এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২১ পিএম
গাজন বাংলা বছরের শেষ উৎসব। ছবি: সংগৃহীত
বাঙালি মানে বারো মাসে তেরো পার্বণ। চৈত্র শেষের আলোয় রাঙে গাজন। বাংলার লোকসংস্কৃতির এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় উৎসব গাজন। নীল ও চড়ক পূজা গাজন উৎসবের অঙ্গ। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র মাসে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের প্রিয় বাংলা সে-তো উৎসবের বাংলা। বাঙালি সমাজে সংস্কৃতি আর ধর্মের মেলবন্ধনে বছরজুড়ে চলে নানা উৎসব অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখের আগে চৈত্র সংক্রান্তির সময় অনুষ্ঠিত হয় গাজন উৎসব। গাজন বাংলা বছরের শেষ উৎসব।
কেউ কেউ মনে করেন গাজন বা চড়ক মানে শুধুই শিবের আরাধনা; কিন্তু শুধু শিবকে কেন্দ্র করেই নয়, গাজন উৎসব পালিত হয় ধর্মরাজকে ঘিরেও। আর দুই দেবতার পূজাতেই জাতপাতের ভেদাভেদ ভেঙে যে কেউ অংশ নিতে পারে।
গাজন শব্দটি এসেছে ‘গর্জন’ থেকে। অনেকে বলেন, সন্ন্যাসীদের হুঙ্কারই শিবসাধনায় গাজন নামে প্রচলিত হয়। বাংলার মঙ্গলকাব্যেও গাজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধর্মমঙ্গল কাব্যে রানি রঞ্জাবতী ধর্মকে তুষ্ট করতে গাজন পালন করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। পুরাণেও রয়েছে গাজনের উল্লেখ। গাজন উৎসব আগের মতো না হলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এখনো। গ্রামবাংলায় তো বটেই শহরাঞ্চলে এখনো গাজনের ছবি দেখা যায়। চৈত্র মাসের শুরু থেকেই ধ্বনিত হয়, ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে।’ গৃহীরাই সন্ন্যাস নেন। সারাদিন সন্ন্যাসীর পথে পথে ঘুরে ভিক্ষা করেন। দিনভর উপবাসের পরে ভিক্ষায় মেলা চাল, সবজি রান্না করে খান। বিভিন্ন জায়গায় বা বিভিন্ন অঞ্চলে গাজনের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য দেখা যায়। কোথাও মুখোশ নৃত্য, কোথাও প্রতীকী শিবচিহ্ন মাথায় নিয়ে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে পথ পরিক্রমা করেন ব্রতধারী সন্ন্যসীরা। গাজন উৎসবের অংশ হিসেবেই পরের দিন পালিত হয় নীল পূজা। সনাতন সংস্কৃতি মেনে সন্তানের মঙ্গল কামনায় গাজন সন্ন্যাসীদের ফল, আতপচাল, ও অর্থ দান করেন মায়েরা। অনেকে গোটা দিন উপবাস করে শিবের পূজা দেন। কেউ দিনের শেষে সাবু খান, কেউ রুটি, লুচি। তবে ভাত নয়। চৈত্রের একেবারে শেষ দিনে উদযাপিত হয় চড়ক। গাজনতলায় হয় চড়কগাছের পূজা। চড়কগাছ মানে একটি লম্বা কাঠের দণ্ড। তার উপর অনেকটা উঁচুতে আংটায় ঝুলে থাকা সন্ন্যাসী ক্রমাগত ঘুরপাক খান। এ দৃশ্য নিয়মিত গ্রামে তো দেখা যায়।
নানা লোককথা রয়েছে গাজন নিয়ে। শোনা যায়, শিবভক্ত বান রাজা ইষ্ট দেবতাকে তুষ্ট করতে কঠিন কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে তপস্যা করেন। সেই সূত্র ধরেই চড়কের শিবভক্ত সন্ন্যাসীরা আজও বান ফোঁড়ান, নানা ধরনের ঝাঁপ দেন। থাকে নানা অদ্ভুত আচার। জীবনের ঝুঁকিও নেন সন্ন্যাসীরা। ব্রিটিশ আমলে এই প্রথাকে অমানবিক আখ্যা দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টাও হয়। এর পরে বানের বদলে পিঠে গামছা বেঁধে চড়কে পাক খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়। এখন সেটাই বেশি প্রচলিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাজনের উৎসবে অনেক বদল এসেছে। তবে অতীতের মতো এখনো গাজন মানে সব স্তরের মানুষের উৎসব। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। বাংলা বছরের শেষ দিনে বাংলার চৈত্র সংক্রান্তির দিন শিবের পূজার পাশাপাশি শিব-গৌরীর বিয়ে, কালীর উন্মাদ নৃত্য প্রদর্শন করা হয় গাজন উৎসবে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন গাজন উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও গোটা বৈশাখ মাসজুড়ে বসে মেলা। লোকসংস্কৃতির প্রাচীন উৎসব হিসেবে গাজন উৎসব আজও টিকে আছে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হিসেবে।