বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে রায়

যত অধিকার হারাল জম্মু-কাশ্মিরের মানুষ

ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল বৈধ। স্বায়ত্বশাসনের বিশেষ মর্যাদা হারিয়েছে জম্মু-কাশ্মির। এখন থেকে এটি দুইভাগ; কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মির এবং লাদাখ অঞ্চল। দুই অঞ্চলের দায়িত্ব দুই উপরাজ্যপালের ওপর। তবে আদালতের নির্দেশ- ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন করতে হবে।

আজ সোমবার (১১ ডিসেম্বর) এমন রায় দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। 

ভারতীয় সংবিধানে একটি অস্থায়ী সংস্থান (টেম্পোরারি প্রভিশন) হলো ৩৭০ অনুচ্ছেদ। সংবিধানের ১১ নম্বর অংশ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মিরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল এবং বিশেষ বিশেষ সংস্থানের কথা বলা হয়েছে এই ১১ নম্বর অংশে। সংবিধানের বাকি সব ধারা দেশের অন্য রাজ্যগুলোতে প্রযোজ্য হলেও জম্মু ও কাশ্মিরের ক্ষেত্রে হবে না। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজ্যপালের জন্য ছিল সদর-ই-রিয়াসত এবং মুখ্যমন্ত্রীর বদলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

বিশেষ মর্যাদা

২০১৯ সালের অগস্ট মাসের আগ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে জম্মু ও কাশ্মিরে হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল না কেন্দ্রের। জম্মু ও কাশ্মিরে কোনও আইন প্রণয়নের অধিকার ছিল না সংসদের। আইন প্রণয়ন করতে হলে রাজ্যের সম্মতি নিতে হতো। তাছাড়া আলাদা পতাকাও ছিল জম্মু ও কাশ্মিরের।

এ ছাড়াও ৩৫-এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, রাজ্যের কে স্থায়ী বাসিন্দা, আর কে নন, তা নির্ধারণ করতে পারত জম্মু ও কাশ্মির বিধানসভা। স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ কাশ্মীরি জমি কিনতে পারতেন না। এমনকি স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ এই রাজ্যে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না। দিতে পারতেন না ভোটও। রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কোনও নারী বাইরের কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন।

মর্যাদা বিলুপ্তির নেপথ্যে

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যে বিধানসভার শেষ নির্বাচন হয়েছিল। ২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর জম্মু-কাশ্মিরের সেই বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ করে নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্র সরকার। জম্মু-কাশ্মির রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মির ও লাদাখে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতে একাধিক মামলা দাখিল হয়েছিল। এসব মামলায় ওই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। তাদের বক্তব্য, কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে ভারত সরকার যে ভারতভুক্তির চুক্তি করেছিল, সেখানেই বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছিল।

সরকারপক্ষের যুক্তি ছিল, দেশের সংবিধান সভা জম্মু ও কাশ্মীরকে ৩৭০ অনুচ্ছেদে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে সংবিধান প্রণয়নের পর ১৯৫৭ সালে সংবিধান সভা ভেঙে দেয়া হয়। ১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় ৩৭০ অনুচ্ছেদে জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হলেও সেই মর্যাদা স্থায়ী ছিল না, বরং তা ছিল অস্থায়ী। ওই অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে ওই ‘বিশেষ মর্যাদা’ তুলে নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির ওই ক্ষমতাকে ব্যবহার করেই ২০১৯ সালে ‘বিশেষ মর্যাদা’ প্রত্যাহার করে মোদী সরকার। অর্থাৎ নির্দেশনামায় রাষ্ট্রপতি সই করার পরের মুহূর্ত থেকেই রদ হয়ে যায় ৩৭০ ধারা।

বিচারিক প্রক্রিয়া ও রায়

২০২০ সালের মার্চ মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের আসন পুনর্বিন্যাসের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনাপ্রকাশ দেশাইয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে ২০২২ সালের মে মাসে জম্মুতে ৬টি এবং কাশ্মিরে একটি আসন বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

চলতি বছরের ২ জুলাই থেকে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ মামলাগুলো এক করে শুনানি শুরু করেন। শুনানি ১৬ দিন চলার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর বেঞ্চ রায় দান স্থগিত রাখেন। সোমবার সুপ্রিম কোর্ট মামলার রায় দিয়েছেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত সাংবিধানিক দিক থেকে বৈধ। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট এই রাজ্যের জন্য নির্ধারিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ করার যে সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি নিয়েছিলেন, তা অসাংবিধানিক নয়। কারণ, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ ছিল এক অস্থায়ী ব্যবস্থা। ভারতে অন্তর্ভুক্তির সময়েই জম্মু-কাশ্মীর তার সার্বভৌমত্বের অধিকার হারিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এখন থেকে ইতিহাস। যত দ্রুত সম্ভব জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। কত দ্রুত, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট করেননি। তবে রায়ে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন করতে হবে।

সরকার ও বিরোধীরা যা বলছে

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ বিষয়ে সামাজিকমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, এই রায় জম্মু, কাশ্মির এবং লাদাখে আমাদের ভাই ও বোনদের জন্য আশা, অগ্রগতি এবং ঐক্যের একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। আদালতের এই সিদ্ধান্ত আমাদের জাতীয় ঐক্যের মূল ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে; যা প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের সিদ্ধান্ত শুধু একটি আইনি দলিল নয়, এটি একটি বড় আশার আলোও বটে। এটি একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ধারণ করে, সেইসাথে একটি শক্তিশালী এবং অখন্ড ভারত গড়ার জন্য আমাদের সম্মিলিত সংকল্প।

সন্ধ্যায় রাজ্যসভায় জম্মু ও কাশ্মির বিল নিয়ে বিতর্কসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, আমাদের বুঝতে হবে যে ৪২ হাজার লোক মারা গিয়েছেন। কেন মারা গিয়েছেন? বিষয়টা হিন্দু-মুসলিমের নয়। কাশ্মিরের চেয়ে বেশি মুসলিম আছেন গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং আসামে। কিন্তু কেন সেসব জায়গায় বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দেয়নি? কেন সেখানে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দেয়নি? সীমান্তের জন্যও হয়নি। একাধিক এরকম রাজ্য আছে। রাজস্থানের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত আছে। গুজরাটের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত আছে। তাহলে কেন জম্মু ও কাশ্মিরেই সন্ত্রাস ছড়াল? কারণ ৩৭০ ধারা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিদের শক্তি জোগাত। আর বিচ্ছিন্নতাবাদের কারণে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দেয়।

বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, জনবিন্যাস কিংবা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক কারণেই বিধানসভায় জম্মুর জন্য আসন বাড়িয়ে উপত্যকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে বিজেপি। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর সরাসরি এক ধরনের আঘাত। সংবিধানের সঙ্গেও ধোঁকাবাজি করা হয়েছে এর মাধ্যমে।

কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বলেন, আমি হতাশ। তবে আশাহত নই। আমাদের লড়াই জারি থাকবে। বিজেপির এই জায়গায় পৌঁছতে বহু বছর সময় লেগেছে। আমরাও দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।

ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ এই রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন। তিনি বলেন, জম্মু-কাশ্মিরের মানুষ এই রায়ে খুশি নন। তবে আমাদের এটি মেনে নিতে হবে।

তবে লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি জানান, বারবারই তাদের দাবি ছিল কবে জম্মু-কাশ্মিরকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর দ্রুত জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে সেখানে দ্রুত নির্বাচন করানোর ব্যবস্থা করা হোক।

সূত্র- এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //