‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতের বিশেষত্ব’, মোদির বার্তা

ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) নিয়ে বিক্ষোভকারী ও বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে যেসব শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে সেগুলোকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তিনি বলেছেন, কংগ্রেস ও তাদের জোটসঙ্গীরা, কিছু আরবান নকশাল, গুজব ছড়াচ্ছে যে, সমস্ত মুসলিমদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। অন্তত আপনাদের শিক্ষার মূল্যায়ন করুন। একবার অন্তত নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জির নিয়ম পড়ুন।

রাজধানী দিল্লি রামলীলা ময়দানে বিজেপির নির্বাচনী জনসভায় ভাষণে মোদি এ কথা বলেন। সেখানে তিনি তুলে ধরেন দলের নতুন স্লোগান, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতের বিশেষত্ব।’

সিএএ ও এনআরসি নিয়ে দেশজোড়া বিক্ষোভের মুখে দাঁড়িয়ে মোদির আশ্বাস, হিন্দু হোক বা মুসলিম, দেশের কোনো নাগরিকের জীবনেই প্রভাব পড়বে না। সেই সঙ্গে উল্লেখ করলেন ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের কাঠামোর কথা। 

বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার বিরোধিতাকারী ভারতের বুদ্ধিজীবীদের ‘আরবান নকশাল’ বলে অভিহিত করেন মোদি। 

এদিন ৯৭ মিনিটের ভাষণে মোদি বলেন, ভারতের ১৩০ কোটি মানুষকে আমি বলতে চাই, ২০১৪ সালে আমার সরকার ক্ষমতার আসার পর থেকে, কোথাও জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) নিয়ে কথা হয়নি। শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর, শুধুমাত্র আসামে তা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে। অনেক নেতা টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, দেশজুড়ে এনআরসি করা হবে, তবে আমি বলতে চাই, কেন আপনারা সেই সমস্ত কথা শুনে নিজেদের মানসিক শক্তি ক্ষয় করছেন, যেগুলো হবে না।

কিন্তু তাহলে কি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অিসিত শাহ মিথ্যা কথা বলেছেন?- প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা কটাক্ষ করে বলেন, সাহেব (নরেন্দ্র মোদি) দিল্লিতে বলেছেন, এনআরসি নিয়ে আলোচনা হয়নি। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে সামঞ্জস্য নেই? দল ও সরকারের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়েছে? নাকি দু’জনে মিলে দেশকে বোকা বানাচ্ছেন? 

তৃণমূলের এক নেতার ব্যাখ্যা, সিএএ ও এনআরসি হচ্ছে বিজেপির যৌথ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী যা-ই বোঝানোর চেষ্টা করুন না কেন, বিজেপি যে এনআরসি গোটা দেশে করবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং দেশবাসীকে কে ভুল বোঝাচ্ছে, তা জলের মতো স্পষ্ট।

এদিকে বিজেপির অভ্যন্তরীণ সূত্রের খবর, অমিত শাহকে আপাতত ক’দিন এনআরসি নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটতে বলা হয়েছে। নাগরিকত্ব আইনের পর এনআরসি সংক্রান্ত পুরনো টুইট মোছাও হচ্ছে। তাই বলে এই নয়, মোদির সঙ্গে অমিত শাহের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আপাতত মোদি নিজেকে সব কিছুর থেকে দূরে রেখে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, যেন কিছুই হয়নি।

দিল্লিতে রবিবারের ভাষণে ভারতের যুব সমাজের প্রতি গুজবে না কান দেয়ার আহ্বান জানিয়ে মোদি বলেন, যেভাবে মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে, তা খুবই দুঃখজনক। কিছু মানুষ এও বলছে যে, নাগরিকত্ব আইন দেশের গরীব মানুষের বিরুদ্ধে। বহু বছর ধরে যে সমস্ত মানুষ ভারতে বাস করছেন তারা নাগরিকত্বের সুযোগ পাবেন এবং কোনো নতুন শরণার্থীকে সুবিধা দেয়া হবে না।

প্রধানমন্ত্রী ভাষণে আবার পরোক্ষে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এখন না হলেও আগামীতে কখনো না কখনো এনআরসি হবেই। বিশেষ করে মুসলিমদের নাম করে বুঝিয়েছেন, তাদের পূর্বপুরুষরা যে এ দেশের (মা ভারতী) সন্তান, এনআরসির সময় তার প্রমাণও দিতে হবে। মোদির দাবি, যিনি ভারতের মাটির মুসলিম, যার পূর্বপুরুষ ‘মা ভারতী’র সন্তান, নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি নিয়ে তার কোনো লেনদেন নেই।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মোদির এই আশ্বাসবাণীর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে অন্য বার্তা। মা ভারতীর সন্তান হলে চিন্তার কারণ নেই ঠিকই। কিন্তু নিজেকে মা ভারতীর সন্তান হিসেবে প্রমাণ করার দায় কিন্তু মুসলিমদের থাকছেই। 

তবে বিজেপির যুক্তি, সে তো হিন্দুদেরও প্রমাণ দিতে হবে। শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে ফারাকটি প্রধামন্ত্রী আজ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন।

১১ ডিসেম্বর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি রাজ্যসভায় পাস হয়, তারপর থেকেই ভারতজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। এই আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ২৪ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে এই সুবিধা পেতে হলে শরণার্থীদের মুসলিম হওয়া চলবে না। ভারতের বিক্ষোভকারীদের আশঙ্কা জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়া হিন্দুরা এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবে। কিন্তু যেসব মুসলিম পুরনো কাগজপত্রের অভাবে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবে না শুধুমাত্র তারাই কোণঠাসা হবে। 

আর আসামসহ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর বিক্ষোভকারীরা বলছেন, এই আইনের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশি হিন্দুরা তাদের এসব রাজ্যে গিয়ে ভিড় জমাবেন। যার ফলে তাদের সংস্কৃতি ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।

আইনটিকে মুসলিমদের প্রতি ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর। এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত সরকারকে আইন সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, এই আইনের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যই হলো বৈষম্য।

ধর্মীয় স্বাধীনতায় আঘাত আসার আশঙ্কার কথা জানিয়ে এই আইনের সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনুরূপ উদ্বেগের কথা বলেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদও। - এনডিটিভি ও আনন্দবাজার পত্রিকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //