দূরপ্রাচ্যে ভারতীয় পরিকল্পনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা মস্কো ঘুরে এলেন। সফরে শ্রিংলা রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ২০২০ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক বাতিল হওয়ায় শ্রিংলার সফরের গুরুত্ব ছিল বেশি। 

সফরকালীন আলোচনার বিষয়বস্তুর মাঝে রাশিয়ার সাথে ভারতের কৌশলগত যোগাযোগ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা বিভিন্ন মিডিয়ায় বিশেষভাবে আলোচিত হয়। ভারতের অর্থনীতিভিত্তিক মিডিয়া মিন্ট জানায়, এই সফরের একটি মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘চেন্নাই ভ্লাডিভস্টক ম্যারিটাইম করিডোর’-এর চিন্তাকে আরো এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে দু’দেশের মাঝে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা, যা বর্তমানে ১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলারের মাঝে রয়েছে। 

রুশ পত্রিকা কমারস্যান্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শ্রিংলা জানান, এই ম্যারিটাইম করিডোরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরকে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরই নয়, রাশিয়ার উত্তরের নন্দার্ন সি রুটের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। শ্রিংলা মনে করিয়ে দেন যে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদি ভ্লাডিভস্টকে পুতিনের সাথে আলোচনার সময় রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের বন্দর ভ্লাডিভস্টককে ইউরেশিয়ার সাথে ইন্দোপ্যাসিফিকের যোগসূত্র বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ভিভেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের এক লেখায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অজয় কুমার চতুর্বেদি জানান, চেন্নাই ভ্লাডিভস্টক ম্যারিটাইম করিডোরকে এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে চ্যালেঞ্জ করবে। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সাখালিন দ্বীপে এবং ভিয়েতনামের উপকূলে তেল-গ্যাস প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারত এই কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিচ্ছে। সাখালিনের প্রকল্পে বিনিয়োগের সময় ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা জানায়, রাশিয়ার তেল-গ্যাস নিয়ে ভারত ও চীন প্রতিযোগিতা করছে।

‘সাখালিন-১’ প্রকল্পে ভারত যেমন নতুন নয়, তেমনি ভারত একাও এখানে তেমন শক্তিশালী কোনো বিনিয়োগকারী নয়। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক খবরে বলা হয়, এই প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা হলো মার্কিন কোম্পানি এক্সন মোবিল। ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ নিয়ে তারাই মূলত এই প্রকল্পের অপারেটর। জাপানের সোডেকোর হাতেও রয়েছে ৩০ শতাংশ মালিকানা; ভারতের ওএনজিসির হাতে রয়েছে ২০ শতাংশ মালিকানা; আর রাশিয়ার রজনেফতের হাতে রয়েছে বাকি ২০ শতাংশ। ২০০১ সালে ওএনজিসি ১.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে এই প্রকল্পের ২০ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়। ২০১৭ সালে নতুন করে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ২০৫১ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। 

প্রকল্পের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ১৯৯৬ সালে এখানে তেল-গ্যাসের জন্য ড্রিলিং শুরু হয় এবং ২০০১ সালে আহরণ শুরু হয়। ২০০৪ সালে সাখালিন দ্বীপের খনির সঙ্গে ২৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন যুক্ত করে ‘দে কাস্ত্রি’ নামের টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তেলের জাহাজ ভর্তি করা শুরু হয়। দৈনিক আড়াই লাখ ব্যারেল উৎপাদন সক্ষমতার এই প্রকল্প থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৩৮০টি জাহাজ ভর্তি করে তেল রফতানি করা হয়েছে। টার্মিনালে সাড়ে ছয় লাখ ব্যারেল তেল ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মোট পাঁচটি তেলের জাহাজ এই প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা হয়; যেগুলোর একেকটির ধারণক্ষমতা এক লাখ টন এবং এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে শীতকালে যখন সমুদ্র বরফাচ্ছাদিত থাকবে, তখনো যেন তেল রফতানি করা যায়। এছাড়াও শীতকালে অপারেশন চালাবার জন্য দুটি আইসব্রেকার জাহাজও রাখা হয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে। এভাবে সারাবছর তেলের সরবরাহ নিশ্চিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

‘সাখালিন-১’ এখানে একমাত্র তেল-গ্যাস প্রকল্প নয়। এর পাশেই ‘সাখালিন-২’ প্রকল্প হলো ব্রিটিশ কোম্পানি শেলের তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজি প্রকল্প। কোম্পানির ওয়েবসাইট বলছে, শেলের বিনিয়োগ এখানে সাড়ে ২৭ শতাংশ; রাশিয়ার গাজপ্রমের বিনিয়োগ ৫০ শতাংশ; জাপানের মিতসুই সাড়ে ১২ শতাংশ এবং মিতসুবিশি ১০ শতাংশ। প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টনের বাৎসরিক সক্ষমতার এই প্রকল্পের গ্যাস রফতানি শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। মূলত জাপান, কোরিয়া ও চীন হলো এই প্রকল্পের গ্যাসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। বিশ্বের মোট এলএনজি রফতানির ৪ শতাংশ এই গ্যাসক্ষেত্র থেকেই আসে। এটি পরিষ্কার যে, সাখালিনের দুটি প্রকল্পের মূল বিনিয়োগকারী হলো মার্কিন কোম্পানি এক্সন মোবিল ও ব্রিটিশ কোম্পানি শেল। রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন থাকলেও রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের বরফাচ্ছাদিত এই এলাকায় পশ্চিমা বিনিয়োগের ব্যাপারে কথা হয়েছে খুব কমই। চীনের সীমানার বেশ কাছাকাছি হওয়ায় পশ্চিমাদের জন্য এখানে প্রভাব ধরে রাখাটা রাশিয়ার সাথে শত্রুতার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দূরপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে কার্নেগি মস্কো সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে যত বিনিয়োগ হয়, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই নামে বা বেনামে চীনা বিনিয়োগ। দূরপ্রাচ্যের মার্কিন বন্ধু দেশ জাপান ও কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা একদিকে যেমন চাইছে অত্র অঞ্চলে চীনা প্রভাব কমাতে; অন্যদিকে রাশিয়ার ওপর মার্কিন অবরোধের কারণে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে চীনের সাথে মার্কিন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির কারণে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা রাশিয়াকে চাপের মাঝে রাখার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। রাশিয়াও চাইছে দূরপ্রাচ্যে চীন ছাড়াও অন্যরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসুক। 

কার্নেগির প্রতিবেদনে কয়েকটি পক্ষের চিন্তার সমন্বয় লক্ষ্যণীয়। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে ভারতের বিনিয়োগকে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ভালো চোখে দেখছে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই চাইছে অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ভারত এই ভূরাজনৈতিক খেলায় একজন অংশগ্রহণকারী মাত্র। দূরপ্রাচ্যে নিজস্ব বিনিয়োগ করে পশ্চিমাদের সহায়তা ছাড়া সেটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা ভারতের কতটুকু রয়েছে, তা বিতর্কসাপেক্ষ। 

তেমনি ভারত মহাসাগরেই যেখানে চীনা প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় ‘কোয়াড’ জোটের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে ভারত, সেখানে দূরপ্রাচ্যে চীনা বিনিয়োগকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এজেন্ডা বাস্তবায়ন বাস্তবতার সঙ্গে যায় না; বরং এমন প্রকল্পে অংশ নেয়ার মাধ্যমে নিজেদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //