দুর্গাপূজা ও ইতিহাসের কালপর্ব

গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে আসে শরৎ। লাল-সাদা শিউলির নয়নকাড়া শোভা, মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুলের দোল, সূর্যের সাথে নীল আকাশে সাদা মেঘের লুকোচুরি, শস্যপূর্ণ শ্যামল প্রান্তর-অপরূপ সাজে সজ্জিত ধরণী। মহালয়ার ভোরে আকাশবাণীতে বীরেন্দ্র কিশোর ভদ্রের সুরেলা কণ্ঠের চণ্ডীপাঠ শোনার পর থেকেই যেন পুজোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তার আমেজে ঘোষিত হয় দেবী দুর্গার আবাহন ও আগমন বার্তা। রাতের শান্ত পৃথিবীতে একটু একটু রুপোলি আলোর ঝরনা ধারায় বইতে থাকে শারদীয় বার্তা।

সময়ের সাথে উল্টায় পঞ্জিকার পাতা, উল্টায় সময়ের গতিধারা। আশ্বিন শুক্লার প্রতিপদ, দ্বিতীয়া,...পঞ্চমী পেরিয়ে আসে ষষ্ঠী। ঢাকির ঢাকে কাঠির ছোঁয়ায় নান্দনিক বাজনা, কাঁসর-ঘণ্টা-শঙ্খের ধ্বনি-হিন্দু সম্প্রদাযের মানুষজনের প্রাণে নতুন স্পন্দন জাগে পূজার ঘনঘটায়। 

সার্বিকভাবে বলতে গেলে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হলো দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত একটি হিন্দু উৎসব। দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব, যার মধ্যে শেষ পাঁচটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। সনাতনী বাঙালির প্রধান উৎসব হওয়ায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড রাজ্যে এবং বাংলাদেশে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। ইদানীং পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালি হিন্দুরাও দুর্গাপূজা পালন করে থাকেন। ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে রাজা জমিদারদের ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আটচালা কেন্দ্রিক পূজাকে সর্বজনের পূজা বা গণমুখী করতে সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। মূলত দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের আকার নেয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দে মাতরম গানটি রচনা করেন, যা ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের এক ভিন্নতর মাত্রা পায়। সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্ন সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন বলে ইতিহাসে বিধৃত হয়েছে। 

দুর্গার এক পরিচয়-তিনি শিবপত্নী। শিবই সর্বভারতীয় প্রধান দেবতা। শিবের ইতিহাস কম বিস্ময়কর নয়। কেননা শিব অনার্য দেবতা, বৈদিক দেবতা নন; ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রমুখ বৈদিক দেবতাকে অপসারণ করে শিবের সর্বভারতীয় দেবতায় মর্যাদা লাভ যেন ভারতীয় অনার্য ভূমিপুত্রদের বিজয়েরই প্রতীক। শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে পার্বতী উমা গঙ্গা দুর্গা ও কালীকে। শিবের পুত্র-গণেশ ও কার্তিক। কন্যা-মনসা ও লক্ষ্মী। দেবী দুর্গার অতি পরিচিত এই প্রতিমাটির ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। তবে এ ব্যাখ্যা বাংলার নয়, যদিও ব্যাখ্যাটি বাংলায় গৃহীত হয়েছে... ব্যাখ্যাটি পৌরাণিক আর্যদের... একবার মহিষাসুরের (মহিষ+অসুর=মহিষাসুর) ধারণা হলো কোনো দেবতা তাকে বধ করতে পারবে না; এই অহংকারে মহিষাসুর দেবতা ইন্দ্রকে সতর্ক করে দেয় যে সে স্বর্গ জয় করে নেবে। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ইন্দ্র ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণুর আশ্রয় নেয়। দেবতারা ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন এবং তাদের পবিত্র দেহ থেকে স্বর্গীয় সুষমায় আচ্ছন্ন অপূর্ব সুন্দরী এক নারীর জন্ম হয়। ইনিই দুর্গা! একজন দেবতা দুর্গাকে অস্ত্র দিলেন, অন্যজন দিলেন বাহন... সিংহ, অন্যজন মদ। এরপর যুদ্ধে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। 

পৌরাণিক আর্যদের ব্যাখ্যায় দুর্গা কিছুটা উগ্র, স্বাধীন ও কারও স্ত্রী নন। সুপ্রাচীনকালে বাংলায়, আজ আমরা মণ্ডপে মণ্ডপে যেভাবে দুর্গাপূজা দেখছি ঠিক সেভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না-এই হলো পণ্ডিতদের অভিমত। (দ্র. ড. আর. এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু; পৃষ্ঠা, ৮২) ... 

বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন দ্বাদশ শতক থেকে। দুর্গাপূজার বিধান সংবলিত রঘুনন্দনের (১৫০০/১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজাতত্ত্ব’ গ্রন্থটি রচিত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। রঘুনন্দন ভট্টাচার্য নবদ্বীপের বিশিষ্ট তান্ত্রিক পণ্ডিত ছিলেন। মনে রাখতে হবে, বাংলার হিন্দুধর্মটি হলো তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম। তন্ত্র হলো বেদবিরোধী এবং সাধনার বিষয়। যে কারণে বাঙালি তান্ত্রিকেরা দুর্গাকে পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর পৌরাণিক আর্যদের মতে দুর্গা ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু কর্তৃক সৃষ্ট দেবী। বাংলা ভাষা যেমন সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও নিজস্ব স্বরূপের জন্য সদাসর্বদা সংগ্রাম করে চলেছে, বাংলার হিন্দুধর্মও ঠিক সেরকমই তার স্থানীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য সদাসর্বদা বৈদিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। এ কারণেই ভারতবর্ষের পশ্চিমের আর্যপ্রভাবিত অঞ্চলে শিব ও দুর্গার পুত্র গণেশপূজার চল থাকলেও (তান্ত্রিক) দুর্গাপূজার চল নেই।

পূজার উপচারগুলোর মধ্যে প্রধান হলো ষষ্ঠীর অঙ্গানুষ্ঠান কল্পারম্ভ, বোধন, অধিবাস ও আমন্ত্রণ। কল্পারম্ভের মধ্য দিয়ে পূজানুষ্ঠানের সূচনা। শাস্ত্রমতে, সাতটি কল্পে (প্রকারে) করা যায় দুর্গাপূজা। স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন কল্পে পূজার অনুষ্ঠান লক্ষণীয়। তবে আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত বিহিত পূজা (৩য় কল্প) বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে যে কোনো বিশেষ কাজ শুরুর আগে তার সফল সমাপ্তির জন্য সঙ্কল্প করে থাকি আমরা। দুর্গাপূজার শুরুতেও সেরকম। পূজার উদ্দেশ্য কী? দেবতাকে প্রসন্ন করা, তার প্রীতিকামনা। দেবতার প্রসন্নতাতেই লাভ হয় পূজারির প্রত্যাশিত ফল। পূজার উদ্দেশ্য ও বিরাট বিশ্বপ্রকৃতির (মাস, পক্ষ, তিথি ইত্যাদি) সাথে পূজকের নিত্য সম্বন্ধ স্মরণ করিয়ে পূজককে মহানভাবে ভাবিত করাও সংকল্পের অন্যতম বিষয়। সংকল্প মন্ত্রে তদনুরূপ চিন্তন রয়েছে। ষষ্ঠীতে প্রাতঃকালে করা হয় কল্পারম্ভের অনুষ্ঠান। পূজামণ্ডপে ঘট স্থাপন, দেবী দুর্গা ও শ্রীশ্রীচণ্ডী ষোড়শোপচারে পূজা এবং চণ্ডী পাঠ কল্পারম্ভের অন্তর্গত অন্যতম অঙ্গানুষ্ঠান। 

প্রতিমায় প্রত্যক্ষ যে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী-শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাদেবীরই প্রতিরূপ। শাস্ত্র ও আচার্যগণ দ্বারা বর্ণিত সত্যকে জীবনে উপলব্ধির জন্যই দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। দেবী দুর্গাকে বলা হয় অসুর বিনাশিনী মানে অশুভ তাড়িনী ভগবতী দুর্গা। দুর্গা নামের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-ভগ মানে ঐশ্বর্য। তাই ভগবতী মানে ঐশ্বর্যশালিনী। ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি ঐশ্বর্যর নাম ‘ভগ’। এই ছয়টিই মা-দুর্গার মধ্যে পূর্ণ মহিমায় বিরাজিত। 

আবার তিনি ‘মহামায়া’। দেবতারা যখন অসুরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ, তখন সব দেবতার মিলিত শক্তিই দুর্গা। সনাতন ধর্মের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-দেবতাদের অনুরোধে দুর্গম অসুরকে বধ করেন বলেই তিনি দুর্গা নামে অভিহিত হন। দুর্গাপূজার শুরুর অংশকে ‘বোধন’ বলা হয়। ‘বোধন’ মানে জাগরণ বা চেতন করে তোলা। সনাতন ধর্মেও দেবী দুর্গা সাধারণের কাছে দেবী দুর্গা, মহামায়া, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, শ্রী চণ্ডী প্রভৃতি নামে পরিচিত। দেবী দুর্গা শত্রু বিনাশে যেমন ভয়ঙ্করী আবার তার ভক্তদের কাছে তিনি স্নেহময়ী জননী, কল্যাণ প্রদায়িনী। 

মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরথ খ্রিষ্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) দুর্গাপূজা প্রচলন করেছিলেন। শাস্ত্রীয় পরিচয়ে তিনি শিবের স্ত্রী, কার্তিক ও গণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলোতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয় দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলোর (দুর্গাপূজা) অধিষ্ঠাত্রী।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়,পরিব্রাজক, বৌদ্ধ পণ্ডিত হিউয়েন সাঙকে নিয়ে দুর্গাপূজার একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। চীনা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের মূল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে ৬৩০ সালে ভারত সফরে আসেন। ভারতবর্ষের নানা বিহারে বিদ্যা অর্জন করেন। ৬৩৫-৬৪৩ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি হর্ষবর্ধনের রাজসভায় ছিলেন। তবে তার কাহিনি দুর্গা, কালী, কালীর আরেক রূপ চণ্ডী নাকি বনদেবীকে নিয়ে-সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে তার রচনায় উল্লেখ করেছেন, হর্ষবর্ধনের সময়ে দস্যু তস্করের উপদ্রব খুব বেশি ছিল এবং তিনি নিজেও একাধিক বার দস্যুর হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন। এই অসুর তৎকালীন তস্কর কিনা এটাও ভাবা যেতে পারে। 

শারদীয়া দুর্গাপূজাকে ‘অকালবোধন’ বলা হয়। কালিকা পুরাণ ও ব্রহ্মবর্র্ত পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাদের পূজার যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে এই পূজার নাম হয় ‘অকালবোধন’। এই দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনি অনুসারে, হিন্দু ধর্মের অবতার রামচন্দ্র স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। তবে রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মীকি মুনি রামায়ণে রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কোনো কিছু উল্লেখ করেননি। উপরন্তু রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। রামায়ণের অনুবাদক হংস নারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, ‘অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।’ সনাতম ধর্মে দেবী দুর্গার আবাহন ও পূজার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃত মন্ত্রগুলো। দুর্গাপূজার মন্ত্রগুলো সাধারণত শ্রী শ্রী চণ্ডী থেকে পাঠ করা হয়। 

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গাপূজার প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয় বার দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দুর্গাপূজার আয়োজন করেন মহাদেব। মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দুর্গাপূজার কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব আছে। সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গাপূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাক্ষসরাজ রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রাম চন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০১টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে দুর্গাপূজা করে তার কৃপা লাভ করেন। তবে দুর্গাপূজার সবচেয়ে বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণে। এই পুরাণের মধ্যে তেরোটি অধ্যায় দেবীমহাত্ম্যম নামে পরিচিত। মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। 

ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। ১১শ বা ১২শ শতক থেকে এখানে কালীপূজার সাথে দুর্গাপূজাও হতো। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। তবে দুর্গাপূজা কবে কোথায় প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইতিহাসের আলোকে দেখা যায় কারও মতে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দুর্গাপূজা করেন। আবার কারও মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংস নারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন। 

১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গাপূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার সুবর্ণ রায় চৌধুরী সপরিবারে দুর্গাপূজা চালু করেন। ১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরের শারদীয় পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আক্রমণে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংস হওয়ার পর সেখানে কোনো উৎসব আয়োজনের অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নব কৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। আধুনিক দুর্গাপূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ শতকে নানা বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসায়ী, রাজদরবারের রাজকর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল। ১৮ শতকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে দুর্গাপূজা হতো। পাটনাতে ১৮০৯ সালে দুর্গাপূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। উড়িষ্যা (ওডিশা) রামেশ্বরপুরে একই স্থানে চারশ বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। বর্তমানে দুর্গাপূজা দুইভাবে হয়ে থাকে-ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে; পাড়ায় যৌথভাবে সনাতন ধর্মাববলম্বীরা বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, চিরবিধবাসহ নানা অবিচারে নারীরা ছিল নিপীড়িত। চিরকুমার বিবেকানন্দ নারীকে দেবীর আসনে সম্মানিত করার জন্যই হয়তো অষ্টমী পূজার দিন ‘কুমারী পূজার’ পুনঃপ্রচলন করেছিলেন। ১৯০১ সালের পর প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে।

রাজশাহীর তাহেরপুরের পূজা 

প্রায় ৫০০ বছর আগে দুর্গোৎসবের প্রথম প্রচলন করেছিলেন রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায়। তারপর থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। তবে দুর্গোৎসবের সূচনা করলেও সেই পুণ্যভূমি এখনো অনেকটাই অবহেলায় রয়েছে। দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পায়নি জাতীয় স্বীকৃতি। অবশ্য তাহেরপুরের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এ বছরও সেখানে দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, রাজা কংস নারায়ণের মন্দির বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। রাজা কংস নারায়ণ রায় বাহাদুর ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে (৮৮৭ বঙ্গাব্দ) এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, অসুরের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং এরপর থেকে এ উপমহাদেশে সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরু। তাহিরপুর রাজবংশ বাংলাদেশের প্রাচীন রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে জায়গাটি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার একটি পৌরসভা। তবে কালক্রমে ‘তাহিরপুর’ নামটি তাহেরপুর বলে উচ্চারিত হচ্ছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজা কংস নারায়ণ সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রবর্তন করেন। উৎসবটি হয়েছিল বারনই নদের পূর্বতীরে রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে। আজও বাঙালির সর্বজনীন দুর্গোৎসবে সেই পদ্ধতিই অনুসৃত হচ্ছে। তবে কংস নারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ লক্ষ্মী নারায়ণের সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছোট ভাই বাংলার সুবেদার শাহ সুজা বারনই নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজা কংসের প্রাসাদ ধ্বংস করে দিয়ে যান। পরে অবশ্য লক্ষ্মী নারায়ণ আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় নদীর পশ্চিম তীরে একটি পরগনা লাভ করেন। সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করে রাজত্ব করেন। ১৮৬২ সালে রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী রানী জয় সুন্দরী রাজবাড়ির সঙ্গে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের নামফলকটি বর্তমানে রাজশাহীতে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিবশেখরেশ্বর। তার বাবা শশী শেখরেশ্বরের সময় থেকে রাজারা কলকাতায় গিয়ে থাকতেন। শুধু পূজার সময় আসতেন। ১৯২৭ সালে শেষবারের মতো তাহেরপুরে এসেছিলেন। এরপর তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়। একপর্যায়ে রাজবাড়ির এই মন্দির প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িতে কলেজ করা হয়। রাজবাড়ির ভেতর থেকে মন্দিরে যাওয়ার ফটকটিও এক সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। শ্রী শ্রী দুর্গামাতার মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক চিরঞ্জীব রায় জানান, দেশভাগের পর ১৯৬২ সাল থেকে মন্দিরে দুর্গাপূজা বন্ধ হয়। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়ীতে কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কলেজের ভেতর নেওয়া হয় দুর্গামন্দিরকে। মাঝখানে প্রায় ৬০ বছর মন্দিরে দুর্গাপূজা বন্ধ থাকার পর ২০১২ সাল থেকে মন্দির সংস্কার করে আবার সেখানে দুর্গাপূজার উৎসব শুরু হয়। ২০১৮ সালে মন্দিরে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অষ্টধাতুর প্রতিমা দেন স্থানীয় সাংসদ। উপমহাদেশে এ মন্দিরের মাধ্যমে দুর্গোৎসবের প্রচলন শুরু হলেও এখনো এর জাতীয় স্বীকৃতি মেলেনি। অনেকটাই অবহেলা অনাদরে রয়েছে মন্দিরটি। 

(তাহেরপুরের ছবি ও তথ্য : এস এম আরিফুল ইসলাম)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //