প্রথমবারের মত ক্ষমতার অংশীদারিত্বে নেই মুসলিমরা:

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও ১৫ রাজ্যে নেই মুসলিম মন্ত্রী

সম্প্রতি ভারতের ৫টি রাজ্যে নির্বাচনের পর সরকার গঠনের বিষয়ে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনও অংশীদারিত্ব থাকবে বলে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরইমধ্যে কংগ্রেসশাসিত তেলেঙ্গানায় মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হলেও সেখানে একজন মুসলিমকেও মন্ত্রী করেনি কংগ্রেস। অন্যদিকে বিজেপিশাসিত মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়েও মুসলমানদের মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। কারণ, তিনটি রাজ্যেই বিজেপির প্রতীকে নিয়ে জয়লাভ করা কোনো মুসলিম বিধায়ক নেই। 

দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের স্মৃতি ইরানির কাছে। বর্তমানে দেশটিতে মোট ২৮ জন গভর্নর নিযুক্ত রয়েছেন, যাদের মধ্যে মাত্র দুই জন মুসলিম। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে মোট ৩৪ জন বিচারপতির মধ্যে মাত্র একজন বিচারপতি মুসলিম সম্প্রদায়ের। আর এবারেই হয়ত দেশের ২৮টি রাজ্যের ১৫টিতে প্রথমবারের মতো একজনও মুসলিম মন্ত্রী থাকছেন না। গুজরাট, আসাম, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, তেলেঙ্গানা এবং উত্তর-পূর্বের ছয়টি রাজ্যেও চিত্রটি সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই রাজ্যগুলোতে একজনও মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নেই। অসমে এক কোটিরও বেশি ও তেলেঙ্গানায় প্রায় ৪৫ লাখ মুসলমানের বসবাস। অসমে ১.০৬ কোটি, গুজরাটে ৫৮ লাখ, তেলেঙ্গানায় ৪৫ লাখ, হরিয়ানায় ১৭ লাখ এবং উত্তরাখণ্ডে ১৪ লাখ মুসলিম হলেও এসব রাজ্যে নেই মুসলিম মন্ত্রী ।

এদিকে রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ের মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ স্থগিত রয়েছে। কিন্তু  এসব রাজ্যে কোনো মুসলিমের মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। দুটি প্রধান কারণ হল- বিজেপিশাসিত মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে বিজেপির একজনও মুসলিম বিধায়ক নেই। এসব রাজ্যের নির্বাচনে দলটি একজন মুসলিমকেও নির্বাচনের টিকিট দেয়নি। আর এই রাজ্যগুলোতে বিধান পরিষদের কোনও ব্যবস্থা নেই। এমন  পরিস্থিতিতে উত্তর প্রদেশের মতো এখানে কোনো মুসলমানকে মন্ত্রী বানানো সহজ নয়। উত্তর প্রদেশে কোনো মুসলিম বিধায়ক না থাকা সত্ত্বেও বিজেপি দানিশ আজাদ আনসারিকে মন্ত্রী বানিয়েছিল। বিধান পরিষদ কোটা থেকে তাকে বিধানসভায় পাঠানো হয়েছিল। 

রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে সম্প্রতি বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। রাজস্থানে ৬২ লাখের বেশি মুসলিম থাকলেও এখানে বিজেপির একজনও মুসলিম বিধায়ক নেই। মধ্য প্রদেশে ৪৮ লাখ মুসলিম আর অনুরূপ এ রাজ্যেও নেই বিজেপি থেকে নির্বাচিত মুসলিম বিধায়ক। আর ছত্তিশগড়ে ৫ লাখ মুসলিম। কিন্তু এখানেও বিজেপির কোনো মুসলিম বিধায়ক নেই। এভাবে এসব রাজ্যে মুসলিম বিধায়ক না থাকার ফলে কোনো মুসলিমের মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। 

যদি মুখ্যমন্ত্রীর প্রসঙ্গেও আসা যায় সেখানেও দেখা যাচ্ছে বর্তমানে দেশের কোনো রাজ্যে একজনও মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নেই। দেশের ২৮টি রাজ্য এবং দু'টি কেন্দ্রীয় সরকারশাসিত অঞ্চলে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন। এর মধ্যে ২৫ জন মুখ্যমন্ত্রী হিন্দু, দু'জন খ্রিস্টান  এবং একজন বৌদ্ধ ও একজন শিখ সম্প্রদায়ের। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন নিজেকে কোনো ধর্মের লোক বলে মনে করেন না। এক বিবৃতিতে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও যে সম্প্রদায় থেকে স্ট্যালিন এসেছেন তাকে ভারতে হিন্দু ধর্ম হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।

 দেশে ১৪ শতাংশ মুসলিম বাস করলেও কোনো রাজ্যে একজনও মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নেই। এর বিপরীতে দেশে ১.৭ শিখ সম্প্রদায়ের বাস হলেও পাঞ্জাবে তাদের মুখ্যমন্ত্রী আছে। অন্যদিকে ০.৭ শতাংশ বৌদ্ধ সম্প্রদায় থেকে আসা প্রেম সিং তামাং সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী। ভারতে ২.৩ শতাংশ খ্রিস্টানদের বাস। মেঘালয় এবং মিজোরামে রয়েছেন খ্রিস্টান মুখ্যমন্ত্রী। জম্মু-কাশ্মীরে আগে মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে সেখানে নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমানে সেটি কেন্দ্রীয় সরকারের অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সেখানে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়েছে। যেভাবে নয়া ডিলিমিটেশন হয়েছে তাতে সেখানে মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসাদ মালিক বলছেন, মুসলিমদের ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব পাওয়ার বিষয়ে কোনো আইন নেই। আগের সরকারের ঐতিহ্য অনুযায়ী মুসলিম নেতারা রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি বা অন্য কোনও বড় পদ পেতেন, যার কারণে তারা বড় সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতেন। বর্তমান সরকার ঐতিহ্য না মানলে এ বিষয়ে কিছু বলা যায় না।  

বিধানসভা এবং লোকসভা আসনের পুনর্বিন্যাসের ফলে মুসলিম অধ্যুষিত অনেক আসনেও মুসলিমরা বিধায়ক ও এমপি হতে পারছেন না। যার ফলে সরকারের অংশীদারিত্বের সমীকরণে তারা নেই। বিহারের গোপালগঞ্জ, উত্তর প্রদেশের নাগিনা ও বুলন্দশহর, গুজরাটের কচ্ছ এবং আহমেদাবাদ পশ্চিম এমন লোকসভার আসন যেখানে মুসলিমদের জনসংখ্যা দলিতদের চেয়ে বেশি। কিন্তু এই আসনগুলো ২০০৯ সালে দলিতদের জন্য সংরক্ষিত রাখা ছিল।

স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ৩/৪ জন মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন, যারা বড় দায়িত্বও পেয়েছিলেন। নেহরুর আমলে জাকির হুসেনকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। নেহরুর মৃত্যুর পর জাকির হুসেন ভারতের রাষ্ট্রপতিও হন। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে বরকতুল্লাহ খান রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী এবং আবদুল গফুরকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারেও মুসলিমদের অংশীদারিত্ব দেওয়া হয়েছিল। অটল সরকার ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য এপিজে আবদুল কালাম আজাদকে মনোনীত করেছিলেন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফয়সাল দেবজির মতে, ১৯৯০ সালের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম মুসলমানদের ক্ষমতা হ্রাস করেছে। ১৯৯০ সালের পর, মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অন্যদিকে হিন্দুরা ধীরে ধীরে এক দলে একত্রিত হয়েছে।

সূত্র: পারস টুডে 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //