স্কটল্যান্ডের মহাকাব্যিক আগুন উৎসব

জাফর খান

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৪, ০২:১৯ পিএম

স্কটল্যান্ডের মহাকাব্যিক আগুন উৎসব উদযাপনের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

স্কটল্যান্ডের মহাকাব্যিক আগুন উৎসব উদযাপনের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

তখন সকাল ৮টা। সূর্যোদয়ের কিছুবাদেই স্কটল্যান্ডের শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী ল্যারউইকের জানুয়ারির দীর্ঘরাতের কোণগুলোকে কেবলমাত্র লাল করতে শুরু করেছে সূর্য। এরমধ্যেই একদল পুরুষ হুইস্কি, আতশবাজির মধ্যদিয়ে দিনটিকে উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। হাড়-ঠাণ্ডা বাতাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছে দ্বীপবাসী। বিশাল হ্যাঙ্গার-সদৃশ একটি শেডের দরজার পিছনে হৈ হুল্লোড়ে মাতোয়ারা হয়ে সবাই জড়ো হয়েছেন। ৩০ ফুটের এক বিশাল কাঠের জাহাজাকৃতির ড্রাগন নকশা সমৃদ্ধ হিমবাহী নীল রঙের আঁকা কাঠের এই বাহনটির সামনে সবাই সমবেত হয়ে উৎসবের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। স্থানীয়দের ভাষায় এটিকে বলা হয় গ্যালি, যা কিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পোড়ানো হবে এই রাতে।  শীতকাল শেষে আবারও সূর্যের আলো ঝলমলে দিনের দেখা পাবার প্রত্যাশায় ‘আপ হেলিয়া অ্যা’-তে উৎসব পালন করে থাকেন এলাকাবাসী। আর এটি শেটল্যান্ডের গর্বিত নর্স ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখানোর বিরল উৎসব বলে কথিত রয়েছে।

চারপাশ থেকে শতশত পায়ের পদচারণা, ইস্পাতের ঝনঝন শব্দ, ড্রামের আওয়াজ, জোরে জোরে যুদ্ধের চিৎকারের সাথে বিম্বিত ভাইকিংদের একটি দল, (জার্ল স্কোয়াড নামে পরিচিত) খেলোয়াড়গণ এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। আর তাদের দিন কাটবে জমকালো ফিরোজা রঙের  পোশাকে। একইসঙ্গে ভাইকিং সাজে ডানাওয়ালা হেলমেট, কুড়াল এবং ঢাল পরিহিত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে নর্স গান গাইতে গাইতে ছবির জন্য পোজ দেওয়া, খাওয়া, পান আর আনন্দের মধ্যদিয়ে কাটাবে দিনটিকে। মজার বিষয় হলো এই স্কোয়াডের নেতা ১৫ বছর আগে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। যিনি সকলের কাছে "গুইজার জার্ল" নামে পরিচিত। এদিন তিনি ঐতিহাসিক একজন ভাইকিং হিসাবে পোশাক পরিধান করেন। ইতিহাস বলে এই উৎসবের জন্য শ্মশ্রুমণ্ডিত রিচার্ড মোয়ার, হ্যারাল্ডার ওলাফসনকে একদা বেছে নিয়েছিলেন, যিনি ১২৪৮ সালে শেটল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে একটি জাহাজ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।

আর এবার ২০২৪ সালে ভাইকিং সংস্কৃতিতে ২১ শতকের মধ্যে এবারেই প্রথম মহিলা এবং মেয়েদেরকে এই জার্ল স্কোয়াডের সদস্য হিসাবে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। 

"এটি আমাদের জন্য সত্যিই এক নতুন বছর, আমরা খুব বেশি ‘হগমানয়ে (একটি স্থান)’ যাই না," বলছিলেন লায়ল গাইর নামক ভাইকিং উৎসবের আরেক সদস্য যিনি কিনা ২০১৭ সালে গুইজার জার্ল এর হয়ে মিছিলের জন্য মার্শাল প্রস্তুতে সহায়তা করেছিলেন৷ 

"প্রতি বছর গ্যালি পোড়ানো এবং একটি নতুন কিছু তৈরি করাই নতুন করে শুরু করার প্রতীক হিসেবে আমাদের কাছে বিবেচ্য হয়। তবে এটিও আপনাকে প্রচণ্ড শীতের মধ্যেই করতে হবে- এটি আমাদের কাছে সত্যি করার মতো একটা কিছু!" জার্ল স্কোয়াডের পোশাকের মতোই গ্যালিও সম্পূর্ণরূপে স্থানীয়দের দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে। অপেশাদার একদল মানুষ অক্টোবর থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এ কাজটি করে থাকেন আনন্দিত হয়ে। গাইর বলেন, "এটি আমাদের শীতের সমাপ্তি চিহ্নিত করার একটি দিন, তবে এটি কখনই পুরোপুরি করতে পারি না।" "সুতরাং, আমরা শুধু পোড়াই, পোড়াই আর পোড়াই।" ‘আপ হেলি অ্যা’ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের শক্তিশালী নর্ডিক গোষ্ঠীর রীতিনীতির প্রভাব সম্পন্ন একটি স্থান। এটি নরওয়ের ২০০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। ১৪২৭ সাল পর্যন্ত নরওয়ে রাজ্যের অংশ ছিল এ স্থানটি। এটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সাংস্কৃতিক সত্ত্বার সঙ্গেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সহাবস্থান করে আসছে। 

নরওয়ের মতো শেটল্যান্ডের লোকসংগীত স্কটল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডের মতোই সর্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। এসব লোকগীতি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নানা ট্রলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু দুষ্টু প্রাণীদের সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে থাকে। মিথ রয়েছে, দ্বীপবাসীদের এজন্য বাঁশির সুর শিখতে হয়েছিল একদা। রাজা হ্যারাল্ড, সেন্ট ওলাফ এবং কিং হাকনের নামানুসারে ল্যারউইক শহরের মূল কেন্দ্রে (পপ: ৭০০০) অসংখ্য রাস্তার নামকরণ করা রয়েছে। ধূসর বেলেপাথরের ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে আঁকা নানান রঙিন নকশা। এগুলো কাঠ বা ঢেউতোলা ইস্পাতের ধাতু দিয়ে তৈরি,যা অনেকটা দেখতে আইসল্যান্ডে অবস্থিত মাছ ধরার কুঁড়েঘরের মতো।

আর শহরের বাইরের রাস্তায় ইংরেজি ও পুরানো নর্স ভাষায় নানা চিহ্নের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানের নামের উল্লেখ রয়েছে। আমি ভিনসগর্থ গ্রামের বাসিন্দ ছিলাম। প্রতিবেশী গ্রামটিকে বলা হয়ে থাকে টিংওয়াল (Þingvǫllr বা পার্লামেন্ট ফিল্ড), আর এটির অনুবাদিত নাম-আইসল্যান্ডীয় সাইট যা বিশ্বের প্রাচীনতম পার্লামেন্টের স্থানের সাথে তুলনা করা হয়েছে। টিংওয়ালে (১৩ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে) শেটল্যান্ডের প্রথম সংসদ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শেটল্যান্ডের প্রধান পূর্বপুরুষরা হলেন স্কটস এবং নর্ন। আর ভাষা হিসেবে ওল্ড নর্স থেকে উদ্ভূত (বিলুপ্ত) ভাষা ব্যবহার করতেন তারা, যেটির শেষ বক্তা ১৮৫০ সালে মারা গিয়েছিলেন। অবশ্য শেটল্যান্ডে এখনও নর্ডিক উৎস হতে গৃহীত এমন কিছু শব্দ এখন অবধি শোনা যায়। যেমন- ফিলস্কেট, যার অর্থ "দুষ্টু উচ্চতর আধ্যাত্মিক শক্তি"; du অর্থ "তুমি"; এবং dat অর্থ "সেই"।

গত ২০০ বছরে ইংরেজদের উত্থানের সময় শেটল্যান্ডকে কলঙ্কিত করা হয়েছিল। বলা হতো স্কুল কিংবা এবং আনুষ্ঠানিক বা দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য শেটল্যান্ডারদের এ ভাষা অঅনুপযুক্ত। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত শেটল্যান্ডের বাসিন্দারা ইংরেজিতে কথা বলাকেই সঠিক   বলে মনে করে থাকেন। প্রায় এক পাহাড় পরিমাণ স্যান্ডউইচ, অবাধ মদ্যপান আর বেহালা ও অ্যাকর্ডিয়ন ব্যান্ডদলের সুরের মূর্ছনায় রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে  লোক নৃত্য আর "স্কোয়াড" পরিবেশিত হরেক রকমের পারফরম্যান্স ও নাচ-গানে এক মনোমুগ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় তারা কৌতুক পরিবেশনের পাশপাশি বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে থাকেন। দিনটিকে উদযাপনে সকলের মাঝে ক্লান্তি চলে আসায় পরবর্তী দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে সবাই পালন করে থাকেন। ভাইকিং পূর্বপুরুষদের মতোই আজকের শেটল্যান্ড বাসীরাও  জানেন একটি স্মৃতিময় উৎসব পালনের মধ্যদিয়েই নতুন বছর শুরু এক সর্বোত্তম পন্থা।  

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh