মোদির কাছে কী চায় পশ্চিমা বিশ্ব

পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধ গোটা বিশ্বের জন্য আতঙ্কের বিষয়। বর্তমানে এশিয়ার তিন দেশ নিয়ে শঙ্কিত নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। 

চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান তো আছেই। অন্যদিকে চীন-ভারতের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধের জের গত কয়েক মাসে সহিংসতার রূপ নিয়েছে। 

ভারত-পাকিস্তান ও ভারত-চীন দ্বৈরথ তৃতীয় বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের কপালের বলিরেখা আরো চওড়া করে দিচ্ছে। ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পশ্চিমাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। 

এ পরিস্থিতিতে প্রকৃত অর্থে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে কি চায় পশ্চিমা বিশ্ব? ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সালভাটোর ব্যাবনস।

সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার অলিখিত শর্ত কয়েক দশক ধরে দুই দেশের সেনারাই মেনে আসছিল। তবে হাতাহাতি লড়াইয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে পাথরের মতো অস্ত্র ব্যবহার করেও সেনার মৃত্যু থামানো যায়নি। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। বন্দুকের গুলি ছোড়ার সুযোগ পেয়েছেন সেনারা। তবে গুলি ছোড়া যাবে কেবল বাতাসে। এ নিয়েও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। প্রথম গুলি কে ছুড়েছে- চলছে একে অন্যকে দোষারোপ।

পাকিস্তান ও চীনের নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বড়ই মধুর। প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের চেয়ে তিন গুণ বেশি খরচ করে চীন। সেনাদের জন্য রয়েছে বিপুল প্রযুক্তিগত সুবিধা। তাই পাকিস্তান ও চীনের সাথে দা-কুমড়া সম্পর্কে ভারতের মাথাব্যথাটাই বেশি। লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে বৈরিতা এ সময়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে পাকিস্তানের দিকে নজর রাখতে হচ্ছে ভারতকে। 

অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার। দেশের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্রকেই মূল ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে ভারত। তাই সম্প্রতি ভারতীয় সেনা ও নৌসেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যথাক্রমে অ্যাপাচি ও সি-হক হেলিকপ্টার কেনা হয়েছে। জাপানের সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে মহড়ায় অংশ নিয়েছে ভারতীয় সেনারা। এছাড়া শোনা যাচ্ছে, যদি করোনাভাইরাসের কারণে বাতিল না হয়, তাহলে ভারতের মালাবার উপকূলে বার্ষিক নৌ-মহড়ায় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে যোগ দিতে পারে অস্ট্রেলিয়া। 

ওই নিবন্ধে ব্যাবনস লিখেছেন, চীনের সাথে দ্বন্দ্বে পশ্চিমা সমর্থন পেতে চাইলে মোদিকে তার অবস্থান বা তিনি কি চান তা স্পষ্ট করতে হবে। ২০০৭ সালে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ ব্যবস্থা হিসেবে কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ (কোয়াড) স্থাপন করেছিল অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু এটিকে এখনো বাস্তব রূপ দিতে পারেনি তারা। কোয়াডের কার্যক্রম শুরু করার বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু এক্ষেত্রে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ইস্যু হলো- কোয়াড সমর্থকরা ভারতের বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিতে ভরসা রাখতে পারছেন না। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারসাম্য বজায় রাখতে একসাথে কাজ করা অত্যাবশ্যক। আবার সব দেশেরই নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রাজনীতি রয়েছে। আর পশ্চিমা অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই মোদিকে ‘গণতন্ত্রের অভিশাপ’ হিসেবে দেখে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের চোখে মোদির অবস্থান যা-ই হোক, নিজ দেশে এখনো বেশ জনপ্রিয় তিনি। নির্বাচনী হিসাবে, ভারতের ১৩৫ কোটি জনগণের ৭৮ শতাংশের সমর্থন রয়েছে মোদির। সে বিবেচনায় তিনি সম্ভবত বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তি। 

ভারতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে থেকেই দেশটির অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের কারণে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এখন আরও সঙ্গিন। এর আগে মোদির নোটবন্দি অভিযান ব্যর্থ হয়। এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও ছয় বছরে মোদির জনপ্রিয়তায় কোনো ভাটা পড়েনি। তিনি ও তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে বিবেচিত। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক উদারপন্থী, এমনকি বহুসংখ্যক ইংরেজিভাষী সেক্যুলার ভারতীয় বুদ্ধিজীবীর কাছে ঘৃণার পাত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। এই সমালোকচরা পশ্চিমা নীতি নির্ধারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই মোদি পছন্দ করুন বা না করুন, সমালোচকদের শান্ত রাখতে হবে। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ ভারত, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এটি বিশ্বের ২২তম প্রাচীন গণতন্ত্র। সেইসাথে উন্নয়নশীল বিশ্বের দীর্ঘতম স্থায়ী গণতন্ত্রও বটে। 

তবে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এটিকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের অর্থনীতি সম্পর্কেও তাদের একই অভিমত।

পশ্চিমা বিশ্বের মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যমের মতে, মোদির শাসনে ভারতের গণতন্ত্র বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, ভারতে ৪০ শতাংশ গণতন্ত্র রয়েছে। অথবা এটি নাৎসি জার্মানির পথ অনুসরণ করা একটি ‘ফ্যাসিস্ট গণতন্ত্র’। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, অ্যাডলফ হিটলারের চেয়েও বিপজ্জনক মোদি। অনেকের দাবি, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত জরুরি অবস্থাকালের চেয়েও খারাপ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সে সময় এই জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়েছিল। মোদির বিরুদ্ধে করা সমালোচনাগুলো খুবই জোরালো। এ কারণেই ওয়াশিংটনসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াতে উদগ্রীব ভারত। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের সঙ্গে মোদির ভারতের সম্পর্ক খুবই স্বাচ্ছন্দ্যময়; কিন্তু নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মোদির পক্ষে এ সম্পর্ক বজায় রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে। কারণ কাশ্মীর ও ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন প্রশ্নে জোর সমালোচনা রয়েছে বাইডেনের। এ দুই ঘটনা কেন্দ্র করে গত বছরের শেষ ও চলতি বছরের শুরুতে ভারতের দিল্লিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপও এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একাধিকবার নাগরিকত্ব সংশোধন আইন স্থগিতের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এতে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতকে মুসলিমবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সমালোচকরা। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনুপ্রবেশকারী হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেয়ার স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল। জরিপে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নাগরিকত্ব সংশোধন আইনকে মুসলিমবিরোধী হিসেবে দেখছে। শরণার্থীদের রক্ষার পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপনের বদলে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনটি ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ আইন ব্যবহার করে আসামের প্রায় ২০ লাখ মানুষকে রাষ্ট্রহীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হলে তা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দমন করা হয়, হত্যা করা হয় বহু মুসলমান ও হিন্দুত্ববাদের বিরোধীদের। এসব ঘটনায় পশ্চিমা বিশ্বে মোদির ভাবমূর্তি খর্ব হয়েছে বহুলাংশে। 

পাশাপাশি, গত বছর জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইনটি পাস করে মোদি সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিল। এটিও একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হিসেবে মনে করে পশ্চিমারা। প্রতিটি ক্ষেত্রে মোদি সরকার গৃহীত আনাড়ি ও অনুদারপন্থী পদক্ষেপে পশ্চিমা বিশ্বে মোদির প্রতি সমর্থন কমেছে। সমস্যার একটি অংশ হলো- প্রতিটি পদক্ষেপের দুর্বল বাস্তবায়ন। ভারতের মতো স্বল্পোন্নত দেশে সরকারের নীতিমালা বাস্তবায়নে যথেষ্ট যোগ্য লোক পাওয়া দুষ্কর। মোদি নিজেও এ সমস্যার একটি অংশ। ব্যাবনসের মতে, কিছুটা কম আক্রমণাত্মক ও একটু বেশি উদারপন্থী হলে বিজেপিই বিশ্বমঞ্চে ভারতকে আরও সফল করে তুলতে পারে।

জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতাদের মতো মোদিও প্রতিপক্ষ ও তাদের সমর্থকদের উসকে দিতে আনন্দ পান। অনেক সময় পশ্চিমা মিডিয়াকেও তাদের বিরুদ্ধে উসকে দেন। অনেকে মনে করেন, পশ্চিমাদের নাক গলানোয় ভারতের নির্বাচনে বড় ভোটের ব্যবধানে জয় এসেছে। তবে এতে চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমা বিশ্বের যে সমর্থন প্রয়োজন তা পাওয়া যাবে না। 

ব্যাবনস বলেন, সীমান্তযুদ্ধে চীনের কাছে পরাজিত হলে ভারতের রাজনীতিতে মোদির অবস্থান খর্ব হতে পারে। চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমা রাজনৈতিক সমর্থন পেতে হলে তাকে ক্ষমতা ব্যবহারের কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে। বিজেপি কখনো ধর্মনিরপেক্ষ দল হতে না পারলেও আরও বেশি উদারপন্থী হতে পারে। আর পশ্চিমা সরকারের সমর্থন পেতে এটাই যথেষ্ট।

বেশিরভাগ ভারতীয় আরও বেশি উদারপন্থী মনোভাবের বিজেপিকে দেখতে চান। এতে বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে সাধারণ ভারতীয়দের। নিজেদের দলকে ‘সংস্কারী’ বলে বেশ অহংকার রয়েছে বিজেপির; কিন্তু সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ হলো- কট্টর দলটির স্বার্থেই এটিকে সংস্কার করা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //