শ্রীলঙ্কায় পরিবারতন্ত্রে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের উত্থান

এক ভাই প্রেসিডেন্ট, আরেক ভাই প্রধানমন্ত্রী; সরকারি উচ্চ পদে রয়েছেন ওই পরিবারের আরো কয়েক ডজন প্রতিনিধি।

এরই মধ্যে প্রেসিডেন্টকে অভূতপূর্ব ক্ষমতা প্রদানে সংবিধানে একটি সংশোধনী বিলও এনেছে পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া ক্ষমতাসীন দল। ২০০৫ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান পরিবার হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজাপক্ষে পরিবার। জাতীয় বিমান পরিবহন সংস্থা, বিভিন্ন করপোরেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের বড় পদগুলো রয়েছে এই পরিবারের দখলে। 

জাতীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার নামে উগ্র-জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবার সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঘটাচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।

বিতর্কিত সংশোধনী

মাহিন্দা ও গোতাবায়া রাজাপক্ষে তাদের পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পুরো প্রচারণার সময়টাতেই সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী পরিবর্তনের কথা বলে এসেছেন। মাহিন্দা রাজাপক্ষে পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাওয়ার পর আর দেরি করেননি, দেড় মাসের মধ্যেই সংবিধানে নতুন সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন। 

২২ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে উত্থাপিত বিলটিতে মানবাধিকার ও সরকারি ব্যয়সংক্রান্ত ইস্যুতে আইনি ও পার্লামেন্টীয় জবাবদিহির আওতা থেকে প্রেসিডেন্টকে দায়মুক্তি দেয়া হয়। এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার দেয়া হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি পার্লামেন্ট এক বছর পূর্ণ করার পরই তা বাতিল করার ক্ষমতাও দেয়া হয় প্রেসিডেন্টকে। একইসাথে বিচার বিভাগ, পুলিশ, সিভিল সার্ভিস ও নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাখার বিধানেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে নতুন সংশোধনীতে।

এই সংশোধনী সম্পর্কে বিরোধীদলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা বলেন, ‘এমনটা হলে শ্রীলঙ্কা একটি নির্বাচিত স্বৈরশাসনামলে প্রবেশ করবে।’ পার্লামেন্ট তিনি আরো বলেন, ‘এ বিলটি পাস হলে পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্টের হাতের পুতুল হয়ে পড়বে। আজকের দিনটি আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিন।’

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে ইউএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯তম সংশোধনী আনা হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা অনেকখানি কমিয়ে আনা হয়েছিল। রাজাপক্ষে পরিবারের দাবি, ১৯তম সংশোধনী করা হয়েছে মূলত রাজাপক্ষেদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য। যেমন- প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বয়সসীমা বাড়ানো ও ন্যূনতম বয়স ৩৫ বছর করা হয়েছে। 

২০১৮ সালে ভারত সফরকালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ভারতীয় মিডিয়াকে বলেছিলেন, তার ছেলে নামাল রাজাপক্ষে ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। কিন্তু ১৯তম সংশোধনীর কারণে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার হারান। ওই সংশোধনীতে আরো যোগ করা হয় যে, দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী কেউ পার্লামেন্ট সদস্য হতে পারবে না। এটাকেও রাজাপক্ষে পরিবারকে ঠেকানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার কয়েক মাস আগে মার্কিন নাগরিকত্ব ছাড়তে হয়।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ (২২৫ আসনের মধ্যে ১৫০টি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) মাইলফলক বিজয় পায়। সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে আর তার ভাইদের তৈরি চার বছর বয়সী দলটির এ জয় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সব প্রতিযোগিতাই মুছে দিয়েছে। সাবেক সরকারি দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) পার্লামেন্ট থেকে প্রায় পুরোপুরি মুছে গেছে ও সেখানে তাদের মাত্র একটি রাজনৈতিক আসন রয়েছে, যেখানে আগে ছিল ১০৬টি। 

পার্লামেন্টে বিরোধী দল হিসেবে রয়েছে ইউএনপি থেকে আলাদা হয়ে আসা সামাগি জন বালাবেগায়া (এসজেবি)। তবে এসজেবি সরকারি দলের পরিকল্পনার বিরোধিতা করতে পারবে না বলেই মনে করা হচ্ছে, কারণ পার্লামেন্টে তাদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব নেই। আবার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সাথেও এসজেবির ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সাল থেকে তৎকালীন চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা ও মার্কিনপন্থী প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে রাজনৈতিক সংকট চলছিল। ওই বছর ২৬ অক্টোবর অনেকটা অসাংবিধানিকভাবে বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী করেন সিরিসেনা। তীব্র সাংবিধানিক সংকটের ফলে ১৬ ডিসেম্বর রানিল বিক্রমাসিংহেকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। গত বছর ২১ এপ্রিল গির্জায় সন্ত্রাসী সিরিজ বোমা হামলা রাজনৈতিক সংকট আরো তীব্র করে। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ জন্য ভোটাররা একজন কঠোর শাসক চেয়েছিলেন; আর সে অনুযায়ী প্রচারণা চালিয়ে ক্ষমতায় আসেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তিনি ৫২.২৫ শতাংশ ভোট পান। সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় সব এলাকায় তিনি জয়ী হন।

যুদ্ধাপরাধ ও উগ্র-জাতীয়তাবাদ

১১ বছর আগে তামিল বিদ্রোহীদের নৃশংসভাবে দমন ও কয়েক দশক ধরে চলা রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ অবসানের জন্য শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জনগোষ্ঠীর কাছে দুই ভাই- প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের শেষের দিকে তারা শত শত যুদ্ধাপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। ওই বছর তামিলদের ওপর চালানো গণহত্যায় ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত হন বলে ধারণা করা হয়।

১৯ মে দিনটিকে শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহযুদ্ধ অবসানের দিন হিসেবে স্মরণ করা হয়। তবে তামিলদের কাছে এর আগের দিনটি, অর্থাৎ ১৮ মে গণহত্যা ও পরাজয়ের ‘স্মরণ দিবস’। গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশের মুল্লিভাইক্কাল এলাকায় অর্ধলক্ষাধিক তামিলকে হত্যা করে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী। তখন প্রেসিডেন্ট ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী  ছিলেন যথাক্রমে মাহিন্দা ও গোতাবায়া রাজাপক্ষে।

যুদ্ধ হয়তো শেষ হয়েছে; কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী পপুলিস্ট সরকারের হাতে তামিল সংখ্যালঘুদের বৈষম্যের মাত্রা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে তামিলদের দমনের মাত্রা আরো জোরালো হয়েছে। 

উল্লেখ্য, তামিল সংখ্যাগুরু জেলাগুলোতে যুদ্ধ সমাপ্তির এত বছর পরও সেনা প্রত্যাহার করা হয়নি। শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে উচ্চ মাত্রায় সামরিকায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ১৯টি ডিভিশনের মধ্যে ১৬টিই সেখানে মোতায়েন রয়েছে। তামিল সংখ্যাগুরু জেলাগুলোতে প্রতি তিনজন বেসামরিক ব্যক্তির বিপরীতে একজন সেনা মোতায়েন করা হয়। যুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনীর আকার আরো বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে সেনা সংখ্যা ছিল দুই লাখ, এখন তা হয়েছে চার লাখ। 

২০১৯ সালে এসে শ্রীলঙ্কা সরকার প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে যে, নম্বর প্লেটবিহীন সাদা গাড়িতে যেসব তামিলকে অপহরণ করা হয়েছিল, তাদের কীভাবে কুমিরের মুখে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে ওই ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধের জন্য শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রকে বিচারের আওতায় নেয়া হয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিচার ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য এক ধরনের কৃত্রিম ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ব্যক্ত করে আসছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘন

শ্রীলঙ্কার শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধের ঠিক পর যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। শ্রীলঙ্কার সিংহল প্রধান দক্ষিণাঞ্চলে অবশ্য সামরিক ব্যক্তিদের ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ত্রাতা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই এ প্রচারণা চালানো হয়, যার মধ্য দিয়ে জাতিগত বিদ্বেষ চাঙ্গা রাখা হয়। 

চলতি বছরের মার্চে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে শিশুসহ আট বেসামরিক তামিলকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এক সেনা কর্মকর্তাকে ক্ষমা করে দেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকা মেজর জেনারেল শাভেন্দ্র সিলভা বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় গঠিত টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে পুলিশের সহিংসতাও ঘটছে অহরহ; তামিলদের বিরুদ্ধে যা মাত্রায় অনেক বেশি। গোতাবায়া পুলিশকে নাগরিকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি ও সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। সম্প্রতি কভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার জন্য কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।

তামিল মন্দির ও সেমেট্রিগুলো ধ্বংস করে সেখানে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করা হচ্ছে। সিংহলিদের অভিজাত ও তামিলদেরকে নিম্নতর আখ্যা দিয়ে এমনটা করা হচ্ছে- যে ধারণা শ্রীলঙ্কার সমাজে নিত্যদিনের বাস্তবতা। ইতিমধ্যে পাঠ্য বই থেকে তামিল সভ্যতা ও তামিল রাজাদের ইতিহাস বাদ দেয়া হয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে সিংহলি রাজাদের কীর্তি।

প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগুরু সিংহলি ভোট বিভক্ত হলে ক্ষমতায় আসতে তামিল ও মুসলিমদের সমর্থনের দরকার পড়ত নির্বাচনী দলগুলোর, সেই বাস্তবতা এখন আর নেই। তাই তামিল, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের দমন করে সিংহলিদের প্রাধান্য দিচ্ছে রাজাপক্ষে পরিবার। 

বর্তমান সরকার তাদের প্রচারণায় সুস্পষ্টভাবেই বলেছে, সিংহলিদের ইচ্ছাই প্রাধান্য পাবে ও সিংহলি বৌদ্ধদের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। যার মানে- অঘোষিতভাবে সিংহলিরা সমাজে প্রথম শ্রেণির নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন। আর অন্যরা পরিগণিত হবেন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। 

রাজাপক্ষে ভ্রাতৃদ্বয় এই উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী গণতন্ত্রের আদলে এক নতুন সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিচ্ছেন। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে হয়তো এর রেশ থাকবে বহু বছর ধরে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //