মণিপুর থেকে নজর ফেরাতেই হরিয়ানায় পরিকল্পিত সহিংসতা

নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হিন্দুত্ববাদের ধারাবাহিক বিদ্বেষ-বিভাজন ভারতের রাজনীতির মূল দিক হয়ে পড়েছে। এমন সব উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও ‘মুজফফরনগর’ বিজেপির হাতছাড়া হয়, কর্নাটক নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে। ফলে এসেছে বুলডোজার-আগ্রাসন, হরিয়ানা মুসলিমবিদ্বেষী বাস্তবতার সাম্প্রতিকতম শিকার। লোকসভা ভোটের আগে এরকম আরও সহিংসতা দেখা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। 

৩১ জুলাই হরিয়ানার মেওয়াত জেলার নুহতে বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সংঘর্ষে দুই হোম গার্ড এবং একজন ধর্মগুরুসহ ৬ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। এছাড়া শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে মুসলিম অধ্যুষিত নুহের বিভিন্ন স্থানে ‘বেআইনি ঝুপড়ি’ উচ্ছেদ শুরু করে প্রশাসন। সেই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বুলডোজার। জেলা পুলিশের দাবি, এসব ঝুপড়ি অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। বসবাসকারীরা অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে চলে আসা মানুষ। নুহ ও গুরুগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় তারা অবৈধভাবে বসবাস করছেন। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে তারাই ধর্মীয় শোভাযাত্রাকারীদের ওপর ইটবৃষ্টি করেছিলেন।

প্রথমে কোনো ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো, তারপর সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসরত মুসলিমদের উচ্ছেদ করা- এটি বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষী আগ্রাসনের একটি ধরন। উত্তর ভারতে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলিমবিরোধী কর্মকাণ্ডে এ বিশেষ ধরন উঠে আসে। 

২০২২ সালের ১১ এপ্রিল মধ্যপ্রদেশের খারগাঁওয়ে বুলডোজার দিয়ে বহু মুসলিমের বাসস্থান ও সম্পত্তি ধ্বংস করেছিল মধ্যপ্রদেশ সরকার। অজুহাত, আগের দিন ১০ এপ্রিল রামনবমীর শোভাযাত্রায় মুসলিমরা নাকি পাথর ছুড়েছিল। একই রকম অজুহাত খাড়া করে গুজরাট ও উত্তরাখণ্ডে বুলডোজার অভিযান চালানো হয়েছিল। ওই বছরের ১৬ এপ্রিল দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতে হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রা চলাকালে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। আর ২০ এপ্রিল উত্তর দিল্লি মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন (বিজেপি পরিচালিত) বুলডোজার নিয়ে সেখানে মসজিদ থেকে মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভাঙতে ছুটেছিল। সবক্ষেত্রেই সরকারের যুক্তি ছিল- ওসব বেআইনি নির্মাণ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কোনো নির্মাণ বেআইনি কিনা সে সম্পর্কে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তার জন্য আদালত আছে।

হরিয়ানায় মুসলিম বস্তি উচ্ছেদে অভিযোগ গুরুতর। এখানে অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। বিরোধী রাজনীতিকদের মতে, সত্যিই যদি সেখানকার বাঙালি মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী সাব্যস্ত করতে হয়, তার জন্য ফরেনার্স অ্যাক্ট আছে, পাসপোর্ট আইন আছে এবং সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আছে। এদিকটা এড়িয়ে যাওয়া সংবিধান লঙ্ঘনেরই নামান্তর। কংগ্রেস নেতা উদিত রাজ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন হরিয়ানা সরকারকে আক্রমণ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, মণিপুর সহিংসতা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে এটা করা হয়েছিল। এজন্যই মেওয়াতের জনগণকে উসকানি দেওয়া হয়েছিল। বিজেপি মণিপুরে একটি পরীক্ষা শুরু করে এবং উত্তর ভারতে পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মেওয়াতকে বেছে নেয়। বিজেপি শুধু মণিপুর থেকে মানুষের মনোযোগ সরাতে চায়। মনু মানেসার অনুষ্ঠানের তিন-চার দিন আগে একটি ভিডিও প্রকাশ করে সহিংসতার উসকানি দিয়েছে বিজেপি। তাছাড়া যদি মিছিল বের করতেই হয়, তাহলে তলোয়ার, লাঠি, ছুরি ব্যবহার করবে কেন? গুরুগ্রামের বাদশাপুরে এক হাজারেরও বেশি বাড়ি রয়েছে। তবে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মাত্র চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছিল। অনিল ভিজ এর আগে বলেছিলেন, যেভাবে টিলা থেকে গুলি চালানো হয়েছিল এবং ভবনগুলোর ছাদে পাথর সংগ্রহ করা হয়েছিল তা নির্দেশ করে যে নুহের সহিংসতা পূর্বপরিকল্পিত ছিল।

হরিয়ানার নুহ ও তাউরুতে যেসব ‘অবৈধ স্থাপনা’ ভাঙা হয়, পুলিশের দাবি সেগুলো তিন বছর ধরে গড়ে উঠেছিল। প্রশ্ন উঠছে, এত বছর প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেয়নি? কেনই বা সংঘর্ষের পর তারা সক্রিয় এবং কেনই বা শুধু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা? যাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা ছড়াল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি। রাজস্থান পুলিশের কাছে ‘ফেরার’ মনু মানেসরকেও হরিয়ানা পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। অথচ ওই ব্যক্তির ভিডিওই উত্তেজনা ছড়িয়েছে ও হিংসায় প্ররোচনা দিয়েছে বলে অভিযোগ।

দিল্লির লাগোয়া গুরুগ্রামেও এই উচ্ছেদ অব্যাহত রয়েছে। তবে সেখানে বুলডোজার ব্যবহারের খবর এখনো নেই। গুরুগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার মুসলিম ঝুপড়িবাসীদের স্থানীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতারা চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই হুকুম মেনে কয়েকশ মুসলিম পরিবার অন্যত্র চলে গেছেন। তাদের অধিকাংশ গুরুগ্রামের অভিজাত হাউজিং সোসাইটিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পুরুষেরা নানা রকম পেশায় যুক্ত       থাকলেও নারীরা বেশিরভাগই সম্ভ্রান্ত পরিবারে গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্ত। দলে দলে গৃহত্যাগের ফলে বিভিন্ন সোসাইটিতে ঘর গেরস্তালির কাজে সংকট দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীর কাজেও লোকাভাব দেখা দিয়েছে। গুরুগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাছ-মাংসের সরবরাহ হয় নুহ থেকে। সংঘর্ষের পর সেই সরবরাহও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে।

গুরুগ্রাম হরিয়ানার প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সংঘর্ষের পর সেখানে সৃষ্টি হয়েছে প্রবল অনিশ্চয়তা। সংঘর্ষের দিন নুহ জেলার পুলিশ সুপার বরুণ সিংলা ছুটিতে ছিলেন। তাকে বদলি করা হয়েছে। দায়িত্বে আনা হয়েছে ভিওয়ানি জেলার পুলিশ কর্তা নরেন্দ্র বিজারনিয়াকে। বেআইনি ঝুপড়ি উচ্ছেদ করছেন তিনিই। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল অভিযোগ করেছে, বিজেপি সামনের লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের উদ্দেশ্যে হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ব্যবহার করতে চাইছে। 

২০১৩ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর জেলায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ঘটেছিল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার পুরো ফায়দা তুলেছিল। সেদিন ছিল নির্বাচনী ফায়দা ওঠানো। কিন্তু আজ স্রেফ নির্বাচন উদ্দেশ্য নয়, পরিকল্পনা প্রসারিত- একটা জনগোষ্ঠীকে দেশের পক্ষে বিপজ্জনক হিসেবে দেখানো। স্বয়ং হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মুসলিমরা আক্রমণকারী এবং তারা বহিরাগত। যারা অনুপ্রবেশকারী, তারাই আক্রমণকারী- এই বিভ্রান্তিকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম পীড়ন ও বিতাড়নকে বৈধতা দিতে চায় হরিয়ানা সরকার। মুসলিমবিরোধী রাজনৈতিক এজেন্ডায় রাষ্ট্রের একাংশ ও বিভেদকামী হিন্দু সংগঠন জড়িত। এভাবে মুসলিম দমন-পীড়ন থেকে হিন্দু মেরুকরণ, একটা মতাদর্শের অধীনেই এটা হওয়া সম্ভব। হিন্দুত্বের রাজনীতি এই ধারাতেই তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //