ঢাকার বিস্মৃত নড়াই নদী

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৪, ০১:০৫ পিএম

নড়াই নদী। ফাইল ছবি

নড়াই নদী। ফাইল ছবি

ঢাকা শহরের নদী বললে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুড়িগঙ্গা। আর ঢাকার চারপাশ ঘিরে রাখা অন্য নদী বলতে তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু। কিন্তু এই শহরের ভেতরে দিয়ে যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বয়ে গেছে এবং এখন যে নদীটার নাম লোকেরা জানে না বললেই চলে, সেটি হচ্ছে ‘নড়াই’।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বেগুনবাড়ী ও গুলশান এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যে জলরাশিটি এখন ‘হাতিরঝিল লেক’ নামে পরিচিত, সেটি আসলে নড়াই নদীর অংশ। এই নদীটি রামপুরার পাশ দিয়ে পুবদিকে বালু নদীতে গিয়ে মিশেছে।

ইতিহাস বলছে, প্রাচীনকাল থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত ঢাকার মধ্যাঞ্চলের প্রধান নৌপথ ছিল নড়াই নদী। এই নদীর দুই তীরে পাল, সেন, সুলতানি ও মোগল আমলের বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন প্রমাণ দেয় এখানে শহর গড়ে উঠেছিল অনেক কাল আগে থেকেই। পূর্ব দিকের বালু নদী থেকে পশ্চিম দিকের তুরাগ নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নড়াইয়ের ধারা। পরে এর পশ্চিমাংশ পুরোই ভরাট করা হয়।

এক সময়ের প্রমত্তা এই নদী দিয়ে পণ্য আনা হতো কারওয়ান বাজারে। সেখানে ছিল এই নদীর ঘাট। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া জানান, বর্তমানে যেখানে কারওয়ান বাজারের অবস্থান, সেখানে তিনি গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে মোগল আমলের আম্বর সেতুর ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। যে জলধারার ওপর আম্বর সেতু তৈরি হয়েছিল, সেই জলধারা যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের দক্ষিণে অবস্থিত ধানমন্ডি লেকের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, তাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। 

তিনি বলেন, ৩২ নম্বর সড়কের পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি স্থান থেকে বর্তমান পান্থপথ পর্যন্ত খালের অস্তিত্ব গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকেও দেখা গেছে। এই খাল যে ধানমন্ডি লেকের বর্ধিত রূপ এবং পূর্বভাগে এটি যে বিশাল আয়তনের ছিল, এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। (সমকাল, ১ অক্টোবর ২০১৫)।

গবেষণা বলছে, কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএ ভবনের পাশে মাছের পাইকারি বাজারটিতে একসময় শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর মাছের ল্যান্ডিং পোর্ট ছিল। এ ছাড়া এই নদীটিতে মগবাজার, মধুবাগ, উলন, দাসপাড়া, রামপুরা, খিলগাঁও, মেরুল, বাড্ডা, বেগুনবাড়ীসহ আশপাশ এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতো। বর্তমানে সেই পানি হাতিরঝিল প্রকল্পের পাম্পের মাধ্যমে খালে নিষ্কাশন করা হয়। তা ছাড়া ঝিলের অতিরিক্ত পানিও রামপুরা ব্রিজ হয়ে নড়াই খালে পড়ে।

যদিও নড়াই নদী এখন একটি ক্ষীণ জলরেখা বা একটি ড্রেনের আকারে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে দীর্ঘদিন এটি ‘রামপুরা খাল’ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। স্থানীয়রাও ‘রামপুরা খাল’ নামেই এটিকে চেনে। কিন্তু নদীরক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের দাবির মুখে নড়াই ফিরে পেয়েছে তার পরিচয়। রামপুরা সেতু থেকে নেমে পুবদিকে বনশ্রীর দিকে যেতে হাতের বাঁয়ে নদীর তীরে সিমেন্টের যে ফলকে রামপুরা খাল লেখা ছিল, ‘নোঙর’ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীরা সেটিকে লাল কালি দিয়ে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন এবং নড়াই নদীর সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে বিস্মৃত নড়াই নদী তার স্বনামে আবির্ভূত হলেও নদীর সংকট কাটেনি। বরং পশ্চিম দিকে যে রামপুরা সেতুর নিচ দিয়ে নদীটি হাতিরঝিল লেকে প্রবেশ করেছে সেখানে নদীটিকে গলাটিপে হত্যার রাষ্ট্রীয় আয়োজন। স্লুইস গেট দিয়ে এমনভাবে নদীটিকে হাতিরঝিল থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে যে, এখন চাইলেও হাতিরঝিলের কোনো নৌকা বা ওয়াটার ট্যাক্সি নড়াই নদীতে প্রবেশ করতে পারবে না। অর্থাৎ আজকে যে অংশটি ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত, সেটি নড়াই নদীর অংশ হলেও স্লুইস গেট দিয়ে একে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছ। উপরন্তু এখানে দাঁড়ালে চোখে পড়বে বিভিন্ন উৎস থেকে কালো কুচকুচে ময়লা পানি এসে অব্যাহতভাবে পড়ছে নড়াইয়ের বুকে। তাতে নদীটি এখন একটি ড্রেন বা বড়জোর ময়লা পানি অপসারণের ক্ষীণরেখায় পরিণত হয়েছে।

বনশ্রী ও আফতাব নগরের বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে নদীর সীমানা দখল করে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি। এসব বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। সড়ক সম্প্রসারণের নামেও নদীর জায়গা দখল করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া রামপুরা থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত প্রায় ২০টি ড্রেন থেকে প্রতিনিয়ত দূষিত পানি এসে নদীতে পড়ছে। নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আবাসিক ভবনগুলোর স্যুয়ারেজ লাইন।

নদীটির পাশ দিয়ে পুবদিকে মেরাদিয়া হাটের দিকে যেতে থাকলে আফতাব নগর এলাকায় নদীটির সৌন্দর্য বর্ধন এবং এর প্রবাহ বাড়ানোর বেশ কিছু আয়োজন চোখে পড়ে। কিন্তু মূল সংকট হয়েছে নদীর সীমানা চিহ্নিতকরণে। নদীর দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ বনশ্রীর প্রান্তে সীমানা চিহ্নিত করা হলেও উত্তর দিকে, অর্থাৎ আফতাব নগরের প্রান্তে সীমানা চিহ্নিত নয়। বরং সাদা চোখেই দেখা যায় অনেক ভবনের সীমানা প্রাচীর নদীর ভেতরে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির সীমানায় এই নদীটির দুই পাড়ের প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ জরুরি। কেননা নড়াই নদীর সীমানা নির্ধারণে স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদার এবং কিছু আবাসন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। 

তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, নদীর সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের নামে এখানে যে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, সেখানে নদীকে কী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে? নদীটি কি শুধু ময়লা পানি অপসারণ করবে? একটি নদীর কাজ কি শুধু পানি কিংবা ময়লা পরিবহন করা? মৎস্যসম্পদ, যোগাযোগ এবং একটি নদীকে ঘিরে শত শত বছরে যে ইকোলজি বা প্রতিবেশ গড়ে ওঠে, সেটিও ভাবনায় রাখা জরুরি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh