দীপংকর গৌতম
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:০৩ এএম
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন। প্রতীকী ছবি
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও এ সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু হঠকারী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বুদ্ধিজীবী সমাজ। তারই ফলে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন মুনীর চৌধুরী, এ কে এম আহসান, কল্যাণ দাসগুপ্ত প্রমুখ। সভা শেষে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেটিই ছিল সর্বপ্রথম প্রতিবাদ মিছিল। যার পথ ধরে আসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সোপানও।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেদিন অজস্র শিক্ষার্থী যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তা দেখে কেঁপে উঠেছিল তৎকালীন শাসকের সিংহাসন। তারা ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি করলেও ছাত্ররা মানেনি। পুলিশ গুলি চালালে রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে; কিন্তু আন্দোলনে পিছু হটেনি। ভাষা আন্দোলনে সেই সময়ে কতজন মারা গিয়েছিল আজও কি তা নিশ্চিত জানা গেছে? শৈশবে আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়ছি, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে। এর বাইরে আর কে কে, কোথায় মারা গেছেন তা জানা যায়নি আজও।
১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি কতজন নিহত হয়েছে তা জানতে আমাদের তখনকার পত্রিকা বা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বইয়ের পাতা উল্টাতে হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছিল ১৯৫৩ সালের মার্চে। সেই বইয়ে কবির উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপঞ্জি’ নামে একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘শহীদদের লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় ‘সীমান্ত’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল এ রকম:
‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়...’
উল্লেখিত কবিতায় কবি যে ৪০ সংখ্যাটি ব্যবহার করেছেন, তা কি শুধু কবিতার জন্য, সেটা জানা না গেলেও বিভিন্নসূত্র অনুযায়ী আটজন শহীদের নাম পাওয়া যায়। ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক তার ‘একুশ থেকে একাত্তর’ নামের বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পত্রিকা ‘সৈনিক’-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। খবরে বলা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণে ৭ জন নিহত : ৩ শতাধিক আহত। তা ছাড়া দৈনিক আজাদের ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতকের বুলেটে নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে তার ডায়েরিতে লিখেছেন : গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল।’ বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু। দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ জন নিহত হন। সংবাদে লাশ গুমের দায়ে সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। আসলে শহীদ কতজন এটা বের করতে বাংলা একাডেমি, ভাষা ইনস্টিটিউট উদ্যোগ নিলে কাজটি যথাযথ হতো। এ ছাড়াও এখনো যারা বেঁচে আছেন তাদের ইন্টারভিউ এবং তৎকালীন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট দেখলে ঘটনা দ্রুত প্রকাশ করা সহজ হবে। ভাষা সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছেন তাদের তালিকাটা দ্রুত করে ফেললে ইতিহাসের একটি দিগন্ত উন্মোচিত হবে।