প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতিক্রিয়া; আইনি লড়াই অব্যাহত রাখার ঘোষণা আব্দুল্লাহর; কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ অস্থায়ী ছিল; আদালত জম্মু -কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পক্ষে; ২০২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে নির্দেশ

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত বৈধ

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আজ (সোমবার) সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার বিষয়ে কেন্দ্রের পদক্ষেপকে বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। একইসঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন আদালত। দেশটির ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় জানিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব জম্মু ও কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো হবে। আর তাই আগামী বছর নির্বাচনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এর আগে ২০১৯ সালে কেন্দ্র সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করে। সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে বিভক্ত করা হয়। পরে সুপ্রিম কোর্টে এই পদক্ষেপের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়। এর আগেও ৩৭০ ধারা বাতিলের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে বহু মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সেগুলো একত্রে এনে সম্প্রতি শুনানি শুরু করেন দেশের শীর্ষ আদালত। সোমবার ঘোষিত রায়ে শীর্ষ আদালত জানিয়েছেন, ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক নয়। এসময় আদালত রাষ্ট্রপতির নেয়া সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে জানিয়েছেন। একইসঙ্গে কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে অবিলম্বে বিধানসভা নির্বাচনের নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আর তা করতে হবে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।

এর আগে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিষয়টি ২০১৯ সালের আগস্টে বাতিল করা হয় ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ। এরপর ওই বিশেষ অঞ্চলকে ভেঙে দুটি ইউনিয়ন টেরিটোরি বানানো হয়। আর কেন্দ্রীয় সরকারের এ উদ্যোগ সাংবিধানিকভাবে বৈধ বলেই রায় দিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারকের বেঞ্চ। 

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন যে জম্মু ও কাশ্মীরকে অন্যান্য রাজ্যের সমকক্ষ করা উচিত "যত তাড়াতাড়ি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব" এবং ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ এর মধ্যে রাজ্যে নির্বাচন করতে হবে।

জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বিরোধ আরও তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছিল সেসময়। চার বছর আগে ওই অনুচ্ছেদ বাতিলের বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করে আবেদনের বিষয়ে দীর্ঘদিন শুনানি হয় আদালতে। পিটিশনকারীদের যুক্তি, কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করতে পারে না।

এ সময় সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন- সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের সুপারিশ কে করতে পারেন। আইন অনুযায়ী, সংবিধানের অস্থায়ী ৩৭০ ধারা বাতিল করতে হলে গঠনতন্ত্র পরিষদের (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) অনাপত্তি প্রয়োজন। আর সেই গঠনতন্ত্র পরিষদ বিলুপ্ত হওয়ার পর কিভাবে এই ধারাটি স্থায়ী হলো, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।  জবাবে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে যুক্তিতে বলা হয়, আইনি কাঠামোর অধীনেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, জম্মু ও কাশ্মীরের মূলধারায় সন্ত্রাসবাদ হ্রাস পেয়েছে। সমান প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বলছে, এর ফলে গত চার বছরে ওই রাজ্যে দ্রুততার সঙ্গে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর অধীনে জম্মু ও কাশ্মীরের অসংখ্য মানুষকে মৌলিক অধিকার বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে আছে শিক্ষার অধিকার। সাংবিধানিক অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারতের প্রতিজন নাগরিকের ওপর যা  প্রযোজ্য। 

প্রধান বিচারপতি বলেন," জে অ্যান্ড কে সাংবিধানিক পরিষদ একটি স্থায়ী সংস্থা হওয়ার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়নি। এটি গঠন করা হয়েছিল শুধুমাত্র সংবিধান প্রণয়নের জন্য। সংবিধান পরিষদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না।" 

আদালত বলেন, রাজ্যটি কেন ভারতের সঙ্গে একীভূত হলে পরেও বিশেষ মর্যাদা ভোগ করবে যেখানে "অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব" নেই রাজ্যটির। 

আদলত জানায়, "যখন সাংবিধানিক পরিষদের অস্তিত্ব রহিত করা হয় তখন যে বিশেষ শর্তের জন্য ৩৭০ ধারা প্রবর্তন করা হয়েছিল সেটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু রাজ্যের পরিস্থিতি এভাবেই রয়ে যায় ও ধারাটি অব্যাহত ছিল। 

"দেশের সমস্ত রাজ্যের আইন প্রণয়ন এবং কার্যনির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে, যদিও তা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়। অনুচ্ছেদ ৩৭১এ থেকে ৩৭১জে বিভিন্ন রাজ্যের জন্য এমনই বিশেষ ব্যবস্থার উদাহরণ। এটি অসমযুক্ত ফেডারেলিজমের উদাহরণ... জম্মু ও কাশ্মীরের আলাদা অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নেই অন্যান্য রাজ্যের মতই’’ বলেও মন্তব্য করেন আদালত।

এসময় পাঁচজনের বেঞ্চ তিনটি পৃথক রায় দেন। প্রধান বিচারপতি তার নিজের মতামত দেন, বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি সূর্য কান্ত; বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কাউল দেন আরেকটি সমন্বিত রায় এবং বিচারপতি সঞ্জীব খান্না অপর দুই রায়ের সাথে একমত হয়ে তার তৃতীয় রায়টি দেন।

বলা হয়, অনুচ্ছেদ ৩৭০ জম্মু ও কাশ্মীরকে তার নিজস্ব সংবিধান এবং প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক বিষয় ব্যতীত সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দিয়েছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ৩৫এ অনুচ্ছেদ পূর্ববর্তী রাষ্ট্রকে সংজ্ঞায়িত করার অনুমতি দেয়ার পাশপাশি কারা সরকারি চাকরি এবং সম্পত্তির মালিকানাসহ স্থায়ী নাগরিকত্ব এবং বিশেষ অধিকার পাবেন সে বিষয়েও বলছে।  

এদিকে ঘোষিত রায়কে স্বাগত জানিয়ে এক্স-এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লিখেন, ৩৭০ ধারা বাতিল ইস্যুতে আজকের সুপ্রিম কোর্টের রায়টি ঐতিহাসিক এবং সাংবিধানিকভাবে ৫ আগস্ট ২০১৯-এ ভারতের সংসদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে; এটি জম্মু, কাশ্মীর এবং লাদাখের আমাদের বোন এবং ভাইদের জন্য আশা, অগ্রগতি এবং ঐক্যের একটি শক্তিশালী ঘোষণা। আদালত, তার গভীর প্রজ্ঞায়, ঐক্যের সারমর্মকে সুদৃঢ় করেছে যে আমরা, ভারতীয় হিসাবে, সব কিছুর উপরে এটিকে লালন করি।

আমি জম্মু, কাশ্মীর এবং লাদাখের সহনশীল জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আপনার স্বপ্ন পূরণে আমাদের অঙ্গীকার অটুট রয়েছে। আমরা নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, এই প্রগতির ফল শুধু আপনার কাছেই পৌঁছাবে না বরং আমাদের সমাজের সবচেয়ে দুর্বল এবং প্রান্তিক অংশের কাছেও তাদের সুবিধা প্রসারিত করবে যারা ৩৭০ ধারার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি লিখেন, আজকের রায় শুধু আইনি রায় নয়; এটি একটি আশার আলো, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি। এই রায় অখণ্ড ভারত গড়ার জন্য আমাদের সম্মিলিত সংকল্পের প্রমাণ৷

অন্যদিকে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও এনসি নেতা ওমর আবদুল্লাহ রায়ের বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘’আমি হতাশ। তবে আশাহত নই। আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। বিজেপির এই জায়গায় পৌঁছতে বহু বছর সময় লেগেছে। আমরাও দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।“

ওদিকে আইনি উপায়েই লড়াই অব্যাহত রাখবেন বলে জানান পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। রায় ঘোষণার আগে তিনি আদালত জনগণের কাতারে থাকবেন বলে আশা প্রকাশ করে মন্তব্য করেন।  

 এদিকে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কাশ্মীর উপত্যকায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা জানিয়েছিল বিজেপি। অন্যদিকে বিরূপ রায় আসলেও নিজের দল শান্তি বিঘ্নিত করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রধান ওমর আবদুল্লাহ। 

সূত্র: এনডিটিভি, আনন্দবাজার অনলাইন 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //