মোদিবিরোধী জোট সমাচার

সংসদীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন কাজে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জোট হয়ে থাকে। জোট কখনো আদর্শিক জায়গা থেকে হয়; আবার কখনো বিশেষ পরিস্থিতিতে, বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থে হয়ে থাকে। ভারতে এখন এমনই এক জোটের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন ধারার দল এক ছাদের তলায় এসেছে সাধারণ প্রতিপক্ষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। 

বছর ঘুরলেই লোকসভা ভোট। ভোটে হ্যাটট্রিক করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। এদিকে বিপক্ষ ‘ইন্ডিয়া’ জোট তাদের তৃতীয় বৈঠকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিজেপিবিরোধী ২৮টি দল মুম্বাইয়ের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে বৈঠকে বসে। এতে যোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, শারদ পাওয়ার, ফারুক আবদুল্লাহ থেকে সোনিয়া গান্ধী, লালু প্রসাদের মতো নেতারা।

‘ইন্ডিয়া’ জোটের দিকে তাকালে বোঝা যাবে দুই ধরনের দল আছে, প্রথমটা হলো কংগ্রেস বা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা দল, আর দ্বিতীয়টা হলো জনতা পার্টির থেকে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। একসময় যে দলকে হারাতে যে দল তৈরি হয়েছিল, আজ তাদেরই মিলনক্ষেত্র এই ইন্ডিয়া জোট। কাজেই এই দুই রাজনৈতিক ধারার প্রকাশ থাকতে হবে লোগো, স্লোগান বা কর্মসূচিতে। বৈঠকের পর বেশ কয়েকটি কমিটি তৈরি হয়েছে, দেশজুড়ে এক প্রচারাভিযানের কর্মসূচি সামনে আসবে, সেই কর্মসূচির জন্যও কমিটি তৈরি হয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে দিল্লিতে জনসভার আয়োজন করা হবে। সেখান থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে জোটের প্রচার। চেষ্টা হচ্ছে, তার মধ্যেই জোটের লোগো চূড়ান্ত করার। 

৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর দুই দিনব্যাপী বৈঠকের শেষ দিনে নেওয়া হয় নানা সিদ্ধান্ত। তবে বৈঠকের মূল ইস্যুই ছিল আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। আসন বণ্টন, প্রচারণা আর নেতৃত্বে কে থাকবেন, তাই নিয়েই চলে ম্যারাথন আলোচনা। অবশেষে ১৪ দলের ১৪ নেতাকে নিয়ে গঠিত হয় সমন্বয় কমিটি। যাদের মূল কাজই হবে আসন বণ্টনের ইস্যুটি সুরাহা করা। ১৪ দলের সমন্বয় কমিটিতে প্রথমে সিপিএম ছিল না। পরে ওই দলের নাম সংযোজিত হয়। বাকি সদস্যরা হলেন- এনসিপির শারদ পাওয়ার, ডিএমকের এম কে স্ট্যালিন, তৃণমূল কংগ্রেসের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেসের কে সি বেণুগোপাল, শিবসেনার (উদ্ধব) সঞ্জয় রাউত, ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওমর আবদুল্লাহ, পিডিপির মেহবুবা মুফতি, আম আদমি পার্টির রাঘব চাড্ডা, আরজেডির তেজস্বী যাদব, জেএমএমের হেমন্ত সোরেন, জেডিইউয়ের লালন সিং, এসপির জাভেদ আলী খান ও সিপিআইয়ের ডি রাজা।

এ প্রসঙ্গে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার বলেন, ‘সরকার এখন বলছে তারা নাকি লোকসভা আর বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে করবে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী আদমশুমারি এখনো করা হয়নি। তার মানে সরকার আমাদের ভয় পেয়ে নির্বাচন এগিয়ে আনতে চাইছে।’ 

বৈঠকে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তাতে বলা হয়েছে, আসন্ন লোকসভা ভোট ইন্ডিয়া জোট যথাসম্ভব জোটবদ্ধ হয়ে লড়বে। সেই লক্ষ্যে দেওয়া-নেওয়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজ্যে আসন সমঝোতা ও ভাগাভাগি অতি দ্রুত চূড়ান্ত করে ফেলা হবে। রাজনৈতিক প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেগুলোর প্রতি জনতাকে সজাগ করে তুলতে সময় নষ্ট না করে রাজ্যে রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটের পক্ষে জনসভার আয়োজন করা হবে। প্রচারের মূল অঙ্গ বা ‘থিম’ ঠিক করা হয়েছে। সেটাই জোটের স্লোগান হবে ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’। এই স্লোগান কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর দেওয়া।

মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধীরে ধীরে এক স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে ভারতে। রাজনীতির এ বিভাজন সংসদীয় দলগুলোর মধ্যেও খুবই স্পষ্ট। একদিকে কিছু দল যারা ভারতের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘু মানুষের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে ঠিক এর বিপরীত। অবশ্যই দুদিকেই এমন অনেক দলও আছে, যারা যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো শিবিরে যেতে পারে। কিন্তু একথা জানার পরও তারা জোটের অংশ। কারণ তারা জোট ছাড়লে তো অন্য জোটের লাভ। ইন্ডিয়া জোটের কেউই চন্দ্রবাবু নাইডু, জগন রেড্ডি, সি চন্দ্রশেখর রাও, নবীন পট্টনায়ক, দেবেগৌড়া, এমনকি মায়াবতীকে নিয়েও কটু কথা বলছেন না। কারণ তারাও জোটের অংশীদার হতে পারেন।

এ জোটের সবচেয়ে বড় অংশীদার ভারতের পুরনোতম দল জাতীয় কংগ্রেস। তাদের অবস্থান ইতিহাসের সর্বনিম্ন তলানিতে এসে ঠেকেছে। এরপর আরও নামলে তাদের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। কাজেই এ জোট নিয়ে তাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। জোট সরকারে তারা প্রধানমন্ত্রীর পদ পেল কিনা, তা নিয়ে তাদের খুব মাথাব্যথা নেই, আপাতত লক্ষ্য দলকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো। জোটের দ্বিতীয় বড় দল আম আদমি পার্টি বা আপ, তাদের মূল ভিত্তি যদিও কংগ্রেসশাসিত রাজ্য; কিন্তু তারা বুঝেছে যে বিজেপি থাকলে তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন। তারা জানে দেশজুড়ে তাদের অস্তিত্ব এখনো তত বড় নয়, যা দিয়ে বিজেপিকে ঠেকানো যাবে। তাদের ন্যূনতম চাহিদা হলো বিজেপিকে ২৪০ থেকে ২৫০-এর নিচে রাখা এবং এই জোটে থেকেই তাদের ছড়িয়ে পড়ার হিসাব তারা কষছে। 

তৃণমূল কংগ্রেসের আপাতত চাহিদা সংখ্যালঘু ভোটকে নিজেদের দিকে রাখা এবং বিভিন্ন এজেন্সির আক্রমণ আটকানো। বিভিন্ন রাজ্যে বেড়ে ওঠার চিন্তা তাদের মাথাতে আছে, তবে সেটি তাদের প্রাধান্যে নেই। তৃণমূলের জন্য জোট জরুরি, এই জোট বিজেপির বিরুদ্ধে, সেই জোটের অন্যতম শরিক তৃণমূল দল- এই তকমা রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের ক্ষয় আটকাবে এবং মোদি সরকারের ক্রমাগত ইডি সিবিআই আক্রমণের মুখে তৃণমূলের এই জোট জরুরি। আরজেডি বা নীতীশ কুমারের সমস্যা টিকে থাকার, দলকে টিকিয়ে রাখার। বিহারের ক্ষমতায় থাকাটা জরুরি, বিজেপির কাছে দুই দলের অস্তিত্ব বিপন্ন সবদিক থেকেই। মহারাষ্ট্রের শারদ পাওয়ার বা উদ্ধব ঠাকরের দল বিজেপি ইতোমধ্যেই ভেঙেছে, জোটে না থাকলে বিকল্প একটাই- বিজেপির জোট এনডিএতে চলে যাওয়া। তবে এনডিএতে গেলে এই দুই দলের স্বাধীন অস্তিত্ব থাকবে না, এটাই এদের জোটে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ।

দক্ষিণের ডিএমকে এই জোটে থাকার মূল কারণ তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এআইডিএমকে এনডিএতে আছে। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি লড়ছে বিজেপির বিরুদ্ধেই, বিরোধী জোটে থাকা তাদের কাছে খানিকটা আনুষ্ঠানিক, তাদের পক্ষে অন্য জোটে যাওয়াটা অসম্ভব। বামপন্থিদের অবশ্য এই জোট থেকে কোনো প্রাপ্তি নেই। কারণ তারা ওই এক ত্রিপুরা ছাড়া কোথাও বিজেপির সঙ্গে লড়ছে না। কেরলায় কংগ্রেসের সঙ্গে, বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে তাদের লড়াই, অন্য কোথাও তাদের তেমন কোনো অবস্থান নেই। মায়াবতী আপাতত একলা চলো নীতি ধরে আছেন। তিনি হয়তো মেপে দেখছেন, এই জোট কতদূর যেতে পারে। তা ছাড়া বেশ কিছু দুর্নীতি মামলায় ইডি, সিবিআই-এর চাপ আছে। কাজেই ঝট করে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। তবে জোট শক্তিশালী হলে তিনি যে এখানে যুক্ত হবেন, তা আঁচ করা যায়। 

দক্ষিণের দেবেগৌড়ার দল জেডিএস, এনডিএতে যাওয়ার কথা বাজারে ভেসে বেড়ালেও শেষ পর্যন্ত এনডিএ দরজা খোলেনি। তারাও ‘ইন্ডিয়া’ জোটে যুক্ত হতে পারেন। অন্ধ্রতে চন্দ্রবাবু নাইডুও এনডিএতে যেতে চান, রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে চান; কিন্তু বিজেপির সমস্যা হলো অন্ধ্রের ক্ষমতায় বসে আছে ওয়াইএসআরসিপির জগন রেড্ডি। বিজেপির প্রায় সব বিলেই রাজ্যসভা, লোকসভায় সঙ্গে থেকেছেন তিনি। রেড্ডির ব্যাপক জনপ্রিয়তার মধ্যে বিরুদ্ধে যাবে না বিজেপি। তবে বিজেপি ঝুলিয়ে রাখায় চন্দ্রবাবুর বিরোধী জোটে আসাটাও ঝুলে আছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //