলে উল্লেখ করছেন। ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধু সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারতেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। ওই অনুচ্ছেদ বিলোপ করার বিষয়টি বিজেপির পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর একটি ছিল। এমন বিশেষ ধারা ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতেও রয়েছে। সেসব রাজ্যে এ বিশেষ অধিকার রদ করা হয়নি। এ নিয়ে কোনো আলোচনাও নেই। কারণ সেখানে বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষী রাজনীতির সুযোগ নেই।

কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে ২০১৯ সালে যখন পূর্বতন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য পুরোপুরি মুছে ফেলে একে লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করা হয়েছিল। ওই অনুচ্ছেদ বাতিলের পর কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। এমন ২৩টি মামলাকে একত্র করে জুলাই মাস থেকে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চে শুরু হয় এর ধারাবাহিক শুনানি।

গত চার বছরের বিভিন্ন সময়ে দায়ের করা এই মামলাগুলোতে সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে যে বিশেষ মর্যাদা ও সুবিধা দেওয়া হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরকে, তা রদ করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে একাধিক প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা এবং জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কি পার্লামেন্টের আছে? নাকি কেবল কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা পূর্ববর্তী রাজ্যের গণপরিষদের সুপারিশের ভিত্তিতে তা করা যেতে পারে? মামলা চলাকালে, শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়েছিল, যে প্রক্রিয়ায় জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করা হয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হবে।

ওই ২৩ মামলার আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন- সুশীল সমাজ, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট। রয়েছেন জম্মু-কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্স, পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ, ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা-এমপি মোহাম্মদ আকবর লোন এবং জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মধ্যস্থতাকারী রাধা কুমার। আবেদনকারীদের পক্ষে কপিল সিব্বল, গোপাল সুব্রহ্মণ্যমের মতো প্রবীণ আইনজীবীরা অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর বিষয়ে নেওয়া কেন্দ্র সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন।

মামলা চলাকালে এ বছর আগস্ট মাসে, আবেদনকারীর পক্ষ থেকে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন আইনজীবী কপিল সিব্বল। শুনানির শুরুতে তিনি বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত আদৌ সাংবিধানিক পদক্ষেপ নয়। পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ আবেদনকারী ও সরকার দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পর, গত ৫ সেপ্টেম্বর এই মামলার রায়দান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ। এর পর গত ১১ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়।

আবেদনকারীদের বক্তব্য, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ একটি স্থায়ী বিধান ছিল। এর যে কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজ্যের গণপরিষদের অনুমতি প্রয়োজন, যা ১৯৫৬ সালে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। আবেদনকারীরা আরও বলেছেন, ৩৭০ ধারা অপসারণের বিষয়টি ইন্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন-এর পরিপন্থি, যার মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়ে যায়। গণপরিষদকে বিধানসভা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায় না, কারণ তাদের কাজ আলাদা। এটি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেওয়া একটি ‘রাজনৈতিক পদক্ষেপ’।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //