ভাষার মুখচ্ছবি লিপি

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু

প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:০৯ এএম

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু।

মো. শাহাবুদ্দিন সাবু।

প্রাচীন গুহাচিত্রের হিজিবিজি সাধারণের কাছে যতটা অর্থহীন, বিজ্ঞানীদের কাছে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। সুদীর্ঘকাল থেকে মানুষ যা ভাবে তা বলার চেষ্টা করেছে আর যা বলে তা আঁকা বা লেখার চেষ্টা করেছে। মনের ভাবকে স্থায়ীভাবে দৃশ্যে পরিণত করার এই প্রচেষ্টার রয়েছে লম্বা ইতিহাস। মনের ভাবকে কথাকে ভাষাকে দৃষ্টিগোচর করতে প্রয়োজন হাতিয়ার, যার নাম লিপি।

প্রায় দশ হাজার বছর আগে মানুষ তার আদিম স্তরে যখন চিত্রলিপি অঙ্কন শুরু করে তখন তারা কি পরবর্তী বংশধরদের জানাতেই আঁকজোক করতো নাকি নিজেরা ভুলে যাওয়ার হাত থেকে নিস্তার পেতে আঁকতো কে জানে? হয়তো বহু দূরের মানুষের কাছে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা বা বস্তুর ভাব প্রকাশের জন্যই পর্বত গুহার গায়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষেরা আঁকত। ধারণা করা হয় এই সময়ের মানুষ সংখ্যাবাচক বিষয়গুলোকেই অঙ্কন করত। সাধারণত গণন চিহ্নকেই লিখন পদ্ধতির আদি রূপ বলা হয়। এমনকি আধুনিককালেও অনেক সমাজে এই পদ্ধতি প্রচলিত। 

কিন্তু এরকম চিত্র দিয়ে শুধু বস্তু প্রকাশ করা যায়; মনের সূক্ষ্ম ভাব প্রকাশ করা যায় না। প্রায় ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরের মানুষেরা ব্যবহার করত হায়ারোগ্লিফ। প্রায় ৭৫০টি চিহ্ন দিয়ে এই প্রাচীন মিশরীয় লিপি পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল। চিহ্নগুলো পর পর লিখে শব্দ এবং বাক্য তৈরি হতো। লিপির এই স্তরকে বলা হয় শব্দলিপি। বিবর্তিত হলে; চিত্রের লেখা হয়ে গেল আরও সংক্ষিপ্ত, সাংকেতিক। সংকেতগুলো সম্পূর্ণ ধ্বনিসমষ্টির পরিবর্তে মানুষের উচ্চারিত ধ্বনির আদ্যধ্বনিকে নির্দেশ করা শুরু করল। এই শীর্ষনির্দেশক লিপিকে বলা হয় অক্ষরলিপি, যার শেষ পরিণতি ধ্বনিলিপি, যেখানে চিহ্নিত হয় একক ধ্বনি। গ্রিক-রোমান লিপি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বনিমূলক; ভারতীয় লিপি অংশত ধ্বনিমূলক এবং অংশত অক্ষরমূলক।

পৃথিবীর প্রায় সকল লিপিই ফিনিশীয় লিপি থেকে উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীন ফিনিশীয়রা প্রথমে ব্যঞ্জনবর্ণ আবিষ্কার করে, পরে গ্রিকরা এতে স্বরবর্ণ যুক্ত করে যা থেকে আধুনিক ইউরোপীয় বর্ণমালার উদ্ভব। প্রাচীন ভারতে দুটি লিপির ইতিহাস মেলে- ব্রাহ্মী ও খরোষ্টি। ব্রাহ্মী লেখা হতো বাম থেকে ডানে আর খরোষ্টি লেখা হতো ডান থেকে বামে অর্থাৎ আরবি, ফারসি লিপির মতো; যে কারণে খরোষ্টিকে সেমেটিক লিপি শ্রেণিতে ধরা হয়। ব্রাহ্মী লিপি থেকেই বাংলা লিপি বিকশিত হয়েছে। ব্রাহ্মী লিপি কখন উদ্ভব হয়েছিল তা সঠিক জানা যায়নি। কিন্তু এ-লিপি কয়েক হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি করেছিল ভারতবাসীরাই। দশম শতকের দিকে ব্রাহ্মী লিপি বদলে হয়ে ওঠে বাংলা লিপি। অনেকের মতে বাংলা লিপির উদ্ভব ঘটেছে উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মী থেকে। উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মী দুটি ধারায় বিভক্ত হয়- পশ্চিমীধারা এবং পূর্বীধারা। এই পূর্বীধারা থেকেই বাংলা লিপির উদ্ভব।

১৭৪৩ সালে লাইডেন থেকে প্রকাশিত ‘ডিসারতিও সিলেকটা’ নামক বইয়ে বাংলা বর্ণমালার নমুনা ছাপা হয়। তবে বাংলা লিপি ও ভাষার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সাল ১৭৭৮। এ বছর হুগলি থেকে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড ইংরেজিতে প্রকাশ করেন A GRAMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE, কিন্তু হ্যালহেড তার বইয়ে বাংলা উদাহরণগুলো বাংলা অক্ষরে ছেপেছিলেন। এর আগে ব্লকে ছাপা হয়েছিল বাংলা বর্ণমালা আর গুটিকয় শব্দ; এই বইয়ে ছাপানো হয় পাতার পর পাতা পুরো বাক্য। বইয়ের জন্য ধাতব অক্ষর তৈরি করেন চার্লস উইলকিন্স, তাকে সাহায্য করেন পঞ্চানন কর্মকার। উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকারই অনেকটা চিরকালের জন্য বাংলা বর্ণের রূপ স্থির করে দেন।

একটি ভাষার জন্য, ভাষা রক্ষার জন্য লিপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা লিপি এখন বিভিন্ন ভাষার লিপি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোল, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী আদিবাসীরা তাদের ভাষা লিখতে বাংলা লিপি ব্যবহার করছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার ঢাকাইয়া সোব্বাসীরাও তাদের ভাষা বিগত ১৮-২০ বছর ধরে বাংলা লিপি ব্যবহার করেই লিখছে। এখনো অনেকেই মনে করে সোব্বাসীদের ভাষা কেবল মৌখিক; আদতে তা নয়। বাংলা লিপি ব্যবহার করে সোব্বাসীদের ভাষায় প্রথম গ্রন্থ ‘বাত মেরা সাচ্চা ঢাকা বাহুত আচ্ছা’ প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। পরবর্তী সময় বাংলা লিপি ব্যবহার করে প্রকাশ হয় ‘বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি’। এ ছাড়াও বাংলা লিপি ব্যবহার করে সোব্বাসীদের বিভিন্ন সংগঠন তাদের স্মরণিকা প্রকাশ করেছে। সোব্বাসীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বাংলা লিপি ব্যবহার করে তাদের ভাষায় লেখালেখি করছে। যেহেতু সোব্বাসীরা বাংলা লিপি পড়তে, লিখতে, শুনতে, দেখতে অভ্যস্ত তাই তারা বাংলা লিপিতেই সোব্বাসী ভাষা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে লিপি ব্যবহার করতে প্রায় অধিকাংশই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে লিপিতে লেখালেখি করাই দূরদর্শিতা এবং বাস্তবসম্মত। 

-শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh