বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলা

বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলা: ভারতীয় বিচার বিভাগের হিন্দুত্বকরণ

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২, প্রকাশ্য দিবালোকে চার শতাব্দী প্রাচীন ভারতের অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। উপস্থিত ছিল পুলিশ, প্রশাসন ও মিডিয়া। মসজিদ ভাঙার পর শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মারা যায় দুই সহস্রাধিক মানুষ। 

এরপর বহু পট-পরিবর্তনে ভারতের রাজনীতিতে উত্থান ঘটেছে হিন্দুত্ববাদের। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ভারতের শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, ওই ভাঙা মসজিদের জায়গাতে একটি মন্দির নির্মাণ করা হবে। সে অনুযায়ী শিলান্যাসও হয়েছে গত ৫ আগস্ট। এবার মসজিদ ভাঙার রায় প্রদান করেন লক্ষে্ণৗয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত। 

গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিচারক সুরেন্দ্র কুমার যাদবের দেয়া রায়ে বলা হয়, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার যে ছবি আদালতে জমা দেয়া হয়েছে, সেটির কোনো নেগেটিভ পাওয়া যায়নি। আদালতের দাবি, ভিডিও ফুটেজ বিকৃত করা হয়েছে ও স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের কারণেই সেদিন মসজিদ ভাঙা হয়! 

অথচ হামলাকারীরা মসজিদ ভাঙার কথা স্বীকার করেছেন অকপটে। ওই মামলায় ৪৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে ইতোমধ্যেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিংঘল, শিবসেনার বাল ঠাকরে, অযোধ্যার পরমহংস রামচন্দ্র দাসসহ ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, জীবিত আছেন ৩২ জন। ওই রায়ে জীবিতদের সবাইকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।

১৯৯২ সালেই অর্ধশতাধিক এফআইআর হয়। মামলা সিবিআই, সিআইডি হয়ে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের হাতে আসে ১৯৯৩ সালের ২৭ আগস্ট। সে বছরের ৫ অক্টোবর সিবিআই প্রথম চার্জশিট দাখিল করে। অতিরিক্ত চার্জশিট দাখিল করা হয় ৯৬ সালের ১০ জানুয়ারি। এদিকে তৎকালীন পিভি নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস সরকার ঘটনার ১০ দিনের মাথায় মনমোহন সিং লিবারহান নামে এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করে। মোট ৪৮ বার সময় বাড়িয়ে তিনি ২০০৯ সালের ৩০ জুন প্রতিবেদন পেশ করেন। ভারতের ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এ হামলা স্বতঃস্ফূর্তও নয়, অপরিকল্পিতও নয়।’ প্রতিবেদনটি পেশ করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। কমিশনের পেছনে সরকারের খরচ হয় প্রায় ৮০ লাখ রুপি। এতে বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানিসহ ৬৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইর আবেদন গ্রহণ করে এলাহাবাদ কোর্টের আদেশ খারিজ করে জানান, এ ঘটনার মধ্যে ষড়যন্ত্র রয়েছে। পুরো মামলা শুনতে হবে লক্ষে্নৗর নিম্ন আদালতকে। পরে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই বলেন, মামলা শেষ করতে হবে নয় মাসের মধ্যে। এমনকি বিচারপতির অবসরের বয়স এক বছর বাড়ানোর নির্দেশও দেন। 

উল্লেখ্য গত বছর ৯ নভেম্বর বাবরি মসজিদ মামলার চূড়ান্ত রায়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বাবরি মসজিদের জমিতে একটি মন্দির নির্মাণের আদেশ দিয়েছেন। ওই রায় অনুযায়ী, বাবরি মসজিদের ২.৭৭ একর জমি পেয়েছে সরকারি হিন্দু ট্রাস্ট। এর বিপরীতে অযোধ্যার অন্য একটি স্থানে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে ৫ একর জমি বরাদ্দের নির্দেশনা দেয়া হয়।  পাশাপাশি ‘মসজিদ ভাঙা আইন ভাঙার সমতুল্য’ বলেও মত দেন সুপ্রিম কোর্ট। তবে এ মতের কোনো প্রতিফলন বিচারকার্যে অন্তত দেখা যায়নি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, ৩০ সেপ্টেম্বর সিবিআই আদালতে রায় ঘোষণার পরই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলা হয়। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তাৎপর্যপূর্ণ রায়টিকে আমি আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাচ্ছি। এতে প্রমাণ হয়ে গেছে, সেদিন যা হয়েছিল তা পরিকল্পিত ছিল না, কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না। লাখ লাখ দেশবাসীর সাথে আমিও এখন অযোধ্যায় ভব্য রাম মন্দিরের নির্মাণকাজ সমাপ্তির অপেক্ষায় আছি।’ 

হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, রায়ের আগে আদালতের বাইরে অভিযুক্তদের অনেকেই মসজিদ ভাঙার কথা স্বীকার করেছেন। বিজেপি নেতা বেদান্তি জানান, ভগবান রামের জন্য ফাঁসিতে ঝুলতেও রাজি আছেন তিনি। উমা ভারতী বলেন, ‘অযোধ্যা আন্দোলনের অংশ হওয়া আমার জন্য গর্বের বিষয়। কারাগারে যাওয়ার সাজা পেলে আমি জামিন চাইব না।’ 

তৎকালীন শিবসেনার উত্তর ভারতের প্রধান ভগবান গোয়েল জানান, আদালতে তিনি মসজিদ ধ্বংসে নিজের দায় স্বীকার করেছেন। অন্যতম অভিযুক্ত শিবসেনা নেতা পবন পান্ডে বলেন, ‘যদি আমি শাস্তি পাই, তবে এই জন্মকে প্রভু রামের সেবায় সফল মনে করব।’ আরেক অভিযুক্ত আচার্য ধর্মেন্দ্র বলেন, ‘মসজিদ ভাঙা দৈব কাজ।’ অভিযুক্তরা স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন, আদালতে তথ্য-প্রমাণ হাজির; কিন্তু তা গ্রহণে সক্ষম নয় আদালত!

দেশভাগের সময় ভারতে শাসন কাঠামোয় হিন্দুত্ববাদের প্রভাব থাকলেও মতাদর্শ আকারে এটি প্রাধান্যে ছিল না। বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করেই প্রথম হিন্দুত্ববাদ রাজনীতিতে বিশেষ স্থান অর্জন করে। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বাবরি মসজিদকে বৈধ মসজিদ বলেই বিবেচনা করা হতো। হিন্দুরা মসজিদের দেয়ালের বাইরে গিয়ে পূজা করতেন; কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতে মসজিদের ভেতর রামের মূর্তি রেখে আসে হিন্দুত্ববাদীরা। পরদিনই মুসলিমদের মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয়। অযোধ্যার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে কে নায়ার ওই মূর্তি মসজিদ থেকে না সরানোর নির্দেশ দেন। পরে তিনি হিন্দুত্ববাদী জন সংঘ পার্টিতে যুক্ত হন, পার্লামেন্ট সদস্যও নির্বাচিত হন। ১৯৮০-এর দশকে ‘রাম জন্মভূমি আন্দোলন’ পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। এই আন্দোলন হিন্দুত্ববাদকে মূলধারায় নিয়ে আসে এবং কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক বিজেপির দিকে ঝুঁকতে থাকে। ১৯৮৯ সালে হিমাচলের পালমপুর কনভেনশনে বিজেপি প্রস্তাব আনে রাম মন্দির স্থাপনের। সেই মতো ১৯৯০ সালে আদভানি গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে রথযাত্রা শুরু করেন। তার মানে বিজেপির তরফ থেকে সব কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত। আদালতের রায় যা-ই হোক না কেন, এই ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা সুস্পষ্টই ছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আরো মসৃণ হতে যাচ্ছে ক্ষমতা কাঠামোর মতাদর্শ হিসেবে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথ। ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন ভারতীয় মুসলিমরা। সামনের দিনে মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হবে। এই রায়ের ধারাবাহিকতায় অন্যান্য মসজিদ বা মুসলিম শাসনামলের স্থাপনাকে হিন্দুত্ববাদীরা মন্দির বলে দাবি করতে পারে, এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। 

হিন্দুত্ববাদী তাত্ত্বিক সীতারাম গোয়েল ও অরুণ সৌরির লেখা এক বই অনুসারে, কয়েক হাজার মসজিদের ক্ষেত্রে এমন দাবি করা হয়েছে যে, সেখানে আগে মন্দির ছিল। গত বছর বাবরি মসজিদের রায় ঘোষণার পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বারানসি ও মথুরার মসজিদের কথা উল্লেখ করে জানায়, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে এ কাহিনি শেষ হয়নি, বরং শুরু হলো মাত্র।’ 

নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, গত বছর মোদি সরকার ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার বাতিল করে। সেই সঙ্গে রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। বিশেষ অধিকার বাতিলের ফলে এখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চরিত্রে পরিবর্তন আনতে চাইছে বিজেপি। সেই সঙ্গে গত বছর সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব সংশোধন আইন প্রণয়ন করে মোদি সরকার। অথচ এসব মৌলিক সাংবিধানিক পরিবর্তনেও কোনো হেলদোল নেই বিচার বিভাগ, তথা সর্বোচ্চ আদালতের।

পঞ্চাশের দশকে যা শুরু হয় বাবরি মসজিদে মূর্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে; ২০২০ সালে তা পূর্ণতা পায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে মন্দির নির্মাণ ও বিচার বিভাগের হিন্দুত্বকরণের মাধ্যমে। চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বেকারত্ব, মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে মুসলিম বিদ্বেষ সামনে আনা হচ্ছে। 

এর আগে নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়; নির্বাহী বিভাগ, সামরিক বাহিনী এবং মিডিয়াকেও বিজেপি সরকার হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে গড়ে তুলেছে। তবে এবার রাম মন্দির ইস্যুতে কার্যত ভারতের বিচার বিভাগের হিন্দুত্বকরণ নিশ্চিত হলো। এসবের মধ্য দিয়ে মোদি সরকার একদিকে যেমন তার সব সমালোচনা ঢেকে রাখতে তৎপর, তেমনি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল তারা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //